হাসপাতালে হতাহতের ভিড়
গাজা শহরের একটি হাসপাতালে গতকাল ইসরায়েলি গোলায় আহত দুই শিশুর চিকিৎসায় ব্যস্ত এক স্বাস্থ্যকর্মী। রয়টার্স |
গাজার উত্তরাঞ্চলের প্রধান হাসপাতাল কামাল আদওয়ানের সামনে গুরুতর আহত একজনকে অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হলো। উন্নত চিকিৎসাসেবা দিতে তাঁকে আরেক হাসপাতালের নিতে হবে। সাইরেন বাজানো শুরু করল অ্যাম্বুলেন্সটি। কিন্তু পথ আগলে থাকা ছয় থেকে সাতজন নারীর কারণে অ্যাম্বুলেন্স এগোতে পারছে না। ওই নারীদের মধ্যে একজন অ্যাম্বুলেন্সের পাশের দরজা খোলার চেষ্টা করছেন। একপর্যায়ে দরজা খোলা হলে অ্যাম্বুলেন্সে শুয়ে থাকা আহত স্বজনকে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি। চোখের জলে আবেগ কিছুটা হালকা হওয়ার পর অন্যরা ওই নারীকে সরিয়ে নিলেন। ছেড়ে দিলেন অ্যাম্বুলেন্সটি।
খবর নিউইয়র্ক টাইমসের। এটা শুধু কামাল আদওয়ান হাসপাতালের সামনের দৃশ্য নয়। গাজায় ইসরায়েলি হামলা শুরু হওয়ার পর সেখানকার ছোট-বড় সব হাসপাতালেই এ দৃশ্য নিয়মিত হয়ে উঠছে। রক্তাক্ত নারী, পুরুষ, শিশুকে হাসপাতালে আনা হচ্ছে, আহতদের আর্তনাদ আর স্বজনদের আহাজারি চলছে, চিকিৎসকসহ হাসপাতালের কর্মীরা আহত লোকজনকে দ্রুত ভেতরে নিয়ে যাচ্ছেন। পরে বাইরে থাকা কোনো কোনো স্বজনকে খবর দেওয়া হচ্ছে, ‘...আর বেঁচে নেই।’ আবার স্বজনদের আহাজারি... শোক। গাজায় তিন দিন ধরে স্থল অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। এতে হতাহতের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। সব মিলিয়ে ৭ জুলাই থেকে গাজায় ইসরায়েলি অভিযান শুরুর পর গতকাল রোববার পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ৪৩৫ জনে দাঁড়িয়েছে; যার অধিকাংশই বেসামরিক নাগরিক। এ সময়ে আহত হয়েছে দুই হাজার ৪০০ জন। সাধারণ সময়েই গাজার হাসপাতালগুলোতে ওষুধের সরবরাহ প্রয়োজনের তুলনায় কম থাকে। গাজায় স্থলবাহিনীর অভিযান শুরু হওয়ার পর তা আরও প্রকট হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ ও যন্ত্রপাতির জোগান না থাকায় হতাশ হতে হয় চিকিৎসকদের। কামাল আদওয়ান হাসপাতালে কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র ও সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ যন্ত্রের সুবিধাসহ মাত্র দুটি শয্যা রয়েছে।তাই আশঙ্কাজনক অনেক ব্যক্তিকে প্রয়োজন সত্ত্বেও শয্যা দেওয়া যাচ্ছে না। অথচ অন্য সময় হলে এ ধরনের ব্যক্তিদেরও হাসপাতালে ভর্তি করানো হতো। ইসরায়েলি হারেৎজ পত্রিকার খবরে বলা হয়, ইসরায়েল গত শনিবার ইরেজ সীমান্ত ক্রসিং খুলে দিয়ে পাঁচ টন পরিমাণ চিকিৎসা-সরঞ্জাম গাজায় প্রবেশের অনুমতি দেয়। কিন্তু গাজায় ইসরায়েলি অভিযান কত দিন চলবে, তা কেউ জানে না।
তাই গাজার হাসপাতাল-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আশঙ্কা, খুব দ্রুতই ওষুধ ও চিকিৎসা-সরঞ্জাম ফুরিয়ে যাবে। আহত লোকজনের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় স্থান সংকুলান হচ্ছে না বলে অপেক্ষাকৃত কম আহত ব্যক্তিদের ভর্তি নেওয়া হচ্ছে না হাসপাতালে। এটা করা হচ্ছে গুরুতর আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা দেওয়ার পথ খোলা রাখতে। গাজার উত্তরাঞ্চলের জরুরি স্বাস্থ্যবিষয়ক পরিচালক সাইদ সালেহ জানান, স্থল অভিযান শুরু হওয়ার পর হাসপাতালে আহত লোকজনের আসার সংখ্যা কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি বলেন, ‘আহত অনেকেরই অবস্থা আশঙ্কাজনক। মৃতের সংখ্যা বাড়তেই থাকবে।’ গাজার উত্তরাঞ্চলের আরেক হাসপাতাল বেইত হানাউনে আগের তুলনায় ছিন্নভিন্ন মরদেহ বেশি আসছে। ওই এলাকায় ইসরায়েলি স্থল অভিযানের ব্যাপ্তিও অনেক বেশি। ট্যাংকের পাশাপাশি যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার গানশিপ ব্যবহার করে হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)। জরুরি স্বাস্থ্যবিষয়ক পরিচালক সাইদ সালেহ বলেন, ওই মরদেহগুলো হয় গুলি, নয়তো ট্যাংকের গোলায় ছিন্নভিন্ন হয়। আসলে ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় স্থল অভিযান শুরু করার পর নির্বিচারে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। আল-শিফা হাসপাতালে ভর্তি ছয় বছর বয়সী শিশুকন্যা নূরের শয্যাপাশে বসে গাজার বাসিন্দা আবু জারাদ বলেন, ‘এখানে নিরাপদ আশ্রয় বলতে কিছু নেই। আমরা কোথায় যাব? তারা রাস্তাঘাটে পর্যন্ত মানুষ হত্যা করছে।’ গত শুক্রবার রাতে ইসরায়েলি বিমান হামলায় আহত হয় শিশু নূর। রাতে তাদের বাড়ির এক পাশে বিমান থেকে ফেলা বোমায় নিহত হয় নূরের তিন স্বজন।তার একটু পরেই আরেকটি বোমায় বিধ্বস্ত হয় তাদের থাকার ঘরসহ পুরো বাড়ি। রক্তাক্ত হয়েও ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় নূর ও তার বাবা-মা।
No comments