হান নদীর গল্পগাথা by সাজ্জাদ শরিফ
সোউলের রাস্তাঘাট দেখলে কে বলবে
আন্তর্জাতিক রপ্তানি-বাণিজ্যের দিক থেকে এটি পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম দেশ
দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী? এতটা পথ ধরে যে যাচ্ছি, গাড়িটাকে আটকে থাকতে
হচ্ছে বড়ই কম। কদাচিৎ খানিক মন্থর হলেও তা হচ্ছে কিছুক্ষণের জন্য মাত্র।
আকাশ-আঁচড়ানো অট্টালিকা কম নেই, কিন্তু অবাধ দৃষ্টির জন্য খোলা পরিসরও
যথেষ্ট। প্রশস্ত রাস্তা উপচে দুপাশের মুক্ত অবকাশ ছড়িয়ে গেছে আরও অনেকটা।
পথের দুপাশ সবুজ গাছের ঘন ফ্রেমে বাঁধানো। শহরের বুক চিরে চলে গেছে হান
নদী। তার সঙ্গে হাতের আঁকিবুঁকি রেখার মতো সরু সরু জলধারা।
আমরা এসেছি কোরিয়া ফাউন্ডেশনে। অধ্যাপক সেওং-কন কিম আমাদের শোনাবেন কোরিয়ার উঠে দাঁড়ানোর গল্প। অধ্যাপক কিম পড়ান সোউল বিশ্ববিদ্যালয়ে, ইংরেজি সাহিত্যে। তিনি যা শোনালেন, সেটি ছাইয়ের সোনা হয়ে ওঠার গল্প। অন্য আরও বহু দেশের মতো কোরিয়ার অতীতও অশ্রু আর বিলাপের কাহিনিতে ভরা। কোরিয়ার ইতিহাসের ধূসর পৃষ্ঠা বারবার লাল হয়ে উঠেছে দখল আর অত্যাচারের ঘটনায়। চীনের মোঙ্গলরা আক্রমণ করতে করতে কোরিয়ার প্রায় পুরোটাই একসময়ে খেয়ে নিয়েছিল। নাক উঁচু করে বেঁচে ছিল শুধু দ্বীপের মতো সামান্য একটু অংশ।
এ ছাড়া গত শতকের গোড়ায়, ১৯১০ সালে, জাপানের সঙ্গে তারা এক দাস্য চুক্তির অধীনে যেতে বাধ্য হয়। কয়েকটি সংখ্যাই এর পরের ঘটনা বলে দেবে। ৫০ লাখ কোরীয়কে জাপানের কাছে স্বেচ্ছাশ্রম দিতে হয়। কেবল যুদ্ধেই প্রাণ হারান চার লাখ শ্রমিক। শরীর দিতে বাধ্য করা হয় চীনাসহ প্রায় দুই লাখ কিশোরী ও নারীকে।
আমরা এসেছি কোরিয়া ফাউন্ডেশনে। অধ্যাপক সেওং-কন কিম আমাদের শোনাবেন কোরিয়ার উঠে দাঁড়ানোর গল্প। অধ্যাপক কিম পড়ান সোউল বিশ্ববিদ্যালয়ে, ইংরেজি সাহিত্যে। তিনি যা শোনালেন, সেটি ছাইয়ের সোনা হয়ে ওঠার গল্প। অন্য আরও বহু দেশের মতো কোরিয়ার অতীতও অশ্রু আর বিলাপের কাহিনিতে ভরা। কোরিয়ার ইতিহাসের ধূসর পৃষ্ঠা বারবার লাল হয়ে উঠেছে দখল আর অত্যাচারের ঘটনায়। চীনের মোঙ্গলরা আক্রমণ করতে করতে কোরিয়ার প্রায় পুরোটাই একসময়ে খেয়ে নিয়েছিল। নাক উঁচু করে বেঁচে ছিল শুধু দ্বীপের মতো সামান্য একটু অংশ।
এ ছাড়া গত শতকের গোড়ায়, ১৯১০ সালে, জাপানের সঙ্গে তারা এক দাস্য চুক্তির অধীনে যেতে বাধ্য হয়। কয়েকটি সংখ্যাই এর পরের ঘটনা বলে দেবে। ৫০ লাখ কোরীয়কে জাপানের কাছে স্বেচ্ছাশ্রম দিতে হয়। কেবল যুদ্ধেই প্রাণ হারান চার লাখ শ্রমিক। শরীর দিতে বাধ্য করা হয় চীনাসহ প্রায় দুই লাখ কিশোরী ও নারীকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে স্নায়ুযুদ্ধের সূচনাকালে, ১৯৪৮ সালে, দুই টুকরোর এই ভাগের দক্ষিণ কোরিয়া হয়ে পড়ে আরও নিঃস্ব। উপরন্তু বারবার তারা কখনো চীন, কখনো রাশিয়ার সমর্থনে ক্রমাগত আক্রমণে ছিন্নভিন্ন হতে থাকে।
‘১৯৬০-এর দশকেও আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা উত্তর কোরিয়ার চেয়ে খারাপ ছিল।’ বললেন অধ্যাপক কিম। ‘কিন্তু আমরা অতীতের ধ্বংসস্তূপে মুখ গুঁজে না থাকার পণ করেছিলাম। যতটা সামান্য সুযোগই পেয়েছি, সেটুকুই ব্যবহার করেছি উঠে দাঁড়ানোর কাজে।’
কিন্তু উঠে দাঁড়ালেন কীভাবে? অধ্যাপক কিমের মতে, তাঁদের জাতীয় নেতাদের দূরদৃষ্টি আর সাধারণ মানুষের অদম্য সংকল্প। রাজনীতিতে সামরিক-বেসামরিক যে সরকারই আসুক না কেন, অর্থনৈতিক গতিশীলতা বাড়ানোর চেষ্টা করেছে সবাই। ১৯৬২ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত এর ব্যাঘ্রতুল্য অর্থনীতি বেড়েছে বছরে ১০ শতাংশ করে, রপ্তানি বেড়েছে ২০ শতাংশ করে। তাঁদের অর্থনীতি এখন বিশ্বের দ্বাদশ বৃহত্তম। এই মায়াবী কাহিনিকে কেউ কেউ আখ্যা দেয় রাজধানীর বুক চিরে চলে যাওয়া ‘হান নদীর জাদুগাথা’ বলে।
খাত তৈরি করেছেন নেতারা, আর সে পথ ধরে এগিয়ে গেছে সাধারণ মানুষ। কিম বলেন, ‘পৃথিবীর বিস্ময় যে স্যামসাং, সে কিন্তু তার কারিগর জ্ঞান পেয়েছে সনির কাছ থেকে; হিউন্দাইয়ের প্রকৌশলজ্ঞান মিৎসুবিশির কাছ থেকে পাওয়া। কিন্তু মূল প্রতিষ্ঠানগুলোকে ছাড়িয়ে গিয়ে যে ওরা পৃথিবীটাকে সয়লাব করে দিল, তার পেছনে আছে মানুষ।’
রূপকথার গল্পটির আবেশ মাথায় নিয়ে আমরা বেরিয়ে আসি বাইরে। চোখ পড়ে ভবনের ঠিক পাশেই চওড়া ফুটপাতের ওপরে। ফেস্টুন-ব্যানার টানিয়ে তাতে অবস্থান ধর্মঘটে বসেছেন শ্রমিক সংঘের সদস্যরা। ১৬ এপ্রিল ভয়াবহ এক ফেরি দুর্ঘটনায় ৩০৪ জন মানুষের মৃত্যুতে এই প্রতিবাদ। মৃতদের বড় অংশটি দানওন নামে একটি স্কুলের ছাত্রছাত্রী। আজ চলছে ধর্মঘটের দশম দিন। নানা তৎপরতাও চলছে শ্রমিকদের। কিন্তু কোথাও কোনো অস্থিরতা নেই। আছে নীরব গাম্ভীর্য। নৈঃশব্দ্যই কেমন এক অদ্ভুত ভার চাপিয়ে দিয়েছে চারপাশের ব্যস্ততার ওপর।
শ্রমিকদের একটি ব্যানারে লেখা, ‘এই নৌ-দুর্ঘটনা সরকারি নীতির ব্যর্থতার ফল। তাদের কাছে ব্যবসার মুনাফা আর দক্ষতার জায়গা মানুষের জীবন ও নিরাপত্তার ওপরে।’ এই এক বৈপরীত্যময় টানাপোড়েন, প্রায় সর্বত্র।
কোরিয়া ফাউন্ডেশনের এক কর্মকর্তা জানান, বর্তমান প্রেসিডেন্ট পার্ক গেউন-হাইয়ের ৭১ শতাংশ জনপ্রিয়তা এ দুর্ঘটনার পরে নেমে এসেছে ৪০ শতাংশে। সামনেই কোরিয়ার স্থানীয় সরকারের বিরাট নির্বাচন। এ দুর্ঘটনা সব রকম প্রচার-প্রচারণার গায়ে পানি ঢেলে দিয়েছে। কোথাও কোনো বাড়াবাড়ি তো দূরের কথা, সাড়াশব্দই প্রায় নেই। ‘কোরিয়ার গণতন্ত্র এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে মানুষের আবেগকে মূল্য না দিয়ে উপায় নেই।’
সে আবেগেরই ভিন্ন একটি গল্প পড়া গেল পত্রিকায়। যে স্কুলের এতগুলো ছাত্রছাত্রী প্রাণ হারাল, তার উপাধ্যক্ষও আত্মহত্যা করেছেন ঘটনার কয়েক দিন পর। কেন? তাঁরই পরিকল্পিত এক মাঠসফরে যাওয়ার সময়েই যে বাচ্চাগুলো বেঘোরে প্রাণ হারাল। এ বেদনার ভার তিনি বইতে পারছিলেন না। আত্মহত্যার আগে চিরকুটে লিখে গেছেন, ‘স্বর্গে হয়তো আমি আবার ওই শিশুগুলোর শিক্ষক হব, যাদের শরীর খুঁজে পাওয়া যায়নি।’
কোরিয়ার এই মানুষগুলো মানুষ হিসেবে আমাদের সীমানা কতটাই না বাড়িয়ে দিয়েছেন।
সোউল, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে
সাজ্জাদ শরিফ: কবি, সাংবাদিক৷
No comments