আমরা যাবো কোথায়? by শামীমুল হক
ঘরে থাকবো? চারদিকে বিল্ডিং বানানোর
যন্ত্রের শব্দ কান স্তব্ধ করে দিচ্ছে। যন্ত্রণায় দগ্ধ হচ্ছে মন। গড় গড়
শব্দে শুতে গেলে ঘুম আসে না। রোজার দিনে কি আর করা? বাইরে যাবেন? এ-ও কি
সম্ভব? যানজটে কেটে যাচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ৫ মিনিটের পথ যেতে লাগে এক
থেকে দেড় ঘণ্টা। ট্রাফিক পুলিশ কি আছে? নাহ! আছে। তবে তারাও যানজটে কাহিল।
হাত আর নড়ছে না। মুখের বাঁশি আর বাজছে না। বেচারা ট্রাফিক পুলিশ অগত্যা
দেখেও না দেখার ভান করে রাস্তার পাশে গিয়ে আশ্রয় নেয়। মানুষ রাগে ক্ষোভে
ট্রাফিক বেটার চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করছে। ট্রাফিক পুলিশেরই বা দোষ কোথায়?
আমরাই-বা কতটুকু সুশৃঙ্খল? উল্টোপথে গাড়ি চলাচল বন্ধ করতে ভিআইপি রোডে
বসানো হয়েছিল গাড়ির চাকা ফুটো হয়ে যাওয়ার যন্ত্র। এক সপ্তাহও কাটেনি।
যন্ত্র উধাও। আমরা চলছি উল্টো পথে। সোজা পথে তো আর চলা যাচ্ছে না। তাহলে
কোথায় আছে শৃঙ্খলা? হাসপাতালে যাবেন? সেখানেও একই অবস্থা। বেডে জায়গা হয়নি
তো ফ্লোরে, ফ্লোরে জায়গা হয়নি তো কি হয়েছে। বারান্দা তো আছে। সেখানেও জায়গা
নেই। তাহলে? কিচ্ছু করার নেই- মানুষ চলাচলের পথে বিছানা ফেলে শুইয়ে দেন
রোগীকে। ডাক্তার আসুক আর না আসুক ঠাঁই হয়ে গেল। সুখের আশায় নদীর তীরে গিয়ে
একটু ঘুরে এলে কেমন হয়? দখিনা বাতাসে মনকে রাঙিয়ে আসা যাবে। কিন্তু সেখানে
একি দেখছি। তীরে দাঁড়াতেই পানির পচা গন্ধ। পানির রঙ বদলে কালচে হয়ে গেছে।
কল-কারখানার দূষিত বর্জ্য আর রাজধানীর সুয়ারেজ লাইন গিয়ে মিশেছে বুুড়িগঙ্গা
নদীতে। তাই বুড়িগঙ্গার পানি এখন আর পানি নেই। ওই পানি এখন বিষ। তাহলে কি
করা? রাজধানীর পাশের এক কালে যে নদীর পানি পান করে মানুষ তৃপ্ত হতো,
দেশ-বিদেশে যে নদীর পানি সুখ্যাতি পেয়েছিল, শীতল পানি আর শান্ত লক্ষ্মী বলে
যে নদীর নাম দেয়া হয়েছিল শীতলক্ষ্যা- সেই নদীর তীরে যাবেন? সেখানে গিয়েও
দুঃখ পাবেন। কারণ শীতলক্ষ্যা এখন আর শীতলক্ষ্যা নেই। শীতলক্ষ্যার পানি এখন
খাওয়া তো দূরের কথা ছুঁলেই হাত জ্বালাপোড়া করে। লাশের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে
শীতলক্ষ্যা। প্রতিদিনই নদীতে ভেসে উঠছে লাশ। সর্বশেষ দেশব্যাপী আলোচিত
নারায়ণগঞ্জের ৭ হত্যাকাণ্ড শীতলক্ষ্যাই তুলে আনে সবার সামনে। ঘাতকরা
লাশগুলো ইট বেঁধে ডুবিয়ে দিয়েছিল পানিতে। কিন্তু শীতলক্ষ্যা নারায়ণগঞ্জের
সঙ্গে বেইমানি করেনি। লাশ তার পেটে রাখেনি। ভাসিয়ে দিয়েছে। মানুষ হতবাক
হয়েছে নির্মমতা দেখে। তাহলে দেশের কোথাও কি শান্তির জায়গা নেই? কেন!
কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকত ঘুরে আসতে পারেন যে কেউ। না সেখানেও ঘাতক হাঁ করে
বসে আছে। ক’দিন পর পরই সাগর ভাসিয়ে নিচ্ছে অনেক স্বপ্নকে। শুধুমাত্র চরম
উদাসীনতায় একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে। তারপরও কর্তৃপক্ষ কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে
না। বিপজ্জনক স্থান চিহ্নিত করে সেখানে না যাওয়ার কোন নোটিশও দিচ্ছে না।
কাজেই সাগরও ভয়ানক। যে কোন সময় হতে পারে মৃত্যুগহ্বর। তাহলে? নিরাপদ কোথায়?
মায়ের কোল? না সেখানেও আজকাল নিরাপদ নয় শিশু। সন্ত্রাসী, ঘাতক চক্র,
হাসপাতালের দালাল চক্রও রক্তচক্ষু দিয়ে তাকিয়ে আছে। মা-ও তার সন্তানকে
রক্ষা করতে পারছে না। কান্নাই হয় মায়ের সম্বল। মানুষ জন্মের সময়ই মৃত্যুকে
সঙ্গী করে নিয়ে আসে। কিন্তু অকাল মৃত্যু, ঘাতকের হাতে মৃত্যু, নৃশংস ও
নির্মম মৃত্যু কোন মানুষই কামনা করে না। তবে কেন সমাজে এসব ঘটনা ঘটছে?
নিরাপত্তা দেয়া যাদের দায়িত্ব সেই থানা পুলিশও এখন আরেক আজরাইল হয়ে দেখা
দেয় কারও কারও জীবনে। কথায় বলে বাঘে ছুঁলে এক ঘা, পুলিশে ছুঁলে আঠার ঘা।
তবে দুয়েকজন ভাল পুলিশ যে নেই তা নয়। তাদের কারণেই হয়তো এখনও পুলিশ বিভাগের
প্রতি কারও কারও আস্থা রয়েছে। তবে বেশির ভাগ মানুষের পুলিশ নিয়ে অভিজ্ঞতা
বড় নির্মম। ধর্ষক পুলিশ, খুনি পুলিশ, ডাকাত পুলিশ, চোর পুলিশ, ছিনতাইকারী
পুলিশও দেখেছি আমরা। আর বারবার পুলিশ বিভাগ লজ্জিত হয়েছে। তারপরও পুলিশ
বিভাগ কি পেরেছে তাদের মাঝে শুদ্ধতা ফিরিয়ে আনতে? রমজান মাসে এই যে এত
বাহারি খাবার খাচ্ছে রোজাদাররা- এর কয়টি বিশুদ্ধ খাবার? এমনিতেই সব ফলমূলে
দেয়া হচ্ছে ফরমালিন। মাছ খাবেন সেখানেও একই অবস্থা। ফরমালিনযুক্ত খাবার
খেতে খেতে মানুষের গোটা শরীরই ফরমালিন হয়ে গেছে। বাজেট অধিবেশনে দাঁড়িয়ে
বিরোধীনেত্রী বেগম রওশন এরশাদ বলেছেন, যে পানি আমরা খাচ্ছি সেখানেও ভেজাল।
এই ভেজাল খাবার খেতে খেতে এমন হবে যে এক সময় লাশও পচবে না। কারণ মানুষের
গোটা শরীরই হয়ে গেছে ফরমালিনে আক্রান্ত। যেমন অতিরিক্ত নেশাখোরদের নাকি
সাপে কামরালেও বিষ ধরে না। কারণ তাদের গোটা শরীর নেশার বিষে বিষাক্ত হয়ে
পড়ে। যে বিষ সাপের বিষের চেয়েও ভয়ঙ্কর। তাহলে দাঁড়ালো কি? কোথাও শান্তি
নেই। কি ঘরে, কি বাইরে। খাবারেও বিষ। আসলে মানুষ গোটা দেশটাকেই বসবাসের
অযোগ্য করে তুলেছে। কৃষক এখন আর প্রাকৃতিক সার ব্যবহার করে না। গোবর, ছাই
বাদ দিয়ে অতিরিক্ত সার ও পোকা মারার বিষ ব্যবহার করছে। এক সময় ভাবা হতো,
গ্রামে উৎপাদিত শাক-সবজি, ফলমূল, মাছ বিষমুক্ত। হাল আমলে তা-ও মিথ্যা
প্রমাণিত হয়েছে। এ অবস্থা হলে আমরা যাবো কোথায়? এখন আন্দোলনে নামা প্রয়োজন
বিষমুক্ত সমাজ গঠনে। এ আন্দোলনে নিজের প্রয়োজনেই শরিক হবেন সবাই।
No comments