তালেবান রুখতে দরকার যৌথ প্রচেষ্টা by কুলদীপ নায়ার
ভারত গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের সঙ্গে কোনো
সম্পর্ক রাখতে চায় না, ব্যাপারটা আসলেই করুণার উদ্রেক করে। সন্দেহ নেই, সে
খুব খতরনাক লোক, তাঁর সঙ্গে বোঝাপড়া করা সহজ কাজ নয়। কিন্তু আমরা যদি
১০ বছর পরের কথা চিন্তা করি, তাহলে এই ব্যক্তির ভারতবিরোধী কথাবার্তা হজম
করা উচিত। এসব কিছুই এখন ইতিহাস। এই দুই দেশ, বিশেষ করে ভারতের উচিত
তালেবানদের প্রচণ্ড আক্রমণকে রুখে দেওয়ার জন্য নীতি প্রণয়ন করা।
আফগানিস্তান থেকে পশ্চিমা শক্তিগুলো হাত গুটিয়ে নিলে তারা একদম খাপখোলা
তরবারির মতো ভয়ংকর হয়ে উঠবে।
আফগানিস্তান থেকে মার্কিন ও ন্যাটো সেনা প্রত্যাহার করা হলে কী ঘটবে, তা নিয়ে নয়াদিল্লি এখনো কোনো চিন্তাভাবনা করেনি, ব্যাপারটা কিছুটা বিস্ময়কর ঠেকে আমার কাছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইতিমধ্যে কাবুল সফর করেছেন সেখান থেকে সেনা প্রত্যাহার করা হলে তার পরের পরিকল্পনা কষতে।কিন্তু এই পুরো চিত্রের মধ্যে নয়াদিল্লি একেবারেই দৃশ্যমান নয়।
আফগানিস্তান সব সময় ভারতের শুভকামনাই করবে। ভারত সেখানে হাসপাতাল, বিদ্যালয় ও সড়ক নির্মাণে সহায়তা করেছে। তবে ইসলামাবাদ আফগানিস্তানকে তার ‘কৌশলগত ডেরা’ হিসেবে দেখে থাকে, দেশটিকে তারা নিজেদের স্যাটেলাইট বানাতে চায়। নয়াদিল্লি ইসলামাবাদকে বোঝাতে চেয়েছে, কাবুলকে স্বাধীন ও মুক্ত থাকতে দেওয়া হোক। কিন্তু পাকিস্তান এতে সায় দেয়নি।
এসব কিছুর মূলে রয়েছে আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসন, তারা এই মুসলিম দেশটিতে তাদের আদর্শ কায়েম করতে গিয়েছিল। এই সুযোগে যুক্তরাষ্ট্র মৌলবাদীদের পাকিস্তানে প্রশিক্ষণ দিয়ে আফগানিস্তানে ঢোকায়, সোভিয়েত ইউনিয়নকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার লক্ষ্যে। এরপর সোভিয়েত ইউনিয়ন সেখান থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে চলে এলে যুক্তরাষ্ট্র এদের সম্পর্কে সব আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। কিন্তু এদের হাতে সেই অস্ত্র রয়ে যায়। এই মৌলবাদীরা অস্ত্রের জোরে তাদের কঠোর অনুশাসননির্ভর ইসলামের প্রচারণা চালাতে থাকে।
ইসলামাবাদের চিন্তায় এই সশস্ত্র জঙ্গিদের ব্যাপারটি রয়েছে, যাদের হয়তো ভারতের বিরুদ্ধে কাজে লাগানো যায়। কাশ্মীরের বিদ্রোহ অমুসলিমদের শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করতে না দেওয়ার লক্ষ্যেই করা হয়েছে, এই দাবির সপক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। এটা এক অন্ধবিশ্বাসের উপজাত হিসেবে এসেছে, তবে সেই দাবিটি করা হয়েছে অজ্ঞাতসারে। মাসুদ গ্রুপের এক নেতার সঙ্গে আমার কাবুলে কথা হয়েছিল, তিনি আদর্শিকভাবে তালেবানবিরোধী, তাঁর তরিকা কিছুটা ভারতমুখী। তিনি আমাকে বলেছিলেন, কাবুলের সড়ক ইসলামাবাদ হয়েই গিয়েছে, ফলে ভারত যদি মৌলবাদের রাশ টেনে ধরতে চায়, তাহলে পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে।
সবচেয়ে অনভিপ্রেত ঘটনা হচ্ছে তেহরিক-ই-পাকিস্তান তালেবানের (টিটিপি) উত্থান। এই দেশীয় বাহিনীতে এমন অবস্থানে আছে যে এরা চাইলে যখন যেখানে খুশি হামলা চালাতে পারে। এই সত্য বারবার প্রমাণিত হয়েছে। সম্প্রতি করাচি বিমানবন্দরের হামলা তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তবে করাচির এই ঘটনা রোগের উপসর্গ মাত্র, রোগ নয়। রোগটি হচ্ছে মৌলবাদ, এমনকি পাকিস্তানের মধ্যপন্থী মানুষ এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়লেও এটি দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ছে।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ এক সহজ পথ বেছে নিয়েছেন। তলেবানদের দাবি গ্রহণের লক্ষ্যে তিনি তাদের সঙ্গে আপসরফা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে এটি বেশি দূর এগোয়নি, কারণ তারা পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে প্রমাণ চেয়েছে যে সরকার নারীশিক্ষা বন্ধ ও নারীদের জন্য হিজাব বাধ্যতামূলক করতে আন্তরিক। এরপর তারা দাবি করবে, নারীদের গাড়ি চালানো নিষিদ্ধ করা হোক, সৌদি আরবে ঠিক যেমনটি করা হয়েছে। মৌলবাদের যূপকাষ্ঠে সংগীতের বিসর্জন হয়ে গেছে। পুরোনো দিনের গায়ক ও যন্ত্রীরা এখন ভাতের খোঁজে ভারতে আসছেন—এসব দেখে হৃদয়ে দুঃখের নিনাদ বেজে ওঠে।
অতীত অনেক তিক্ত হলেও ভারত ও পাকিস্তানের হাতে এখন বেছে নেওয়ার মতো নানা সুযোগ রয়েছে, যৌথ বাহিনী গড়ে তুলে তালেবানদের পরাজিত করার ব্যাপারটি ছাড়াও। ফলে এখন আর অতীতের রোমন্থন করে লাভ নেই। নয়াদিল্লির বুঝতে হবে, তালেবানরা আফগানিস্তানে পরাজিত না হলে তারা অমৃতসর সীমান্ত পর্যন্ত চলে আসতে পারে। দুই দেশ যদি প্রকাশ্যে নিজেদের কৌশল নিয়ে কথা বলতে লজ্জা পায়, তাহলে কাশ্মীরে যেমন পেছনের দিক দিয়ে আলোচনা করেছিল, এ ক্ষেত্রেও তারা তেমনটা করতে পারে।
তালেবানরা যদি প্রথমে আফগানিস্তান ও পরে পাকিস্তানকে নিজেদের কবজায় নিয়ে আসে, তাহলে ভারতের নিরাপত্তা ও উন্নয়ন হুমকির মুখে পড়বে। এর মাধ্যমে আফগানিস্তান নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে যে যৌথতা গড়ে উঠতে পারত, সেই সম্ভাবনা তিরোহিত হবে। কাশ্মীরের কারণে দুই দেশের মধ্যে গুরুতর আলোচনা না হলেও আফগানিস্তান প্রশ্নে এই তিক্ততা ঝেড়ে ফেলে দুই সেনাপ্রধানকে বসে দীর্ঘমেয়াদি কৌশল ঠিক করতে হবে: কী করে আফগানিস্তানকে স্বাধীন রাখা যায়।
এমনিতে উদার হলেও জুলফিকার আলী ভুট্টোই প্রথম মৌলবাদীদের আস্থায় নিয়ে আসেন। তাঁর সরকারের আমলে মসজিদের প্রধান মৌলবিদের ভাতা দেওয়া শুরু হয় এবং আহমদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণা করা হয়। আজ পাকিস্তানে আহমদিয়াদের কবর রচনা হয়েছে, যা কিছু অবশিষ্ট ছিল, সেগুলোও ছুড়ে ফেলা হয়েছে। পাকিস্তানি ক্ষমতাচক্র স্যার জাফরুল্লাহ খানের মতো মানুষকেও অপমান করতে কসুর করেনি। অথচ এই ব্যক্তি জাতিসংঘে কাশ্মীর প্রশ্নে ভারতের অবস্থান দুর্বল করে দিয়েছিলেন। নেহরু কাশ্মীরে ‘পাকিস্তানের আগ্রাসন’-এর বিরুদ্ধে জাতিসংঘে যে নালিশ জানিয়েছিলেন, এই ব্যক্তি ব্রিটেনের সহায়তায় তা নস্যাৎ করে দেন।
অবশ্যই, ইসলামাবাদকে তার কৌশল পাল্টাতে হবে। আফগানিস্তানকে আর ‘কৌশলগত ডেরা’ হিসেবে দেখা চলবে না। পাকিস্তানে নিজের স্বার্থেই সেটা করতে হবে। তালেবানরা যেভাবে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে শুরু করেছে, তাতে পাকিস্তানকে এখনই সতর্ক হতে হবে, তালেবানরা দেশটিকে উদার ইসলামি দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে দেবে না।
বলা হচ্ছে, ভারত বিপদটা আঁচ করতে পারছে না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তো একজন কঠোর শাসক, তাঁর উচিত ব্যাপারটি নওয়াজ শরিফের কাছে পাড়া। দিল্লিতে নওয়াজ শরিফ যখন এলেন, দুজনের বন্ধুত্ব তখন চোখে পড়ার মতো ছিল। মোদির কাছে এক পত্রে নওয়াজ শরিফ সেটা স্বীকারও করেছেন। পাকিস্তানের তালেবানীকরণ রুদ্ধ করতে কি কোনো যথাযথ নীতি নেওয়া হবে? এর সপক্ষে পাকিস্তানে একটি জনমতও গড়ে উঠতে শুরু করেছে।
তালেবানবিরোধী নীতি প্রণয়নে নয়াদিল্লির উচিত যুক্তরাষ্ট্রকেও সঙ্গে রাখা। এই পরিকল্পনায় তালেবানরা যদি আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে পরাজিত হয়, তাহলে অন্যান্য ইসলামি দেশেও তারা আর কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারবে না, যদিও এখন বিভিন্ন ইসলামি দেশে তালেবানরা প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছে।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
কুলদীপ নায়ার: ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক।
No comments