টমাস মানর শেষ উপন্যাস কনফেশন অব ফেলিক্স ক্রুল by সরকার মাসুদ
ভিক্টোরীয়
যুগের কবিদের শেষ প্রতিনিধি হচ্ছেন সুইনবার্ন। ঠিক তেমনি, টমাস মান
ক্লাসিক্যাল ঘরানার শেষ ঔপন্যাসিক। ১৯৫৫ সালে (ওই বছর তার মৃত্যুও হয়, ১২
আগস্ট) ৭৯+ বয়সের Confessions of Felix Krull উপন্যাসের প্রথম খণ্ড লিখে
তিনি আরও একবার প্রমাণ করেছেন সে কথা। সেই সঙ্গে পাঠক আরেকবার চমকিত এবং
গভীরভাবে বিনোদিতও হয়েছেন। The Magic Mountain, Death in Venice, Tonio
Kroger, The Holy Sinner প্রভৃতি গল্প উপন্যাসে দেখা যায় পুঙ্খানুপুঙ্খতা,
বুদ্ধিদীপ্ত বর্ণনার অতিরেক। মানের রচনা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দীর্ঘ-
ক্লান্তিকর রকমের দীর্ঘ। টমাস মানের একাধিক নায়ক সেই ধরনের মানুষ যারা
শিল্পী এবং অন্তর্দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত। বলা যায় এ জাতীয় নায়ক পরিকল্পনা
ছিল কথাশিল্পী মানের স্বভাবগত। এবং শিল্পী চরিত্রটি তার যাবতীয় সীমাবদ্ধতা ও
ঔজ্জ্বল্য নিয়েই সবচেয়ে বেশি জীবন্ত হয়ে উঠেছে তার লেখায়। তুলনায়
‘Confessions of Felix Krull’ (ফেলিক্স ক্রুলের স্বীকারোক্তি) বইটি স্পষ্ট
ব্যতিক্রম। এ উপন্যাসের নায়ক ফেলিক্স একজন প্রতারক, চোর এবং জালিয়াত যা
একেবারে অভাবিত। কেননা উপন্যাসকারের শিল্প রুচির সঙ্গে তা খাপ খায়নি।
ফেলিক্স ক্রুলের বীজ লেখকের মাথায় পড়েছিল আনুমানিক চল্লিশ বছর আগে। Stories of Three Decades বইয়ে মান ফেলিক্সের জীবনের ছোট ছোট ঘটনা সাজিয়ে গল্প লিখেছিলেন। তারপর সুদীর্ঘকাল সেই টুকরো টুকরো ঘটনাবলীকে পূর্ণাঙ্গ জীবন কাহিনীতে রূপান্তরিত করার আকাক্সক্ষা পোষণ করেছেন শুধু। সেই আশা পূরণ হয়েছে লেখকের জীবনসায়াহ্নে। অন্যতম প্রধান কারণ, মাঝখানের বছরগুলোতে টমাস মান The Magic Mountain, The Holy Sinner, Death in Venice প্রভৃতি উপন্যাস রচনায় ব্যস্ত ছিলেন।
এখন আমরা উপন্যাসটির ভেতরে প্রবেশ করব। ফেলিক্স এক অন্তঃসারশূন্য বিত্তবান পরিবারের সন্তান। বাবা মদ ব্যবসায়ী। একটা পর্যায়ে আয় কমে এলেও ব্যয় প্রবণতা, হৈ-হল্লা আর জাঁকজমকে মগ্ন গোটা পরিবার। এমন পরিবেশে বড় হচ্ছিল ফেলিক্স। শিশু বয়সেই সে পিতার সই জাল করা শিখেছিল; উদ্দেশ্য স্কুল পালানো। অর্থনৈতিক অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠলে ফেলিক্সের বাবা আত্মহত্যা করেন। নিরুপায় মা হোটেল খোলেন। বোন থিয়েটারের নর্তকি হন। ফেলিক্স পথে নামে সৌভাগ্যের খোঁজে। ফেলিক্স প্রথমে কৌশল করে জার্মান সেনাবাহিনীতে যোগদানের বিষয়টি এড়াতে পারে। এরপর সে ফ্রাঙ্কফুট যায়। সেখানে নাম-ডাক আছে এরকম এক গণিকার সহকারী হিসেবে কিছুদিন কাজ করে। তারপর প্যারিসে চলে আসে। এখানেই আরম্ভ হয় তার আসল কর্মকাণ্ড।
প্যারিসের এক হোটেলে লিফটবয়ের চাকরি নেয় ফেলিক্স। লিফটে ওপর-নিচ করে আর ভাবে, কীভাবে সে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে এ মহানগরে। তার আগে, সীমান্ত পাড়ি দেয়ার সময়, কাস্টমসে তল্লাশি চলাকালে ফেলিক্স এক মহিলার গয়নার বাক্স চুরি করে। তার হাতে এখন গয়না বিক্রির টাকা, পরিমাণে কম নয়। উপরন্ত ফেলিক্স সুঠাম শরীরের টগবগে যুবক। সে অফিস-আওয়ারে লিফট চালায় আর অন্য সময় ঘুরে বেড়ায় নানা জায়গায়। নিরুদ্বেগ দিন কাটছিল তার। ডানায় যেন পাখা গজিয়েছে। একদিন মধ্যবয়স্কা এক ধনী লেখিকা তার প্রতি আকৃষ্ট হন। কয়েকদিন পর লেখিকাটি ফেলিক্সকে রাতে ডাকেন এবং তার শয্যাসঙ্গিনী হন। ঘটনাচক্রে লেখিকা জানতে পারেন যে, তার হারিয়ে যাওয়া গয়নার বাক্সটি সরিয়েছে ফেলিক্স। কিন্তু মহিলার মধ্যে মনোবিচলনের কোনো ভাব দেখা যায় না। লেখিকার স্বামী খুবই ধনাঢ্য ব্যক্তি কিন্তু আহাম্মক ধরনের মানুষ। অলংকার চুরির বিষয়টি জানতে পারলে রেগে ওঠা তো দূরের কথা তাকে হয়তো অনেক বেশি পরিমাণ গয়না কিনে দেবেন। এরকম এটা-ওটা ভেবে লেখিকা ফেলিক্সকে বেশ কিছু টাকা দান করেন। আর্থিকভাবে বেশ সচ্ছল হয়ে ওঠে ফেলিক্স। তার আছে আরেক দুর্লভ সম্পদ ভরা যৌবন এবং সুঠাম দেহ। প্যারিসের নাইট-ক্লাবগুলোতে তার পা পড়তে শুরু করল। মহানগরীর নৈশ জীবনে, ক্রমে, সে হয়ে উঠলো প্লে-বয়।
দিনের বেলা হোটেলের সামান্য চাকুরে, রাতের বেলা মধুলোভী ভ্রমর। কিন্তু এর ভেতর ফেলিক্সের মর্মযাতনাও আছে। কারণ সে তো লিফটম্যান হতে চায়নি। সে চেয়েছে জীবনে সম্মানজনক প্রতিষ্ঠা, যদিও তা সুদূর পরাহত; কেননা অল্প বয়সেই সে চরিত্র খুঁইয়েছে। ফেলিক্সের ছিল মানুষকে ভোলোবাসার আশ্চর্য ক্ষমতা। তার রূপ-যৌবনে আকৃষ্ট এবং কথা-বার্তায় মুগ্ধ হয় এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর মেয়ে। মেয়েটি তার প্রেমে পড়ে। সে প্রেমের আকর্ষণ এমনই যে, সে ফেলিক্সের সঙ্গে বিছানায় যেতেও প্রস্তুত। ওদিকে বিহ্বল, অপ্রস্তুত ফেলিক্স সবিনয়ে এড়িয়ে যায় মেয়েটিকে। এ কঠিন মানস পরিস্থিতি কোনোমতে সামলে নেয় সে। এরপর ভেনোসতা নামের এক শিল্পীর সঙ্গে তার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হয়। ফেলিক্সের এ শিল্পী বন্ধুটি প্যারিসে এসেছে ছবি আঁকা শিখতে। জাজা নামে একটি তরুণীর সঙ্গে তার গভীর প্রেমের সম্পর্ক। শিল্পীর পিতা মার্কুইস ছেলের প্রতি রীতিমতো ক্ষিপ্ত। জাজা থিয়েটারে গান করে এবং সে মডেলও।
জাজার হাত থেকে ছেলেকে রক্ষা করার জন্য ভেনোসতার বাবা-মা এক ফন্দি আঁটেন। তারা সিদ্ধান্ত নেন, ছেলেকে এক বছরের জন্য বিশ্বভ্রমণে পাঠাবেন। যুক্তি দেন, এ ভ্রমণ তার শিল্পীমানসকে প্রসারিত করবে। ভোনোসতা পড়ে গেল বিপদে। একদিকে জাজার আকর্ষণ, অন্যদিকে পিতা-মাতার অবাধ্য হলে পারিবারিক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশংকা। এহেন উভয় সংকটে ফেলিক্স এগিয়ে আসে। মানুষ ভেনোসতা সম্বন্ধে আগে থেকেই তার কিছু ধারণা ছিল। এবার সে শিল্পী ভেনোসতার স্বভাবের খুঁটিনাটি জেনে নেয়। তারপর শিল্পীর বদলে সে বিশ্বভ্রমণে বেরিয়ে পড়ে। ভেনোসতার হাতের লেখা নিখুঁতভাবে নকল করে ভেনোসতা সেজে বাবা-মাকে চিঠিও লেখে।
এভাবে ফেলিক্স ঘুরতে ঘুরতে পর্তুগালে এসে পড়ে। রাজধানী লিসবনে একই সঙ্গে এক মা ও তার মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয় ফেলিক্সের। সম্পর্ক অচিরেই প্রেমের দিকে মোড় নেয়। এখানেই অসম্পূর্ণ অবস্থায় শেষ হয় উপন্যাসটি।
টমাস মান ১৯২৯ সালে নোবেল প্রাইজ জিতেছিলেন। দীর্ঘ আয়ু পেয়েছিলেন তিনি। মোটা মোটা বই লিখে অনেক গভীর ও নাতিগভীর ভাবনা তিনি শেয়ার করেছেন বিশ্বব্যাপী ছড়ানো পাঠকদের সঙ্গে। মান যেমন ভাবগম্ভীর প্রকৃতির লেখক তেমনি তার পাঠকরাও সচরাচর গম্ভীর। মান এবার চাইলেন গম্ভীর পাঠকের মুখে হাসি ছড়াতে। এ হাসি গভীর আত্ম উপলব্ধি এবং জটিল জীবন পরিস্থিতি থেকে উৎসারিত। ‘ঈড়হভবংংরড়হং ড়ভ ঋবষরী কৎঁষষ’ রচনার ভেতর দিয়ে তার ওই চাওয়া সার্থক হয়েছে। এ বই একটি সফল কমিক নভেল। এ ধরনের উপন্যাস জার্মান সাহিত্যে বিরল। মানের লেখার জাদুতে ফেলিক্স ক্রুল হয়ে উঠেছে বিশ্বসাহিত্যের স্মরণযোগ্য চরিত্র। লেখকের ব্যক্তিগত নোট থেকে জানা যায়, ফেলিক্সের গল্প একাধিক খণ্ডে শেষ করার ইচ্ছা ছিল টমাস মানের। কিন্তু তার আগেই চিরবিদায় নিতে হয় তাকে।
ফেলিক্সের মতো একটি নেগেটিভ চরিত্রের আড়ালে মর্মদহন বিরল দক্ষতায় তুলে আনতে পেরেছেন মান। আত্মসম্মানসচেতন ধনী লেখিকা (যিনি বুদ্ধিজীবীও বটে) শারীরিক পরিতৃপ্তির জন্য চাকরপ্রতিম এক ফিলট বয়ের (ফেলিক্স) কাছে নিজেকে সঁপে দিয়েছেন এবং পরে শিকার হয়েছেন অনিবার্য মানসিক অস্বস্তির। এসব বিষয়ও প্রশংসনীয় ভঙ্গিতে চিত্রিত করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। উপন্যাসটি মূলত কমিক মেজাজের হলেও তার ভেতরের অশ্র“বিন্দুগুলো তাকে দিয়েছে অনন্য উচ্চতা।
ফেলিক্স ক্রুলের বীজ লেখকের মাথায় পড়েছিল আনুমানিক চল্লিশ বছর আগে। Stories of Three Decades বইয়ে মান ফেলিক্সের জীবনের ছোট ছোট ঘটনা সাজিয়ে গল্প লিখেছিলেন। তারপর সুদীর্ঘকাল সেই টুকরো টুকরো ঘটনাবলীকে পূর্ণাঙ্গ জীবন কাহিনীতে রূপান্তরিত করার আকাক্সক্ষা পোষণ করেছেন শুধু। সেই আশা পূরণ হয়েছে লেখকের জীবনসায়াহ্নে। অন্যতম প্রধান কারণ, মাঝখানের বছরগুলোতে টমাস মান The Magic Mountain, The Holy Sinner, Death in Venice প্রভৃতি উপন্যাস রচনায় ব্যস্ত ছিলেন।
এখন আমরা উপন্যাসটির ভেতরে প্রবেশ করব। ফেলিক্স এক অন্তঃসারশূন্য বিত্তবান পরিবারের সন্তান। বাবা মদ ব্যবসায়ী। একটা পর্যায়ে আয় কমে এলেও ব্যয় প্রবণতা, হৈ-হল্লা আর জাঁকজমকে মগ্ন গোটা পরিবার। এমন পরিবেশে বড় হচ্ছিল ফেলিক্স। শিশু বয়সেই সে পিতার সই জাল করা শিখেছিল; উদ্দেশ্য স্কুল পালানো। অর্থনৈতিক অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠলে ফেলিক্সের বাবা আত্মহত্যা করেন। নিরুপায় মা হোটেল খোলেন। বোন থিয়েটারের নর্তকি হন। ফেলিক্স পথে নামে সৌভাগ্যের খোঁজে। ফেলিক্স প্রথমে কৌশল করে জার্মান সেনাবাহিনীতে যোগদানের বিষয়টি এড়াতে পারে। এরপর সে ফ্রাঙ্কফুট যায়। সেখানে নাম-ডাক আছে এরকম এক গণিকার সহকারী হিসেবে কিছুদিন কাজ করে। তারপর প্যারিসে চলে আসে। এখানেই আরম্ভ হয় তার আসল কর্মকাণ্ড।
প্যারিসের এক হোটেলে লিফটবয়ের চাকরি নেয় ফেলিক্স। লিফটে ওপর-নিচ করে আর ভাবে, কীভাবে সে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে এ মহানগরে। তার আগে, সীমান্ত পাড়ি দেয়ার সময়, কাস্টমসে তল্লাশি চলাকালে ফেলিক্স এক মহিলার গয়নার বাক্স চুরি করে। তার হাতে এখন গয়না বিক্রির টাকা, পরিমাণে কম নয়। উপরন্ত ফেলিক্স সুঠাম শরীরের টগবগে যুবক। সে অফিস-আওয়ারে লিফট চালায় আর অন্য সময় ঘুরে বেড়ায় নানা জায়গায়। নিরুদ্বেগ দিন কাটছিল তার। ডানায় যেন পাখা গজিয়েছে। একদিন মধ্যবয়স্কা এক ধনী লেখিকা তার প্রতি আকৃষ্ট হন। কয়েকদিন পর লেখিকাটি ফেলিক্সকে রাতে ডাকেন এবং তার শয্যাসঙ্গিনী হন। ঘটনাচক্রে লেখিকা জানতে পারেন যে, তার হারিয়ে যাওয়া গয়নার বাক্সটি সরিয়েছে ফেলিক্স। কিন্তু মহিলার মধ্যে মনোবিচলনের কোনো ভাব দেখা যায় না। লেখিকার স্বামী খুবই ধনাঢ্য ব্যক্তি কিন্তু আহাম্মক ধরনের মানুষ। অলংকার চুরির বিষয়টি জানতে পারলে রেগে ওঠা তো দূরের কথা তাকে হয়তো অনেক বেশি পরিমাণ গয়না কিনে দেবেন। এরকম এটা-ওটা ভেবে লেখিকা ফেলিক্সকে বেশ কিছু টাকা দান করেন। আর্থিকভাবে বেশ সচ্ছল হয়ে ওঠে ফেলিক্স। তার আছে আরেক দুর্লভ সম্পদ ভরা যৌবন এবং সুঠাম দেহ। প্যারিসের নাইট-ক্লাবগুলোতে তার পা পড়তে শুরু করল। মহানগরীর নৈশ জীবনে, ক্রমে, সে হয়ে উঠলো প্লে-বয়।
দিনের বেলা হোটেলের সামান্য চাকুরে, রাতের বেলা মধুলোভী ভ্রমর। কিন্তু এর ভেতর ফেলিক্সের মর্মযাতনাও আছে। কারণ সে তো লিফটম্যান হতে চায়নি। সে চেয়েছে জীবনে সম্মানজনক প্রতিষ্ঠা, যদিও তা সুদূর পরাহত; কেননা অল্প বয়সেই সে চরিত্র খুঁইয়েছে। ফেলিক্সের ছিল মানুষকে ভোলোবাসার আশ্চর্য ক্ষমতা। তার রূপ-যৌবনে আকৃষ্ট এবং কথা-বার্তায় মুগ্ধ হয় এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর মেয়ে। মেয়েটি তার প্রেমে পড়ে। সে প্রেমের আকর্ষণ এমনই যে, সে ফেলিক্সের সঙ্গে বিছানায় যেতেও প্রস্তুত। ওদিকে বিহ্বল, অপ্রস্তুত ফেলিক্স সবিনয়ে এড়িয়ে যায় মেয়েটিকে। এ কঠিন মানস পরিস্থিতি কোনোমতে সামলে নেয় সে। এরপর ভেনোসতা নামের এক শিল্পীর সঙ্গে তার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হয়। ফেলিক্সের এ শিল্পী বন্ধুটি প্যারিসে এসেছে ছবি আঁকা শিখতে। জাজা নামে একটি তরুণীর সঙ্গে তার গভীর প্রেমের সম্পর্ক। শিল্পীর পিতা মার্কুইস ছেলের প্রতি রীতিমতো ক্ষিপ্ত। জাজা থিয়েটারে গান করে এবং সে মডেলও।
জাজার হাত থেকে ছেলেকে রক্ষা করার জন্য ভেনোসতার বাবা-মা এক ফন্দি আঁটেন। তারা সিদ্ধান্ত নেন, ছেলেকে এক বছরের জন্য বিশ্বভ্রমণে পাঠাবেন। যুক্তি দেন, এ ভ্রমণ তার শিল্পীমানসকে প্রসারিত করবে। ভোনোসতা পড়ে গেল বিপদে। একদিকে জাজার আকর্ষণ, অন্যদিকে পিতা-মাতার অবাধ্য হলে পারিবারিক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশংকা। এহেন উভয় সংকটে ফেলিক্স এগিয়ে আসে। মানুষ ভেনোসতা সম্বন্ধে আগে থেকেই তার কিছু ধারণা ছিল। এবার সে শিল্পী ভেনোসতার স্বভাবের খুঁটিনাটি জেনে নেয়। তারপর শিল্পীর বদলে সে বিশ্বভ্রমণে বেরিয়ে পড়ে। ভেনোসতার হাতের লেখা নিখুঁতভাবে নকল করে ভেনোসতা সেজে বাবা-মাকে চিঠিও লেখে।
এভাবে ফেলিক্স ঘুরতে ঘুরতে পর্তুগালে এসে পড়ে। রাজধানী লিসবনে একই সঙ্গে এক মা ও তার মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয় ফেলিক্সের। সম্পর্ক অচিরেই প্রেমের দিকে মোড় নেয়। এখানেই অসম্পূর্ণ অবস্থায় শেষ হয় উপন্যাসটি।
টমাস মান ১৯২৯ সালে নোবেল প্রাইজ জিতেছিলেন। দীর্ঘ আয়ু পেয়েছিলেন তিনি। মোটা মোটা বই লিখে অনেক গভীর ও নাতিগভীর ভাবনা তিনি শেয়ার করেছেন বিশ্বব্যাপী ছড়ানো পাঠকদের সঙ্গে। মান যেমন ভাবগম্ভীর প্রকৃতির লেখক তেমনি তার পাঠকরাও সচরাচর গম্ভীর। মান এবার চাইলেন গম্ভীর পাঠকের মুখে হাসি ছড়াতে। এ হাসি গভীর আত্ম উপলব্ধি এবং জটিল জীবন পরিস্থিতি থেকে উৎসারিত। ‘ঈড়হভবংংরড়হং ড়ভ ঋবষরী কৎঁষষ’ রচনার ভেতর দিয়ে তার ওই চাওয়া সার্থক হয়েছে। এ বই একটি সফল কমিক নভেল। এ ধরনের উপন্যাস জার্মান সাহিত্যে বিরল। মানের লেখার জাদুতে ফেলিক্স ক্রুল হয়ে উঠেছে বিশ্বসাহিত্যের স্মরণযোগ্য চরিত্র। লেখকের ব্যক্তিগত নোট থেকে জানা যায়, ফেলিক্সের গল্প একাধিক খণ্ডে শেষ করার ইচ্ছা ছিল টমাস মানের। কিন্তু তার আগেই চিরবিদায় নিতে হয় তাকে।
ফেলিক্সের মতো একটি নেগেটিভ চরিত্রের আড়ালে মর্মদহন বিরল দক্ষতায় তুলে আনতে পেরেছেন মান। আত্মসম্মানসচেতন ধনী লেখিকা (যিনি বুদ্ধিজীবীও বটে) শারীরিক পরিতৃপ্তির জন্য চাকরপ্রতিম এক ফিলট বয়ের (ফেলিক্স) কাছে নিজেকে সঁপে দিয়েছেন এবং পরে শিকার হয়েছেন অনিবার্য মানসিক অস্বস্তির। এসব বিষয়ও প্রশংসনীয় ভঙ্গিতে চিত্রিত করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। উপন্যাসটি মূলত কমিক মেজাজের হলেও তার ভেতরের অশ্র“বিন্দুগুলো তাকে দিয়েছে অনন্য উচ্চতা।
No comments