মহানায়িকার বিদায়
ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি
অভিনেত্রী সুচিত্রা সেনের মৃত্যুতে আমরা গভীর শোকাহত। তার মৃত্যুতে বাংলা
তথা ভারতীয় উপমহাদেশের অভিনয়ের ইতিহাসে এক সোনালি অধ্যায়ের অবসান হলো। আরেক
অভিনয় কিংবদন্তি অমিতাভ বচ্চন যথার্থই বলেছেন যে, 'আরও এক ইন্দ্রপতন।'
আমরা জানি, তার শূন্যস্থান সহসা পূরণ হওয়ার নয়। তবে তার অভিনয়প্রতিভা,
সহজিয়া সৌন্দর্য, সুবিস্তৃত সাফল্য নতুন প্রজন্মের অভিনেত্রী এমনকি
অভিনেতাদেরও ভাবীকালে অনুপ্রাণিত করে যাবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। নিজের
সময়ে পশ্চিমবঙ্গের চলচ্চিত্র শিল্পে তার একচ্ছত্র আধিপত্যের কথা আলাদা করে
বলতে হবে। রূপালি পর্দায় শ্রেষ্ঠ জুটি হিসেবে উত্তম-সুচিত্রা যদিও একসঙ্গে
উচ্চারিত হয়; যদিও 'মহানায়ক' উত্তমের সূত্রেই তাকে 'মহানায়িকা' আখ্যা দেওয়া
হয়; এ তথ্যও আমাদের জানা যে সে সময়ে তিনি উত্তমের তুলনায় দ্বিগুণ
পারিশ্রমিক পেয়েছেন। সুচিত্রা যদিও মূলত টালিউডে নির্মিত বাংলা ছায়াছবিতে
এবং কর্মজীবনের শেষ দিকে ঢালিউডের কয়েকটি হিন্দি সিনেমায় অভিনয় করেছেন, তার
জনপ্রিয়তা কোনো নির্দিষ্ট ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক সীমানায় আটকে থাকেনি। এপার
বাংলা ওপার বাংলাসহ গোটা বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর কাছে তিনি ছিলেন
স্বপ্নের রাজকুমারী। চলচ্চিত্রের বাইরে বৃহত্তর বাঙালি নারীর সাংস্কৃতিক
রুচি নির্মাণেও তার রয়েছে অসামান্য অবদান। রবীন্দ্রনাথের বুদ্ধিবৃত্তিক
কর্ম এবং ঠাকুর পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে বাঙালি নারীর আলঙ্কারিক অবয়ব
সম্পর্কে যে ধারণা প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল, সুচিত্রার চলচ্চিত্রে তা মূর্ত হয়ে
উঠেছে। ষাট ও সত্তরের দশকের আধুনিক বাঙালি তরুণীর পোশাক-পরিচ্ছদ ও সাজসজ্জা
সুচিত্রার প্রভাবে মগ্ন থেকেছে। বাংলাদেশের সঙ্গে তার সম্পর্ক আরও নিবিড়।
দেশ বিভাগের পর পারিবারিকসূত্রে পশ্চিমবঙ্গে স্থায়ী হলেও সুচিত্রা তথা রমা
দাশগুপ্তের জন্ম পাবনায়। গঙ্গাতীরের নগরীতে পেশাগত প্রতিষ্ঠা পেলেও তার
শৈশব ও কৈশোর কেটেছে, শিক্ষাজীবনের প্রাথমিক ভিত্তি রচিত হয়েছে যমুনা তীরের
শহরটিতেই। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, তিনি ঢালিউড চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সময় ও
সুযোগ পাননি। এর একটি কারণ হতে পারে দেশ বিভাগের পর পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক
শাসকগোষ্ঠীর দুই বাংলার সাংস্কৃতিক অভিন্নতা বিরোধী অবস্থান। এমনকি
রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ করার মতো অবিমৃষ্যকারিতাও তখন আমরা দেখেছি। পরে যখন
পাকিস্তানের নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়
ঘটেছে, ততদিনে সুচিত্রা সেন নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করেছেন। তাতে করে
অবশ্য আমাদের সুচিত্রা-মগ্নতায় বিঘ্ন ঘটেনি। তিনি অভিনয় থেকে অবসর নিলেও
তার অভিনীত চলচ্চিত্র বাংলাদেশের ঘরে ঘরে আলো ছড়িয়েছে। যে কারণে তার
অবসর-পরবর্তী প্রজন্মের কাছেও তিনি মুগ্ধতার নামান্তর হয়ে থেকেছেন।
সীমান্তের ওপারে থেকেও তিনি ছিলেন এ দেশের আপামর জনসাধারণের কাছের মানুষ।
বস্তুত সুচিত্রার মৃত্যুতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী,
স্পিকারসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের শোকবার্তার মধ্য দিয়ে গোটা
জাতির বেদনা ও ঘনিষ্ঠতাই প্রতিফলিত হয়েছে। একই সঙ্গে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটিও
আমরা প্রসঙ্গ করতে চাই। পাবনায় সুচিত্রা সেনের পৈতৃক বাড়ি সাম্প্রদায়িক
শক্তির বেদখলে রয়েছে। আমরা চাইব, পাবনায় বেদখলে থাকা সুচিত্রা সেনের পৈতৃক
বাড়িটি দখলমুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হোক। সেখানে জনসম্পৃক্ত ও কল্যাণমূলক
উদ্যোগ গড়ে তোলা গেলে তার স্মৃতি ও কর্মের প্রতি যথার্থ সম্মান দেখানো হবে।
এই মহীয়সী নারীর জীবন ও কর্মের প্রতি আমরা গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন এবং তার
বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।
No comments