বেসিক ব্যাংকে বিপর্যয়
একটা সময় রাষ্ট্রীয় খাতের বেসিক ব্যাংক ছিল একটি আদর্শ ব্যাংক। রাষ্ট্রীয় মালিকানায় থেকেও বাংলাদেশে কীভাবে একটি ব্যাংক বছরের পর বছর মুনাফার মুখ দেখতে পারে ও দক্ষভাবে পরিচালিত হতে পারে, তার দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছিল বেসিক ব্যাংক। যেহেতু অনেক ছোট পরিসরে ও অল্প শাখা নিয়ে পরিচালিত হতো, সেহেতু এর ওপর নজরদারিও ছিল তুলনামূলকভাবে সহজ। কিন্তু গত পাঁচ বছরে রাজনৈতিক প্রভাবে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ, বিশেষত চেয়ারম্যান ঋণ বিতরণ থেকে নিয়োগ পর্যন্ত—সর্বত্র নিয়মকানুন উপেক্ষা করে ব্যাংক পরিচালনা করতে থাকায় এখন এই ব্যাংকটি রাষ্ট্রের জন্য নতুন এক বোঝায় পরিণত হয়েছে। একই সঙ্গে দেশের আর্থিক খাতে একটি বড় ক্ষত তৈরি করা হয়েছে। অথচ প্রথম আলোসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের একাধিক প্রতিবেদনে গত তিন বছরে বিভিন্ন সময়ে বেসিক ব্যাংকের বিপর্যয়ের চিত্রটি জনসমক্ষে প্রকাশ পেয়েছে। এসব প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, পর্ষদ চেয়ারম্যান সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের সঙ্গে নিজের নিবিড় যোগাযোগকে কাজে লাগিয়ে ব্যাংকের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেন। তাঁর নেতৃত্বে পরিচালনা পর্ষদ ব্যাংকের রীতি–বিধি অনুসরণ না করে ও যাচাই-বাছাইয়ের তোয়াক্কা না করে কোটি কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। ২০১২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুসন্ধানে ধরা পড়ে যে অন্তত ৬৭ জন গ্রাহককে দুই হাজার ৫৬৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা ঋণ অনিয়ম করা দেওয়া হয়েছে। আবার নানা কৌশলে জালিয়াতি করে পর্ষদের সহযোগিতায় ব্যাংক থেকে অন্তত সাড়ে চার হাজার কোটি তুলে নেওয়ার বিষয়টি দুই বছর আগেই ধরা পড়ে। এর মধ্যে তিন হাজার কোটি টাকার অনিয়মের বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত শুরু করে; কিন্তু মাঝপথে তা থেমে যায়।
উদ্বেগজনক হলো, বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন সময় ব্যাংকটির ঋণ–পরিস্থিতি পরিদর্শন করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হয়েছে। আর তাই অনিয়মের বিষয় চিহ্নিত করার পরও তা প্রতিকারে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি। আবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বেসিক ব্যাংকের বিষয়ে বরাবরই নমনীয় অবস্থান নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থ মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার চিঠি দিলেও কোনো কাজ হয়নি। বরং প্রথম আলোসহ গণমাধ্যমের বিভিন্ন প্রতিবেদনকে ‘অজ্ঞতাপ্রসূত’ ও ‘অতিরঞ্জন’ বলে সমালোচনা করা হয়েছে। পরিস্থিতির চরম অবনতি হওয়ায় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে গত রোববার অপসারণ করা হয়। কিন্তু বেসিক ব্যাংকের অনিয়ম ও বিপর্যয় ঘটানোর মূল দায়দায়িত্ব পরিচালনা পর্ষদের। আর তাই গোটা পর্ষদ ভেঙে না দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। বরং আরও আগেই এটা ভেঙে দেওয়া উচিত ছিল। হল-মার্ক কেলেঙ্কারির পর যদি সোনালী ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে পুনর্গঠন করা যেতে পারে, তাহলে কেন বেসিক ব্যাংকের পর্ষদ নয়— এ প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই উঠেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যে এই সুপারিশ করেছে। এটি বাস্তবায়ন করা না হলে সরকার তথা অর্থ মন্ত্রণালয় আর্থিক খাতে অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা উৎসাহিত করার মন্দ দৃষ্টান্তই স্থাপন করবে।
No comments