সরকার, তুমি কার? by হাসান ফেরদৌস
আমি বাংলাদেশ নিয়েই লিখতে বসেছি, তবে তার
আগে আমি আপনাদের এলিজাবেথ ওয়ারেনের সঙ্গে পরিচয় করাতে চাই৷ আমেরিকায়
ডেমোক্রেটিক রাজনীতিকেরা ‘এল’ (অর্থাৎ লিবারেল) শব্দটি ছিনেজোঁকের মতো
এড়িয়ে চলেন৷ অন্য যে নামে ইচ্ছা ডাকুন, কিন্তু লিবারেল বলা যাবে না৷ এর
এক ব্যতিক্রম এই এলিজাবেথ ওয়ারেন৷ দুই বছর আগে ম্যাসাচুসেটস থেকে মার্কিন
সিনেটে নির্বাচিত হওয়ার আগে থেকেই এলিজাবেথ আমেরিকার উদারনৈতিক মহলে
জনপ্রিয়৷ এ দেশে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের মধ্যে মস্ত বিবাদ হলো
সরকারের ভূমিকা নিয়ে৷ রক্ষণশীল রিপাবলিকানদের যুক্তি, সরকারের ভূমিকা যতটা
সম্ভব কাটছাঁট করতে হবে৷ কেউ কেউ সম্ভব হলে পুরো সরকার নামক প্রতিষ্ঠানটি
তুলে দিতে আগ্রহী৷ তা যখন পারা যাচ্ছে না, তখন নিয়মকানুন কমিয়ে এনে
ব্যবসা-বাণিজ্য ও নাগরিক জীবনের ওপর সরকারের হস্তক্ষেপ সীমিত করতে হবে৷
অন্যদিকে, উদারনৈতিকদের বক্তব্য, সরকারের ভূমিকা খাটো করে আনার ফল দাঁড়াবে
বাজারব্যবস্থার ওপর সব দায়দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া৷ তাতে অবশ্য ধনী ও
ক্ষমতাবানদের কোনো সমস্যা নেই৷ কিন্তু যারা অভাবী ও অক্ষম, তাদের সাহায্য
করার আর কেউ থাকবে না৷ সরকারের একটা বড় কাজই হলো এই ক্ষমতাহীনদের পাশে
দাঁড়ানো৷
একসময় এডওয়ার্ড কেনেডি অথবা টিপ ও’িনলের মতো রাজনীতিকেরা গর্বের সঙ্গে উদারনৈতিক নামের চাদর গায়ে জড়াতেন৷ বিল ক্লিনটন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে সে চাদর ছুড়ে ফেলে নিজেদের মধ্যপন্থী হিসেবে প্রমাণ করার৷ অধিকাংশ সামাজিক প্রশ্নে তাঁরা উদারনৈতিক হবেন, কিন্তু অর্থনীতির কথা উঠলে বাজারব্যবস্থার ওপর আর কোনো বড় বাপ নেই৷ এখানে তাঁদের সঙ্গে রিপাবলিকান রক্ষণশীলদের কোনো তফাত নেই৷
এই নিয়মের এক বড় ব্যতিক্রম এলিজাবেথ ওয়ারেন৷ এমনিতে হার্ভার্ডের অধ্যাপক, কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের মতো ধৈর্য ও স্বচ্ছতা নিয়ে তিনি সরকারের ভূমিকা প্রশ্নে বিরুদ্ধবাদীদের সব যুক্তি-তর্ক খণ্ডন করে চলেছেন৷ স্বাভাবিকভাবেই রিপাবলিকানরা তাঁকে দুচক্ষে দেখতে পারেন না, কিন্তু দেশের উদারনৈতিক মহলে তিনি ‘ডার্লিং’৷
এলিজাবেথ ওয়ারেনের যুক্তিগুলো খুব স্পষ্ট৷ যারা সরকারের ভূমিকা ‘ফুঁ ফুঁ’ করে উড়িয়ে দেয়, তাদের উদ্দেশে তাঁর প্রশ্ন, ঠিক আছে, তোমরা সরকার চাও না৷ তাহলে বিমানে চলাচলের জন্য তোমাদের কোনো ট্রাফিক কন্ট্রোলারের প্রয়োজন নেই৷ ফুড ইন্সপেক্টররা কী বলল, তা জানার অপেক্ষা না করেই তোমরা খাবার কিনে খাবে৷ ঘরে আগুন ধরলে নিজেরাই তা নেভাবে, তার জন্য কোনো সরকাির দমকলকর্মীর প্রয়োজন নেই৷
সরকারের ভূমিকাকে বাদ দিতে চায় কারা, সে ব্যাপারেও এলিজাবেথ ওয়ারেন স্পষ্টবাক৷ যারা কোনো জবাবদিহির বিপক্ষে, যারা কর ফাঁকি দিতে চায় বা চুরি করে ফায়দা লোটে, একমাত্র তারাই চায় সরকার দুর্বল হোক৷ যারা সবল, যাদের পকেটে রেস্ত আছে, ঘরে ডাকাত পড়লে যারা নিজেরা লাঠি-বন্দুক নিয়ে প্রতিরোধ করতে পারে, তাদের সরকার না হলেও চলে৷ কিন্তু যারা দুর্বল ও অভাবী, বিপদের সময় যাদের পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই, সরকার ছাড়া, বিশেষ করে গণকল্যাণমুখী সরকার ছাড়া, কার মুখের দিকে তারা তাকাবে?
এলিজাবেথ সম্প্রতি ফাইটিং চান্স নামে আত্মজৈবনিক একটি বই লিখেছেন৷ স্মৃতিকথা, নিজের বড় হয়ে ওঠার গল্প, কিন্তু তারই ফাঁকে ফাঁকে তাঁর লড়াইয়ের কাহিনি৷ অর্থনীতি প্রশ্নে নীতিনির্দেশক বিভিন্ন পরামর্শও রয়েছে৷ এলিজাবেথ ওয়ারেনের সমীকরণ অনুসারে, আমেরিকার সরকার সাধারণ মানুষের স্বার্থ রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত নয়৷ যে ধনিক গোষ্ঠীর কোলে চেপে তারা ক্ষমতায় বসে, দেশের তাবৎ আইনকানুন করা হয় তাদের স্বার্থ সুরক্ষার কথা মাথায় রেখেই৷ অতএব, এলিজাবেথের সরল উপসংহার, এই সরকার আমার নয়৷ চলতি সরকারব্যবস্থার আগাপাছতলা না বদলালে দেশের বৃহদংশ মানুষের অধিকার সংরক্ষিত হবে না৷
আমেরিকার শাসনব্যবস্থার যে গঠনকাঠামো, তাতে ক্ষমতার গোছা ধরা থাকে ক্ষমতাবান একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর হাতে৷ যাদের হাতে টাকার গোছা, রাজনীতির সব কলকাঠি তারাই নাড়ে৷ বাংলাদেশের সঙ্গে আমেরিকার রাজনীতির কাঠামোগত কোনো সমতা নেই, কিন্তু এই এক ক্ষেত্রে তারা যেন গলায় গলায় সই৷ সবচেয়ে যারা অসৎ, তারাই সবচেয়ে অধিক ক্ষমতার অধিকারী৷ রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারের ক্ষমতাও তাদের সর্বাধিক৷ এই সাধারণ মিল সত্ত্বেও একটা জায়গায় আমেরিকার সঙ্গে বাংলাদেশের মস্ত ফারাক৷ হ্যঁা, এ কথা ঠিক, এ দেশের সরকারও গৃহস্থের বদলে চোরের পাহারায় অধিক ব্যস্ত৷ কিন্তু একবার যদি সে চোর ধরা পড়ে, রক্ষা পাওয়া তার জন্য খুব সোজা নয়৷
বাংলাদেশের বেলায় যে চোর, সে-ই পুলিশ৷ আপনি যদি টাকার পাহাড়ের মালিক হন, সাত খুন করেও মাফ পেয়ে যাবেন৷ আমি কথাটা আক্ষরিক অর্থেই বলছি৷ ভাবুন, মাত্র ছয় কোটি টাকা দিয়ে আপনি সাতজন মানুষ খুন করে তাদের লাশ নদীতে ভাসিয়ে দিতে পারেন৷ আরও ছয় বা তার চেয়ে কিছু বেশি মালকড়ি ঢাললে খুনের সরদারকে (অর্থাৎ, যার টাকায় খুন হলো) বিদেশে পাচার করা যায়৷ এর সবটাই বেআইনি, অথচ কোনোটাই বেআইনি নয়৷ খোদ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাই যদি এই মহান দায়িত্ব পালনে নেতৃত্ব দেয়, তাহলে তাকে বেআইনি বলার কোনো সুযোগই তো থাকে না৷
দেশের শাসনব্যবস্থা এখন কতটা অসুস্থ, গলা-পচা আকার নিয়েছে, তা বোঝার জন্য শুধু র্যাবের দিকে তাকিয়ে দেখুন৷ এরা আমাদের দেশের সবচেয়ে এলিট নিরাপত্তা বাহিনী৷ এত দিন পত্রপত্রিকায় অভিযোগ ছিল, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার কাজে র্যাবকে ব্যবহার করা হয়েছে৷ কিন্তু এখন দেশের প্রধানমন্ত্রী নিজে বলেছেন, বিগত সরকারের আমলে র্যাবের হাতে মানুষ খুন হতো৷ সম্প্রতি খালেদা জিয়া র্যাবকে বিলুপ্ত করা না হলে আন্দোলন করা হবে বলে হুঁশিয়ারি দিলে তাঁর জবাব হিসেবে ১৪ মে গণভবনে দলের কার্যনির্বাহী সংসদের সভার সূচনা বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যখন র্যাব দিয়ে বিএনপির নেত্রী হত্যা করতেন, তখন ভালো ছিল৷ অপারেশন ক্লিন হার্টে হত্যা করে দায়মুক্তি দিয়েছিলেন৷ এখন ব্যবহার করতে পারছেন না৷ এ জন্যেই র্যাব বন্ধের কথা বলছেন৷’ (প্রথম আলো, ১৫ মে, ২০১৪)
কী ভয়াবহ কথা! প্রধানমন্ত্রী নিজে জানাচ্ছেন, এই র্যাব একসময় মানুষ খুন করত৷ তিনি সে কথা জানেন, অথচ তাঁদের কারও বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নিয়েছেন, কই, এমন কথা তো শুনিনি! এখনো যাঁরা আইন-নিরাপত্তাব্যবস্থার দায়িত্বে, তাঁরা তো সেই বাহিনীরই লোক৷ সেই একই লোক, কাজকর্মেও কোনো পরিবর্তন নেই৷ তাহলে জেনেশুনে এমন লোকদের পেলেপুষে রাখা কেন? এমন অবস্থা বদলই বা হবে কবে, কীভাবে?
এ প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য কার কাছে যাব, তা আমার জানা নেই৷ গত্যন্তর না পেয়ে আমি এলিজাবেথ ওয়ারেনের শরণাপন্ন হতে মনস্থ করেছি৷ তাঁর বই পড়ে শিখেছি, সরকার অনেকটা ফুলগাছের মতো৷ সময়মতো যত্ন না পেলে, তাতে আগাছা জন্মে, পরগাছা সেখানে আশ্রয় নেয়৷ সত্যিই তো, যেসব খুনি সরদার এখন দাবি করছে, তারা ফুলের মতো পবিত্র, সুবহে সাদিকে ঘুম ভেঙে তারা তাহাজ্জতের নামাজ আদায় করে, তারা আসলে তো ওই পরগাছা৷ সরকার নামক বটবৃক্ষের গা ঘেঁষে তারা দিব্যি হাত-পা ছড়িয়ে বেঁচে থাকে৷
এই অবস্থা বদলাবেন কী করে? এলিজাবেথ ওয়ারেন তাঁর নিজের জীবনের উদাহরণ দিয়ে বলছেন, সমাজ ও সরকার বদলাতে হলে লড়তে হয়৷ আর সে লড়াই দীর্ঘ ও বন্ধুর৷ খুব সহজে বিজয় আসে না, কিন্তু একদম কখনো বিজয় অর্জিত হবে না, সে কথাও সত্যি নয়৷ প্রমাণ এলিজাবেথ নিজে৷ সব প্রতিকূলতা অতিক্রম করে তিনি সিনেটর নির্বাচিত হয়েছেন৷ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের জন্য যে এজেন্সির প্রস্তাব তিনি রেখেছিলেন, এখন তা বাস্তবে পরিণত হয়েছে৷ ব্যাংকিং-ব্যবস্থার ওপর নানাবিধ নজরদারিমূলক আইনকানুন হয়েছে, তাও মুখ্যত তাঁর নেতৃত্বে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের কারণেই৷
আহা, একজন এলিজাবেথ ওয়ারেনের জন্য আরও কত দিন আমাদের অপেক্ষা করতে হবে?
২৭ মে, ২০১৪, নিউইয়র্ক
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
No comments