নরেন্দ্র মোদির উন্নয়ন এজেন্ডা ও বাংলাদেশ by ড. ইমতিয়াজ আহমেদ
বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ের জন্যই ২০১৪ সাল ছিল নির্বাচনের বছর। যে কোনোভাবেই হোক বাংলাদেশ গত ৫ জানুয়ারিতে গ্রহণযোগ্যের চেয়ে কম মাত্রার একটি নির্বাচন করতে পেরেছে। সংসদের বাইরের রাজনৈতিক দল অথবা যে সব রাজনৈতিক দল নির্বাচন বর্জন করেছিল তাদের কাছ থেকে এরই মধ্যে নতুন নির্বাচনের দাবি উঠেছে। অন্যদিকে এপ্রিল থেকে মে মাসে ভারতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, যাতে রীতিমতো প্রত্যাশা ছাড়ানো ফলাফল এসেছে। কেবল কংগ্রেস তার ইতিহাসের খারাপতম পরাজয় বরণ করেনি, একইসঙ্গে বিজেপি ও জোটসঙ্গী একচ্ছত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিতর্কিত নেতৃত্ব নরেন্দ্র মোদির মাধ্যমে ক্ষমতায় ফিরে এসেছে। গত ৩০ বছরে কোনো একক দল এমন অর্জন করতে পারেনি। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো কীভাবে কাজ করবে? এ ক্ষেত্রে দুটি বিষয় সামনে আসতে পারে এবং সে অনুযায়ী নিরীক্ষার মাধ্যমে মতামত পাওয়া যেতে পারে।
প্রথমত, রিয়ালিস্ট বা বিসমার্কিয়ান মতবাদ যা বলে, বৈদেশিক নীতি দেশীয় রাজনীতিরই বিস্তার; তা কতটা গ্রহণযোগ্য? এটি যদি কাজ করে তাহলে বাংলাদেশে বিশেষ করে দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে রাজনৈতিক অচলাবস্থা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলবে। এমন অচল পরিস্থিতিতে ভারত যদি কোনো একটি রাজনৈতিক দলের দিকে ঝুঁকে পড়তে চায়, যেমনটা কংগ্রেস ও আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে এতদিন হয়েছে, তাহলে তা কি বাংলাদেশের ভারতবিরোধী শক্তিকে রসদ জোগাবে? রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে থেকেই বাংলাদেশ কি ভারতের সঙ্গে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি বিষয়গুলোতে সংযুক্ত হয়ে কাজ করতে পারবে? নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির বিজয় ও বিজেপির মাধ্যমে কি ভারতে মৌলবাদী শক্তির ক্ষমতায়ন ঘটবে এবং বাংলাদেশেও কি একই ধরনের শক্তির হাত শক্তিশালী হবে?
দ্বিতীয়ত, পোস্ট রিয়ালিস্ট মত যা বলে, জাতিরাষ্ট্রের সঙ্গে বিশ্বায়নের গুণগত রূপান্তরিত সম্পর্ক রয়েছে। এটি কি বোঝায় যে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, কাঁচামালের সরবরাহ, সাংস্কৃতিক বিনিময়, অ-প্রথাগত নিরাপত্তাহীনতা, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংযোগের মতো আরও কিছু কাঠামো রয়েছে, যেগুলো বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নির্ধারণে ভূমিকা রাখে। একইসঙ্গে এটি কি বলা যায় যে বৈদেশিক নীতি তৈরিতে স্বকীয় চলক এখন অতটা ফ্যাক্টর নয়। বৈদেশিক নীতি নির্ধারণে দলীয় অভিমুখিতা, যেটি বলা হয়ে থাকে পূর্বের কংগ্রেস সরকার ও আওয়ামী লীগের মধ্যে ছিল, তা কি উভয় দেশের জনগণের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থকে ক্ষুণ্ন করা ছাড়া দীর্ঘসময় চলমান থাকবে?
নির্বাচনপরবর্তী অবস্থা বিশ্লেষণ করতে হলে আমাদের বুঝতে হবে নির্বাচন বলতে আমরা কী বুঝি। যুক্তরাষ্ট্র কিংবা যুক্তরাজ্যের নির্বাচনের সঙ্গে ভারত বা বাংলাদেশের নির্বাচনের অনেক পার্থক্য রয়েছে। এখানে পদ্ধতি ভিন্ন, রাজনৈতিক দলগুলোর বৈশিষ্ট্যও ভিন্ন। দক্ষিণ এশিয়ার নির্বাচন ও গণতন্ত্রের ধরন ব্যাখ্যা করতে গেলে আমাদের চারটি বিষয় সামনে আনতে হবে। এক. এখানে নির্বাচনীয় গণতন্ত্র কিংবা নির্বাচনীয় কর্তৃত্ববাদ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে দুর্বল নাগরিক সমাজের দায় রয়েছে। নাগরিক সমাজের এখন দলীয় আনুগত্য রয়েছে। দুই. দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনীতির ক্ষেত্রে পরিবারতন্ত্রের প্রভাব রয়েছে। 'পলিটিক্স অব ট্র্যাজেডি' চলমান থাকলেই কেবল পরিবারতন্ত্রের পুনরুৎপাদন সম্ভব। এর সঙ্গে রয়েছে 'পলিটিক্স অব সিমপ্যাথি'। আমাদের দেশের কথাই বলা যাক। এখানে কোনো বড় রাজনৈতিক নেতাই রাজনৈতিক পরিবার থেকে উঠে আসেননি। কিন্তু রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র তখনই ভিত করে নিতে পারছে যখন কোনো ট্র্যাজেডি ঘটছে। তবে পলিটিক্স অব ট্র্যাজেডির প্রতিলিপি বারবার করা সম্ভব নয়। পাকিস্তানে বেনজির ভুট্টোর পুত্র বিলাওয়াল পারেননি। জারদারি 'পলিটিক্স অব সিমপ্যাথির' সূত্রে সামনে চলে এসেছেন। তিন. এখানে পলিটিক্যাল-বিজনেস (ব্যুরোক্রেটিক) যোগসূত্র রয়েছে। সুশাসনের কথা অনেক সময়ই বলা হয়। সুশাসন অর্জনের জন্য পদক্ষেপের কথা আমরা শুনতে পাই। অন্যদিকে এটিও সত্যি যে, অপশাসন লাভযোগ্য। যেমন বিদ্যুতের লাইন নিতে গেলে সঠিক পদ্ধতিতে অনেক অনেক সময় লেগে যাবে। কিন্তু বিকল্প কিছু পদ্ধতি রয়েছে, যার মাধ্যমে সহজেই এটি পাওয়া সম্ভব। সুতরাং এটি বলা যায় যে পলিটিক্যাল-বিজনেস (ব্যুরোক্রেটিক) নেক্সাস এমন প্রবণতা বহন করে, যা দুর্বল নাগরিক সমাজকে দুর্বল করে দিচ্ছে। চার. স্থানীয় নির্বাচনী অঞ্চল, আধিপত্যবাদ, সীমান্তকেন্দ্রিক সংঘাত, জাতিগোষ্ঠীর অর্থ দক্ষিণ এশিয়ার নির্বাচন ও গণতন্ত্রে ভূমিকা রাখে।
রাজনীতির সঙ্গে অর্থনীতিও গুরুত্বপূর্ণ। জনগণের রাজনীতি নিয়ে অনেক আগ্রহ রয়েছে, কিন্তু একটা সময় তারা অর্থনীতি কোনদিকে যাচ্ছে তা নিয়েও সতর্ক। দক্ষিণ এশিয়ায় অর্থনীতির লক্ষণীয় রূপান্তর ঘটেছে। হিউম্যান ক্যাপিটালিজমের প্রভাব এতে পড়েছে। মার্কস ও লেনিন উৎপাদন প্রক্রিয়াকে যেভাবে দেখেছেন এখন আর তেমনটি নেই। প্রথমবারের মতো এখন উৎপাদন আন্তর্জাতিক হয়ে উঠেছে। উৎপাদন আগে জাতীয় বিষয় ছিল। আমরা এখন যা-ই কিনছি তার সঙ্গেই আন্তর্জাতিক উৎপাদনের সম্পর্ক রয়েছে। বিশ্বায়নের যুগে এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের বাণিজ্য ঘাটতি হিসাব করেই কেবল অর্থনৈতিক সম্পর্কের ধরন কিংবা অর্থনীতিতে ঘাটতির প্রভাব বোঝা সম্ভব নয়। একদিকে যেমন রয়েছে ইকোনমিক গ্গ্নোবালাইজেশন, অন্যদিকে ভিজ্যুয়াল মিডিয়ার শক্তিতে দৃশ্যমান হয়েছে রিভার্স গ্গ্নোবালাইজেশন। আবার আন্ডারওয়ার্ল্ডের অধিবাসীদের জন্য রয়েছে সাবঅলটার্ন গ্গ্নোবালাইজেশন। মানব থেকে মাদক পাচারের ক্ষেত্রে এই সাবঅলটার্ন গ্গ্নোবালাইজেশন কাজ করে। বিশ্বায়নের প্রভাবকে এখন উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই।
এখন ভারতের নির্বাচনে মোদির বিপুল জয়লাভ প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। বলা হচ্ছে মোদির বিজয়ে ভারতে এক ধরনের 'মোদিফিকেশন' ঘটেছে। এটি কিন্তু ভারতের বৈদেশিক নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। সেখানে রিয়ালিস্ট ও পোস্ট-রিয়ালিস্ট মতবাদের সমন্বয় আমরা দেখতে পাই। বিশ্বায়নের সঙ্গে দেশীয় বাধ্যবাধতার ভারসাম্য এতে রয়েছে। মোদির ক্ষেত্রে ইমেজ ফ্যাক্টর গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। তার কাছে দুটি কার্ড ছিল। উন্নয়ন কার্ড ও সাম্প্রদায়িকতার কার্ড। তিনি কিন্তু বুদ্ধি করে উন্নয়নের কার্ডটাই খেলেছেন। এতে তিনি এখন পর্যন্ত সফল। মানুষ কিন্তু দায়িত্বশীল কোনো পদে সক্ষম ব্যক্তিটিকেই দেখতে চায়। মোদি নিজের সক্ষমতার বিষয়টি মানুষকে বিশ্বাস করাতে পেরেছেন। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানেও তিনি চমক দেখিয়েছেন। এমন সব অতিথিকে দাওয়াত দিয়েছেন, যাদের কথা অনেকেই ভাবেইনি। প্রথম ভ্রমণ ভুটানে করার ঘোষণা দিয়ে মোদি চমক সৃষ্টি করেছেন এবং বিশ্ববাসীকে বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি নতুন কিছু করতে চান।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের বাংলাদেশ সফর এই আলোচনায় প্রাসঙ্গিক। এই সফরের সময় গত ২৬ জুন সুষমা স্বরাজ যে লিখিত বক্তব্য দিয়েছেন তাতে তিনি কয়েকটা বিষয় স্পষ্ট করতে চেয়েছেন। প্রথমত, মোদিকে তিনি রাজনৈতিক অঙ্গনের একজন দায়িত্বশীল প্লেয়ার হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন। দ্বিতীয়ত, তিনি নির্বাচনকালীন স্মৃতি মনে করিয়ে দিয়েছেন। তিনি তার বক্তব্যে বলেছেন, আমরা অবহিত যে এই বছরের এপ্রিল ও মে মাসে অনুষ্ঠিত ভারতের জাতীয় নির্বাচন বাংলাদেশ থেকে গভীরভাবে অনুসরণ করা হয়েছে। আমরা সকল শুভকামনার জন্য আপনাদের ধন্যবাদ জানাই। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শুভকামনা ছিল কি? আওয়ামী লীগের অনেক নেতা, এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কি সরাসরি মোদির সমালোচনা করেননি, যেখানে তারা মনমোহন কিংবা সোনিয়ার ব্যাপারে চুপ ছিলেন? তৃতীয়ত, সুষমা স্বরাজ নিজেদের সিভিলাইজেশন ফ্যাক্টরকে সামনে এনেছেন। তিনি বলেছেন, আমাদের সরকার নতুন ধরন ও তাজা চিন্তার মাধ্যমে পরিচালিত হবে এবং একইসঙ্গে আমাদের সভ্যতার মৌল ভিত্তিগুলো আমাদেরকে নির্দেশনা জোগাবে। তিনি অনেকটা গান্ধীর মতো করেই বলেছেন, ধর্ম ও রাজনীতি হাতে হাত ধরে চলে! চতুর্থত, তিনি বাংলাদেশের শাসন সংকটের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের বিষয়টিও এই রেফারেন্সে রয়েছে। পঞ্চমত, তিনি অবৈধ অভিবাসীদের ব্যাপারে নরম মনোভাব প্রকাশ করেছেন। গত ১৮ জুলাই টাইমস অব ইন্ডিয়াতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকেও একই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি পাওয়া গেছে। ষষ্ঠত, তিনি দুই দেশের ডেভলেপমেন্ট এজেন্ডার কথা বলেছেন। বাংলাদেশের রূপকল্প ২০২১ অর্জনে ভারত যে উন্নয়ন সহযোগী হতে পারে তাও উল্লেখ করেছেন। সপ্তমত, তিনি সাম্যতার নীতির প্রসঙ্গে বলেছেন। বক্তৃতায় তিনি বলেছেন, আমাদের ইচ্ছা এই যে ভারত ও বাংলাদেশ সমান অংশীদার হিসেবে সামনে এগিয়ে যাবে। অষ্টমত, তার এই বক্ততায় এক ধরনের মনস্তাত্তি্বক দূরত্ব রয়েছে। ২৪০৫ শব্দের লিখিত বক্তৃতায় তিনি একবারও আমাদের প্রধানমন্ত্রীর নাম উল্লেখ করেননি।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে দুটি বিষয়ের সমাধান হওয়া জরুরি। একটি তিস্তার পানি বণ্টন, আরেকটি স্থল সীমান্ত চুক্তি। আমার মনে হয় স্থল সীমান্ত চুক্তি আগে সম্ভব, তিস্তা চুক্তি নয়। তিস্তা চুক্তি করতে হলে মমতা ব্যানার্জির সম্মতি প্রয়োজন। কারণ পানি রাজ্যের বিষয়বস্তু। মমতা কেন তিস্তা চুক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন? তিনটি কারণে মমতার এমন অবস্থান। তিস্তার উৎপত্তিস্থল সিকিম থেকে কতটা পানি পশ্চিমবঙ্গে আসবে তার নিশ্চয়তা তিনি দিলি্লর কাছে চেয়েছেন। তিনি দিলি্লর কাছ থেকে একটি ইকোনমিক প্যাকেজ চেয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গে অবাঙালি ব্যবসায়ী কমিউনিটির ব্যবসা নিয়েও মমতা কিছু পদক্ষেপ চেয়েছেন। মমতার এই দাবিগুলোকে অযৌক্তিক বলা যায় না। আমার মনে হয় তিস্তা চুক্তির ক্ষেত্রেও কিছুটা সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ যে করপোরেট সেক্টর মোদিকে সমর্থন করেছে তারাই আবার মমতাকেও সমর্থন করেছে। যেহেতু করপোরেট সেক্টর এক, তাই তারা মোদি ও মমতাকে আলোচনার টেবিলে হাজির করতে পারবে বলে আমার মনে হয়। স্থল সীমান্ত চুক্তি ও তিস্তা চুক্তি সম্পাদন হলে তা নরেন্দ্র মোদিকে আলাদা ইমেজ দেবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি সফলতার সঙ্গে এগুলো সম্পাদন করতে পেরেছেন, এটি নিশ্চয়ই তার জন্য আলাদা ভাবমূর্তি এনে দেবে। আমার মনে হয় স্থল সীমান্ত চুক্তি করা সহজ হবে। কারণ যা এরইমধ্যে কার্যত সূত্রে রয়েছে, তাকে আইনি সূত্রের অধীনে নিয়ে আসতে হবে। এতে করে কারও পরাজয় হবে না।
এখন বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু বলা যাক। এ ক্ষেত্রে চারটি বিষয় বিবেচ্য হতে পারে। মোদির ডেভেলপমেন্ট এজেন্ডা বাস্তবায়নের স্বার্থেই স্থিতিশীল বাংলাদেশ প্রয়োজন। একইসঙ্গে মোদির ডেভেলপমেন্ট এজেন্ডা বাস্তবায়নের ওপরেই নির্ভর করবে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক। বাংলাদেশে সরকার নিয়ে সংকট রয়েছে, তার সমাধান জরুরি। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে যে পারস্পরিক অচলাবস্থা বিদ্যমান তার নিষ্পত্তি করতে হবে। মোদি যুগের দিলি্লর সঙ্গে মনস্তাত্তি্বক দূরত্ব আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে সংলাপ শুরুর পথ বাতলে দিতে পারে। যদি মোদি ডেভেলপমেন্ট এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হন তবে কী ঘটবে তা এখনই বলতে যাওয়া খুব তাড়াহুড়া মনে হবে। তবে তখন কি মোদি তার অন্য কার্ডের কাছে ফিরে যাবেন? ধর্মান্ধতার গুরুত্বপূর্ণ কার্ডটি কিন্তু তার কাছে রয়েছে। সময়ই হয়তো তা বলে দেবে।
প্রথমত, রিয়ালিস্ট বা বিসমার্কিয়ান মতবাদ যা বলে, বৈদেশিক নীতি দেশীয় রাজনীতিরই বিস্তার; তা কতটা গ্রহণযোগ্য? এটি যদি কাজ করে তাহলে বাংলাদেশে বিশেষ করে দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে রাজনৈতিক অচলাবস্থা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলবে। এমন অচল পরিস্থিতিতে ভারত যদি কোনো একটি রাজনৈতিক দলের দিকে ঝুঁকে পড়তে চায়, যেমনটা কংগ্রেস ও আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে এতদিন হয়েছে, তাহলে তা কি বাংলাদেশের ভারতবিরোধী শক্তিকে রসদ জোগাবে? রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে থেকেই বাংলাদেশ কি ভারতের সঙ্গে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি বিষয়গুলোতে সংযুক্ত হয়ে কাজ করতে পারবে? নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির বিজয় ও বিজেপির মাধ্যমে কি ভারতে মৌলবাদী শক্তির ক্ষমতায়ন ঘটবে এবং বাংলাদেশেও কি একই ধরনের শক্তির হাত শক্তিশালী হবে?
দ্বিতীয়ত, পোস্ট রিয়ালিস্ট মত যা বলে, জাতিরাষ্ট্রের সঙ্গে বিশ্বায়নের গুণগত রূপান্তরিত সম্পর্ক রয়েছে। এটি কি বোঝায় যে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, কাঁচামালের সরবরাহ, সাংস্কৃতিক বিনিময়, অ-প্রথাগত নিরাপত্তাহীনতা, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংযোগের মতো আরও কিছু কাঠামো রয়েছে, যেগুলো বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নির্ধারণে ভূমিকা রাখে। একইসঙ্গে এটি কি বলা যায় যে বৈদেশিক নীতি তৈরিতে স্বকীয় চলক এখন অতটা ফ্যাক্টর নয়। বৈদেশিক নীতি নির্ধারণে দলীয় অভিমুখিতা, যেটি বলা হয়ে থাকে পূর্বের কংগ্রেস সরকার ও আওয়ামী লীগের মধ্যে ছিল, তা কি উভয় দেশের জনগণের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থকে ক্ষুণ্ন করা ছাড়া দীর্ঘসময় চলমান থাকবে?
নির্বাচনপরবর্তী অবস্থা বিশ্লেষণ করতে হলে আমাদের বুঝতে হবে নির্বাচন বলতে আমরা কী বুঝি। যুক্তরাষ্ট্র কিংবা যুক্তরাজ্যের নির্বাচনের সঙ্গে ভারত বা বাংলাদেশের নির্বাচনের অনেক পার্থক্য রয়েছে। এখানে পদ্ধতি ভিন্ন, রাজনৈতিক দলগুলোর বৈশিষ্ট্যও ভিন্ন। দক্ষিণ এশিয়ার নির্বাচন ও গণতন্ত্রের ধরন ব্যাখ্যা করতে গেলে আমাদের চারটি বিষয় সামনে আনতে হবে। এক. এখানে নির্বাচনীয় গণতন্ত্র কিংবা নির্বাচনীয় কর্তৃত্ববাদ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে দুর্বল নাগরিক সমাজের দায় রয়েছে। নাগরিক সমাজের এখন দলীয় আনুগত্য রয়েছে। দুই. দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনীতির ক্ষেত্রে পরিবারতন্ত্রের প্রভাব রয়েছে। 'পলিটিক্স অব ট্র্যাজেডি' চলমান থাকলেই কেবল পরিবারতন্ত্রের পুনরুৎপাদন সম্ভব। এর সঙ্গে রয়েছে 'পলিটিক্স অব সিমপ্যাথি'। আমাদের দেশের কথাই বলা যাক। এখানে কোনো বড় রাজনৈতিক নেতাই রাজনৈতিক পরিবার থেকে উঠে আসেননি। কিন্তু রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র তখনই ভিত করে নিতে পারছে যখন কোনো ট্র্যাজেডি ঘটছে। তবে পলিটিক্স অব ট্র্যাজেডির প্রতিলিপি বারবার করা সম্ভব নয়। পাকিস্তানে বেনজির ভুট্টোর পুত্র বিলাওয়াল পারেননি। জারদারি 'পলিটিক্স অব সিমপ্যাথির' সূত্রে সামনে চলে এসেছেন। তিন. এখানে পলিটিক্যাল-বিজনেস (ব্যুরোক্রেটিক) যোগসূত্র রয়েছে। সুশাসনের কথা অনেক সময়ই বলা হয়। সুশাসন অর্জনের জন্য পদক্ষেপের কথা আমরা শুনতে পাই। অন্যদিকে এটিও সত্যি যে, অপশাসন লাভযোগ্য। যেমন বিদ্যুতের লাইন নিতে গেলে সঠিক পদ্ধতিতে অনেক অনেক সময় লেগে যাবে। কিন্তু বিকল্প কিছু পদ্ধতি রয়েছে, যার মাধ্যমে সহজেই এটি পাওয়া সম্ভব। সুতরাং এটি বলা যায় যে পলিটিক্যাল-বিজনেস (ব্যুরোক্রেটিক) নেক্সাস এমন প্রবণতা বহন করে, যা দুর্বল নাগরিক সমাজকে দুর্বল করে দিচ্ছে। চার. স্থানীয় নির্বাচনী অঞ্চল, আধিপত্যবাদ, সীমান্তকেন্দ্রিক সংঘাত, জাতিগোষ্ঠীর অর্থ দক্ষিণ এশিয়ার নির্বাচন ও গণতন্ত্রে ভূমিকা রাখে।
রাজনীতির সঙ্গে অর্থনীতিও গুরুত্বপূর্ণ। জনগণের রাজনীতি নিয়ে অনেক আগ্রহ রয়েছে, কিন্তু একটা সময় তারা অর্থনীতি কোনদিকে যাচ্ছে তা নিয়েও সতর্ক। দক্ষিণ এশিয়ায় অর্থনীতির লক্ষণীয় রূপান্তর ঘটেছে। হিউম্যান ক্যাপিটালিজমের প্রভাব এতে পড়েছে। মার্কস ও লেনিন উৎপাদন প্রক্রিয়াকে যেভাবে দেখেছেন এখন আর তেমনটি নেই। প্রথমবারের মতো এখন উৎপাদন আন্তর্জাতিক হয়ে উঠেছে। উৎপাদন আগে জাতীয় বিষয় ছিল। আমরা এখন যা-ই কিনছি তার সঙ্গেই আন্তর্জাতিক উৎপাদনের সম্পর্ক রয়েছে। বিশ্বায়নের যুগে এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের বাণিজ্য ঘাটতি হিসাব করেই কেবল অর্থনৈতিক সম্পর্কের ধরন কিংবা অর্থনীতিতে ঘাটতির প্রভাব বোঝা সম্ভব নয়। একদিকে যেমন রয়েছে ইকোনমিক গ্গ্নোবালাইজেশন, অন্যদিকে ভিজ্যুয়াল মিডিয়ার শক্তিতে দৃশ্যমান হয়েছে রিভার্স গ্গ্নোবালাইজেশন। আবার আন্ডারওয়ার্ল্ডের অধিবাসীদের জন্য রয়েছে সাবঅলটার্ন গ্গ্নোবালাইজেশন। মানব থেকে মাদক পাচারের ক্ষেত্রে এই সাবঅলটার্ন গ্গ্নোবালাইজেশন কাজ করে। বিশ্বায়নের প্রভাবকে এখন উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই।
এখন ভারতের নির্বাচনে মোদির বিপুল জয়লাভ প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। বলা হচ্ছে মোদির বিজয়ে ভারতে এক ধরনের 'মোদিফিকেশন' ঘটেছে। এটি কিন্তু ভারতের বৈদেশিক নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। সেখানে রিয়ালিস্ট ও পোস্ট-রিয়ালিস্ট মতবাদের সমন্বয় আমরা দেখতে পাই। বিশ্বায়নের সঙ্গে দেশীয় বাধ্যবাধতার ভারসাম্য এতে রয়েছে। মোদির ক্ষেত্রে ইমেজ ফ্যাক্টর গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। তার কাছে দুটি কার্ড ছিল। উন্নয়ন কার্ড ও সাম্প্রদায়িকতার কার্ড। তিনি কিন্তু বুদ্ধি করে উন্নয়নের কার্ডটাই খেলেছেন। এতে তিনি এখন পর্যন্ত সফল। মানুষ কিন্তু দায়িত্বশীল কোনো পদে সক্ষম ব্যক্তিটিকেই দেখতে চায়। মোদি নিজের সক্ষমতার বিষয়টি মানুষকে বিশ্বাস করাতে পেরেছেন। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানেও তিনি চমক দেখিয়েছেন। এমন সব অতিথিকে দাওয়াত দিয়েছেন, যাদের কথা অনেকেই ভাবেইনি। প্রথম ভ্রমণ ভুটানে করার ঘোষণা দিয়ে মোদি চমক সৃষ্টি করেছেন এবং বিশ্ববাসীকে বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি নতুন কিছু করতে চান।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের বাংলাদেশ সফর এই আলোচনায় প্রাসঙ্গিক। এই সফরের সময় গত ২৬ জুন সুষমা স্বরাজ যে লিখিত বক্তব্য দিয়েছেন তাতে তিনি কয়েকটা বিষয় স্পষ্ট করতে চেয়েছেন। প্রথমত, মোদিকে তিনি রাজনৈতিক অঙ্গনের একজন দায়িত্বশীল প্লেয়ার হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন। দ্বিতীয়ত, তিনি নির্বাচনকালীন স্মৃতি মনে করিয়ে দিয়েছেন। তিনি তার বক্তব্যে বলেছেন, আমরা অবহিত যে এই বছরের এপ্রিল ও মে মাসে অনুষ্ঠিত ভারতের জাতীয় নির্বাচন বাংলাদেশ থেকে গভীরভাবে অনুসরণ করা হয়েছে। আমরা সকল শুভকামনার জন্য আপনাদের ধন্যবাদ জানাই। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শুভকামনা ছিল কি? আওয়ামী লীগের অনেক নেতা, এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কি সরাসরি মোদির সমালোচনা করেননি, যেখানে তারা মনমোহন কিংবা সোনিয়ার ব্যাপারে চুপ ছিলেন? তৃতীয়ত, সুষমা স্বরাজ নিজেদের সিভিলাইজেশন ফ্যাক্টরকে সামনে এনেছেন। তিনি বলেছেন, আমাদের সরকার নতুন ধরন ও তাজা চিন্তার মাধ্যমে পরিচালিত হবে এবং একইসঙ্গে আমাদের সভ্যতার মৌল ভিত্তিগুলো আমাদেরকে নির্দেশনা জোগাবে। তিনি অনেকটা গান্ধীর মতো করেই বলেছেন, ধর্ম ও রাজনীতি হাতে হাত ধরে চলে! চতুর্থত, তিনি বাংলাদেশের শাসন সংকটের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের বিষয়টিও এই রেফারেন্সে রয়েছে। পঞ্চমত, তিনি অবৈধ অভিবাসীদের ব্যাপারে নরম মনোভাব প্রকাশ করেছেন। গত ১৮ জুলাই টাইমস অব ইন্ডিয়াতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকেও একই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি পাওয়া গেছে। ষষ্ঠত, তিনি দুই দেশের ডেভলেপমেন্ট এজেন্ডার কথা বলেছেন। বাংলাদেশের রূপকল্প ২০২১ অর্জনে ভারত যে উন্নয়ন সহযোগী হতে পারে তাও উল্লেখ করেছেন। সপ্তমত, তিনি সাম্যতার নীতির প্রসঙ্গে বলেছেন। বক্তৃতায় তিনি বলেছেন, আমাদের ইচ্ছা এই যে ভারত ও বাংলাদেশ সমান অংশীদার হিসেবে সামনে এগিয়ে যাবে। অষ্টমত, তার এই বক্ততায় এক ধরনের মনস্তাত্তি্বক দূরত্ব রয়েছে। ২৪০৫ শব্দের লিখিত বক্তৃতায় তিনি একবারও আমাদের প্রধানমন্ত্রীর নাম উল্লেখ করেননি।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে দুটি বিষয়ের সমাধান হওয়া জরুরি। একটি তিস্তার পানি বণ্টন, আরেকটি স্থল সীমান্ত চুক্তি। আমার মনে হয় স্থল সীমান্ত চুক্তি আগে সম্ভব, তিস্তা চুক্তি নয়। তিস্তা চুক্তি করতে হলে মমতা ব্যানার্জির সম্মতি প্রয়োজন। কারণ পানি রাজ্যের বিষয়বস্তু। মমতা কেন তিস্তা চুক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন? তিনটি কারণে মমতার এমন অবস্থান। তিস্তার উৎপত্তিস্থল সিকিম থেকে কতটা পানি পশ্চিমবঙ্গে আসবে তার নিশ্চয়তা তিনি দিলি্লর কাছে চেয়েছেন। তিনি দিলি্লর কাছ থেকে একটি ইকোনমিক প্যাকেজ চেয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গে অবাঙালি ব্যবসায়ী কমিউনিটির ব্যবসা নিয়েও মমতা কিছু পদক্ষেপ চেয়েছেন। মমতার এই দাবিগুলোকে অযৌক্তিক বলা যায় না। আমার মনে হয় তিস্তা চুক্তির ক্ষেত্রেও কিছুটা সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ যে করপোরেট সেক্টর মোদিকে সমর্থন করেছে তারাই আবার মমতাকেও সমর্থন করেছে। যেহেতু করপোরেট সেক্টর এক, তাই তারা মোদি ও মমতাকে আলোচনার টেবিলে হাজির করতে পারবে বলে আমার মনে হয়। স্থল সীমান্ত চুক্তি ও তিস্তা চুক্তি সম্পাদন হলে তা নরেন্দ্র মোদিকে আলাদা ইমেজ দেবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি সফলতার সঙ্গে এগুলো সম্পাদন করতে পেরেছেন, এটি নিশ্চয়ই তার জন্য আলাদা ভাবমূর্তি এনে দেবে। আমার মনে হয় স্থল সীমান্ত চুক্তি করা সহজ হবে। কারণ যা এরইমধ্যে কার্যত সূত্রে রয়েছে, তাকে আইনি সূত্রের অধীনে নিয়ে আসতে হবে। এতে করে কারও পরাজয় হবে না।
এখন বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু বলা যাক। এ ক্ষেত্রে চারটি বিষয় বিবেচ্য হতে পারে। মোদির ডেভেলপমেন্ট এজেন্ডা বাস্তবায়নের স্বার্থেই স্থিতিশীল বাংলাদেশ প্রয়োজন। একইসঙ্গে মোদির ডেভেলপমেন্ট এজেন্ডা বাস্তবায়নের ওপরেই নির্ভর করবে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক। বাংলাদেশে সরকার নিয়ে সংকট রয়েছে, তার সমাধান জরুরি। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে যে পারস্পরিক অচলাবস্থা বিদ্যমান তার নিষ্পত্তি করতে হবে। মোদি যুগের দিলি্লর সঙ্গে মনস্তাত্তি্বক দূরত্ব আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে সংলাপ শুরুর পথ বাতলে দিতে পারে। যদি মোদি ডেভেলপমেন্ট এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হন তবে কী ঘটবে তা এখনই বলতে যাওয়া খুব তাড়াহুড়া মনে হবে। তবে তখন কি মোদি তার অন্য কার্ডের কাছে ফিরে যাবেন? ধর্মান্ধতার গুরুত্বপূর্ণ কার্ডটি কিন্তু তার কাছে রয়েছে। সময়ই হয়তো তা বলে দেবে।
No comments