ভুল সবই ভুল by শামীমুল হক
‘জাইগ্গা না করি রাও/বুঝি হগল কতার বাউ’-
গ্রামবাংলার প্রচলিত একটি প্রবাদ। আসলে আমজনতা সর্বদাই জেগে থাকে। তাদের
চোখ-কান সবসময় খোলা থাকে। কে কি বলছেন তারা সবই বোঝেন। কিন্তু তাদের মুখে
কুলুপ আঁটা থাকে। তারা কোন কথা বলেন না। সময়মতো প্রতিশোধ নেন। মানে নিতেন।
এখন এই প্রতিশোধ নেয়াতেও বাধা। অর্থাৎ তারা প্রতিশোধ নিতে পারবেন না।
তাদের
শুনেই যেতে হবে। বলতে পারবেন না। রাগে ক্ষোভে কিড়মিড় করলেও কিছু করার নেই।
২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে তাদের সেই অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। আর
পাঁচ ধাপে হওয়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচন একেবারে তা খোলাসা করে দিয়েছে। দেশের
মালিক জনগণকে হাত-পা বেঁধে বদ্ধ ঘরে তালা মেরে দেয়া হয়েছে। মুখে দেয়া
হয়েছে স্কচটেপ। চিৎকারও করতে পারবেন না দেশের মালিকরা। এ যেন নিজ দেশে
পরবাসী অবস্থা। নির্বাচন কমিশন তাতেই খুশি। মহাখুশি। আর তা-ই তারা জোর গলায়
বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিয়েছে। রাজনৈতিক
নেতার মতো বক্তব্য দিয়ে আলোচনায় এসেছেন এক কমিশনার। সাংবিধানিক পদে থেকে
এভাবে কেউ কথা বলতে পারেন কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে সুশীল সমাজ। আর
সাবেক মন্ত্রী সুরঞ্জিৎ সেনগুপ্ত তো নিয়েছেন এক হাত। বিএনপির স্থায়ী কমিটির
সদস্য গয়েশ্বর রায় আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, ‘থুথুর মধ্যে গোসল করাবো
মোবারক সাহেবকে।’ এসব দেখে হয়তো রক্তে কেনা গণতন্ত্র আজ ডুকরে কাঁদছে।
স্বাধীনতা হয়তো বিদ্রূপ করছে। দেশের রাজনীতিকরা একদিনের গণতন্ত্রকেও গ্রহণ
করতে পারেননি? পাঁচ বছরে একদিন হয় ভোট। আর ওই দিনই দেশের মালিক জনগণ মনে
করেন তারা সত্যিকার অর্থেই দেশের মালিক। আর বাকি ৪ বছর ৩৬৪ দিন রাজনীতিকরা
গণতন্ত্রকে তাদের হাতে বন্দি করে রাখেন। তারা যা বলেন দেশে তা-ই হয়। তারা
যা করেন তা-ই ঠিক। তারা যদি বলেন, সূর্য আজ পশ্চিম দিকে উঠেছে তা-ও ঠিক।
যদি বলেন, সূর্য পূর্ব দিকে অস্ত গেছে- তাও ঠিক বলে ধরে নেন জনগণ। এভাবেই
দিন যায়, সপ্তাহ যায়, মাস যায়, বছর যায়। ৪ বছর ৩৬৪ দিন পর আসে জনতার দিন।
ওই একটি দিনও কেড়ে নেয়া হলো জনতার কাছ থেকে। কিন্তু কেন? এই দিনটিও তাদের
হাতে দেশকে ছেড়ে দেয়া যায় না? দাদা বললেন, আরে বোকা! ওই দিনটিই তো আসল। ওই
দিনেই তো রাজনীতিকদের ভাগ্য নির্ধারণ হয়। কাজেই জনতার হাতে ছেড়ে দিলে
ভাগ্যের চাকা যদি ঘুরে যায় তাহলে তো সর্বনাশ। এর চেয়ে না দেয়াই তো অনেক
ভাল। এর জন্যই তো দেশে এত কিছু হয়ে গেল। ‘গণতন্ত্র’ ‘গণতন্ত্র’ বলে চিৎকার
করলেও কেউ দেশের মালিকের কাছে একদিনের জন্য ক্ষমতা ছাড়তে রাজি নন। কারণ
তারা দেশের মালিকদের বিশ্বাস করেন না। দেশের মালিকদের ওপর তাদের আস্থা নেই।
কারও আস্থা কেন্দ্র দখলের ওপর। কারও আস্থা ভোট ডাকাতির ওপর। কারও আস্থা
বিদেশী রাষ্ট্রদূতদের ওপর। কারও আস্থা হেফাজতের ওপর। দেশের মালিকের ওপর
কারও আস্থা নেই। আর আস্থা নেই বলেই দেশের মালিকরাও চুপ করে বসে আছেন। তারা
হিসাব কষছেন। যোগ বিয়োগ করছেন। আর কানে কানে বলছেন, এভাবে দেশ চলতে পারে
না। চলতে দেয়া যায় না। কাজেই এর প্রতিবাদ জানাতে হবে। সবাইকে নিজের অধিকার
আদায়ে সোচ্চার হতে হবে। রাজনীতিকদের বোঝাতে হবে আপনারা যা করছেন তা ঠিক নয়।
আপনারা ভুল পথে হাঁটছেন। ভুল পথে চলছেন। এ পথে চললে একদিন পা পিছলে পড়ে
যেতে হবে। দেশের মালিক হিসাবে আপনাদের সচেতন করাও আমাদের কাজ। কাজেই দয়া
করে কেউ ভুল পথে হাঁটবেন না। ভুলকে আঁকড়ে থাকবেন না। তাহলে একদিন ভুল সবই
ভুল বলে মাথা চাপড়াবেন। দেশের মালিক হয়ে এ দৃশ্যও জনতা দেখতে চায় না। তারা
চায় রাজনীতিকরা দেশ চালাবেন। দেশের মঙ্গলে কাজ করবেন। দেশের মালিক জনতা
রাজনীতিকদের নিয়ে গর্ববোধ করবেন। দাদা বললেন, এটা এদেশে কখনও হবে কি? আপাত
দৃষ্টিতে দেখলে মনে হয় আমরা এক অন্ধকারে ডুবে আছি। সামনে কি হবে? কি ঘটতে
যাচ্ছে? কিছুই আমাদের জানা নেই। আমরা সবাই রাতের অন্ধকার পেরিয়ে ভোরের আলো
দেখতে চাই। কিন্তু এ রাত কত দীর্ঘ, এ রাত কখন পোহাবে এর উত্তর জানা নেই
কারও। সবাই এক অনিশ্চিত যাত্রায় হাঁটছে। গন্তব্য কোথায় কেউ জানে না। কত দূর
হাঁটতে হবে তা-ও জানা নেই। মাঝে মাঝে মনে হয় এরশাদ আর রওশনের মতো এক ঘরের
বাসিন্দা হয়ে বাস করছি যোজন যোজন দূরে। যা দেখে জনতা বলে ওঠেন, ‘জাইগ্গা না
করি রাও/বুঝি হগল কথার বাউ।’
No comments