ঢাকায় 'কায়রো গেম' সফল হলো না by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি
২০১৪ সালে যে বিষয়টি অর্জন করেছে, তা '৭১ সালের বিজয়ের চেয়ে গৌরবময় নয়,
কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ। একাত্তর সালের যুদ্ধ দেশকে স্বাধীনতা দিয়েছে, ২০১৪
সালের যুদ্ধ সেই স্বাধীনতার গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিকে রক্ষা
করেছে। এবার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি শত চক্রান্তের মুখে জয়ী হতে না
পারলে দেশ একাত্তর সালের পূর্বাবস্থায় ফিরে যেত। অঘোষিত পূর্ব পাকিস্তান
হতো। চাই কি মধ্যযুগীয় তালেবান রাষ্ট্র হওয়ার সূচনা হতে পারত। বাংলাদেশের
সাম্প্রতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট অথবা ঢাকায়
মার্কিন রাষ্ট্রদূত যাই বলুন, এই পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি প্রভাবশালী
মার্কিন সাময়িকীর মন্তব্য অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য। সাময়িকীটি লিখেছে,
'বাংলাদেশে গণতন্ত্র বিপন্ন হয়েছে বলে যে অভিযোগ তোলা হয়েছে, তা সঠিক নয়।
বাংলাদেশে বিপন্ন হয়েছিল সেক্যুলারিজম। এই সেক্যুলারিজম ছাড়া বাংলাদেশের
অস্তিত্ব অর্থহীন। একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ অর্থহীন। এই সেক্যুলারিজমকে
রক্ষার জন্য হাসিনা সরকারকে যা করতে হয়েছে তা হয়তো সর্বতোভাবে ট্রাডিশনাল
গণতন্ত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কিন্তু এই পন্থা গ্রহণ ছাড়া হাসিনা
সরকারের সামনে দ্বিতীয় পথ খোলা ছিল না। বাংলাদেশে সেক্যুলারিজম রক্ষা না
পেলে গণতন্ত্রও রক্ষা পেত না।'
হাতের কাছে মার্কিন ম্যাগাজিনটি নেই বলে তার ভাষ্যকারের বাংলাদেশ সম্পর্কিত মন্তব্যটি হুবহু তুলে দিতে পারলাম না। কিন্তু তার সারাংশ তুলে ধরতে পেরেছি। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ গণতন্ত্র বা সেক্যুলারিজমের খাঁটি প্রতিনিধি তা আমি বলি না। আওয়ামী লীগ একটি শ্রেণী সংগঠন নয়, একটি ব্রড বেইজড মাস অর্গানাইজেশন। তার ভেতর গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রমনা মানুষ যেমন আছেন, তেমনি আছে সাম্প্রদায়িকতাবাদী, আপসবাদী, সুবিধাবাদী গোষ্ঠীও। কিন্তু সামগ্রিকভাবে দলটি বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নিবুনিবু প্রদীপ এখনও জ্বালিয়ে রেখেছে।
২০১৪ সালে শেখ হাসিনা কিছু ডান ও বামের গণতান্ত্রিক দল নিয়ে চতুর্দিকের চক্রান্ত ও হামলা যে কোনো উপায়েই হোক প্রতিহত করতে না পারলে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নিবুনিবু প্রদীপ দুটিও নিভে যেত। তার প্রতিক্রিয়া গড়াত শুধু ভারতে নয়, সারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। ভারতেও কংগ্রেস দল এখন পর্যন্ত তার সব দুর্বলতা, দুর্নীতি ও অপশাসন সত্ত্বেও গণতন্ত্র ও সেক্যুলারিজমের বাতিটি ঝড়ো হাওয়া থেকে বাঁচিয়ে রেখেছে। নইলে একটি শক্তিশালী সর্বভারতীয় বাম গণতান্ত্রিক দলের অনুপস্থিতিতে কংগ্রেসের বিপর্যয় এই বিরাট দেশটিতে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করবে_ এই আশঙ্কায় নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেনসহ দেশটির সচেতন মানুষ ও বুদ্ধিজীবীরা এখনও কংগ্রেসের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেননি।
বাংলাদেশেও ভারতের মতো অনুরূপ অবস্থা চলছে। কংগ্রেসের মতোই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অপশাসনের অভিযোগ রয়েছে। 'গত পাঁচ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার দেশের যত উন্নয়ন ঘটিয়েছে, গত ৪০ বছরেও তা কেউ করতে পারেনি'_ এ কথাটা সবাই বলেন। কিন্তু উন্নয়নের পাশাপাশি দেশকে সুশাসন উপহার দিতে না পারাটাই আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ এবং সরকারের জনপ্রিয়তা হ্রাসের কারণ। তা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন এ জন্যই দরকার ছিল যে, দলটির হাতে এখনও গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নিবুনিবু প্রদীপ। এই দলের অনুপস্থিতিতে এই নিবুনিবু প্রদীপও রক্ষা করার কোনো শক্তিশালী বাম গণতান্ত্রিক দল নেই। এই অবস্থায় আওয়ামী লীগের বিপর্যয়ের অর্থ বাংলাদেশের আবার মধ্যযুগীয় ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের কবলে গিয়ে পড়া।
মার্কিন ম্যাগাজিনটি সঠিক কথাই বলেছে, 'বাংলাদেশে এবার গণতন্ত্র বিপন্ন হয়নি, বিপন্ন হয়েছিল সেক্যুলারিজম।' এই সেক্যুলারিজমকে হিংস্র মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা এবং 'সুশীল সমাজ' নামক একটি আত্মবিক্রীত ও আত্মঘাতী গোষ্ঠীর সম্মিলিত হামলা (তার পেছনে আবার বিদেশি পৃষ্ঠপোষকতা) থেকে রক্ষা করার জন্য গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটি হয়তো সর্বত্র সঠিকভাবে অনুসৃত হয়নি। তাতে ক্ষতি নেই। সেক্যুলারিজম রক্ষা পেলে গণতন্ত্রেরও সুরক্ষা পেতে দেরি হবে না।
ভারতের নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন ও সচেতন বুদ্ধিজীবীদের মতো আমাদের অর্ধ নোবেলজয়ী এবং 'সুশীল সমাজে'র বুদ্ধিজীবীরা কেন ওপরে বর্ণিত সত্যটি বুঝতে পারেননি এবং এখনও পারছেন না তা আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধির অগম্য। বাজারে গুজব, আমেরিকা, সৌদি আরব, পাকিস্তানের সমর্থন ও অর্থপুষ্ট জামায়াত দু'হাতে পেট্রো ডলার ছড়িয়ে গরিব বাংলাদেশের জাগ্রত বিবেকের অর্ধেকেরও বেশি কিনে নিয়েছে। তারই প্রতিফলন ঘটেছে এক শ্রেণীর প্রিন্টিং মিডিয়ায়, টিভি টক শোতে, সেমিনারে, গোলটেবিল বৈঠকে।
আমি আবারও মিসরের পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতির তুলনা টানছি। মিসরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদেল নাসের লৌহকঠিন হাতে তার সেক্যুলার আরব জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা দ্বারা বাংলাদেশের জামায়াতের অনুরূপ সন্ত্রাসী মৌলবাদী গোষ্ঠী মুসলিম ব্রাদারহুডকে দান করেছিলেন। বাংলাদেশে জামায়াত নেতা গোলাম আযমকে তার স্বদেশদ্রোহিতার জন্য ফাঁসি দেওয়া হয়নি। কিন্তু মিসরের প্রেসিডেন্ট নাসের মুসলিম ব্রাদারহুড নেতা সাইয়িদ কুতুবকে প্রাণদণ্ড দিয়েছিলেন।
নাসেরের আরব জাতীয়তাবাদ চরিত্রে শুধু সেক্যুলার ছিল না, ছিল ঘোরতর পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী। আমেরিকা তাই এই জাতীয়তাবাদ উচ্ছেদের চক্রান্ত শুরু করে। নাসেরের মৃত্যুর পর সাদাত প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ওয়াশিংটন তাকে কব্জা করে ফেলে। একদিকে ইসরায়েলের সঙ্গে মিসরের তথাকথিত শান্তিচুক্তি ঘটায় এবং অন্যদিকে নাসেরপন্থিদের দমন করে মৌলবাদীদের প্রতি নমনীয় নীতি গ্রহণে প্ররোচিত করে। দুই নৌকায় পা রাখতে গিয়ে সাদাত মৌলবাদী বা মুসলিম ব্রাদারহুডের সন্ত্রাসীদের হাতেই প্রাণ হারান।
সাদাতের পর মার্কিন তাঁবেদার প্রেসিডেন্ট মোবারকের আমলে মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতি তোষণনীতি বেড়ে যায়। মুসলিম ব্রাদারহুড সেই সুযোগে বাংলাদেশের জামায়াতের মতো মসজিদ-মাদ্রাসায় শক্ত ঘাঁটি গড়ে তোলে। মোবারকের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে যখন মিসরের সেক্যুলার ও জাতীয়তাবাদী শিবিরের অভ্যুত্থান ঘটে, মুসলিম ব্রাদারহুড তার ভেতরে অনুপ্রবেশ করে। ওয়াশিংটন সুযোগ পায়। গণতন্ত্রের নামে মিসরের সুশীল সমাজের একাংশ দ্বারা প্রোপাগান্ডা চালিয়ে অনুগত সামরিক বাহিনীকে নিষ্ক্রিয় রেখে মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা মোহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতা দখলে সহায়তা দেয়। অবশ্য নির্বাচনের মাধ্যমেই।
মুরসি ক্ষমতায় বসেই নিজমূর্তি ধারণ করেন। তিনি নির্বাচন প্রতিশ্রুতি ভেঙে নারী স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেন। ধর্মের নামে বাকস্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করেন। প্রশাসন দলীয়করণ শুরু করেন এবং মিসরের বহু শতাব্দীর সেক্যুলার কালচার ধ্বংসের উদ্যোগ নেন। সেক্যুলার শিবিরের নেতারা এবার আর ঘরে বসে থাকতে পারেননি। তারা মুরসি সরকারের বিরুদ্ধে আবার সেক্যুলার মিসর রক্ষার জন্য রাস্তায় নেমে আসেন। কিন্তু তাদের আগের শক্তি তখন খর্ব। একার শক্তিতে মুরসি সরকারের কঠোর দমননীতি মোকাবেলা করার পরিস্থিতি নেই। ওয়াশিংটন এবার তার নতুন খেলায় নেমে আসে।
সামরিক বাহিনী সেক্যুলার শিবিরের পক্ষাবলম্বন করার ভান করে। সেক্যুলার শিবির এবং গণআন্দোলন প্রতারিত হয়। সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখন করে। নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত ও বন্দি করা হয়। স্বৈরাচারী পতিত ডিক্টেটর মোবারককে বিভিন্ন অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়ে তার কারামুক্তির ব্যবস্থা করা হয়। মিসরের যে 'সুশীল সমাজের' ও মিডিয়ার একটা অংশ আগে গণতন্ত্রের নামে মুসলিম ব্রাদারহুডের নির্বাচন জয়ে সমর্থন ও সাহায্য জুগিয়েছিল, পরবর্তীকালে তারা সেক্যুলারিজমের নামে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলে সমর্থন জোগায়। ওয়াশিংটন প্রথমদিকে ভাব দেখিয়েছিল, মিসরে নির্বাচিত সরকারের ক্ষমতাচ্যুতিতে তারা সন্তুষ্ট নয়। কিন্তু পরে দেখা গেল, সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখল ও মোবারককে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনতে না পারলেও মিসরে মোবারক যুগ ফিরিয়ে আনার পেছনে ওয়াশিংটনের পরোক্ষ মদদ রয়েছে।
ওয়াশিংটন বহুদিনের সাধনায় এক গুলিতে দুই পাখি বধ করার সুযোগ লাভ করে। তা হলো, সাদাতের আমলে মৌলবাদীদের খেলিয়ে সেক্যুলার আরব জাতীয়তাবাদ উৎখাতের চেষ্টা সফল করা। অতঃপর মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে সেক্যুলারিস্টদের খেলিয়ে সামরিক বাহিনীর সহায়তায় মৌলবাদীদের ক্ষমতা থেকে উৎখাত এবং শাসন ব্যবস্থায় সাদাত-মোবারক যুগ আবার ফিরিয়ে আনা। দুটি খেলাতেই ওয়াশিংটনের মদদপুষ্ট সুশীল সমাজের এবং মিডিয়ার একটি অংশ কখনও গণতন্ত্রের অনুসারী, কখনও সেক্যুলারিজমের ভক্ত সেজে সাম্রাজ্যবাদী অভিসন্ধি পূরণে সহায়তা জুগিয়েছে।
বাংলাদেশেও মার্কিন কূটনীতির চিত্রটি মিসরের প্রায় অনুরূপ। শেখ মুজিবের বাঙালি জাতীয়তাবাদ চরিত্রে শুধু সেক্যুলার নয়, সাম্রাজ্যবাদবিরোধীও। ফলে শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ ও তার শাসনের প্রতি আমেরিকা কখনোই প্রকৃত অনুকূল মনোভাব দেখায়নি। মাঝে মধ্যে যেটুকু দেখিয়েছে, তা তার নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধির জন্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে '৭১ সালে আমেরিকার যে ভূমিকা ছিল, ২০১৪ সালে বিএনপি-জামায়াতের প্রচণ্ড সন্ত্রাসী তৎপরতা সত্ত্বেও সেই সন্ত্রাস দমন দ্বারা বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও সেক্যুলারিজম রক্ষায় আওয়ামী সরকারকে সহযোগিতা না দিয়ে তার বিরোধিতায় ওয়াশিংটন '৭১-এর মতোই একই ভূমিকা নিয়েছে।
মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুডের উত্থানের মতো বাংলাদেশে জামায়াতের অভ্যুত্থানে মদদ জুগিয়েছে আমেরিকা। সন্ত্রাসের রাজনীতি এবং যুদ্ধাপরাধের জন্য অভিযুক্ত জামায়াতকে আমেরিকা 'মডারেট মুসলিম গণতান্ত্রিক দল' বলে সার্টিফিকেট দেয়। অনেকের মতো আমার ধারণা, এবার উদ্দেশ্য ছিল বিএনপি ও জামায়াতকে খেলিয়ে বাংলাদেশে সেক্যুলার বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্রের ভিত্তিকে ধ্বংস করা। আওয়ামী লীগকে হটিয়ে বিএনপি-জামায়াতকে ক্ষমতায় বসানো। তারপর সেক্যুলারিজম রক্ষার নামে মৌলবাদী জোটকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে তথাকথিত সুশীল সমাজের প্রতিনিধি স্থানীয় ড. ইউনূস বা ড. কামাল হোসেনের মতো ব্যক্তিদের দ্বারা বাংলাদেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার নামে আফগানিস্তানের কারজাই মার্কা একটি অনির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা করা। এই সরকার ভারত মহাসাগরে মার্কিন অর্থনৈতিক ও সামরিক আধিপত্যকে সুরক্ষা দেবে।
এই উদ্দেশ্যে ২০০১ সালের মতো ২০১৪ সালেও আমেরিকা ও তাদের মিত্র কতিপয় ইউরোপীয় দেশ বাংলাদেশে তাদের অনুগত সুশীল সমাজ, বিগ এনজিও ও তথাকথিত একশ্রেণীর 'নিরপেক্ষ' মিডিয়াকে গণতন্ত্রের নামে আওয়ামী সরকারের নির্বাচন সংক্রান্ত সর্বপ্রকার কার্যক্রমের বিরোধিতায় ব্যবহার করেছে। তাতে বিএনপি (আড়ালে জামায়াত) ক্ষমতায় এলে তাদের আপত্তি ছিল না। পরবর্তী পর্যায়ে মিসরের মতো এই সুশীল সমাজকেই সেক্যুলারিজম রক্ষার ভূমিকায় নামিয়ে একটি অনির্বাচিত বিগ এনজিও সমর্থিত সরকার প্রতিষ্ঠাই হয়তো লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াত। বাংলাদেশের নবপ্রজন্মের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে ধন্যবাদ। তারা এবার এই ট্র্যাপে পা দেয়নি।
কিন্তু ষড়যন্ত্র এখনও শেষ হয়নি। একটি বড় এবং সম্মিলিত ষড়যন্ত্র কেবল ব্যর্থ হয়েছে। মনে হয় গোটা দক্ষিণ এশিয়াতেই একটি নতুন স্নায়ুযুদ্ধের মেঘ ঘনীভূত হচ্ছে। এই যুদ্ধে মার্কিন নেতৃত্বে সম্ভবত থাকবে ইউরোপীয় কতিপয় দেশ, পাকিস্তান, সৌদি আরব এবং মধ্যপ্রাচ্যের আরও দু'একটি দেশ। অন্যদিকে থাকবে ভারত, চীন, রাশিয়া, ব্রাজিল এবং আরও ছোট-বড় দু'একটি দেশ। বাংলাদেশের ওপরই এই ঝড়ের প্রথম ঝাপটা আঘাত হানতে পারে। এবারের হাসিনা সরকারকে তাই অনেক বেশি সতর্ক ও সজাগ থাকতে হবে। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক শক্তি যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি দেশের ডান ও বামের সব গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। একমাত্র ঐক্যবদ্ধ গণপ্রতিরোধই একটি গণতান্ত্রিক দেশকে আসল সুরক্ষা দিতে পারে। এ কথাটি রেটোরিকের মতো শোনালেও এ যুগে এর চেয়ে বড় সত্য আর কিছু নেই। শেখ হাসিনা কঠোর হোন। দেশের ভেতরে-বাইরের শত্রু ও মিত্রদের বাছাই করে মিত্রদের পাশে শক্তভাবে দাঁড়ান। ১৯৭১ সালের মতোই বাংলাদেশের স্বাধীনতার দেশি ও বিদেশি শত্রুরা আবার পরাজিত হবে বলে আমার দৃঢ়বিশ্বাস। ২০১৪ সালের নির্বাচনটি তারই সূচনা হোক।
পুনশ্চ :লেখাটি শেষ করে এনেছি এমন সময় খবর পেলাম, উপমহাদেশের চলচ্চিত্র জগতের কিংবদন্তি নায়িকা সুচিত্রা সেন দীর্ঘ রোগভোগের পর প্রয়াত হয়েছেন। তাকে বলা হতো এশিয়ার স্ক্রিনের গ্রেটা গার্বো। এই মহানায়িকা ও একজন শ্রেষ্ঠ শিল্পীর প্রয়াণে তার প্রতি একজন ভক্ত হিসেবে শ্রদ্ধা জানাই।
লন্ডন, ১৭ জানুয়ারি শুক্রবার, ২০১৪
হাতের কাছে মার্কিন ম্যাগাজিনটি নেই বলে তার ভাষ্যকারের বাংলাদেশ সম্পর্কিত মন্তব্যটি হুবহু তুলে দিতে পারলাম না। কিন্তু তার সারাংশ তুলে ধরতে পেরেছি। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ গণতন্ত্র বা সেক্যুলারিজমের খাঁটি প্রতিনিধি তা আমি বলি না। আওয়ামী লীগ একটি শ্রেণী সংগঠন নয়, একটি ব্রড বেইজড মাস অর্গানাইজেশন। তার ভেতর গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রমনা মানুষ যেমন আছেন, তেমনি আছে সাম্প্রদায়িকতাবাদী, আপসবাদী, সুবিধাবাদী গোষ্ঠীও। কিন্তু সামগ্রিকভাবে দলটি বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নিবুনিবু প্রদীপ এখনও জ্বালিয়ে রেখেছে।
২০১৪ সালে শেখ হাসিনা কিছু ডান ও বামের গণতান্ত্রিক দল নিয়ে চতুর্দিকের চক্রান্ত ও হামলা যে কোনো উপায়েই হোক প্রতিহত করতে না পারলে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নিবুনিবু প্রদীপ দুটিও নিভে যেত। তার প্রতিক্রিয়া গড়াত শুধু ভারতে নয়, সারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। ভারতেও কংগ্রেস দল এখন পর্যন্ত তার সব দুর্বলতা, দুর্নীতি ও অপশাসন সত্ত্বেও গণতন্ত্র ও সেক্যুলারিজমের বাতিটি ঝড়ো হাওয়া থেকে বাঁচিয়ে রেখেছে। নইলে একটি শক্তিশালী সর্বভারতীয় বাম গণতান্ত্রিক দলের অনুপস্থিতিতে কংগ্রেসের বিপর্যয় এই বিরাট দেশটিতে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করবে_ এই আশঙ্কায় নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেনসহ দেশটির সচেতন মানুষ ও বুদ্ধিজীবীরা এখনও কংগ্রেসের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেননি।
বাংলাদেশেও ভারতের মতো অনুরূপ অবস্থা চলছে। কংগ্রেসের মতোই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অপশাসনের অভিযোগ রয়েছে। 'গত পাঁচ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার দেশের যত উন্নয়ন ঘটিয়েছে, গত ৪০ বছরেও তা কেউ করতে পারেনি'_ এ কথাটা সবাই বলেন। কিন্তু উন্নয়নের পাশাপাশি দেশকে সুশাসন উপহার দিতে না পারাটাই আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ এবং সরকারের জনপ্রিয়তা হ্রাসের কারণ। তা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন এ জন্যই দরকার ছিল যে, দলটির হাতে এখনও গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নিবুনিবু প্রদীপ। এই দলের অনুপস্থিতিতে এই নিবুনিবু প্রদীপও রক্ষা করার কোনো শক্তিশালী বাম গণতান্ত্রিক দল নেই। এই অবস্থায় আওয়ামী লীগের বিপর্যয়ের অর্থ বাংলাদেশের আবার মধ্যযুগীয় ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের কবলে গিয়ে পড়া।
মার্কিন ম্যাগাজিনটি সঠিক কথাই বলেছে, 'বাংলাদেশে এবার গণতন্ত্র বিপন্ন হয়নি, বিপন্ন হয়েছিল সেক্যুলারিজম।' এই সেক্যুলারিজমকে হিংস্র মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা এবং 'সুশীল সমাজ' নামক একটি আত্মবিক্রীত ও আত্মঘাতী গোষ্ঠীর সম্মিলিত হামলা (তার পেছনে আবার বিদেশি পৃষ্ঠপোষকতা) থেকে রক্ষা করার জন্য গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটি হয়তো সর্বত্র সঠিকভাবে অনুসৃত হয়নি। তাতে ক্ষতি নেই। সেক্যুলারিজম রক্ষা পেলে গণতন্ত্রেরও সুরক্ষা পেতে দেরি হবে না।
ভারতের নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন ও সচেতন বুদ্ধিজীবীদের মতো আমাদের অর্ধ নোবেলজয়ী এবং 'সুশীল সমাজে'র বুদ্ধিজীবীরা কেন ওপরে বর্ণিত সত্যটি বুঝতে পারেননি এবং এখনও পারছেন না তা আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধির অগম্য। বাজারে গুজব, আমেরিকা, সৌদি আরব, পাকিস্তানের সমর্থন ও অর্থপুষ্ট জামায়াত দু'হাতে পেট্রো ডলার ছড়িয়ে গরিব বাংলাদেশের জাগ্রত বিবেকের অর্ধেকেরও বেশি কিনে নিয়েছে। তারই প্রতিফলন ঘটেছে এক শ্রেণীর প্রিন্টিং মিডিয়ায়, টিভি টক শোতে, সেমিনারে, গোলটেবিল বৈঠকে।
আমি আবারও মিসরের পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতির তুলনা টানছি। মিসরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদেল নাসের লৌহকঠিন হাতে তার সেক্যুলার আরব জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা দ্বারা বাংলাদেশের জামায়াতের অনুরূপ সন্ত্রাসী মৌলবাদী গোষ্ঠী মুসলিম ব্রাদারহুডকে দান করেছিলেন। বাংলাদেশে জামায়াত নেতা গোলাম আযমকে তার স্বদেশদ্রোহিতার জন্য ফাঁসি দেওয়া হয়নি। কিন্তু মিসরের প্রেসিডেন্ট নাসের মুসলিম ব্রাদারহুড নেতা সাইয়িদ কুতুবকে প্রাণদণ্ড দিয়েছিলেন।
নাসেরের আরব জাতীয়তাবাদ চরিত্রে শুধু সেক্যুলার ছিল না, ছিল ঘোরতর পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী। আমেরিকা তাই এই জাতীয়তাবাদ উচ্ছেদের চক্রান্ত শুরু করে। নাসেরের মৃত্যুর পর সাদাত প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ওয়াশিংটন তাকে কব্জা করে ফেলে। একদিকে ইসরায়েলের সঙ্গে মিসরের তথাকথিত শান্তিচুক্তি ঘটায় এবং অন্যদিকে নাসেরপন্থিদের দমন করে মৌলবাদীদের প্রতি নমনীয় নীতি গ্রহণে প্ররোচিত করে। দুই নৌকায় পা রাখতে গিয়ে সাদাত মৌলবাদী বা মুসলিম ব্রাদারহুডের সন্ত্রাসীদের হাতেই প্রাণ হারান।
সাদাতের পর মার্কিন তাঁবেদার প্রেসিডেন্ট মোবারকের আমলে মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতি তোষণনীতি বেড়ে যায়। মুসলিম ব্রাদারহুড সেই সুযোগে বাংলাদেশের জামায়াতের মতো মসজিদ-মাদ্রাসায় শক্ত ঘাঁটি গড়ে তোলে। মোবারকের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে যখন মিসরের সেক্যুলার ও জাতীয়তাবাদী শিবিরের অভ্যুত্থান ঘটে, মুসলিম ব্রাদারহুড তার ভেতরে অনুপ্রবেশ করে। ওয়াশিংটন সুযোগ পায়। গণতন্ত্রের নামে মিসরের সুশীল সমাজের একাংশ দ্বারা প্রোপাগান্ডা চালিয়ে অনুগত সামরিক বাহিনীকে নিষ্ক্রিয় রেখে মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা মোহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতা দখলে সহায়তা দেয়। অবশ্য নির্বাচনের মাধ্যমেই।
মুরসি ক্ষমতায় বসেই নিজমূর্তি ধারণ করেন। তিনি নির্বাচন প্রতিশ্রুতি ভেঙে নারী স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেন। ধর্মের নামে বাকস্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করেন। প্রশাসন দলীয়করণ শুরু করেন এবং মিসরের বহু শতাব্দীর সেক্যুলার কালচার ধ্বংসের উদ্যোগ নেন। সেক্যুলার শিবিরের নেতারা এবার আর ঘরে বসে থাকতে পারেননি। তারা মুরসি সরকারের বিরুদ্ধে আবার সেক্যুলার মিসর রক্ষার জন্য রাস্তায় নেমে আসেন। কিন্তু তাদের আগের শক্তি তখন খর্ব। একার শক্তিতে মুরসি সরকারের কঠোর দমননীতি মোকাবেলা করার পরিস্থিতি নেই। ওয়াশিংটন এবার তার নতুন খেলায় নেমে আসে।
সামরিক বাহিনী সেক্যুলার শিবিরের পক্ষাবলম্বন করার ভান করে। সেক্যুলার শিবির এবং গণআন্দোলন প্রতারিত হয়। সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখন করে। নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত ও বন্দি করা হয়। স্বৈরাচারী পতিত ডিক্টেটর মোবারককে বিভিন্ন অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়ে তার কারামুক্তির ব্যবস্থা করা হয়। মিসরের যে 'সুশীল সমাজের' ও মিডিয়ার একটা অংশ আগে গণতন্ত্রের নামে মুসলিম ব্রাদারহুডের নির্বাচন জয়ে সমর্থন ও সাহায্য জুগিয়েছিল, পরবর্তীকালে তারা সেক্যুলারিজমের নামে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলে সমর্থন জোগায়। ওয়াশিংটন প্রথমদিকে ভাব দেখিয়েছিল, মিসরে নির্বাচিত সরকারের ক্ষমতাচ্যুতিতে তারা সন্তুষ্ট নয়। কিন্তু পরে দেখা গেল, সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখল ও মোবারককে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনতে না পারলেও মিসরে মোবারক যুগ ফিরিয়ে আনার পেছনে ওয়াশিংটনের পরোক্ষ মদদ রয়েছে।
ওয়াশিংটন বহুদিনের সাধনায় এক গুলিতে দুই পাখি বধ করার সুযোগ লাভ করে। তা হলো, সাদাতের আমলে মৌলবাদীদের খেলিয়ে সেক্যুলার আরব জাতীয়তাবাদ উৎখাতের চেষ্টা সফল করা। অতঃপর মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে সেক্যুলারিস্টদের খেলিয়ে সামরিক বাহিনীর সহায়তায় মৌলবাদীদের ক্ষমতা থেকে উৎখাত এবং শাসন ব্যবস্থায় সাদাত-মোবারক যুগ আবার ফিরিয়ে আনা। দুটি খেলাতেই ওয়াশিংটনের মদদপুষ্ট সুশীল সমাজের এবং মিডিয়ার একটি অংশ কখনও গণতন্ত্রের অনুসারী, কখনও সেক্যুলারিজমের ভক্ত সেজে সাম্রাজ্যবাদী অভিসন্ধি পূরণে সহায়তা জুগিয়েছে।
বাংলাদেশেও মার্কিন কূটনীতির চিত্রটি মিসরের প্রায় অনুরূপ। শেখ মুজিবের বাঙালি জাতীয়তাবাদ চরিত্রে শুধু সেক্যুলার নয়, সাম্রাজ্যবাদবিরোধীও। ফলে শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ ও তার শাসনের প্রতি আমেরিকা কখনোই প্রকৃত অনুকূল মনোভাব দেখায়নি। মাঝে মধ্যে যেটুকু দেখিয়েছে, তা তার নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধির জন্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে '৭১ সালে আমেরিকার যে ভূমিকা ছিল, ২০১৪ সালে বিএনপি-জামায়াতের প্রচণ্ড সন্ত্রাসী তৎপরতা সত্ত্বেও সেই সন্ত্রাস দমন দ্বারা বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও সেক্যুলারিজম রক্ষায় আওয়ামী সরকারকে সহযোগিতা না দিয়ে তার বিরোধিতায় ওয়াশিংটন '৭১-এর মতোই একই ভূমিকা নিয়েছে।
মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুডের উত্থানের মতো বাংলাদেশে জামায়াতের অভ্যুত্থানে মদদ জুগিয়েছে আমেরিকা। সন্ত্রাসের রাজনীতি এবং যুদ্ধাপরাধের জন্য অভিযুক্ত জামায়াতকে আমেরিকা 'মডারেট মুসলিম গণতান্ত্রিক দল' বলে সার্টিফিকেট দেয়। অনেকের মতো আমার ধারণা, এবার উদ্দেশ্য ছিল বিএনপি ও জামায়াতকে খেলিয়ে বাংলাদেশে সেক্যুলার বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্রের ভিত্তিকে ধ্বংস করা। আওয়ামী লীগকে হটিয়ে বিএনপি-জামায়াতকে ক্ষমতায় বসানো। তারপর সেক্যুলারিজম রক্ষার নামে মৌলবাদী জোটকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে তথাকথিত সুশীল সমাজের প্রতিনিধি স্থানীয় ড. ইউনূস বা ড. কামাল হোসেনের মতো ব্যক্তিদের দ্বারা বাংলাদেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার নামে আফগানিস্তানের কারজাই মার্কা একটি অনির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা করা। এই সরকার ভারত মহাসাগরে মার্কিন অর্থনৈতিক ও সামরিক আধিপত্যকে সুরক্ষা দেবে।
এই উদ্দেশ্যে ২০০১ সালের মতো ২০১৪ সালেও আমেরিকা ও তাদের মিত্র কতিপয় ইউরোপীয় দেশ বাংলাদেশে তাদের অনুগত সুশীল সমাজ, বিগ এনজিও ও তথাকথিত একশ্রেণীর 'নিরপেক্ষ' মিডিয়াকে গণতন্ত্রের নামে আওয়ামী সরকারের নির্বাচন সংক্রান্ত সর্বপ্রকার কার্যক্রমের বিরোধিতায় ব্যবহার করেছে। তাতে বিএনপি (আড়ালে জামায়াত) ক্ষমতায় এলে তাদের আপত্তি ছিল না। পরবর্তী পর্যায়ে মিসরের মতো এই সুশীল সমাজকেই সেক্যুলারিজম রক্ষার ভূমিকায় নামিয়ে একটি অনির্বাচিত বিগ এনজিও সমর্থিত সরকার প্রতিষ্ঠাই হয়তো লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াত। বাংলাদেশের নবপ্রজন্মের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে ধন্যবাদ। তারা এবার এই ট্র্যাপে পা দেয়নি।
কিন্তু ষড়যন্ত্র এখনও শেষ হয়নি। একটি বড় এবং সম্মিলিত ষড়যন্ত্র কেবল ব্যর্থ হয়েছে। মনে হয় গোটা দক্ষিণ এশিয়াতেই একটি নতুন স্নায়ুযুদ্ধের মেঘ ঘনীভূত হচ্ছে। এই যুদ্ধে মার্কিন নেতৃত্বে সম্ভবত থাকবে ইউরোপীয় কতিপয় দেশ, পাকিস্তান, সৌদি আরব এবং মধ্যপ্রাচ্যের আরও দু'একটি দেশ। অন্যদিকে থাকবে ভারত, চীন, রাশিয়া, ব্রাজিল এবং আরও ছোট-বড় দু'একটি দেশ। বাংলাদেশের ওপরই এই ঝড়ের প্রথম ঝাপটা আঘাত হানতে পারে। এবারের হাসিনা সরকারকে তাই অনেক বেশি সতর্ক ও সজাগ থাকতে হবে। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক শক্তি যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি দেশের ডান ও বামের সব গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। একমাত্র ঐক্যবদ্ধ গণপ্রতিরোধই একটি গণতান্ত্রিক দেশকে আসল সুরক্ষা দিতে পারে। এ কথাটি রেটোরিকের মতো শোনালেও এ যুগে এর চেয়ে বড় সত্য আর কিছু নেই। শেখ হাসিনা কঠোর হোন। দেশের ভেতরে-বাইরের শত্রু ও মিত্রদের বাছাই করে মিত্রদের পাশে শক্তভাবে দাঁড়ান। ১৯৭১ সালের মতোই বাংলাদেশের স্বাধীনতার দেশি ও বিদেশি শত্রুরা আবার পরাজিত হবে বলে আমার দৃঢ়বিশ্বাস। ২০১৪ সালের নির্বাচনটি তারই সূচনা হোক।
পুনশ্চ :লেখাটি শেষ করে এনেছি এমন সময় খবর পেলাম, উপমহাদেশের চলচ্চিত্র জগতের কিংবদন্তি নায়িকা সুচিত্রা সেন দীর্ঘ রোগভোগের পর প্রয়াত হয়েছেন। তাকে বলা হতো এশিয়ার স্ক্রিনের গ্রেটা গার্বো। এই মহানায়িকা ও একজন শ্রেষ্ঠ শিল্পীর প্রয়াণে তার প্রতি একজন ভক্ত হিসেবে শ্রদ্ধা জানাই।
লন্ডন, ১৭ জানুয়ারি শুক্রবার, ২০১৪
No comments