৬৫০ কোটি টাকার চাঁদাবাজি
ঈদকে কেন্দ্র করে রাজধানীর ফুটপাতগুলোতে চলছে জমজমাট চাঁদাবাজি। লাইনম্যানদের মাধ্যমে তোলা এই চাঁদা যাচ্ছে স্থানীয় সরকারদলীয় নেতা ও পুলিশের পকেটে। রাজধানী জুড়ে ফুটপাতে চাঁদাবাজি করে এমন অন্তত ৬০টি গ্রুপ রয়েছে। হকার সমিতির তথ্য অনুযায়ী ফুটপাতগুলোতে আড়াই লাখের মতো হকার রয়েছে। এরা সারা বছরই ব্যবসা করে থাকে। কিন্তু ঈদের আগে আরও অন্তত ৫০ হাজার হকার নতুন করে যুক্ত হয়। ঈদের সময় এই তিন লাখ হকারের কাছে প্রায় ৬৫০ কোটি টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। সূত্র জানায়, রাজধানীর ফুটপাতে বছর জুড়েই চাঁদাবাজি হয়। তবে ঈদকে সামনে রেখে এই চাঁদাবাজি বেড়ে যায়। রমজানের শুরুতে প্রত্যেক হকারের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা করে ‘ঈদের বকশিশ’ নেয়া হয়। এই হিসেবে প্রায় আড়াই লাখ হকারের কাছ থেকে ঈদের সময়েই আদায় করা হয় ২৫০ কোটি টাকা। এছাড়া নতুন করে যে ৫০ হাজার নতুন হকার যুক্ত হয়, তাদের প্রত্যেকের কাছে ‘পজিশন’ বিক্রি করা হয় ৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকায়। প্রতিটি ‘পজিশন’ ৩০ হাজার টাকা করে হিসাব করলেও এ থেকে আদায় করা হয় প্রায় ১৫০ কোটি টাকা। এছাড়া প্রতি হকারের কাছে দৈনিক কমপক্ষে ৩ শ’ টাকা করে আদায় করা হয়। এই হিসাবে তিন লাখ হকারের কাছে দৈনিক আদায় করা হয় ৯ কোটি টাকা। পুরো রমজান মাসে এর পরিমাণ ২৭০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ঈদকে কেন্দ্র করে রাজধানীর বিভিন্ন ফুটপাতের হকারদের কাছ থেকে প্রায় ৬৫০ কোটি টাকারও বেশি চাঁদা আদায় করা হয়। বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশনের সভাপতি আবুল কাশেম জানান, সর্ষের মধ্যেই যদি ভূত থাকে তাহলে ভূত তাড়ানো যায় না। ফুটপাতে চাঁদাবাজি নিয়ে বহুবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে। কিন্তু কোন কাজ হয়নি। উল্টো চাঁদা না দিলে লাইনম্যানরা পুলিশ ও সন্ত্রাসী দিয়ে হকার উচ্ছেদ বা মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। তিনি বলেন, ফুটপাতের মালিক ঢাকা সিটি কর্পোরেশন। সিটি কর্পোরেশন চাইলে প্রকৃত হকারদের কাছে ফুটপাত ইজারা দিতে পারে। তাহলে সরকারের রাজস্ব ব্যয় বাড়বে। হকাররাও শান্তিপূর্ণভাবে ব্যবসা করতে পারবেন।
ঢাকার ফুটপাতগুলো সরকারদলীয় স্থানীয় নেতাকর্মী ও ক্যাডাররা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। স্থানীয় নেতাকর্মীরা নিজেরা আলোচনার মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকা দখল বা ভাগবাটোয়ারা করে নেয়। এসব নেতাকর্মীর সঙ্গে স্থানীয় থানা পুলিশের যোগসাজশ থাকে। রাজধানীতে এমন অন্তত ৬০টি গ্রুপ রয়েছে যারা বিভিন্ন এলাকার ফুটপাত নিয়ন্ত্রণ করে। এদের বেশির ভাগই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী। এদের মধ্যে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ফুটপাত দখলে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে। সূত্র জানায়, প্রতিটি এলাকায় ফুটপাতকেন্দ্রিক লাইনম্যান নিয়োগ করা হয়। তাদের কাজ হকারদের কাছ থেকে চাঁদার টাকা আদায় করা। বিশেষ করে রাত ৯টার পরে লাইনম্যানরা হকারের কাছে ঘুরে ঘুরে চাঁদার টাকা আদায় করে। এই টাকা স্থানীয় নেতার কাছে চলে যায়। তাকে ক্যাশিয়ার হিসেবে সম্বোধন করা হয়। সেখান থেকে টাকার ভাগবাটোয়ারা হয়ে শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে সবার কাছেই যায়। নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারার আগেই আদায়কৃত চাঁদার একটি অংশ যায় সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের কাছে। প্রত্যেক থানায় দায়িত্বরত একজন উপপরিদর্শক সংশ্লিষ্ট থানার অফিসার ইনচার্জের হয়ে এই টাকা গ্রহণ করেন। তবে রাজধানীর মিরপুর, নিউ মার্কেট, ফার্মগেট, গুলিস্তান ও মতিঝিল এলাকার একাধিক হকার জানিয়েছেন, স্থানীয় রাজনৈতিক ক্যাডারদের পাশাপাশি পুলিশের লাইনম্যানকেও তাদের চাঁদা দিতে হয়। চাঁদা না দিলে তাদের দোকান তুলে দেয়া ও থানায় ধরে নিয়ে যাওয়াসহ নানারকম হয়রানি করা হয়। থানা পুলিশের লাইনম্যান ছাড়াও টহল পুলিশও চাঁদা আদায় করে। স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে এখন দ্বিগুণ অর্থ আদায় করা হয়।
রাজধানীর নিউ মার্কেট এলাকার ফুটপাতের বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করেন থানা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক আলী হোসেন। তার সঙ্গে লাইনম্যান হিসেবে কাজ করে সাত্তার, শামীম, আবদুল ওহাব ও রফিক। ঢাকা কলেজের বিপরীতে লাইনম্যান হিসেবে কাজ করে সাইফুল মোল্লা। গুলিস্তান সুন্দরবন মার্কেটের আশপাশের এলাকার লাইনম্যান জজমিয়া, বায়তুল মোকাররম এলাকায় টোকন, কাদের, সাজু, নূরু, সালাম, দুলাল ও বাবুল (১) ও (২), হাছান, কালা নবী ও সুলতান চাঁদা তোলে। ফার্মগেট এলাকার লাইনম্যান দুলাল ও শাহ আলম। মিরপুর মাজার রোড এলাকার ফুটপাত নিয়ন্ত্রণ করেন ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের প্রচার সম্পাদক মিরন। তার হয়ে লাইনম্যান হিসেবে কাজ করে জুয়েল ও বাবুল। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতার প্রশ্রয়ে মিরন ফুটপাতে বেপরোয়া চাঁদাবাজি করছে। শীর্ষ ওই নেতার কারণে মিরনের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলতে সাহস পায় না। বিমানবন্দর এলাকার লাইনম্যান মোহাম্মদ আলী ও ইব্রাহীম। মতিঝিলের লাইনম্যান নূরুল ইসলাম, আজাদ ও পবন। যাত্রাবাড়ী এলাকায় সোনা মিয়া, আবুল কালাম ও তোরাব আলী; জুরাইন এলাকায় সিরাজ তালুকদার, মদারু নূরুল ও তার ছেলে বাবু; সদরঘাট এলাকায় কালু মিয়া ও আলম লাইনম্যান হিসেবে কাজ করে।
ফুটপাত থেকে চাঁদা আদায়ের বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান বলেন, ফুটপাতে চাঁদাবাজি নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কেউ অভিযোগ করে না। অভিযোগ পেলে সবসময় আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়। চাঁদাবাজিতে পুলিশ সদস্যদের সম্পৃক্ততা পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়। এক্ষেত্রে ছাড় দেয়ার কোন সুযোগ নেই। তিনি বলেন, আমরা সবসময় ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদ করতে চাই। কিন্তু মানবিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে অনেক সময় তা হয়ে ওঠে না।
স্পট নিউ মার্কেট: ঢাকা কলেজের সামনের ৬ নম্বর মিরপুর রোডের নূরজাহান সুপার মার্কেটের ফুটপাতের কাপড় ব্যবসায়ী শরীফ উদ্দীন জানান, ‘এখানে দীর্ঘ ৯ বছর ধরে ব্যবসা করে আসছি। এমন কোন দিন নেই যে চাঁদা নেয়া হয়নি। ঝড়-বৃষ্টি যা-ই হোক না কেন শামীম নামে একজন লাইনম্যান প্রতিদিন এসে চাঁদা নিয়ে যায়। আগে ১৫০ টাকা দিতে হতো। ঈদ উপলক্ষে দ্বিগুণ নিচ্ছে। নিউ মার্কেটের রাফিন প্লাজার সামনের ফুটপাতের হকার আজহার উদ্দীন জানান, ‘ঈদ উপলক্ষে ডাবল চাঁদা দিতে হচ্ছে। তার কাছ থেকেও শামীম টাকা নিয়ে যায়।’ পাশের জুতার হকার মোস্তাফিজুর রহমান রিপন বলেন, ‘চাঁদা দিতে অস্বীকার করায় এক কাপড় ব্যবসায়ীকে তুলে দিয়েছিল শামীম। ওই ব্যবসায়ী পাশের থানায় এ বিষয়ে অভিযোগ করেছিলেন। কিন্তু, কোন লাভ হয়নি। এজন্য লাইনম্যান এলেই আমরা টাকা দিয়ে দিই।’ বলাকা ভবনের ৭ নম্বর দোকানের সামনের ফুটপাতে শিশুদের পোশাক বিক্রেতা আবদুল আজিজ জানান, ‘এখানকার লাইনম্যান শামীমের সঙ্গে নিউ মার্কেট থানার অপারেশন অফিসার মাজহারুল আনোয়ারের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক। তাদেরকে প্রায় একসঙ্গে ঘুরতে দেখা যায়। পুলিশের সঙ্গে লাইনম্যানদের সখ্য থাকে। কারণ চাঁদার একটি অংশ পুলিশ পায়। লাইনম্যান হিসেবে চাঁদা নেয়া শামীম নিউ মার্কেট থানাধীন ৫২ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সমাজসেবা বিষয়ক সম্পাদক। ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের কর্মী। ওই চাঁদার টাকা পুলিশের পাশাপাশি ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি-সম্পাদকসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছেও যায়। সাইন্স ল্যাবরেটরির ৪৯ নম্বর বাইতুল মামুর মসজিদ মার্কেটের সামনের ফুটপাতের খুচরা শার্ট ব্যবসায়ী মিনহাজুল ইসলাম জানান, এখানে ব্যবসা করবেন তো টাকা দেয়া লাগবেই। কোন বিকল্প নেই। টাকা দিবেন তো ব্যবসা করবেন। টাকা না দিলে ব্যবসা বন্ধ। ঈদ উপলক্ষে চাঁদার পরিমাণ দ্বিগুণ হয়েছে। আগে ১৫০ টাকা নিতো। এখন প্রতিদিন ৩০০ টাকা চাঁদা দেয়া লাগে। আবদুল ওহাব নামে এক লাইনম্যান এসে টাকা নিয়ে যায়। আবদুল ওহাবের ব্যাপারে অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকা কলেজে ইলিয়াস ছাত্রাবাসের তৃতীয় তলার বি ব্লকের ৩০৭ নম্বর রুমে তার একটি সিট রয়েছে। কিন্তু সে সেখানে থাকে না। লালবাগের ঢাকেশ্বরী মন্দিরের পাশের একটি মেসে থাকে। আবদুল ওহাব ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি ইকবাল গ্রুপের কর্মী।
স্পট ফার্মগেট: রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা ফার্মগেট যেমন ফুটপাত কেন্দ্রিক ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র। তেমনি জমজমাট চাঁদাবাজিও চলে এখানে। ঈদ উপলক্ষে ফার্মগেটের ফুটপাতের পশ্চিম ও দক্ষিণ দুই প্রান্তে প্রতিদিন প্রায় হাজার খানেক ছোট বড় দোকান বসে। সরজমিন ফার্মগেট এলাকা ঘুরে ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রমজান শুরুর পর থেকেই ফার্মগেটের ফুটপাতের দোকানগুলো থেকে প্রতিদিন প্রায় ২ লাখ টাকা চাঁদা তোলা হয়। এর একটা অংশ যাচ্ছে তেজগাঁও ও শেরেবাংলানগর থানায়। একটি অংশ স্থানীয় সরকারি দলের নেতাকর্মী ও রাজনৈতিক ক্যাডারদের হাতে, এক ভাগ যায় স্থানীয় পুলিশবক্সে কর্তব্যরতদের পকেটে। ফার্মগেটে তিন-চার হাত দৈর্ঘ্য-প্রস্থের ফুটপাত এককালীন বিক্রি হয়েছে ৫০ হাজার থেকে লাখ টাকায়। ঈদ উপলক্ষে মওসুমি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তিন-সাড়ে তিন বা চার হাত দৈর্ঘ্য প্রস্থের পজিশন বাবদ নেয়া হয়েছে ক্ষেত্রবিশেষে ১০-২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। এছাড়া প্রতিদিন দুই থেকে ৩০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। ইন্দিরা রোড এলাকার একজন জুতা ব্যবসায়ী জানান, সন্ধ্যার পরে সোহেল নামে একজন লাইনম্যান এসে ২০০ টাকা নিয়ে যায়। আরেক পাঞ্জাবি বিক্রেতা মেহেদী হাসান বলেন, ৩০০ টাকা লাইনম্যানকে দিতে হয়। ঈদ উপলক্ষে রেট বেড়েছে। এছাড়া অন্যান্য যন্ত্রণা তো আছেই। ইন্দিরা রোড এলাকার কয়েকজন ক্ষুদে ব্যবসায়ী জানান, ৬ মাস আগে তারা প্রত্যেকেই ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা লাইনম্যানকে দিয়ে দোকানের পজিশন নিয়েছেন। প্রতিদিন তাদের ভাড়া হিসেবে দিতে হয় ৩০০ টাকা। ঈদের ব্যবসা জমজমাট- এই কথা বলে ঈদ উপলক্ষে বাড়তি টাকা দেয়ার জন্য তলব করা হয়েছে। ফার্মগেট এলাকার কয়েকজন ক্ষুদে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের ঢাকা মহানগর উত্তরের সাধারণ সম্পাদক ফরিদুর রহমান খান ইরান। এই চাঁদার ভাগ শীর্ষস্থানীয় এক প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধি পর্যন্ত পৌঁছে। এছাড়া ইরানের সঙ্গে বিভিন্নভাবে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ জড়িত। ইরানের লোক হিসেবে পরিচিত শ্রমিক লীগ নেতা চুন্নু ও আনোয়ার লাইনম্যান হিসেবে চাঁদা আদায় করেন। ব্যবসা না হলেও চাঁদার টাকা ঠিকই দিতে হয়। এক্ষেত্রে সময়ক্ষেপন করলে দোকানের মালামাল রাস্তায় ফেলে দেয়াসহ গালিগালাজ শুনতে হয়। ফার্মগেট দক্ষিণপাশের আল-রাজী হাসপাতাল সংলগ্ন এলাকায় ফুটপাতের দোকান থেকে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের এক নেতা ও সাবেক এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর ভাই চাঁদা আদায় করেন। লাইনম্যান হিসেবে কাজ করেন ছাত্রলীগের স্থানীয় নেতা রিপনসহ কয়েক জন।
স্পট গুলিস্তান: রাজধানীর ব্যস্ততম গুলিস্তান এলাকার ফুটপাত ঘিরে গড়ে উঠেছে কয়েক হাজার ছোট-বড় দোকানপাট। প্রতিদিন কয়েক লাখ টাকা চাঁদা ওঠানো হয় এই অঞ্চলের ফুটপাত থেকে। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, চঁাঁদা না দিলে ওই এলাকায় ব্যবসা করার সুযোগ নেই। প্রতিদিন রাতে দোকান বন্ধ হওয়ার আগেই লাইনম্যান এসে হাজির হয়ে যায়। বেচাকেনা হোক না হোক তার হাতে টাকা তুলে দিতে হবেই। এই এলাকায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় অবস্থিত হওয়ার কারণে নামে-বেনামে চলে চাঁদাবাজি। সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের আনাগোনা বেশি থাকার কারণে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পান না। এছাড়া দৈনন্দিন চাঁদার টাকার বড় একটি অংশ পুলিশের পকেটে চলে যায়। সচিবালয়ের সামনে থেকে জিপিও হয়ে স্টেডিয়াম মার্কেট পর্যন্ত ফুটপাতের টাকা তোলে কালাম নামে এক ব্যক্তি। সবাই তাকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা বলে জানেন। সাধারণ সময়ে ১০০-১৫০ টাকা দিতে হতো। ঈদ উপলক্ষে ২০০-৩০০ টাকা দিতে হচ্ছে প্রতিদিন। ব্যবসায়ীরা জানান, কালাম মূলত লাইনম্যান। এই অঞ্চলে শুধু তাকে টাকা দিলেই চলে। এই টাকার একটা অংশ যায় পুলিশের পকেটে। আর বাকী টাকা আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতাদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা হয়। স্টেডিয়াম মার্কেটের সামনে দিয়ে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ হয়ে গুলিস্তান মোড় পর্যন্ত ফুটপাতের নিয়ন্ত্রণ করেন আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা। এই এলাকার ফুটপাতে রয়েছে মোবাইল ও ইলেক্ট্রিক সামগ্রির পার্টসের দোকান। দৈনিক বাংলা মোড় থেকে বায়তুল মোকাররম উত্তর গেট হয়ে পল্টন মোড় পর্যন্ত এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেন ৩৬নং ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি দুলাল। তার লাইনম্যান হিসেবে কাজ করেন ওই ওয়ার্ড ও সংশ্লিষ্ট ইউনিটের নেতা মন্টু, সাজু ও জসিম। তারা সবাই যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের কাছের লোক হিসেবে পরিচিত। বায়তুল মোকাররম মার্কেটের পশ্চিম পাশের গলি নিয়ন্ত্রণ করেন মিজান ও জাহাঙ্গীর। তারা সবাই স্থানীয় যুবলীগের সদস্য। অপরদিকে গুলিস্তানের মোড় থেকে সার্জেন্ট আহাদ পুলিশ বক্স পর্যন্ত ফুটপাতের চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করেন স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতা সালাম। তার রয়েছে একাধিক লাইনম্যান। গুলিস্তান থেকে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ হয়ে গোলাপ শাহের মাজারের ফুটপাত নিয়ন্ত্রণ করেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা হারুন ও বাবু। স্টেডিয়াম মার্কেটের সামনের ফুটপাতের মোবাইল ফোনের পার্টস ব্যবসায়ী নাজমুল জানান, মাসে গড়ে তাকে ৪-৫ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। দৈনিক বিদ্যুৎ বিল বাবদ ৪০ টাকা দিতে হয়। যদিও তিনি মাত্র তিন ঘণ্টা বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন। অনেক সময় একাধিক লাইনম্যানও টাকা তোলে।
স্পট মতিঝিল: ঈদকে সামনে রেখে ব্যাংক পাড়া মতিঝিল এলাকায় ফুটপাত থেকে চাঁদা আদায় করছেন স্থানীয় যুবলীগীগ নেতা চাঁদাবাজ নুরুল ইসলাম। মতিঝিল এলাকার ফুটপাত থেকে গড়ে প্রতিদিন তিন লক্ষাধিক টাকা চাঁদা করা হয়। ঈদের আগে চাঁদার হার দ্বিগুণ হয়েছে। ঈদের আগের দিন রাত পর্যন্ত এ হারে চাঁদা আদায় করা হবে। ব্যাংক পাড়ার ফলের ব্যবসায়ী হাসান জানান, রঞ্জিত নামে এক লাইনম্যান তার কাছ থেকে প্রতিদিন চাঁদার টাকা নিয়ে যায়। এই চাঁদা স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও পুলিশের মধ্যে ভাগাভাগি হয়। সূত্র জানায়, মতিঝিলের ফুটপাতের দোকানের সংখ্যা প্রায় ৬০০০। প্রতিটি দোকান থেকে আগে দৈনিক এক থেকে ১৫০ টাকা করে টাকা তোলা হতো। এখন প্রতিদিন ৩০০ টাকা করে নেয়া হচ্ছে। এটা শুরু হয়েছে রোজার প্রথম দিন থেকে। মতিঝিল এলাকায় লাইনম্যান তাজুল ও তার ছেলে বাবুল, নুরুল ইসলাম, মকবুল, আজাদ, রহিম, সেলিম, বাতেন, বাদল ও হাসান চাঁদা আদায় করে। মতিঝিল সাধারণ বীমা ভবন, বাংলাদেশ ব্যাংক, শাপলা চত্বর, আলিকো বীমা ভবন, ইত্তেফাক মোড়, বক চত্বর, বায়তুল মোকারম পিছন গেট, রাজউক ভবন, ফকিরাপুল বাজার, কমলাপুর মোড়, আরামবাগের ফুটের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে থেকে চাঁদা আদায় করা হয়।
সুত্র জানায়, মতিঝিল এজিবি কলোনির সামনের ফুট থেকে পুলিশের চাঁদার টাকা আদায় করে লাইনম্যান সাইফুল মোল্লা। মতিঝিল এলাকায় ফুটের দোকান নিয়ন্ত্রণ করে পুলিশের পিআই আবুল বাশার ও স্থানীয় যুবলীগ নেতা সাইদ। যুবলীগ নেতার পক্ষে সাব-কনট্্রাক্টারের দায়িত্ব পালন করছে সাইদের সহযোগী মানিক। পুলিশের ছত্রছায়ায় লাইনম্যান ও মানিক গং চাঁদবাজি করে আসছে। লাইনম্যানকে ব্যবসায়ীরা চাঁদার টাকা দিতে না পারলে মানিক তার লোকজন দিয়ে তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে।
ঢাকার ফুটপাতগুলো সরকারদলীয় স্থানীয় নেতাকর্মী ও ক্যাডাররা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। স্থানীয় নেতাকর্মীরা নিজেরা আলোচনার মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকা দখল বা ভাগবাটোয়ারা করে নেয়। এসব নেতাকর্মীর সঙ্গে স্থানীয় থানা পুলিশের যোগসাজশ থাকে। রাজধানীতে এমন অন্তত ৬০টি গ্রুপ রয়েছে যারা বিভিন্ন এলাকার ফুটপাত নিয়ন্ত্রণ করে। এদের বেশির ভাগই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী। এদের মধ্যে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ফুটপাত দখলে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে। সূত্র জানায়, প্রতিটি এলাকায় ফুটপাতকেন্দ্রিক লাইনম্যান নিয়োগ করা হয়। তাদের কাজ হকারদের কাছ থেকে চাঁদার টাকা আদায় করা। বিশেষ করে রাত ৯টার পরে লাইনম্যানরা হকারের কাছে ঘুরে ঘুরে চাঁদার টাকা আদায় করে। এই টাকা স্থানীয় নেতার কাছে চলে যায়। তাকে ক্যাশিয়ার হিসেবে সম্বোধন করা হয়। সেখান থেকে টাকার ভাগবাটোয়ারা হয়ে শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে সবার কাছেই যায়। নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারার আগেই আদায়কৃত চাঁদার একটি অংশ যায় সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের কাছে। প্রত্যেক থানায় দায়িত্বরত একজন উপপরিদর্শক সংশ্লিষ্ট থানার অফিসার ইনচার্জের হয়ে এই টাকা গ্রহণ করেন। তবে রাজধানীর মিরপুর, নিউ মার্কেট, ফার্মগেট, গুলিস্তান ও মতিঝিল এলাকার একাধিক হকার জানিয়েছেন, স্থানীয় রাজনৈতিক ক্যাডারদের পাশাপাশি পুলিশের লাইনম্যানকেও তাদের চাঁদা দিতে হয়। চাঁদা না দিলে তাদের দোকান তুলে দেয়া ও থানায় ধরে নিয়ে যাওয়াসহ নানারকম হয়রানি করা হয়। থানা পুলিশের লাইনম্যান ছাড়াও টহল পুলিশও চাঁদা আদায় করে। স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে এখন দ্বিগুণ অর্থ আদায় করা হয়।
রাজধানীর নিউ মার্কেট এলাকার ফুটপাতের বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করেন থানা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক আলী হোসেন। তার সঙ্গে লাইনম্যান হিসেবে কাজ করে সাত্তার, শামীম, আবদুল ওহাব ও রফিক। ঢাকা কলেজের বিপরীতে লাইনম্যান হিসেবে কাজ করে সাইফুল মোল্লা। গুলিস্তান সুন্দরবন মার্কেটের আশপাশের এলাকার লাইনম্যান জজমিয়া, বায়তুল মোকাররম এলাকায় টোকন, কাদের, সাজু, নূরু, সালাম, দুলাল ও বাবুল (১) ও (২), হাছান, কালা নবী ও সুলতান চাঁদা তোলে। ফার্মগেট এলাকার লাইনম্যান দুলাল ও শাহ আলম। মিরপুর মাজার রোড এলাকার ফুটপাত নিয়ন্ত্রণ করেন ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের প্রচার সম্পাদক মিরন। তার হয়ে লাইনম্যান হিসেবে কাজ করে জুয়েল ও বাবুল। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতার প্রশ্রয়ে মিরন ফুটপাতে বেপরোয়া চাঁদাবাজি করছে। শীর্ষ ওই নেতার কারণে মিরনের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলতে সাহস পায় না। বিমানবন্দর এলাকার লাইনম্যান মোহাম্মদ আলী ও ইব্রাহীম। মতিঝিলের লাইনম্যান নূরুল ইসলাম, আজাদ ও পবন। যাত্রাবাড়ী এলাকায় সোনা মিয়া, আবুল কালাম ও তোরাব আলী; জুরাইন এলাকায় সিরাজ তালুকদার, মদারু নূরুল ও তার ছেলে বাবু; সদরঘাট এলাকায় কালু মিয়া ও আলম লাইনম্যান হিসেবে কাজ করে।
ফুটপাত থেকে চাঁদা আদায়ের বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান বলেন, ফুটপাতে চাঁদাবাজি নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কেউ অভিযোগ করে না। অভিযোগ পেলে সবসময় আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়। চাঁদাবাজিতে পুলিশ সদস্যদের সম্পৃক্ততা পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়। এক্ষেত্রে ছাড় দেয়ার কোন সুযোগ নেই। তিনি বলেন, আমরা সবসময় ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদ করতে চাই। কিন্তু মানবিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে অনেক সময় তা হয়ে ওঠে না।
স্পট নিউ মার্কেট: ঢাকা কলেজের সামনের ৬ নম্বর মিরপুর রোডের নূরজাহান সুপার মার্কেটের ফুটপাতের কাপড় ব্যবসায়ী শরীফ উদ্দীন জানান, ‘এখানে দীর্ঘ ৯ বছর ধরে ব্যবসা করে আসছি। এমন কোন দিন নেই যে চাঁদা নেয়া হয়নি। ঝড়-বৃষ্টি যা-ই হোক না কেন শামীম নামে একজন লাইনম্যান প্রতিদিন এসে চাঁদা নিয়ে যায়। আগে ১৫০ টাকা দিতে হতো। ঈদ উপলক্ষে দ্বিগুণ নিচ্ছে। নিউ মার্কেটের রাফিন প্লাজার সামনের ফুটপাতের হকার আজহার উদ্দীন জানান, ‘ঈদ উপলক্ষে ডাবল চাঁদা দিতে হচ্ছে। তার কাছ থেকেও শামীম টাকা নিয়ে যায়।’ পাশের জুতার হকার মোস্তাফিজুর রহমান রিপন বলেন, ‘চাঁদা দিতে অস্বীকার করায় এক কাপড় ব্যবসায়ীকে তুলে দিয়েছিল শামীম। ওই ব্যবসায়ী পাশের থানায় এ বিষয়ে অভিযোগ করেছিলেন। কিন্তু, কোন লাভ হয়নি। এজন্য লাইনম্যান এলেই আমরা টাকা দিয়ে দিই।’ বলাকা ভবনের ৭ নম্বর দোকানের সামনের ফুটপাতে শিশুদের পোশাক বিক্রেতা আবদুল আজিজ জানান, ‘এখানকার লাইনম্যান শামীমের সঙ্গে নিউ মার্কেট থানার অপারেশন অফিসার মাজহারুল আনোয়ারের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক। তাদেরকে প্রায় একসঙ্গে ঘুরতে দেখা যায়। পুলিশের সঙ্গে লাইনম্যানদের সখ্য থাকে। কারণ চাঁদার একটি অংশ পুলিশ পায়। লাইনম্যান হিসেবে চাঁদা নেয়া শামীম নিউ মার্কেট থানাধীন ৫২ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সমাজসেবা বিষয়ক সম্পাদক। ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের কর্মী। ওই চাঁদার টাকা পুলিশের পাশাপাশি ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি-সম্পাদকসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছেও যায়। সাইন্স ল্যাবরেটরির ৪৯ নম্বর বাইতুল মামুর মসজিদ মার্কেটের সামনের ফুটপাতের খুচরা শার্ট ব্যবসায়ী মিনহাজুল ইসলাম জানান, এখানে ব্যবসা করবেন তো টাকা দেয়া লাগবেই। কোন বিকল্প নেই। টাকা দিবেন তো ব্যবসা করবেন। টাকা না দিলে ব্যবসা বন্ধ। ঈদ উপলক্ষে চাঁদার পরিমাণ দ্বিগুণ হয়েছে। আগে ১৫০ টাকা নিতো। এখন প্রতিদিন ৩০০ টাকা চাঁদা দেয়া লাগে। আবদুল ওহাব নামে এক লাইনম্যান এসে টাকা নিয়ে যায়। আবদুল ওহাবের ব্যাপারে অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকা কলেজে ইলিয়াস ছাত্রাবাসের তৃতীয় তলার বি ব্লকের ৩০৭ নম্বর রুমে তার একটি সিট রয়েছে। কিন্তু সে সেখানে থাকে না। লালবাগের ঢাকেশ্বরী মন্দিরের পাশের একটি মেসে থাকে। আবদুল ওহাব ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি ইকবাল গ্রুপের কর্মী।
স্পট ফার্মগেট: রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা ফার্মগেট যেমন ফুটপাত কেন্দ্রিক ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র। তেমনি জমজমাট চাঁদাবাজিও চলে এখানে। ঈদ উপলক্ষে ফার্মগেটের ফুটপাতের পশ্চিম ও দক্ষিণ দুই প্রান্তে প্রতিদিন প্রায় হাজার খানেক ছোট বড় দোকান বসে। সরজমিন ফার্মগেট এলাকা ঘুরে ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রমজান শুরুর পর থেকেই ফার্মগেটের ফুটপাতের দোকানগুলো থেকে প্রতিদিন প্রায় ২ লাখ টাকা চাঁদা তোলা হয়। এর একটা অংশ যাচ্ছে তেজগাঁও ও শেরেবাংলানগর থানায়। একটি অংশ স্থানীয় সরকারি দলের নেতাকর্মী ও রাজনৈতিক ক্যাডারদের হাতে, এক ভাগ যায় স্থানীয় পুলিশবক্সে কর্তব্যরতদের পকেটে। ফার্মগেটে তিন-চার হাত দৈর্ঘ্য-প্রস্থের ফুটপাত এককালীন বিক্রি হয়েছে ৫০ হাজার থেকে লাখ টাকায়। ঈদ উপলক্ষে মওসুমি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তিন-সাড়ে তিন বা চার হাত দৈর্ঘ্য প্রস্থের পজিশন বাবদ নেয়া হয়েছে ক্ষেত্রবিশেষে ১০-২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। এছাড়া প্রতিদিন দুই থেকে ৩০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। ইন্দিরা রোড এলাকার একজন জুতা ব্যবসায়ী জানান, সন্ধ্যার পরে সোহেল নামে একজন লাইনম্যান এসে ২০০ টাকা নিয়ে যায়। আরেক পাঞ্জাবি বিক্রেতা মেহেদী হাসান বলেন, ৩০০ টাকা লাইনম্যানকে দিতে হয়। ঈদ উপলক্ষে রেট বেড়েছে। এছাড়া অন্যান্য যন্ত্রণা তো আছেই। ইন্দিরা রোড এলাকার কয়েকজন ক্ষুদে ব্যবসায়ী জানান, ৬ মাস আগে তারা প্রত্যেকেই ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা লাইনম্যানকে দিয়ে দোকানের পজিশন নিয়েছেন। প্রতিদিন তাদের ভাড়া হিসেবে দিতে হয় ৩০০ টাকা। ঈদের ব্যবসা জমজমাট- এই কথা বলে ঈদ উপলক্ষে বাড়তি টাকা দেয়ার জন্য তলব করা হয়েছে। ফার্মগেট এলাকার কয়েকজন ক্ষুদে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের ঢাকা মহানগর উত্তরের সাধারণ সম্পাদক ফরিদুর রহমান খান ইরান। এই চাঁদার ভাগ শীর্ষস্থানীয় এক প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধি পর্যন্ত পৌঁছে। এছাড়া ইরানের সঙ্গে বিভিন্নভাবে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ জড়িত। ইরানের লোক হিসেবে পরিচিত শ্রমিক লীগ নেতা চুন্নু ও আনোয়ার লাইনম্যান হিসেবে চাঁদা আদায় করেন। ব্যবসা না হলেও চাঁদার টাকা ঠিকই দিতে হয়। এক্ষেত্রে সময়ক্ষেপন করলে দোকানের মালামাল রাস্তায় ফেলে দেয়াসহ গালিগালাজ শুনতে হয়। ফার্মগেট দক্ষিণপাশের আল-রাজী হাসপাতাল সংলগ্ন এলাকায় ফুটপাতের দোকান থেকে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের এক নেতা ও সাবেক এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর ভাই চাঁদা আদায় করেন। লাইনম্যান হিসেবে কাজ করেন ছাত্রলীগের স্থানীয় নেতা রিপনসহ কয়েক জন।
স্পট গুলিস্তান: রাজধানীর ব্যস্ততম গুলিস্তান এলাকার ফুটপাত ঘিরে গড়ে উঠেছে কয়েক হাজার ছোট-বড় দোকানপাট। প্রতিদিন কয়েক লাখ টাকা চাঁদা ওঠানো হয় এই অঞ্চলের ফুটপাত থেকে। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, চঁাঁদা না দিলে ওই এলাকায় ব্যবসা করার সুযোগ নেই। প্রতিদিন রাতে দোকান বন্ধ হওয়ার আগেই লাইনম্যান এসে হাজির হয়ে যায়। বেচাকেনা হোক না হোক তার হাতে টাকা তুলে দিতে হবেই। এই এলাকায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় অবস্থিত হওয়ার কারণে নামে-বেনামে চলে চাঁদাবাজি। সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের আনাগোনা বেশি থাকার কারণে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পান না। এছাড়া দৈনন্দিন চাঁদার টাকার বড় একটি অংশ পুলিশের পকেটে চলে যায়। সচিবালয়ের সামনে থেকে জিপিও হয়ে স্টেডিয়াম মার্কেট পর্যন্ত ফুটপাতের টাকা তোলে কালাম নামে এক ব্যক্তি। সবাই তাকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা বলে জানেন। সাধারণ সময়ে ১০০-১৫০ টাকা দিতে হতো। ঈদ উপলক্ষে ২০০-৩০০ টাকা দিতে হচ্ছে প্রতিদিন। ব্যবসায়ীরা জানান, কালাম মূলত লাইনম্যান। এই অঞ্চলে শুধু তাকে টাকা দিলেই চলে। এই টাকার একটা অংশ যায় পুলিশের পকেটে। আর বাকী টাকা আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতাদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা হয়। স্টেডিয়াম মার্কেটের সামনে দিয়ে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ হয়ে গুলিস্তান মোড় পর্যন্ত ফুটপাতের নিয়ন্ত্রণ করেন আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা। এই এলাকার ফুটপাতে রয়েছে মোবাইল ও ইলেক্ট্রিক সামগ্রির পার্টসের দোকান। দৈনিক বাংলা মোড় থেকে বায়তুল মোকাররম উত্তর গেট হয়ে পল্টন মোড় পর্যন্ত এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেন ৩৬নং ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি দুলাল। তার লাইনম্যান হিসেবে কাজ করেন ওই ওয়ার্ড ও সংশ্লিষ্ট ইউনিটের নেতা মন্টু, সাজু ও জসিম। তারা সবাই যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের কাছের লোক হিসেবে পরিচিত। বায়তুল মোকাররম মার্কেটের পশ্চিম পাশের গলি নিয়ন্ত্রণ করেন মিজান ও জাহাঙ্গীর। তারা সবাই স্থানীয় যুবলীগের সদস্য। অপরদিকে গুলিস্তানের মোড় থেকে সার্জেন্ট আহাদ পুলিশ বক্স পর্যন্ত ফুটপাতের চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করেন স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতা সালাম। তার রয়েছে একাধিক লাইনম্যান। গুলিস্তান থেকে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ হয়ে গোলাপ শাহের মাজারের ফুটপাত নিয়ন্ত্রণ করেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা হারুন ও বাবু। স্টেডিয়াম মার্কেটের সামনের ফুটপাতের মোবাইল ফোনের পার্টস ব্যবসায়ী নাজমুল জানান, মাসে গড়ে তাকে ৪-৫ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। দৈনিক বিদ্যুৎ বিল বাবদ ৪০ টাকা দিতে হয়। যদিও তিনি মাত্র তিন ঘণ্টা বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন। অনেক সময় একাধিক লাইনম্যানও টাকা তোলে।
স্পট মতিঝিল: ঈদকে সামনে রেখে ব্যাংক পাড়া মতিঝিল এলাকায় ফুটপাত থেকে চাঁদা আদায় করছেন স্থানীয় যুবলীগীগ নেতা চাঁদাবাজ নুরুল ইসলাম। মতিঝিল এলাকার ফুটপাত থেকে গড়ে প্রতিদিন তিন লক্ষাধিক টাকা চাঁদা করা হয়। ঈদের আগে চাঁদার হার দ্বিগুণ হয়েছে। ঈদের আগের দিন রাত পর্যন্ত এ হারে চাঁদা আদায় করা হবে। ব্যাংক পাড়ার ফলের ব্যবসায়ী হাসান জানান, রঞ্জিত নামে এক লাইনম্যান তার কাছ থেকে প্রতিদিন চাঁদার টাকা নিয়ে যায়। এই চাঁদা স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও পুলিশের মধ্যে ভাগাভাগি হয়। সূত্র জানায়, মতিঝিলের ফুটপাতের দোকানের সংখ্যা প্রায় ৬০০০। প্রতিটি দোকান থেকে আগে দৈনিক এক থেকে ১৫০ টাকা করে টাকা তোলা হতো। এখন প্রতিদিন ৩০০ টাকা করে নেয়া হচ্ছে। এটা শুরু হয়েছে রোজার প্রথম দিন থেকে। মতিঝিল এলাকায় লাইনম্যান তাজুল ও তার ছেলে বাবুল, নুরুল ইসলাম, মকবুল, আজাদ, রহিম, সেলিম, বাতেন, বাদল ও হাসান চাঁদা আদায় করে। মতিঝিল সাধারণ বীমা ভবন, বাংলাদেশ ব্যাংক, শাপলা চত্বর, আলিকো বীমা ভবন, ইত্তেফাক মোড়, বক চত্বর, বায়তুল মোকারম পিছন গেট, রাজউক ভবন, ফকিরাপুল বাজার, কমলাপুর মোড়, আরামবাগের ফুটের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে থেকে চাঁদা আদায় করা হয়।
সুত্র জানায়, মতিঝিল এজিবি কলোনির সামনের ফুট থেকে পুলিশের চাঁদার টাকা আদায় করে লাইনম্যান সাইফুল মোল্লা। মতিঝিল এলাকায় ফুটের দোকান নিয়ন্ত্রণ করে পুলিশের পিআই আবুল বাশার ও স্থানীয় যুবলীগ নেতা সাইদ। যুবলীগ নেতার পক্ষে সাব-কনট্্রাক্টারের দায়িত্ব পালন করছে সাইদের সহযোগী মানিক। পুলিশের ছত্রছায়ায় লাইনম্যান ও মানিক গং চাঁদবাজি করে আসছে। লাইনম্যানকে ব্যবসায়ীরা চাঁদার টাকা দিতে না পারলে মানিক তার লোকজন দিয়ে তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে।
No comments