জাতীয় উন্নয়নে বহুতল ভবনের প্রভাব by ডি এম মওদুদ চৌধুরী
ছোট এই বাংলাদেশে ৫৬,০০০ বর্গমাইল এলাকায় প্রায় ১৬
কোটি লোকের বাস। এই ঘনবসতিপূর্ণ দেশে সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার সকলের
কাম্য। কৃষিপ্রধান এই দেশে সীমিত সম্পদের মধ্যে জমি সর্বপ্রথম বিবেচনায়
আসে।
আবাসনের জন্য জমির ব্যবহার যত কম হবে তত বেশি জমি কৃষি, জলমহাল,
বনাঞ্চল ইত্যাদির জন্য অবশিষ্ট থাকবে। জলমহাল ও বনাঞ্চলের জন্য যথেষ্ট
পরিমাণ জায়গা না থাকলে দেশে ঘন ঘন বন্যা, দুর্যোগ দেখা দেবে। এই অবস্থায়
আবাসনের জন্য জমির ব্যবহার কমানোর লক্ষ্যে বহুতল ভবন নির্মাণ ছাড়া উপায়
নেই। সিঙ্গাপুর সহ পৃথিবীর বড় বড় শহরে ইতিমধ্যে বহুতল ভবন নির্মাণ ও তার
বহুমুখী ব্যবহার চালু আছে। বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য ব্যবহৃত জমির পরিমাণ
কম লাগবে। কৃষি, জলমহাল, বনাঞ্চলের জন্য অধিক জমি অবশিষ্ট থাকবে। অবকাঠামো
খরচ কম হবে। ভবন নির্মাণে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং খরচ কিছুটা বেশি হলেও নির্মাণ
খরচ তুলনামূলকভাবে অনেক কমবে। ভবন নির্মাণে জমির পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম
ব্যবহার হবে, নির্মাণ সামগ্রী একই স্থানে রাখা যাবে ফলে ভবন নির্মাণ খরচ
স্বাভাবিকভাবেই কমে যাবে। ভবন মাল্টিপারপাস হিসেবে ব্যবহার করলে
কাঁচাবাজার, গাড়ির পার্কিং, শপিং কমপ্লেক্স, স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত,
বাসস্থান একই ভবনে থাকবে। একই ভবনে স্কুল থাকলে বাচ্চা নিয়ে মায়েদের দূরের
স্কুলে যেতে হবে না বিধায় মায়েরা স্কুলের বারান্দায় অলসভাবে বসে থাকা থেকে
মুক্তি পাবেন। কাঁচাবাজার বা শপিং-এর জন্য দূরে যেতে হবে না। ফলে রাস্তায়
ট্রাফিক জ্যাম কিছুটা হলেও কম হবে। একই ভবনে বসবাস করার ফলে অফিস-আদালতে
যাওয়ার জন্য অনেকের যানবাহনের প্রয়োজন কমে যাবে। ফলে রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম
কম হবে। ভবনে বসবাসরত সকলের সার্বিক নিরাপত্তা বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে।
ট্রাফিক সমস্যা হ্রাস পাবার ফলে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ে আমদানি করা জ্বালানির
খরচও বহুলাংশে কমে যাবে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে। বিদ্যুৎ তারের
দৈর্ঘ্য কম থাকার কারণে বিদ্যুতের পরিচালন ব্যয় কম হবে। একই সঙ্গে
ক্ষেত্রবিশেষে কম গেজের তার দ্বারা সংযোগ প্রদান সম্ভব হবে। ফলে খরচ কমবে।
টেলিফোনের তারের দৈর্ঘ্য কম হবে, সেই সঙ্গে ছোট গেজের তার দিয়ে সংযোগ
প্রদান সম্ভব হবে, এতে ব্যয় কমবে। পানি ও গ্যাস পাইপ ও স্যুয়ারেজ পাইপের
দৈর্ঘ্যও কম হবে। ফলে স্থাপন ব্যয় বহুলাংশে কমে যাবে। ভবনের ছাদে যথেষ্ট
পরিমাণ জায়গা খালি থাকবে বিধায় সৌর প্যানেল ব্যবহারের মাধ্যমে বিদ্যুতের
ব্যবহার কমানো যাবে। অন্যান্য সেবা প্রদানকারী সংস্থা গ্যাস, পানি,
পয়ঃনিষ্কাসন, টেলিফোন, বিদ্যুৎ, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের পক্ষেও কম সময়ে, কম
খরচে, মানসম্মত সেবা প্রদান সম্ভব ও সহজতর হবে। পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন ও
পরিকল্পিত নগরায়ন করা সম্ভব হবে। ভবনে পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ রক্ষণাবেক্ষণে
প্রয়োজনীয় জনবল ভবন কর্তৃপক্ষেরই থাকার প্রয়োজন হবে। বাংলাদেশ একটি
বন্যাপ্রবন দেশ। বহুমুখী বহুতল ভবন বন্যার সময় নানাবিধ কল্যাণমূলক অবদান
রাখে। আলো- বাতাসের সুবিধার জন্য দুইটি ভবনের মধ্যে প্রায় ৫০ ফুট খালি রাখা
যেতে পারে। দুই ভবনের মধ্যে যথেষ্ট খালি জায়গা থাকার কারণে শুধু প্রাকৃতিক
আলো-বাতাসেরই ব্যবস্থা হবে তা নয় বিদ্যুৎ ব্যবহারের পরিমাণ যথেষ্টই হ্রাস
পাবে। অনেক ক্ষেত্রে এয়ারকন্ডিশনের প্রয়োজনীয়তা কমে যাবে। বহুতল ভবনে
স্বাভাবিক ভাবেই কয়েকটি ফ্লোর বেইজমেন্টে তৈরি করতে হবে। এতে ভূমিকম্পের
প্রভাব কিছুটা থাকবে। তাছাড়াও ভবন ডিজাইনের সময় ভূমিকম্পজনিত দিকটি
পর্যালোচনায় আনা এবং সেই অনুযায়ী ভবন ডিজাইন করলে এই অসুবিধা দূর করা বা
ক্ষতির পরিমাণ হ্রাস করা যেতে পারে। ভবন থেকে সহজে বের হওয়ার পথ, ডিজাইন
পরিকল্পনার সময় বিবেচনায় আনতে হবে। ভবনে কমপক্ষে তিনটি বহির্গমন পথ (লিফট
এবং সিঁড়ি) এবং প্রত্যেকটির নির্গমন পথ আলাদা আলাদাভাবে যথেষ্ট পরিমাণ দূরে
থাকতে হবে। সেই সঙ্গে ছাদে জলাধারও আলাদা আলাদা জায়গায় থাকতে পারে। ভবনে
আগুন লাগলে শুধু আগুন সংলগ্ন লিফটটের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা বন্ধ করা যাবে অন্য
লিফটসমূহের বিদ্যুৎ সংযোগ যথাযথ চালু থাকবে। ফলে আগুন লাগা অবস্থায়
বসবাসকারীরা নিরাপদে অন্য লিফট বা সিঁড়ি ব্যবহারের মাধ্যমে ভবন হতে বের হতে
পারবে। আমি মনে করি দেশের যে কোন শহরেই অন্তত ৪০ তলাবিশিষ্ট ভবন করা যেতে
পারে। এসব ভবনের বহুমুখী ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করতে হবে। প্রতি ভবনে বা
পাশাপাশি তিন-চারটি ভবনের জন্য নিচতলায় অন্তত একটি কাঁচা বাজারের ব্যবস্থা
করা যেতে পারে। বেইজমেন্টে গাড়ির পার্কিং- এর সুবিধা রাখা যেতে পারে।
দুই-তিন তলায় (প্রয়োজন অনুসারে) শপিং কমপ্লেক্স থাকতে পারে। চার-আট তলায়
(প্রয়োজন অনুসারে) স্কুল-কলেজ, অফিস, আদালত, হাসপাতাল, ডাক্তারখানা
ইত্যাদির জন্য নির্ধারণ করা যেতে পারে। উপরের তলাসমূহে বাসস্থানের ব্যবস্থা
করা যেতে পারে। বাসস্থানের জন্য ভিন্নদিকে আলাদা লিফটের ব্যবস্থা করা যেতে
পারে। শুধুমাত্র বিশেষ প্রয়োজনে এক-দুই তলা ভবন নির্মাণের অনুমতি দেয়া
যেতে পারে। নতুন ভবন নির্মাণের সময় অবশ্যই এই নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে।
যেহেতু বহুতল ভবন নির্মাণ করতে হবে, তাই প্রতিটি ভবনের জন্য কমপক্ষে এক
বিঘা বা তদূর্ধ্ব পরিমাণ জমির প্রয়োজন হবে। ভবনে সরকারি সকল প্রতিষ্ঠানের
অফিস, আদালত, বাসস্থান ইত্যাদির ব্যবস্থা করা। সম্ভাব্যক্ষেত্রে
সরকারি/বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আলাদাভাবে বিবেচনা না করা। অর্থাৎ
সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান একই ভবনে সংকুলান করা যেতে পারে।
No comments