আকাশপথে এই মর্মান্তিক ট্রাজেডির জন্য দায়ী কে? by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
আরব ভূখণ্ড গাজায় ইসরাইলের ফ্যাসিস্ট নেতা নেতানিয়াহু যে বর্বর গণহত্যা চালাচ্ছে তাকে চাপা দেয়া এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে গণহত্যার পাল্টা প্রোপাগান্ডা চালানোর জন্য পশ্চিমা মিডিয়া ইউক্রেনের আকাশসীমায় একটি মালয়েশিয়ান যাত্রীবাহী বিমান (এমএইচ-১৭) মিসাইল হামলায় ধ্বংস হওয়ার মর্মান্তিক ট্রাজেডিকে ব্যবহার করার চমৎকার মওকা পেয়েছে অথবা মওকাটি নিজেরাই সৃষ্টি করেছে। কয়েক দিন ধরে পশ্চিমা মিডিয়ায় ইসরাইলি বর্বরতায় গাজার মতো জনপদ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ার খবর ও মৃত অসংখ্য নারী-শিশুর রক্তাক্ত দেহের ছবি আর তেমন নেই। এখন প্রথম পাতা থেকে ভেতরের পাতা পর্যন্ত শুধু বিমানটি ধ্বংস হওয়ার খবর ও মৃতযাত্রীদের ছবি। একটি নিরপেক্ষ তদন্তে এ মিসাইল হামলার জন্য রাশিয়া যে দায়ী তা প্রমাণিত হওয়ার আগেই জোরেশোরে প্রচারবাদ্য বাজানো হচ্ছে- রাশিয়া এই ম্যাসাকারের জন্য দায়ী। সানডে টাইমস (২০ জুলাই) প্রথম পাতাজুড়ে খবরের হেডিং দিয়েছে রাশিয়া ইন দ্য ডক (রাশিয়া আসামির কাঠগড়ায়)।
অধিকাংশ পশ্চিমা মিডিয়ায় এখন রাশিয়া ও পুতিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধংদেহি ভাব। সানডে টাইমসের প্রধান সম্পাদকীয়র হেডিং হচ্ছে মেক পুতিন দ্য ব্যারিয়াহ্ পে ফর দিস আউটরেজ (পুতিনকে একঘরে করে এই ধ্বংসকাণ্ডের খেসারত দিতে বাধ্য করা হোক)। এই মিসাইল হামলার পেছনে যে রাশিয়ার প্রত্যক্ষ হাত রয়েছে এ খবরের একমাত্র সূত্র হল মার্কিন মদদপুষ্ট ইউক্রেন সরকারের ভাষণ। তাদের দাবি, গত বৃহস্পতিবার (১৭ জুলাই) বিমান দুর্ঘটনার দিন সকালে মিসাইল লঞ্চারটি রাশিয়া থেকে পূর্ব ইউক্রেনে চোরাচালান হয়। কাজটি করে ইউক্রেনের রাশিয়া সমর্থক বিদ্রোহীরা।
এখন পশ্চিমা মিডিয়া দুয়ে দুয়ে চার করে প্রচার চালাচ্ছে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনই নিজ হাতে মিসাইলটি রাশিয়াপন্থী বিদ্রোহী ইউক্রেনিয়ানদের হাতে তুলে দিয়েছেন। ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের হাতে বিশ্ব ধ্বংসী মারণাস্ত্র আছে বলে যে পশ্চিমা প্রোপাগান্ডা চালানো হয়েছিল, তা যেমন পরে প্রমাণিত হয়েছে সর্বৈব মিথ্যা; তেমনি মালয়েশিয়ান যাত্রীবাহী বিমান ধ্বংস করার পেছনে পুতিন বা রাশিয়া সরাসরি জড়িত রয়েছে, এই প্রচারটিও অদূর ভবিষ্যতে মিথ্যা প্রমাণিত হলে পশ্চিমা নেতারা বা মিডিয়া লজ্জা পাবে মনে হয় না।
মাত্র কিছুদিন আগে একটি মালয়েশিয়ান যাত্রীবাহী বিমান রহস্যজনকভাবে অসংখ্য যাত্রী নিয়ে নিখোঁজ হয়েছে। তখনও রাশিয়াকে জড়িয়ে পশ্চিমা মিডিয়ায় অনেক কনস্পিরেসি থিয়োরি শোনা গেছে। তা সঠিক প্রমাণিত হয়নি। এর কিছুদিন পরই আরেকটি মালয়েশিয়ান যাত্রীবাহী বিমানের মিসাইল আক্রান্ত হয়ে ধ্বংস হওয়া এ যুগের একটি মর্মান্তিক ট্রাজেডি। এই যে আকাশপথে মানবতা বারবার বিপন্ন হচ্ছে তার প্রতিকারের কোনো কার্যকর পন্থা ও ব্যবস্থার কথা না ভেবে আমেরিকা ও অধিকাংশ পশ্চিমা দেশ তার রাজনৈতিক সুবিধা গ্রহণের জন্য ডে ওয়ান থেকেই তৎপর হয়েছে। বিশ্ব রাজনীতিতে তাদের প্রতিপক্ষকে অসাধু উপায়ে হটানোর জন্য একটি যাত্রীবাহী বিমানের অসংখ্য যাত্রীর (যাদের মধ্যে অনেক শিশুও রয়েছে) মর্মান্তিক মৃত্যুকে তাদের রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডার মূলধন করেছে। মানবতার প্রতি এর চেয়ে বড় অবমাননা কী হতে পারে?
এই যাত্রীবাহী বিমানটি যদি ইউক্রেনের রুশপন্থী বিদ্রোহীরা ভুল করেও ধ্বংস করে থাকে, তাহলেও নিরপেক্ষ তদন্তে তা প্রমাণিত হলে তাদের বিচার ও দণ্ডদানের জন্য ওবামা ও ক্যামেরন সাহেব পুতিনের সহযোগিতাও চাইতে পারেন। ভবিষ্যতে আকাশপথে যাতে এভাবে গণহত্যা না চলে তার নিশ্চিত ব্যবস্থা করার জন্য রাশিয়া, চীন, ইরান, ভারতসহ সব দেশের সহযোগিতায় প্রেসিডেন্ট ওবামা একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদন এবং তা বলবৎ করার ব্যবস্থাও করতে পারেন। তা না করে রাশিয়াকে একতরফাভাবে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে আবার বিশ্বব্যাপী শীতল যুদ্ধ শুরু করা কি যাত্রীবাহী মালয়েশিয়ান বিমানের হতভাগ্য যাত্রীদের জীবন ফিরিয়ে আনবে, না ভবিষ্যতে এ ধরনের আকাশ-মৃত্যুর ট্রাজেডি বন্ধ করবে? পুতিন ও রাশিয়াকে তখনই আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যাবে, যখন তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগটি নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক তদন্তে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হবে।
রাশিয়ান বাক মিসাইল-লঞ্চার দ্বারা যাত্রীবাহী বিমানটি ধ্বংস হয়ে থাকলে তার দ্বারা কি প্রমাণিত হয় লঞ্চারটি রুশপন্থী বিদ্রোহীদের হাতে রাশিয়াই তুলে দিয়েছে? তাহলে ইসরাইল গাজায় মধ্যপ্রাচ্যের আরব ভূখণ্ডে যে ভয়াবহ গণহত্যা চালাচ্ছে, তা কি ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে আমেরিকার সরাসরি যুদ্ধ বলে গণ্য হওয়া উচিত নয়? খবরেই বলা হয়েছে, পূর্ব ইউক্রেনে রুশ মিসাইল চোরাচালান হয়েছে। ইসরাইলে তো মার্কিন মারণাস্ত্র চোরাচালান হচ্ছে না। ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে যুদ্ধ করা এবং তাদের হত্যা করার জন্য আমেরিকাই সরকারিভাবে অঢেল অর্থ ও অস্ত্রভাণ্ডার ইসরাইলের হাতে তুলে দিচ্ছে। এই গণহত্যায় সহযোগিতা দান এবং মানবতাবিরোধী ভূমিকার জন্য ওবামা-ক্যামেরন সাহেবদেরই কি আগে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়ানো উচিত নয়?
সানডে টাইমসসহ অধিকাংশ পশ্চিমা মিডিয়ার খবরে স্বীকার করা হয়েছে- যাত্রীবাহী বিমানটি ইউক্রেনের যুদ্ধলিপ্ত এলাকার ৩৩ হাজার ফুট ঊর্ধ্বাকাশ পথে উড়ছিল। রুশপন্থী বিদ্রোহীদের রাডারে বিমানটি ধরা পড়ে এবং বিদ্রোহীরা ভেবেছিল, ইউক্রেন সরকারের সামরিক সরঞ্জামবাহী এটি একটি কার্গোপ্লেন বা মালবাহী বিমান। এই ভ্রম থেকে তারা যাত্রীবাহী বিমানটির ওপর মিসাইল হামলার নির্দেশ দেয়। পশ্চিমা মিডিয়ার এ খবর যদি সত্য হয়, তাহলে প্রথমেই প্রশ্ন, একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত বিপজ্জনক এলাকার আকাশসীমা মালয়েশিয়ান যাত্রীবাহী বিমানটি কেন পরিহার করেনি? এর পেছনেও কোনো পশ্চিমা চক্রান্ত কাজ করেছে কিনা? দ্বিতীয়ত, এই মিসাইল হামলার অভিযোগ পুতিন অত্যন্ত ক্রোধের সঙ্গে অস্বীকার করেছেন। আবার রুশ মিসাইলটি পূর্ব ইউক্রেনে চোরাচালান হয়েছে বলে পশ্চিমা মিডিয়াতেই বলা হয়েছে। চোরাচালান এবং সরকারিভাবে বিদ্রোহীদের অস্ত্র সাহায্যদান কি এক কথা? আর রাশিয়া যদি নিজের নিরাপত্তা ও
স্বার্থরক্ষার জন্য ইউক্রেনে রুশপন্থীদের অস্ত্র সাহায্য দেয় তাহলে দোষের কী আছে? আমেরিকা সিরিয়ার বিদ্রোহীদের অস্ত্র সাহায্য জোগাচ্ছে না? ইউক্রেনের তাঁবেদার সরকারকে সামরিক সাহায্য ও সমর্থন জোগাচ্ছে না?
পশ্চিমা প্রোপাগান্ডায় বারবার বলা হচ্ছে, পূর্ব ইউক্রেনের যুদ্ধ হচ্ছে 'Russian-sponsored war' (রাশিয়া-প্ররোচিত যুদ্ধ)। অথচ এ কথা সবারই জানা ইউক্রেন (ক্রিমিয়াসহ) ছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর ইউক্রেন স্বাধীন দেশ হয় এবং তখন থেকেই আমেরিকা সেখানে রাশিয়ার নিরাপত্তা-বিরোধী সামরিক তৎপরতা শুরু করে। কিছুকাল আগে ক্রিমিয়ায় গণভোট হয় এবং ক্রিমিয়া ইউক্রেন থেকে বেরিয়ে এসে রাশিয়ান ফেডারেশনে যোগ দেয়। এটাকে পশ্চিমা মিডিয়া রাশিয়ার ক্রিমিয়া-গ্রাস বলে আখ্যা দেয়। ইউক্রেনে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে তারা রুশপন্থী সরকারের পতন ঘটায়। ফলে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে রুশপন্থীরা বিদ্রোহী হয়। ইউক্রেনে শুরু হয় তাঁবেদার সরকারের কাঁধে চেপে আমেরিকার প্রক্সিওয়ার। আর সেই যুদ্ধের দায় এখন রাশিয়ার কাঁধে চাপানো হচ্ছে।
পশ্চিমা মিডিয়াতেই মালয়েশিয়ান যাত্রীবাহী বিমানটি ধ্বংস হওয়া সম্পর্কে সন্দেহের তীরটি কেউ কেউ আমেরিকার দিকে নিক্ষেপ করেছেন। অতীতের ইতিহাস বলে রাশিয়াকে জব্দ করার জন্য আগেও যাত্রীবাহী বিমান মিসাইল-হামলার মুখে ঠেলে দিতে আমেরিকার যুদ্ধবাজ প্রশাসনের বিবেকে বাধেনি। সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ জমানায় সাইবেরিয়ার একটি রুশ এলাকা ছিল দেশটির নিরাপত্তামূলক প্রোটেক্টেড এলাকা। তার আকাশপথে বহিঃদেশীয় বিমান চলাচল নিষিদ্ধ ছিল। এখানে সোভিয়েতের গোপন সামরিক ঘাঁটি আছে সন্দেহ করে আমেরিকা সেখানে প্রথমে গোয়েন্দা-প্লেন পাঠায়। অতঃপর সোভিয়েত নেতাদের মনোবল ও ক্ষমতা পরীক্ষার জন্য ওই আকাশসীমার কাছ দিয়ে যাত্রীবাহী বিমান পাঠানোর ব্যবস্থা করে। এই বিমানে যাত্রী হিসেবে একজন মার্কিন সিনেটরও ছিলেন। তাকেও জানতে দেয়া হয়নি, এই বিপজ্জনক বিমান যাত্রায় তিনি যাচ্ছেন।
এই যাত্রীবাহী বিমানটিতে রাশিয়া মিসাইল হামলা চালায় এবং ওই মার্কিন সিনেটরসহ সব যাত্রী মর্মান্তিক মৃত্যুবরণ করেন। আমেরিকার মনস্কামনা সিদ্ধ হয়। তারা প্রোপাগান্ডা যুদ্ধে নামেন এই বলে যে, সোভিয়েত নেতারা ইচ্ছাকৃতভাবে একটি যাত্রীবাহী বিমানে মিসাইল হামলা চালিয়ে মানবতা-বিরোধী অপরাধ করেছেন। পরে জানাজানি হয়ে যায়, ওই যাত্রীবাহী বিমানটি মার্কিন সিআইএর চক্রান্তে ওই বিপজ্জনক আকাশসীমায় পাঠানো হয়েছিল এবং তৎকালীন শীতল যুদ্ধের স্বার্থে অসংখ্য যাত্রী (নিজেদের সিনেটরসহ) হত্যায় মার্কিন প্রশাসন দ্বিধা করেনি।
ইরাক-ইরান আট বছরব্যাপী যুদ্ধের সময়েও আমেরিকা ইরানকে ধ্বংস করার জন্য (এই চক্রান্ত এখনও চলছে) ইরাকের সাদ্দাম হোসেনকে বিষাক্ত গ্যাসসহ নানা ধরনের মারণাস্ত্র সরবরাহ করে। তাতেও সন্তুষ্ট না থেকে ইরানের একটি যাত্রীবাহী বিমানে মিসাইল হামলা চালিয়ে তিনশর মতো নির্দোষ যাত্রীকে (নারী ও শিশুসহ) হত্যা করে। পরে বলা হয় ভুল করে নাকি এই মিসাইলটি ছোড়া হয়েছিল। সেদিন এই গণহত্যা নিয়ে পশ্চিমা মিডিয়ায় কোনো হা-মাতম শুরু হয়নি।
মালয়েশিয়ার এই যাত্রীবাহী বিমানটি আকাশপথে ধ্বংস হওয়াকে কেন্দ্র করে রাশিয়া ও পুতিনকে একঘরে করার চেষ্টা হবে। অর্থনৈতিক বয়কট আরও কঠোর করা হবে। চাই কি সাময়িক ব্যবস্থা গ্রহণের পাঁয়তারা চলবে। রাশিয়াকে জব্দ করা গেলে সিরিয়া ও ইরানের পাশ থেকে এক শক্তিশালী মিত্রকে অপসারণ করা সম্ভব হবে। ইসরাইলকে অবাধ হত্যাকাণ্ড চালানো এবং আরব ভূমি দখলের সুযোগ দেয়া যাবে। আমেরিকার পতন্মুখ অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং সামরিক আধিপত্য রক্ষার ব্যবস্থা হবে।
কিন্তু এই চক্রান্ত সফল হবে কি? মালয়েশিয়ান যাত্রীবাহী বিমানটি ধ্বংস হওয়ার পেছনে কাদের নেপথ্য চক্রান্ত দায়ী, সাইবেরিয়ায় যাত্রীবাহী বিমান ধ্বংস হওয়ার রহস্য ফাঁস হওয়ার মতো সে রহস্যও শিগগিরই ফাঁস হয়ে যেতে পারে। বিশ্বময় এই ধ্বংসযজ্ঞ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদেরই মৃত্যুযন্ত্রণার লাথি। এই লাথি ব্যুমেরাং হয়ে আমেরিকার কাছেই ফিরে আসতে পারে।
লন্ডন, ২০ জুলাই, রোববার ২০১৪
অধিকাংশ পশ্চিমা মিডিয়ায় এখন রাশিয়া ও পুতিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধংদেহি ভাব। সানডে টাইমসের প্রধান সম্পাদকীয়র হেডিং হচ্ছে মেক পুতিন দ্য ব্যারিয়াহ্ পে ফর দিস আউটরেজ (পুতিনকে একঘরে করে এই ধ্বংসকাণ্ডের খেসারত দিতে বাধ্য করা হোক)। এই মিসাইল হামলার পেছনে যে রাশিয়ার প্রত্যক্ষ হাত রয়েছে এ খবরের একমাত্র সূত্র হল মার্কিন মদদপুষ্ট ইউক্রেন সরকারের ভাষণ। তাদের দাবি, গত বৃহস্পতিবার (১৭ জুলাই) বিমান দুর্ঘটনার দিন সকালে মিসাইল লঞ্চারটি রাশিয়া থেকে পূর্ব ইউক্রেনে চোরাচালান হয়। কাজটি করে ইউক্রেনের রাশিয়া সমর্থক বিদ্রোহীরা।
এখন পশ্চিমা মিডিয়া দুয়ে দুয়ে চার করে প্রচার চালাচ্ছে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনই নিজ হাতে মিসাইলটি রাশিয়াপন্থী বিদ্রোহী ইউক্রেনিয়ানদের হাতে তুলে দিয়েছেন। ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের হাতে বিশ্ব ধ্বংসী মারণাস্ত্র আছে বলে যে পশ্চিমা প্রোপাগান্ডা চালানো হয়েছিল, তা যেমন পরে প্রমাণিত হয়েছে সর্বৈব মিথ্যা; তেমনি মালয়েশিয়ান যাত্রীবাহী বিমান ধ্বংস করার পেছনে পুতিন বা রাশিয়া সরাসরি জড়িত রয়েছে, এই প্রচারটিও অদূর ভবিষ্যতে মিথ্যা প্রমাণিত হলে পশ্চিমা নেতারা বা মিডিয়া লজ্জা পাবে মনে হয় না।
মাত্র কিছুদিন আগে একটি মালয়েশিয়ান যাত্রীবাহী বিমান রহস্যজনকভাবে অসংখ্য যাত্রী নিয়ে নিখোঁজ হয়েছে। তখনও রাশিয়াকে জড়িয়ে পশ্চিমা মিডিয়ায় অনেক কনস্পিরেসি থিয়োরি শোনা গেছে। তা সঠিক প্রমাণিত হয়নি। এর কিছুদিন পরই আরেকটি মালয়েশিয়ান যাত্রীবাহী বিমানের মিসাইল আক্রান্ত হয়ে ধ্বংস হওয়া এ যুগের একটি মর্মান্তিক ট্রাজেডি। এই যে আকাশপথে মানবতা বারবার বিপন্ন হচ্ছে তার প্রতিকারের কোনো কার্যকর পন্থা ও ব্যবস্থার কথা না ভেবে আমেরিকা ও অধিকাংশ পশ্চিমা দেশ তার রাজনৈতিক সুবিধা গ্রহণের জন্য ডে ওয়ান থেকেই তৎপর হয়েছে। বিশ্ব রাজনীতিতে তাদের প্রতিপক্ষকে অসাধু উপায়ে হটানোর জন্য একটি যাত্রীবাহী বিমানের অসংখ্য যাত্রীর (যাদের মধ্যে অনেক শিশুও রয়েছে) মর্মান্তিক মৃত্যুকে তাদের রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডার মূলধন করেছে। মানবতার প্রতি এর চেয়ে বড় অবমাননা কী হতে পারে?
এই যাত্রীবাহী বিমানটি যদি ইউক্রেনের রুশপন্থী বিদ্রোহীরা ভুল করেও ধ্বংস করে থাকে, তাহলেও নিরপেক্ষ তদন্তে তা প্রমাণিত হলে তাদের বিচার ও দণ্ডদানের জন্য ওবামা ও ক্যামেরন সাহেব পুতিনের সহযোগিতাও চাইতে পারেন। ভবিষ্যতে আকাশপথে যাতে এভাবে গণহত্যা না চলে তার নিশ্চিত ব্যবস্থা করার জন্য রাশিয়া, চীন, ইরান, ভারতসহ সব দেশের সহযোগিতায় প্রেসিডেন্ট ওবামা একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদন এবং তা বলবৎ করার ব্যবস্থাও করতে পারেন। তা না করে রাশিয়াকে একতরফাভাবে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে আবার বিশ্বব্যাপী শীতল যুদ্ধ শুরু করা কি যাত্রীবাহী মালয়েশিয়ান বিমানের হতভাগ্য যাত্রীদের জীবন ফিরিয়ে আনবে, না ভবিষ্যতে এ ধরনের আকাশ-মৃত্যুর ট্রাজেডি বন্ধ করবে? পুতিন ও রাশিয়াকে তখনই আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যাবে, যখন তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগটি নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক তদন্তে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হবে।
রাশিয়ান বাক মিসাইল-লঞ্চার দ্বারা যাত্রীবাহী বিমানটি ধ্বংস হয়ে থাকলে তার দ্বারা কি প্রমাণিত হয় লঞ্চারটি রুশপন্থী বিদ্রোহীদের হাতে রাশিয়াই তুলে দিয়েছে? তাহলে ইসরাইল গাজায় মধ্যপ্রাচ্যের আরব ভূখণ্ডে যে ভয়াবহ গণহত্যা চালাচ্ছে, তা কি ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে আমেরিকার সরাসরি যুদ্ধ বলে গণ্য হওয়া উচিত নয়? খবরেই বলা হয়েছে, পূর্ব ইউক্রেনে রুশ মিসাইল চোরাচালান হয়েছে। ইসরাইলে তো মার্কিন মারণাস্ত্র চোরাচালান হচ্ছে না। ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে যুদ্ধ করা এবং তাদের হত্যা করার জন্য আমেরিকাই সরকারিভাবে অঢেল অর্থ ও অস্ত্রভাণ্ডার ইসরাইলের হাতে তুলে দিচ্ছে। এই গণহত্যায় সহযোগিতা দান এবং মানবতাবিরোধী ভূমিকার জন্য ওবামা-ক্যামেরন সাহেবদেরই কি আগে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়ানো উচিত নয়?
সানডে টাইমসসহ অধিকাংশ পশ্চিমা মিডিয়ার খবরে স্বীকার করা হয়েছে- যাত্রীবাহী বিমানটি ইউক্রেনের যুদ্ধলিপ্ত এলাকার ৩৩ হাজার ফুট ঊর্ধ্বাকাশ পথে উড়ছিল। রুশপন্থী বিদ্রোহীদের রাডারে বিমানটি ধরা পড়ে এবং বিদ্রোহীরা ভেবেছিল, ইউক্রেন সরকারের সামরিক সরঞ্জামবাহী এটি একটি কার্গোপ্লেন বা মালবাহী বিমান। এই ভ্রম থেকে তারা যাত্রীবাহী বিমানটির ওপর মিসাইল হামলার নির্দেশ দেয়। পশ্চিমা মিডিয়ার এ খবর যদি সত্য হয়, তাহলে প্রথমেই প্রশ্ন, একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত বিপজ্জনক এলাকার আকাশসীমা মালয়েশিয়ান যাত্রীবাহী বিমানটি কেন পরিহার করেনি? এর পেছনেও কোনো পশ্চিমা চক্রান্ত কাজ করেছে কিনা? দ্বিতীয়ত, এই মিসাইল হামলার অভিযোগ পুতিন অত্যন্ত ক্রোধের সঙ্গে অস্বীকার করেছেন। আবার রুশ মিসাইলটি পূর্ব ইউক্রেনে চোরাচালান হয়েছে বলে পশ্চিমা মিডিয়াতেই বলা হয়েছে। চোরাচালান এবং সরকারিভাবে বিদ্রোহীদের অস্ত্র সাহায্যদান কি এক কথা? আর রাশিয়া যদি নিজের নিরাপত্তা ও
স্বার্থরক্ষার জন্য ইউক্রেনে রুশপন্থীদের অস্ত্র সাহায্য দেয় তাহলে দোষের কী আছে? আমেরিকা সিরিয়ার বিদ্রোহীদের অস্ত্র সাহায্য জোগাচ্ছে না? ইউক্রেনের তাঁবেদার সরকারকে সামরিক সাহায্য ও সমর্থন জোগাচ্ছে না?
পশ্চিমা প্রোপাগান্ডায় বারবার বলা হচ্ছে, পূর্ব ইউক্রেনের যুদ্ধ হচ্ছে 'Russian-sponsored war' (রাশিয়া-প্ররোচিত যুদ্ধ)। অথচ এ কথা সবারই জানা ইউক্রেন (ক্রিমিয়াসহ) ছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর ইউক্রেন স্বাধীন দেশ হয় এবং তখন থেকেই আমেরিকা সেখানে রাশিয়ার নিরাপত্তা-বিরোধী সামরিক তৎপরতা শুরু করে। কিছুকাল আগে ক্রিমিয়ায় গণভোট হয় এবং ক্রিমিয়া ইউক্রেন থেকে বেরিয়ে এসে রাশিয়ান ফেডারেশনে যোগ দেয়। এটাকে পশ্চিমা মিডিয়া রাশিয়ার ক্রিমিয়া-গ্রাস বলে আখ্যা দেয়। ইউক্রেনে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে তারা রুশপন্থী সরকারের পতন ঘটায়। ফলে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে রুশপন্থীরা বিদ্রোহী হয়। ইউক্রেনে শুরু হয় তাঁবেদার সরকারের কাঁধে চেপে আমেরিকার প্রক্সিওয়ার। আর সেই যুদ্ধের দায় এখন রাশিয়ার কাঁধে চাপানো হচ্ছে।
পশ্চিমা মিডিয়াতেই মালয়েশিয়ান যাত্রীবাহী বিমানটি ধ্বংস হওয়া সম্পর্কে সন্দেহের তীরটি কেউ কেউ আমেরিকার দিকে নিক্ষেপ করেছেন। অতীতের ইতিহাস বলে রাশিয়াকে জব্দ করার জন্য আগেও যাত্রীবাহী বিমান মিসাইল-হামলার মুখে ঠেলে দিতে আমেরিকার যুদ্ধবাজ প্রশাসনের বিবেকে বাধেনি। সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ জমানায় সাইবেরিয়ার একটি রুশ এলাকা ছিল দেশটির নিরাপত্তামূলক প্রোটেক্টেড এলাকা। তার আকাশপথে বহিঃদেশীয় বিমান চলাচল নিষিদ্ধ ছিল। এখানে সোভিয়েতের গোপন সামরিক ঘাঁটি আছে সন্দেহ করে আমেরিকা সেখানে প্রথমে গোয়েন্দা-প্লেন পাঠায়। অতঃপর সোভিয়েত নেতাদের মনোবল ও ক্ষমতা পরীক্ষার জন্য ওই আকাশসীমার কাছ দিয়ে যাত্রীবাহী বিমান পাঠানোর ব্যবস্থা করে। এই বিমানে যাত্রী হিসেবে একজন মার্কিন সিনেটরও ছিলেন। তাকেও জানতে দেয়া হয়নি, এই বিপজ্জনক বিমান যাত্রায় তিনি যাচ্ছেন।
এই যাত্রীবাহী বিমানটিতে রাশিয়া মিসাইল হামলা চালায় এবং ওই মার্কিন সিনেটরসহ সব যাত্রী মর্মান্তিক মৃত্যুবরণ করেন। আমেরিকার মনস্কামনা সিদ্ধ হয়। তারা প্রোপাগান্ডা যুদ্ধে নামেন এই বলে যে, সোভিয়েত নেতারা ইচ্ছাকৃতভাবে একটি যাত্রীবাহী বিমানে মিসাইল হামলা চালিয়ে মানবতা-বিরোধী অপরাধ করেছেন। পরে জানাজানি হয়ে যায়, ওই যাত্রীবাহী বিমানটি মার্কিন সিআইএর চক্রান্তে ওই বিপজ্জনক আকাশসীমায় পাঠানো হয়েছিল এবং তৎকালীন শীতল যুদ্ধের স্বার্থে অসংখ্য যাত্রী (নিজেদের সিনেটরসহ) হত্যায় মার্কিন প্রশাসন দ্বিধা করেনি।
ইরাক-ইরান আট বছরব্যাপী যুদ্ধের সময়েও আমেরিকা ইরানকে ধ্বংস করার জন্য (এই চক্রান্ত এখনও চলছে) ইরাকের সাদ্দাম হোসেনকে বিষাক্ত গ্যাসসহ নানা ধরনের মারণাস্ত্র সরবরাহ করে। তাতেও সন্তুষ্ট না থেকে ইরানের একটি যাত্রীবাহী বিমানে মিসাইল হামলা চালিয়ে তিনশর মতো নির্দোষ যাত্রীকে (নারী ও শিশুসহ) হত্যা করে। পরে বলা হয় ভুল করে নাকি এই মিসাইলটি ছোড়া হয়েছিল। সেদিন এই গণহত্যা নিয়ে পশ্চিমা মিডিয়ায় কোনো হা-মাতম শুরু হয়নি।
মালয়েশিয়ার এই যাত্রীবাহী বিমানটি আকাশপথে ধ্বংস হওয়াকে কেন্দ্র করে রাশিয়া ও পুতিনকে একঘরে করার চেষ্টা হবে। অর্থনৈতিক বয়কট আরও কঠোর করা হবে। চাই কি সাময়িক ব্যবস্থা গ্রহণের পাঁয়তারা চলবে। রাশিয়াকে জব্দ করা গেলে সিরিয়া ও ইরানের পাশ থেকে এক শক্তিশালী মিত্রকে অপসারণ করা সম্ভব হবে। ইসরাইলকে অবাধ হত্যাকাণ্ড চালানো এবং আরব ভূমি দখলের সুযোগ দেয়া যাবে। আমেরিকার পতন্মুখ অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং সামরিক আধিপত্য রক্ষার ব্যবস্থা হবে।
কিন্তু এই চক্রান্ত সফল হবে কি? মালয়েশিয়ান যাত্রীবাহী বিমানটি ধ্বংস হওয়ার পেছনে কাদের নেপথ্য চক্রান্ত দায়ী, সাইবেরিয়ায় যাত্রীবাহী বিমান ধ্বংস হওয়ার রহস্য ফাঁস হওয়ার মতো সে রহস্যও শিগগিরই ফাঁস হয়ে যেতে পারে। বিশ্বময় এই ধ্বংসযজ্ঞ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদেরই মৃত্যুযন্ত্রণার লাথি। এই লাথি ব্যুমেরাং হয়ে আমেরিকার কাছেই ফিরে আসতে পারে।
লন্ডন, ২০ জুলাই, রোববার ২০১৪
No comments