বিষাদাচ্ছন্ন সোমবার by কাজল ঘোষ
ক ’মাস ধরেই ভেতরে শূন্যতা অনুভব
করছিলাম। সেই শূন্যতা এত দ্রুতই প্রলম্বিত হবে ভাবিনি। কোটি মানুষের এই
শহরে এত মানুষ তবু কি যেন নেই। তাঁকে নিয়ে হাজারো স্মৃতি। কর্মব্যস্ত
নগরীতে রাত পোহালে যে ছোটাছুটির মধ্যেও এই মানুষটি আর কোনও দিন ফোনে জানতে
চাইবেন না, টকশোতে আছি, না-নাই। এটা শেষ পাঁচ, ছ’ বছরের নিয়মিত ঘটনা।
রাত
১২টায় চ্যানেল আই-তে প্রচারিত ‘গ্রামীণফোন আজকের সংবাদপত্র’ অনুষ্ঠানে
নিয়মিত আলোচক ছিলেন। সপ্তাহ ঘুরে সোমবার সকালে ফোনের ও প্রান্ত থেকে উদ্বেগ
আর জোরালো কণ্ঠের এমন জিজ্ঞাসা শুনেছি শ্রদ্ধাভাজন মূসা ভাইয়ের। যে কোনও
প্রতিকূল অবস্থাতেও মূসা ভাইকে দমতে দেখেনি। কখনও ভয় নিয়ে বা উদ্বেগ নিয়ে
টকশোতে কথা বলতে শুনিনি। মূসা ভাই যা ভাবতেন, যা বিশ্বাস করতেন অবলীলায় তাই
বলতেন। কখনও কখনও বিশেষ পরিস্থিতিতে মূসা ভাইকে রয়ে-সয়ে বলতে অনুরোধ করিনি
তা নয়। সাফ বলতেন, আমার কথা আমি বলবো। আমি এবিএম মূসা। এটাই আমার পরিচয়।
ওয়ান ইলেভেনে সেনা সমর্থিত সরকারের সময় বিভিন্ন স্থান থেকে খবর আসছিল
টকশোতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ হচ্ছে। অনেক অতিথির বিষয়েই গাইডলাইন আসছে।
রিপোর্টারদের নানা স্থান থেকে হুমকি-ধমকি দেয়া হচ্ছে। বাঘা বাঘা সম্পাদকরা
যখন চুপ আছেন সব জেনেও। মূসা ভাই এক সকালে প্রেস ক্লাবে আতাউস সামাদ, ফয়েজ
আহমদকে নিয়ে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার ডাক
দিলেন। এবিএম মূসা বঙ্গবন্ধুকে অন্ধের মতোই ভালবাসতেন। আর বঙ্গবন্ধু
কন্যাকে স্নেহের চোখে দেখা এই মানুষটি হাসিনা সরকারের প্রতিটি কাজের কঠোর
সমালোচনা করেছেন। তীব্র চাপও সইতে হয়েছে। সিঁধেল চোর আর মানসিক ভারসাম্যহীন
এই অভিধাও দিয়েছেন সরকারের মন্ত্রী-নেতারা। তাতে কি তিনি দমেছেন? বরং
সরবেই বলতেন, মানুষ রাত জেগে অপেক্ষায় থাকে সত্য শোনার জন্য। আমার পক্ষে
কারও জন্যে দালালি সম্ভব নয়। মানুষটি ৯ই এপ্রিল আমাদের ছেড়ে বিদায় নিয়েছেন।
শেষ দেখা হয়েছিল ২৮শে ফেব্রুয়ারি। জন্মদিনে। স্ট্রেচারে বসেই জিজ্ঞেস
করেছিলেন, ঘোষবাবুর খবর কি? তোর এডিটর কেমন আছে? তারও আগে ল্যাবএইডে দেখা
হয়েছে জানুয়ারিতে যখন চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। মুখ ফিরিয়ে বলছিলেন, আর টকশোতে
যাবো কিনা বুঝতে পারছি না। খোঁজ নিয়েছেন, কারা আসেন আর কে কি বলছেন। আমি
তথ্য দেয়ার আগেই তিনি বলতে শুরু করলেন, কে কে এই মুহূর্তে ব্ল্যাকলিস্টেড।
কাদেরকে টকশোতে আনা নিয়ে নজরদারি চলছে। লম্বা আড্ডার ফাঁকেই মূসা ভাই
উদ্বেগ নিয়ে বলছিলেন, কবে থেকে আবার হাঁটতে পারবো বুঝতে পারছি না। এক গাদা
রোগের ভিড়েও স্মৃতি থেকে নানা গল্পে মেতে ছিলেন। মূসা ভাইয়ের সঙ্গে প্রথম
দেখা বেইলি রোডে চ্যানেল আই স্টুডিওতে। তা-ও প্রায় ১৫ বছর হতে চললো। টকশোর
সুবাদে প্রায় প্রতিদিনই কথা হতো। অন্যান্য দিনের মতোই এক রাতে মূসা ভাই
অতিথি। নির্ধারিত সোমবার রাত পৌনে ১২টার মধ্যেই পৌঁছে যান তিনি। এটাই চলছে
বছরের পর বছর। মতি ভাইয়ের সঙ্গে অনুষ্ঠানের আলোচ্যসূচি নিয়ে কথা বলার পর
খেয়াল হলো ঘড়ি বারোটা ছুঁই ছুঁই। মূসা ভাই তখনও পৌঁছাননি। কোন সমস্যা হয়নি
তো? বার বার ফোনে চেষ্টা করেও সংযোগ বিচ্ছিন্ন আসছে। অনেক কষ্টে পরিবারের
সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেলো কখন মূসা ভাই ঘুমিয়ে গেছেন খেয়াল করতে
পারেননি। সঙ্গে সঙ্গেই মূসা ভাই রওনা হলেন। টেলিভিশনের সময় মেপে মেপে ভাগ
করা। অন্যদিকে দর্শকের অপেক্ষা। মতি ভাই সেদিনের মতো শিরোনাম পড়েই অনুষ্ঠান
শেষ করলেন। মূসা ভাই যখন ঢুকছেন ঠিক তখনই অনুষ্ঠানের ইতি টানছিলেন মতি
ভাই। কথা বলে জানলাম, অতিরিক্ত ঔষধ সেবনে ঘুম এসে গিয়েছিল। এতটা অপরাধী ও
বিব্রত মূসা ভাইকে কখনও দেখিনি। ফিরতে ফিরতে রাতে একাধিকবার ফোনে কথা বললেন
মূসা ভাই। পরদিন সকালেও মূসা ভাইয়ের দুঃখ প্রকাশ। এটা শেষ হলো এরপর যেদিন
তিনি অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে এলেন সেদিন। সরাসরি দর্শকের কাছে দুঃখ প্রকাশ ও
ক্ষমা চাওয়ার মধ্য দিয়ে। রাতে চ্যানেল আইতে যাওয়ার সময় ফোনে জিজ্ঞেস করতেন,
ঘোষবাবু তোমাকে কোত্থেকে ওঠাতে হবে। অনেক দিন গভীর রাতে তিনি বাসায়ও পৌঁছে
দিয়েছেন। ব্যক্তিগত এক অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ করতে গিয়ে মূসা ভাইকে অসুস্থ
অবস্থায় সিঙ্গাপুর রওনা হতে দেখলাম। ব্যস্ততাতেও নিমন্ত্রণ গ্রহণ করে
বললেন, দোয়া কোরো যেন ভালো হয়ে ফিরি আসি তখন যাবো। অবাক হয়েছিলাম, সেই
নিমন্ত্রণে মূসা ভাই এসে আমাকে একটি ল্যাপটপ গুঁজে দিয়ে বলেছিলেন-
প্যাড-কলমের দিন শেষ, ডিজিটাল বাংলাদেশ। আশীর্বাদ করি তুমি ডিজিটাল
সাংবাদিক হও। যে কোনও বিষয়ে অনুসন্ধিৎসু ছিলেন মূসা ভাই। ফোনে প্রায় দিনই
রিপোর্টের ফলোআপ করতে বলতেন। নতুন নতুন রিপোর্টের আইডিয়া দিতেন। পেশাগত
প্রয়োজনেই দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিকে একাধিকবার মূসা ভাইয়ের সাক্ষাৎকার
নিতে হয়েছে। প্রতিটি সাক্ষাৎকারেই সময়ের সবচেয়ে স্পষ্ট উচ্চারণ করেছেন। সকল
ব্যস্ততাতেও নেয়া সাক্ষাৎকার অথবা লেখা অন্ততঃ দু থেকে তিনবার প্রুফ দেখে
চূড়ান্ত সম্পাদনা করে ছাড়তেন। শেষ এক বছর প্রায়ই বিভিন্ন স্বাস্থ্য
পরীক্ষার কাজে মূসা ভাইকে ল্যাবএইডে যেতে হতো। সেখান থেকেই রাতে টকশো দেখে
তিনি কথা বলতেন আলোচক-উপস্থাপকের সঙ্গে। আলোচনার নানা দিক বিশ্লেষণ করতেন।
কখনও আসতে পারবেন না এটা আগেই জানতেন। একদিন অফিস থেকে মূসা ভাইয়ের সঙ্গে
প্রেস ক্লাব যাচ্ছি সোনারগাঁও সিগন্যালে গাড়ি থামতেই কাচ নামিয়ে ভিক্ষুককে
দেখলাম পয়সা নয়, বিস্কিটের প্যাকেট দিতে। জানতে চাইলে বললেন, পয়সা দেয়ার
চেয়ে খাবার দেয়া ভাল। গত বছরের শারদীয় দুর্গোৎসবে অবাক হয়েছিলাম একটি
এসএমএস পেয়ে। মূসা ভাই লিখেছেন, তোমাকে ও বৌমাকে শারদীয় শুভেচ্ছা। মূসা ভাই
চলে গেছেন এটাই চিরায়ত সত্য। আর ফিরবেন না। ধ্রুবসত্য তা-ও। শুধু রয়ে যাবে
ব্যক্তি এবিএম মূসার সাংবাদিকতা নিয়ে স্পষ্ট উচ্চারণ। আর আমার মন পড়ে
থাকবে সেই স্নেহার্দ্র উচ্চারণ, কাজল ভোমরা কই? বিচ্চুর যন্ত্রণায় টকশোতে
না এসে পারি না। মতি, তোর বিচ্ছু কই।
No comments