খেসারত পাঁচ হাজার কোটি টাকা মাত্র! by এ কে এম জাকারিয়া
প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত সবই অভিযোগ৷ তা
দুর্নীতি বা খুনখারাবি যা-ই হোক না কেন৷ তার পরও শুধু অভিযুক্ত হয়েই
অনেকে চাকরি-পদ এসব হারান, যায় মানসম্মানও৷ পরে নির্দোষ প্রমাণিত হলেও
হারানো এই বিষয়গুলোর সব কোনোভাবেই আর ফিরে পাওয়া যায় না৷ কোনো অপকর্মে
অভিযুক্ত হওয়াটাই যে এক বড় শাস্তি৷
পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি বা দুর্নীতির চেষ্টা হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠার কারণে বাংলাদেশকে যে খেসারত দিতে হবে, সেটা প্রত্যাশিতই ছিল৷ ‘অভিযোগ’ এবং অভিযোগের ব্যাপারে যথাযথ সাড়া দিতে না পারার শাস্তি পেয়েছে বাংলাদেশ৷ এই প্রকল্পে ঋণ-সহায়তা দেওয়ার অবস্থান থেকে একে একে সরে গেছে বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাইকার মতো প্রতিষ্ঠান৷ দুর্নীতিচেষ্টার অভিযোগের কারণে ক্ষুণ্ন হয়েছে দেশটির মানসম্মানও৷ এটুকু হলেও হয়তো ঠিক ছিল, কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এই ‘অভিযোগের’ মূল্য যে এখনই দাঁড়িয়েছে কমবেশি পাঁচ হাজার কোটি টাকা মাত্র!
২০০৭ সালে পদ্মা সেতুর প্রকল্পের পরিকল্পনায় এর নির্মাণব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার কোটি টাকা৷ এখন সেই সেতুর নির্মাণব্যয় দাঁড়াচ্ছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা৷ সাত বছরে খরচ বাড়ার পরিমাণ ১৫ হাজার কোটি টাকা৷ মাঝে ২০১১ সালে প্রকল্প ব্যয় সংশোধন করে দ্বিগুণ করা হয়৷ খরচ এত বেড়ে যাওয়ার পক্ষে তখন যুক্তিটি ছিল, প্রাথমিক পরিকল্পনায় বিস্তারিত অনেক কিছুই ছিল না এবং পরে প্রকল্পের নানা খুঁটিনাটি দিক বিবেচনায় নিয়ে ও বিস্তারিতভাবে করতে গিয়ে খরচ এতটা বেড়ে গেছে৷
পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি বা দুর্নীতির চেষ্টা হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠার কারণে বাংলাদেশকে যে খেসারত দিতে হবে, সেটা প্রত্যাশিতই ছিল৷ ‘অভিযোগ’ এবং অভিযোগের ব্যাপারে যথাযথ সাড়া দিতে না পারার শাস্তি পেয়েছে বাংলাদেশ৷ এই প্রকল্পে ঋণ-সহায়তা দেওয়ার অবস্থান থেকে একে একে সরে গেছে বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাইকার মতো প্রতিষ্ঠান৷ দুর্নীতিচেষ্টার অভিযোগের কারণে ক্ষুণ্ন হয়েছে দেশটির মানসম্মানও৷ এটুকু হলেও হয়তো ঠিক ছিল, কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এই ‘অভিযোগের’ মূল্য যে এখনই দাঁড়িয়েছে কমবেশি পাঁচ হাজার কোটি টাকা মাত্র!
২০০৭ সালে পদ্মা সেতুর প্রকল্পের পরিকল্পনায় এর নির্মাণব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার কোটি টাকা৷ এখন সেই সেতুর নির্মাণব্যয় দাঁড়াচ্ছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা৷ সাত বছরে খরচ বাড়ার পরিমাণ ১৫ হাজার কোটি টাকা৷ মাঝে ২০১১ সালে প্রকল্প ব্যয় সংশোধন করে দ্বিগুণ করা হয়৷ খরচ এত বেড়ে যাওয়ার পক্ষে তখন যুক্তিটি ছিল, প্রাথমিক পরিকল্পনায় বিস্তারিত অনেক কিছুই ছিল না এবং পরে প্রকল্পের নানা খুঁটিনাটি দিক বিবেচনায় নিয়ে ও বিস্তারিতভাবে করতে গিয়ে খরচ এতটা বেড়ে গেছে৷
খরচ বাড়ার এই যুক্তি মেনে নিলে ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি একনেক পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য সংশোধিত যে ২০ হাজার ৫৭০ কোটি টাকার ব্যয় অনুমোদন করেছে, সেটিই হচ্ছে সেতু বানানোর চূড়ান্ত খরচ৷ এখন সেই একই সেতু তৈরিতে বাড়তি যে পাঁচ হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হবে, তার স্রেফ কারণ পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে ওঠা দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ৷ আর সেতু নির্মাণ শুরু ও শেষ হতে হতে এই বাড়তি পাঁচ হাজার কোটি টাকার অঙ্কটি যে কোথায় গিয়ে ঠেকবে কে জানে৷ অতীতের অভিজ্ঞতা আর পরিবেশ-পরিস্থিতি খরচ আরও বাড়ারই ইঙ্গিত দিচ্ছে৷
২০১১ সালে যখন সাড়ে ২০ হাজার কোটি টাকা খরচ ধরা হয়েছিল, তখন অর্থের জোগানসহ সবকিছুই চূড়ান্ত ছিল৷ বিশ্বব্যাংকসহ দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে পাওয়ার কথা ছিল খরচের প্রায় পুরোটাই, ১৮ হাজার কোটি টাকার মতো৷ দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ পরিস্থিতি পাল্টে দিল৷ এই অভিযোগ আমলে না নেওয়ার একগুঁয়ে নীতি নিয়ে সরকার চূড়ান্ত সর্বনাশটি করল৷ অর্থের প্রতিশ্রুতি গেল, নতুন অর্থের খোঁজে সময় গেল (শেষ পর্যন্ত কোথাও থেকে তা পাওয়াও গেল না এবং নিজেদের রিজার্ভ ভেঙেই তা করতে হবে) এবং খচরও বেড়ে গেল পাঁচ হাজার কোটি টাকা৷ আর বাড়াল সেতুর জন্য অপেক্ষার সময়ও৷
আগের এক লেখায় লিখেছিলাম, বিশ্বব্যাংকসহ দাতা সংস্থাগুলো এই প্রকল্প থেকে সরে যাওয়ায় এ ধরনের বড় সেতু নির্মাণে অভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে৷ অর্থের নিশ্চয়তাটি তাদের জন্য বড় ব্যাপার৷ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ভেঙে অর্থ দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে বড় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো ভরসা পাবে না৷ বাস্তবে এখন তা-ই হলো৷ বিশ্বব্যাংকের তত্ত্বাবধানে মূল সেতু নির্মাণের জন্য প্রাক্যোগ্য হয়েছিল চারটি প্রতিষ্ঠান৷ দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাং ও ডেইলেম, চীনের চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানি ও ফ্রান্সের ভিন্সি৷ বিশ্বব্যাংক সরে যাওয়ার পর একমাত্র চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানি ছাড়া আর কোনো প্রতিষ্ঠানই বাংলাদেশ সরকারের ‘নিজস্ব অর্থে’ পদ্মা সেতু নির্মাণপ্রক্রিয়ায় আস্থা রাখতে পারেনি৷ দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানি দুটি সরকারের কাছ থেকে অর্থের ‘লিখিত প্রতিশ্রুতি’ চেয়েছিল৷ সরকারের কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে এই দুটি প্রতিষ্ঠান চূড়ান্ত আর্থিক প্রস্তাব আর জমাই দেয়নি৷ ‘অপ্রতিদ্বন্দ্বী’ চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানিকে কাজ না দিয়ে তখন আর উপায় কী, তারা যে প্রস্তাবই দিক না কেন!
যাচাই-বাছাইয়ের সুযোগ ছাড়া একটি মাত্র প্রতিষ্ঠানের আর্থিক প্রস্তাবের ভিত্তিতে ঠিকাদার নিয়োগে যে ‘ঝুঁকি’ রয়েছে, সে কথা জানিয়েছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম৷ তিনি বাংলাদেশে চীনা কোম্পানির কাজের অতীত অভিজ্ঞতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন৷ (প্রথম আলো, ২২ মে ২০১৪) যে প্রক্রিয়ায় চীনা প্রতিষ্ঠানটি কাজ পেয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই৷ কিন্তু এটা স্বাভাবিক, একটি মাত্র প্রতিষ্ঠান যখন দরপত্র জমা দেয়, তখন ‘অপ্রতিদ্বন্দ্বী’ হিসেবে সেই প্রতিষ্ঠান কিছু সুযোগ নিতেই চাইবে৷ যে আর্থিক প্রস্তাব দিয়ে তারা কাজ পেয়েছে, তা যে আরও বাড়তে পারে বা ব্যয় সংশোধিত হতে পারে, সে কথা অর্থমন্ত্রী নিজেই জানিয়েছেন৷ সরকারের প্রকল্প গ্রহণ, অনুমোদন ও বাস্তবায়নসংক্রান্ত নীতিমালা অনুযায়ী, দুবার প্রকল্প ব্যয় পর্যালোচনার সুযোগ থাকে৷ পদ্মা সেতু তৈরির ক্ষেত্রে সরকারের এই নীতিমালা থেকে দায়মুক্তি চেয়ে আবেদন করে রেখেছে সেতু নির্মাণ, তদারক ও তত্ত্বাবধানকারী সেতু বিভাগ৷ বোঝাই যাচ্ছে খরচ আরও বাড়ার বিষয়টিই মাথায় রেখেছে সেতু বিভাগ৷ সেতুর কাজ শুরুর পর চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানির কাজ তদারকির বিষয়টি হবে সরকারের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ৷ একদিকে আমাদের রয়েছে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নানা অনিশ্চয়তা, অন্যদিকে এ ধরনের বড় প্রকল্পের কাজ তদারকি ও নজরদারির অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের নেই৷ চীনা কোম্পানি কেন, যেকোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানই এই পরিস্থিতির সুযোগ নিতে পারে৷ এসব কারণেই নিজেদের অর্থ জোগান দেওয়ার সামর্থ্য থাকার পর বিশ্বের অনেক দেশ বড় প্রকল্পে ব্যবস্থাপনাগত কারণে বিশ্বব্যাংক বা এ ধরনের প্রতিষ্ঠানকে সঙ্গে রাখতে চায়৷ কারণ, কম সুদে ঋণ পাওয়ার পাশাপাশি তাদের তদারকির দক্ষতাকেও কাজে লাগানো যায়৷
চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানি এর আগে বাংলাদেশে পাকশীতে লালন সেতু নির্মাণ করেছে৷ তখন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান সাকো ইন্টারন্যাশনাল চীনা কোম্পানির সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে এবং সেই প্রকল্পের অন্যতম কর্মকর্তা কামরুজ্জামান এখন পদ্মা সেতু প্রকল্পের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এবং মূল সেতুর দায়িত্বে রয়েছেন৷ ফলে, চীনা কোম্পানির কাজ তদারকির কাজটি কতটা নির্মোহভাবে হবে, সে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে৷ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির স্বার্থে সরকার এ ক্ষেত্রে কী করে, সেটাই দেখার বিষয়৷
এটা সরকারের বিবেচনায় রাখতে হবে যে বিশ্বব্যাপী চীনা কোম্পানিগুলোর সুনামের সংকট রয়েছে৷ আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্নীতিসংক্রান্ত ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) ‘ব্রাইব পেয়ার্স’ সূচকে চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থান একেবারেই নিচের দিকে৷ আর আন্তর্জাতিকভাবে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি যে খাতটিতে হয়ে থাকে, সেটি হচ্ছে এ ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ খাত৷ পদ্মা সেতু নিয়ে যেহেতু একবার দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ উঠেছে, তাই সামনে সব ধরনের বিতর্ক এড়াতে বাড়তি সতর্কতা খুবই দরকার৷
সাদামাটা হিসাবেই পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ ওঠার খেসারত দিতে হচ্ছে পাঁচ হাজার কোটি টাকা৷ আসলে এই ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি৷ ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ২০১০ সালে নির্মাণ শুরু ও ২০১৪ সালে সেতুটি চালুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল৷ এখন সেতু নির্মাণে এই যে দেরি হলো এবং এত দিনে যে সুবিধা দক্ষিণবঙ্গ, তথা দেশের জনগণ পাওয়া শুরু করত, তা থেকে বঞ্চিত হওয়ারও একটি বড় অর্থমূল্য রয়েছে৷ একদিকে দেরি হলো, অন্যদিকে এ কারণে খরচ বাড়ল৷ কিন্তু খরচ বাড়লেও ‘কষ্ট’-এর বিপরীতে ‘বেনিফিট’ বাড়ার কোনো সুযোগ নেই৷ কারণ, ২০১০ সালে যে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল, ২০১৪ সালে এসেও সেই একই সেতুই তৈরি হবে৷ আর খরচ যে হারে বাড়ছে, সেতু থেকে আয় বা টোল আদায় সে অনুযায়ী বাড়ানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়৷
দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগের ফলে ক্ষতি যা হওয়ার এরই মধ্যে হয়ে গেছে৷ কোনো এক সময়ে এই অভিযোগ প্রমাণিত হোক বা না হোক, এই ক্ষতি কোনোভাবেই পূরণ হবে না৷ এই বাস্তবতায় যথাযথ তদারকির অভাব বা অন্য কোনো অনিয়মের কারণে যাতে খরচ আর কোনোভাবেই বাড়তে না পারে, সেটা নিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জ সরকারকে নিতেই হবে৷
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com
No comments