প্রবাসে বসে যাঁরা দেশ নিয়ে উদ্বিগ্ন by ফারুক মঈনউদ্দীন
এবারের শীতে বহু বছরের রেকর্ড ভেঙে
কানাডার টরন্টোসহ পশ্চিমা বিশ্বের আরও কয়েকটি দেশে বৃষ্টি, ঝড়, বরফ ও শীত
যে তাণ্ডব চালিয়েছে, তাতে সে কথা আবারও প্রমাণ করে যে প্রকৃতির শক্তির
কাছে মানুষ ও তার প্রযুক্তি নিতান্তই ঠুনকো।
গত শীতে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার দীর্ঘায়িত শীত ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের তাণ্ডবে সেখানকার প্রবাসী বাংলাদেশিদের অনভ্যস্ততার কষ্ট ছিল তুলনামূলকভাবে বেশি। বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে অনেক দেশে ঘটছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়। সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস যে বঙ্গোপসাগরের দুই ভুজের শীর্ষে থাকা বাংলাদেশকে প্রায়ই প্লাবিত করে, সেটা এই উপসাগরের আকৃতি ও তার একটি বিশেষ কোণে অবস্থানের কারণেই ঘটে, এটা অনেকের জানা নেই। কিন্তু সে রকম কোনো ভৌগোলিক অবস্থানে না থেকেও বিশ্বের কোথাও কোথাও ঘটছে এ রকম বিপর্যয়। টরন্টোর বন্যাপ্লাবিত রাস্তার সঙ্গে বৃষ্টির পর ঢাকার শািন্তনগরের রাস্তার দৃশ্যের সাযুজ্য খঁুজে পেয়ে কোনো কোনো বাংলাদেশি মজাও পেয়েছেন। এবারের তুষার-ঝড়ের পর সেখানে প্রায় টানা ৩৬ ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকার দুর্লভ অভিজ্ঞতাও অর্জন করেছেন অভিবাসী বাংলাদেশিরা। তবে এ কথা স্বীকার করেছেন সবাই যে যদি সে সময় গ্যাস-সংযোগ চালু না থাকত, তাহলে অনেক প্রাণহানি ঘটতে পারত কেবল ঠান্ডায়। কোনো দেশের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে কারও তৃপ্তি পাওয়া উচিত নয়, কিন্তু এ বিষয়ে বদনামটা বাংলাদেশের এত বেশি ছিল যে বাংলাদেশিদের কেউ কেউ নিজ দেশের গ্লানির বিপরীতে সেই তৃপ্তি প্রকাশ করতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি।
এক বছর আগে আমার টরন্টো পেঁৗছার ঠিক পরদিন ঘটে রানা প্লাজার মর্মন্তুদ ঘটনা। লো ব্লু সুপার স্টোরের জো ফ্রেশ ব্র্যান্ডের কাপড় তৈরি হচ্ছিল রানা প্লাজার কোনো এক প্রতিষ্ঠানে৷ সেই সুবাদে কানাডায় বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের স্বল্প মজুরি, কাজের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, অপর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা—এসব বিষয়ে সরব হয়ে উঠেছিল সে দেশের গণমাধ্যম এবং কোনো কোনো সংগঠন। রানা প্লাজা ধসের ঘটনাটি দেশের পোশাকশিল্পে যে ক্ষতের সৃষ্টি করেছে, তার রেশ আমাদের বহু দিন টানতে হবে।
গত শীতে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার দীর্ঘায়িত শীত ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের তাণ্ডবে সেখানকার প্রবাসী বাংলাদেশিদের অনভ্যস্ততার কষ্ট ছিল তুলনামূলকভাবে বেশি। বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে অনেক দেশে ঘটছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়। সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস যে বঙ্গোপসাগরের দুই ভুজের শীর্ষে থাকা বাংলাদেশকে প্রায়ই প্লাবিত করে, সেটা এই উপসাগরের আকৃতি ও তার একটি বিশেষ কোণে অবস্থানের কারণেই ঘটে, এটা অনেকের জানা নেই। কিন্তু সে রকম কোনো ভৌগোলিক অবস্থানে না থেকেও বিশ্বের কোথাও কোথাও ঘটছে এ রকম বিপর্যয়। টরন্টোর বন্যাপ্লাবিত রাস্তার সঙ্গে বৃষ্টির পর ঢাকার শািন্তনগরের রাস্তার দৃশ্যের সাযুজ্য খঁুজে পেয়ে কোনো কোনো বাংলাদেশি মজাও পেয়েছেন। এবারের তুষার-ঝড়ের পর সেখানে প্রায় টানা ৩৬ ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকার দুর্লভ অভিজ্ঞতাও অর্জন করেছেন অভিবাসী বাংলাদেশিরা। তবে এ কথা স্বীকার করেছেন সবাই যে যদি সে সময় গ্যাস-সংযোগ চালু না থাকত, তাহলে অনেক প্রাণহানি ঘটতে পারত কেবল ঠান্ডায়। কোনো দেশের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে কারও তৃপ্তি পাওয়া উচিত নয়, কিন্তু এ বিষয়ে বদনামটা বাংলাদেশের এত বেশি ছিল যে বাংলাদেশিদের কেউ কেউ নিজ দেশের গ্লানির বিপরীতে সেই তৃপ্তি প্রকাশ করতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি।
এক বছর আগে আমার টরন্টো পেঁৗছার ঠিক পরদিন ঘটে রানা প্লাজার মর্মন্তুদ ঘটনা। লো ব্লু সুপার স্টোরের জো ফ্রেশ ব্র্যান্ডের কাপড় তৈরি হচ্ছিল রানা প্লাজার কোনো এক প্রতিষ্ঠানে৷ সেই সুবাদে কানাডায় বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের স্বল্প মজুরি, কাজের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, অপর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা—এসব বিষয়ে সরব হয়ে উঠেছিল সে দেশের গণমাধ্যম এবং কোনো কোনো সংগঠন। রানা প্লাজা ধসের ঘটনাটি দেশের পোশাকশিল্পে যে ক্ষতের সৃষ্টি করেছে, তার রেশ আমাদের বহু দিন টানতে হবে।
ঘটনাক্রমে এবারও টরন্টোয় পেঁৗছার দিনই নারায়ণগঞ্জে ঘটে চাঞ্চল্যকর সাত অপহরণ ও নৃশংস খুনের ঘটনা। এ ঘটনা ঘটার প্রায় একই সময়ে বাংলাদেশ থেকে গিয়েছি বলে বিভিন্নজনের কাছে এ বিষয়ে প্রায় জবাবদিহি করার মতো দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে ব্যাখ্যা দিতে হয়েছে। দূর প্রবাসে থাকলে স্বদেশে সামান্য দুর্ঘটনা ঘটলেই সেটাকে অনেক বড় দেখা যায়, উদ্বিগ্ন বোধ করে মানুষ। ঠিক এই পরিস্থিতিতে বিভ্রািন্ত বোধ করেন অভিবাসীরা, কখনো মনে হয় দেশের এমন শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ থেকে দূরে চলে আসার সিদ্ধান্তই বুঝি ভালো ছিল। তবে দেশে থাকা আত্মীয়-পরিজনের কথা ভেবে উদ্বেগ আর দেশের পালাপার্বণে, পারিবারিক বা সামাজিক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থাকার মর্মবেদনাও হানা দেয় সংগোপনে। এমনকি যাঁরা বহু বছর আগে অভিবাসী জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন দূরদেশে, তাঁদের মধ্যেও একধরনের গোপন ভালোবাসা বহমান থাকে দেশ ও দেশের মানুষের জন্য।
গত বছর টরন্টোর বাংলাদেশিদের জীবন এবং নব্য অভিবাসীদের মোহভঙ্গ সম্পর্কে একটা লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর তার পক্ষে-বিপক্ষে বহু মতামত এসেছিল। বিপক্ষের কয়েকটি মন্তব্য ছিল খুবই আক্রমণাত্মক, আবার অনেকে এই লেখা পড়ার পর তাঁদের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছেন বলেও জানিয়েছিলেন। আবার সেই লেখাটি পড়ার পরও এই নিবন্ধকারের পরিচিত অন্তত পাঁচজন গত এক বছরে তাঁদের ভাগ্যান্বেষণের চেষ্টায় দেশান্তরি হওয়ার সিদ্ধােন্ত অবিচল থেকেছেন। তাই ধারণা করা যায়, কানাডায় পাড়ি দেওয়া বাংলাদেশিদের সংখ্যা কমেনি।
গত এক বছরের মধ্যে আগে বসবাস করা পরিবারের অন্য সদস্যদের সমর্থনে টরন্টোয় গিয়ে অভিবাসনের চূড়ান্ত প্রক্রিয়ায় শামিল হয়েছেন এমন অনেককে দেখেছি, যাঁরা স্বদেশে কোনো অর্থেই অসচ্ছল ছিলেন না। আবার বছর দুয়েক আগে কানাডায় পাড়ি দিয়ে এত দিনে মোটামুটি ভদ্রস্থ একটা চাকরি পেয়ে যাওয়া কয়েকজনকে দেখলাম, যাঁদের দৃষ্টিতে এখন কানাডার সবকিছুই খারাপ৷ কারণ অবচেতনে তাঁরা দেশের অভাব বোধ করছেন, অথচ সব পেছনে ফেলে আসার পর আবার দেশে ফিরে গিয়ে নতুনভাবে জীবন শুরু করা কোনোভাবেই সম্ভব নয় বলে সেই অপছন্দের দেশেই থেকে যেতে হচ্ছে তাঁদের। তাই তাঁদের নিরুপায় পরবাসের সান্ত্বনা হয় সেখানকার উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা, কঠোর আইন ও নিয়মানুবর্তিতা এবং বিভিন্ন ধরনের নাগরিক অধিকার ও সুবিধা।
এবার সে দেশে গিয়ে মনে হলো চাকরির বাজার কিছুটা ভালো হয়েছে৷ কারণ পরিচিত যে দু-একজনের কাজ ছিল না, এবার তাঁদের মুখে হাসি ফিরেছে চাকরি হয়েছে বলে। গত বছরের শীতে ভোর পাঁচটায় মাইনাস ২০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে টানা সাত-আট ঘণ্টা কাজ করার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন একজন, তিনিও মোটামুটি মাঝারি গোছের একটা কাজ পেয়েছেন সম্প্রতি। পরে অবশ্য জানা গেল যে অর্থনীতির চাকা আবার কিছুটা সচল হয়েছে দেশটির। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার সুফল ভোগ করতে শুরু করেছে নাফটার এই সদস্যদেশটি। আইএমএফ-ও পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০১৪ সালে কানাডার অর্থনীতি গতিপ্রাপ্ত হবে।
অর্থনীতির এই গতিবৃদ্ধির কারণে চাকরির বাজার উন্নত হওয়ায় প্রবাসীদের মনেও ফিরেছে স্বস্তি। মাত্র দুই বছর আগে যাওয়া কয়েকজনকে দেখলাম ভালো কাজ পেয়ে কিছুটা উদ্দীপিত। কানাডার অর্থনীতি যে কিছুটা চাঙা হতে শুরু করেছে, সেটা তাঁরাই জানালেন। ড্যানফোর্থের এক বাংলাদেশি রেস্তোরাঁয় বসে দুধ-চা আর ডালপুরি খেতে খেতে কয়েকজন সাবেক সহকর্মীর সঙ্গে আলোচনায় তাঁদের বেশ আশাদীপ্ত মনে হলো, যদিও তাঁদের কয়েকজন এখনো নতুনভাবে ওখানকার ডিগ্রি নেওয়ার জন্য পড়াশোনা করছেন।
একসময় শিল্পসাহিত্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বনামখ্যাত অনেক বাংলাদেশি কানাডার বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে রয়েছেন অভিবাসী হিসেবে। বেশ কয়েক বছর আগে পাড়ি দিয়ে তাঁদের প্রায় সবাই প্রতিষ্ঠিত আজ। একসময় টেলিভিশনের সেলিব্রিটি সংবাদ পাঠিকা আসমা আহমেদও তাঁদের মধ্যে একজন। তাঁর ছিমছাম বাড়িতে আরও কয়েকটা বাংলাদেশি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিমন্ত্রিত হয়ে এক ছুটির দুপুরে সেই প্রতিষ্ঠিত শ্রেণির কয়েকজনের সঙ্গে ভাববিনিময়ের সুযোগ ঘটে এবার।
তবে তাঁদের কাছ থেকে সেখানকার জীবনযাত্রার বিষয়ে কিছু জানার সুযোগ ছিল সীমিত৷ কারণ বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে তাঁদের ক্রমাগত প্রশ্নের জবাব দিতে এবং উদ্বেগ প্রশমিত করতে গিয়ে আমার আর তেমন কিছু জানা হয়ে ওঠে না। তাঁদের উদ্বেগের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল নারায়ণগঞ্জের সাত খুন। তাঁদের বিশ্বাস, বাংলাদেশে গুম কিংবা অপহরণের ঘটনা এমন উদ্বেগজনক যে দেশের কোনো মানুষই নিরাপদ নয়। এমনকি বুঝি, তাঁরা দেশে বেড়াতে যেতেও ভয় পান। আসমা আহমেদের সঙ্গে দেখা হওয়ার পরই তাঁর প্রশ্ন ছিল বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে। তাঁর সেই উদ্বেগ প্রশমনে বহু ধরনের যুক্তি উপস্থাপন করতে হয়েছিল আমাকে৷ দেশের মানুষ ও দেশ নিয়ে প্রবাসীদের এই উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা সহজাত ও চিরন্তন।
ভারতের স্বাধীনতার পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা ভারতীয় বংশোদ্ভূত নাগরিকদের উদ্দেশে নেহরু বলেছিলেন, যাতে তাঁরা সেসব দেশের কৃষ্টি ও সংস্কৃতি ধারণ করে তার সঙ্গে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করে। এই আহ্বানের পেছনের মূল কারণ ছিল অভিবাসী ভারতীয়দের পরবাসের যন্ত্রণা প্রশমিত করা। তাঁর সেই পরামর্শ ও আহ্বানের কারণেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে পরবর্তী প্রজন্মের ভারতীয় বংশোদ্ভূত মানুষেরা আজ সুপ্রতিষ্ঠিত।
বাংলাদেশি অভিবাসীদের জন্য বিষয়টি একটা যথার্থ ইঙ্গিত হতে পারে।
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার।
fmainuddin@hotmail.com
No comments