চলে যাওয়া মানে ভুলে যাওয়া নয় by সাজেদুল হক
সব পরিচয় ছাপিয়ে তিনি পরিণত হয়েছিলেন
জীবনশিল্পীতে। সমালোচনার বান উপেক্ষা করে লিখে গেছেন অবিরাম। দুঃসময়েও
গেয়েছেন জীবনের জয়গান। সব সময় বিশ্বাস স্থাপন করেছেন মানুষের অসীম ক্ষমতার
প্রতি। অন্ধকার তার লেখায় সেভাবে আসেনি। তিনি ছিলেন আলোর পূজারি। যা তাকে
এনে দেয় বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখকের খেতাব। চাঁদনি রাতে
চন্দ্রকারিগরের কাছে যেতে চেয়েছিলেন হুমায়ূন। যদিও বাংলার সবুজ শ্যামল মাটি
থেকে বহুদূরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যু এসে নিয়ে যায় তাকে।
ক্যালেন্ডারে ১৯শে জুলাই ২০১২। সে সময় পুরো বাংলাদেশই যেন শোকে কাতর হয়ে
পড়েছিল। এক সাহিত্যিকের জন্য পুরো জাতি-রাষ্ট্রের এভাবে শোকাতুর হয়ে পড়া
ছিল একেবারেই অভিনব। একটি কফিনের পাশে বাংলাদেশ- সংবাদপত্রের সে শিরোনাম
ভোলার নয়। যেন মৃত্যুও তাকে মহিমান্বিত করেছিল। নুহাশ পল্লীর শ্যামল বুকে
ঠাঁই হয় হুমায়ূন আহমেদের। মৃত্যুকালে মানুষ হুমায়ূন আহমেদের বয়স হয়েছিল ৬৩
বছর আর লেখক হুমায়ূন বাংলাদেশ রাষ্ট্রেরই সমবয়সী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
মহসিন হলে যাত্রা শুরু হয়েছিল বাংলা সাহিত্যের এক নতুন অধ্যায়ের। নন্দিত
নরকের লেখক এরপর এগিয়ে যান ক্রমান্বয়ে। পাঠকপ্রিয়তায় একে একে পিছনে ফেলেন
সব রথী-মহারথীকে। তিনি যেন রূপকথার সে রাজপুত্র- যখন যেখানে হাত দিয়েছেন
সেখানেই সোনা ফলেছে। ৩২৩টির বেশি গ্রন্থে হুমায়ূন বয়ান করেছেন মধ্যবিত্ত
বাঙালি সুখ-দুঃখ, হাসি আর আনন্দ-বেদনার কাহিনী। বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্তের
কাহিনী, কখনও কখনও গ্রামের গল্প আর মুক্তিযুদ্ধ বারবার ফিরে এসেছে তার
লেখায়। মনেপ্রাণে অসাম্প্রদায়িক হুমায়ূনের লেখায়ও ধর্মও উপেক্ষিত ছিল না।
পবিত্র ধর্মগ্রন্থের বহু বাণি খুঁজে পাওয়া যাবে তার লেখায়। শহীদ
মুক্তিযোদ্ধা পিতার সন্তান জোছনা আর জননীর গল্প লিখে শোধ করেছেন মাতৃভূমির
ঋণ। মৃত্যুরও বহু আগে একবার গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে বারবার তার একটি কথাই
মনে হয় সুযোগ পেলে জন্মভূমির ঋণ শোধের বয়ান লিখবেন তিনি। বাদশা নামদার,
মাতাল হাওয়া আর দেয়ালে বাঙালির ভুলে যাওয়া ইতিহাস তিনি সামনে নিয়ে আসেন।
নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদ জনপ্রিয়তায় ছাড়িয়ে যান কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন
আহমেদকেও। বাকের ভাইয়ের স্রষ্টা চীরদিনই বেঁচে থাকবেন। নাটকের একটি
চরিত্রকে বাঁচানোর জন্য রাজপথে মিছিল বের করেছেন মানুষ- সে বিস্ময়কর দৃশ্য
কে-ই বা ভুলতে পারবেন। সিনেমা নির্মাণে হাত দিয়েও সফলতার দেখা পান হুমায়ূন।
বাঙালি মধ্যবিত্তকে আবার সিনেমা হলে ফিরিয়ে আনেন তিনি। ব্যক্তি হুমায়ূন
আহমেদকে নিয়ে বিতর্কও ছিল। বিশেষ করে গুলতেকিনের সঙ্গে বিচ্ছেদ আর শাওনের
সঙ্গে বিয়ে নিয়ে যথেষ্ট সমালোচনা হয় তার। মহত্ত্ব সম্পর্কে উইলিয়াম
শেকসপিয়ারের বিখ্যাত উক্তি- কেউ মহান হয়ে জন্ম নেয়, কেউ মহত্ত্ব অর্জন করে
আর কারও ওপর মহত্ত্ব আরোপ করা হয়। হুমায়ূন আহমেদ কি মহান লেখক ছিলেন? না কি
তিনি শুধুই জনপ্রিয় লেখক। এ নিয়ে হয়তো বিতর্ক চলতেই থাকবে। হুমায়ূনের
জীবদ্দশাতেও অবশ্য এ প্রশ্ন ছিল। অনেক প-িতরাই রায় দিয়েছিলেন- হুমায়ূন
আহমেদের লেখা টিকবে না। যদিও জীবদ্দশাতে লেখা টিকে থাকাতেই সন্তুষ্ট ছিলেন
হুমায়ূন। পরম করুণাময়ের কাছে এর বেশি কিছু চাননি তিনি। লেখক হিসেবে নিজের
সৃষ্টি সম্পর্কে হুমায়ূন আহমেদ কৌতুক করে লিখেছেন, ‘এডগার এলেন পো কে
জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, একজন বড় লেখক হতে হলে কী লাগে? তিনি জবাব দিলেন, একটা
বড় ডাস্টবিন লাগে। লেখা নামক যেসব আবর্জনা তৈরি হবে তা ফেলে দেয়ার জন্য।
লেখকরা ক্রমাগত আবর্জনা তৈরি করেন। নিজেরা তা বুঝতে পারেন না। একজীবনে আমি
কি পরিমাণ আবর্জনা তৈরি করেছি ভেবেই শঙ্কিত বোধ করছি।’ একথা সত্য মহাকালের
উঁইপোকা এরই মধ্যে হুমায়ূন আহমেদের লেখায় দাঁত বসাতে শুরু করেছে। কিন্তু এ
সত্য অস্বীকার করার জো নেই, হুমায়ূনের বহু লেখারই কাল উত্তীর্ণ হওয়ার
সম্ভাবনা রয়েছে। মহাত্মা জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের মতো মানুষও হুমায়ূন
আহমেদের লেখায় মুগ্ধ ছিলেন। চন্দ্র কারিগরের কাছে কেমন আছেন হুমায়ূন
আহমেদ। তিনি কি সত্যি হারিয়ে গেছেন। না মিসির আলী, হিমু, রূপা, শুভ্রের
বেশে জোছনা রাতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তার প্রিয় বাংলাদেশে। ভক্তরা গভীর জোছনা
অথবা তীব্র রোদে খুঁজে বেড়ায় তাদের প্রিয় মানুষটিকে। নয়ন তোমারে পায় না
দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে। প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ যেখানেই থাকুন ভাল থাকুন।
>>গাজীপুরের
নুহাশপল্লীতে নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের দ্বিতীয়
মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় দুই ছেলে নিষাদ ও
নিনিত। ছবি: মাসুদ রানা, প্রথম আলো, গাজীপুর
No comments