এক অপূরণীয় শূন্যতা by রিয়াজউদ্দিন আহমেদ
প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসা’র মৃত্যুতে
সাংবাদিকতা পেশায় সৃষ্টি হয়েছে এক শূন্যতা। তাকে ছাড়া এ পেশা এখন অনেকটাই
দুর্বল হয়ে পড়েছে। তিনি ছিলেন সত্যিকার পেশাদার সাংবাদিক। সহকর্মীদের কাছে
তিনি ছিলেন আত্ম-উৎসর্গীকৃত একজন শিক্ষকের মতো। জাতির কাছে তিনি ছিলেন একজন
মুরব্বি। তার শক্তিশালী কলম ও জোরালো বক্তব্যে মহাক্ষমতাধররাও ভীত ছিল।
যেসব ঘটনায় দেশবাসী ও দেশের ক্ষতি হয় এমন ইস্যুতে তিনি কখনও নীরব দর্শকের
মতো থাকতেন না। দেশবাসী ও দেশের বিরুদ্ধে এমন অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি কড়া
ভাষায় প্রতিবাদ করেছেন। তিনি জানতেন যে, প্রতিটি জাতিরই একটি সঙ্কটময় সময়
থাকে। তখন নীরবতা হলো অপরাধ। তিনি এই অপরাধ কখনও করেন নি। সব অবিচারের
বিরুদ্ধে তিনি সব সময় তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। কথা বলেছেন গণতন্ত্রের পক্ষে,
মানবাধিকারের পক্ষে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে ও সততার পক্ষে।
আমরা এমন এক সময়ে মূসা ভাইকে হারিয়েছি যখন তার মতো সাহসী মানুষের বড়ই প্রয়োজন এ জাতির। তিনি কখনও শাসকের রক্তচক্ষুকে ভয় পান নি। হোক সে শাসক গণতান্ত্রিক অথবা স্বৈরাচার। গত কয়েক বছর ধরে তিনি রাজনীতি ও নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে পরামর্শ দিচ্ছিলেন। তার এ পরামর্শ জাতিকে দিতে পারতো স্থিতিশীলতা ও গণতন্ত্র হতো শক্তিশালী। ৫ই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের আগের তিন মাস যখন জাতি বিশৃঙ্খলায় নিমজ্জিত হয়, আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে তখন তার পূর্বাভাস সত্যে পরিণত হয়। তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, নির্বাচনকালে যদি নির্দলীয় সরকারের দাবি মেনে নিতে ব্যর্থ হয় ক্ষমতাসীন দল তাহলে দেশে গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি দেখা দেবে। তার এ পূর্বাভাস সত্য হয়েছিল। কিন্তু এ মন্তব্যের কারণে এবিএম মূসাকে সরকারের সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব থেকে তিক্ত সমালোচনা করা হয়। তিনি ছিলেন আপসহীন। তাই তার সততা ও স্বাধীনতা যুদ্ধে সাহসী ভূমিকাকে খাটো করে দেখা হয়।
আমার সৌভাগ্য হয়েছিল পাকিস্তান অবজারভারে মূসা ভাইয়ের সঙ্গে কাজ করার। সেখানে ১৯৬৮ সালে আমি একজন রিপোর্টার হিসেবে যোগ দিই। তিনি ছিলেন আমার পথপ্রদর্শক ও শিক্ষক। একজন বার্তা সম্পাদক হিসেবে মূসা ভাই ছিলেন সেরাদের অন্যতম। খবর সম্পর্কে তার সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টিভঙ্গি, দ্রুততার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা ও কোন খবর কিভাবে পরিবেশন করা হবে এ বিষয়ে যথার্থ বোধ থাকায় তখনকার পাকিস্তান অবজারভার এ অঞ্চলের সেরা পত্রিকাগুলোর অন্যতম হয়ে ওঠে। এবিএম মূসা ও কিংবদন্তি সম্পাদক আবদুস সালামের অধীনে কাজ করতে পেরে আমরা গর্বিত। মূসা ভাইয়ের শ্বশুর সম্পাদক আবদুস সালাম। কিন্তু পেশাগত দায়িত্বের সময় তাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিষয় কখনও সামনে আসতো না। সাংবাদিকতার মূলনীতির প্রতি তারা দু’জনেই ছিলেন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কমনওয়েলথ ইন্সটিটিউট ও থমসন ফাউন্ডেশন থেকে সাংবাদিকতায় প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল মূসা ভাইকে। হাওয়াইয়ের ইস্ট-ওয়েস্ট সেন্টারও তাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে।
মূসা ভাইয়ের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা চমৎকার। তিনি রিপোর্টারদের দিকনির্দেশনা দিতেন, পরিকল্পনা দিতেন। তখনকার পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যে বৈষম্য তা তুলে ধরতে তিনি সিরিজ রিপোর্টের পরিকল্পনা করতেন। ওই রিপোর্টগুলো স্বায়ত্তশাসন অথবা ৬ দফা আন্দোলনকে বেগবান করেছে। ‘মিস্টার অবজারভার’-এর মতো রিপোর্টের পরিকল্পনা করতেন, যিনি দেশের বিভিন্ন স্থান সফর করে সমস্যাগুলো তুলে ধরবে। এমন সিরিজ রিপোর্টের কারণে পাঠকদের বড় অংশের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল ওই পত্রিকাটি।
মূসা ভাইয়ের সঙ্গে কাজ করা সব সময়ই ছিল আনন্দের। সরকার ও মালিকের রোষানল থেকে সহকর্মীদের রক্ষা করতেন তিনি। ক্ষমতাধর ও সহকর্মীদের মাঝে তিনি ছিলেন একটি দেয়ালের মতো। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন যে, বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ করা কঠিন। কারণ, তাতে অপরাধীর গায়ে দাগ কাটে। আর এর জবাবে সে তোমাদের গায়ে আঁচড় লাগাবে। কিন্তু তাই বলে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে কোন সমঝোতা করা চলবে না। আমার মতো তরুণ রিপোর্টারদের তিনি বলতেন যে, তোমাকে জানতে হবে কিভাবে সাঁতরাতে হবে এবং তোমাকে অবশ্যই কুমিরকে এড়িয়ে সাঁতরাতে হবে। মূসা ভাই কুমিরকে এড়াতে পারেন নি। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তাকে শুনতে হয়েছে তিক্ত সমালোচনা। সাবেক একজন এমপি হওয়া সত্ত্বেও তার জানাজা জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় করার অধিকার দেয়া হয় নি। এমন রূঢ় সিদ্ধান্ত মূসা ভাইয়ের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করবে এবং কালো শক্তিকে ইতিহাসের ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করবে। মূসা ভাই গৌরবের সঙ্গে মৃত্যুকে বরণ করেছেন। তিনি একজন সফল সাংবাদিক এবং একজন সফল মানুষ। আমরা তার আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থনা করি।
No comments