সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার অধিকার
ইসলাম ধর্মে শাসকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যেন কোনো অবস্থাতেই রাষ্ট্রের সংখ্যালঘু অমুসলিম নাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তা লাভের অধিকার বিঘ্নিত না হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রদত্ত জনকল্যাণময় নীতিমালার আলোকে যাতে অমুসলিমরাও ইহকালীন জীবনে শান্তি ও নিরাপত্তা লাভে ধন্য হতে পারে। কেননা সংখ্যালঘু অমুসলিমদের জানমাল মুসলমানদের নিজের জানমালের মতো পবিত্র আমানত ও নিরাপত্তাযোগ্য। কিন্তু যেখানে মানুষরূপী মানুষের কাছে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের জীবন, সম্পদ ও সম্ভ্রমের নিরাপত্তাহীনতা বোধ হয়, তাকে তো আর সভ্য মানুষ বলা যায় না! অথচ বিশ্বমানবতার মুক্তিদূত মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) সুস্পষ্ট ভাষায় অমুসলিমদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধানের জন্য সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছেন, ‘তাদের রক্ত আমাদের রক্তের মতো এবং তাদের ধনসম্পদ আমাদের ধনসম্পদের মতো।’
মদিনা সনদে যে উম্মাহর কথা বলা হয়েছে, তা শুধু মুসলমান সমন্বয়ে সংগঠিত নয়, বরং তা সর্বধর্মের সমন্বয়ে গঠিত। সনদের ২৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘বনু আউফের ইহুদিরা মুমিনদের সঙ্গে একই উম্মাহ। ইহুদিদের জন্য তাদের ধর্ম আর মুসলমানদের জন্য তাদের ধর্ম, তাদের মাওয়ালি বা আশ্রিত এবং তারা নিজেরাও। অবশ্য যে অন্যায় বা অপরাধ করবে সে নিজের এবং তার পরিবার-পরিজনের ক্ষতিই করবে।’ যেমনভাবে মহানবী (সা.) কে উদ্দেশ করে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘(বলুন!) তোমাদের ধর্ম তোমাদের এবং আমার ধর্ম আমার।’ (সূরা আল-কাফিরুন, আয়াত: ৭) মহানবী (সা.) ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের সঙ্গে যে মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করেন, এর মূল বিষয়বস্তু ছিল যথাক্রমে: ১. অমুসলিমরা শত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হলে মুসলমানেরা তাদের রক্ষা করবে। ২. তাদের ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করা হবে না। ৩. তাদের সকল প্রকার নিরাপত্তা দেওয়া হবে। ৪. তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, সম্পত্তি ও অধিকারের নিরাপত্তা প্রদান করা হবে। ৫. তাদের ধর্ম, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও গির্জা বা উপাসনালয়ের কোনো ক্ষতি করা হবে না। ৬. তাদের কোনো অধিকার ক্ষুণ্ন করা হবে না। ৭. তাদের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনী প্রেরণ করা হবে না। ৮. ধর্মীয় ও বিচারব্যবস্থায় তাদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হবে।
মহানবী (সা.)-এর সঙ্গে অমুসলিম পৌত্তলিক, ইহুদি ও খ্রিষ্টানরা গোপনে বা প্রকাশ্যে শত্রুতা ও বিরোধিতা করতে শুরু করলেও তিনি অসহিষ্ণুতা প্রদর্শন করেননি। ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে তায়েফবাসীর প্রস্তরের আঘাতে নিজের গায়ের রক্ত ঝরালেন, উহুদের ময়দানে নিজের দাঁত মোবারক শহীদ হলো; কিন্তু তিনি ক্ষোভ প্রকাশ বা অভিশাপ না দিয়ে স্বজাতিকে মাফ করে দিলেন এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। যে বিধর্মী মক্কাবাসী একদা তাঁকে বিভিন্ন দিক দিয়ে নির্মম নির্যাতন করে মদিনায় হিজরত করতে বাধ্য করেছিল, মক্কা বিজয়ের পর তিনি সবার প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন। তাঁর সমগ্র জীবনে এমন অতুলনীয় ক্ষমা ও মহানুভবতার উদাহরণ ভরপুর। তিনি কখনো অমুসলিমদের সঙ্গে অসদাচরণ করেননি, বরং তাঁর সদ্ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে বহু অমুসলিম ইসলাম গ্রহণ করেছিল। তাই অমুসলিমদের সঙ্গে অসদাচরণ, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা-নির্যাতন, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, জানমালের নিরাপত্তা বিনষ্টকরণ এবং সামাজিক দুর্বৃত্তায়ন, মানবিক বিপর্যয় ও অনিষ্ট সাধনকে সমাজে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করা দরকার। এ জন্য দেশের জনগণকে হতে হবে মানবাধিকার সচেতন। যেন মানুষ আর মনুষ্যত্ব না হারায়; বরং সবাই মনুষ্যত্ব অর্জনে হয়ে ওঠে তৎপর ও সচেষ্ট এবং হূদয়ে গর্জে তোলে মানবতার হাতিয়ার। আবালবৃদ্ধবনিতা, হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা, আত্মীয়স্বজন, পরিবার-পরিজন—সবাই সমবেত কণ্ঠে ঘোষণা করুক, ‘ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের কোনো ক্ষতিসাধন করবে না; বরং পারলে অন্যের উপকার করবে!’
কেননা অহেতুক অমুসলিমদের ওপর জোর-জবরদস্তি বা জুলুম-নির্যাতন করা মহাপাপ। এ জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) মুসলমানদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যদি কোনো অমুসলিমের প্রতি অন্যায় করে, তবে আমি কিয়ামতের দিন সেই মুসলমানের বিরুদ্ধে সাক্ষী হবো।’ আবু দাউদ)পৃথিবীতে ধর্মমতের পার্থক্যের কারণে মানুষ মানুষকে হত্যা করছে, ধনসম্পদ লুট করছে, এমনকি মা-বোনদের সম্ভ্রমহানিও পর্যন্ত করছে! একশ্রেণীর মানুষরূপী পশুর উন্মত্ত নাশকতায় নিরীহ সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর জানমালের নিরাপত্তা আজ বিপন্নপ্রায়। অথচ মানুষ যে জাতি-ধর্ম-বর্ণ ও দলমতের অনুসারী হোক না কেন, তাকে সাহায্য-সহযোগিতা করা, বিপদ-আপদ থেকে উদ্ধার করা শান্তিকামী মুসলমানের ইমানি দায়িত্ব ও কর্তব্য। যেহেতু মানবসমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা, সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি ও জাতি-গোষ্ঠীর মিলেমিশে একতাবদ্ধ থাকা নির্ভর করে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের সম্পর্কের ওপর, সেহেতু তাদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও পারস্পরিক সুসম্পর্ক যতটা সহনশীল ও সম্প্রীতিময় হবে, সমাজ-জীবনে ততটাই শান্তি-শৃঙ্খলা ও জানমালের নিরাপত্তা বিরাজ করবে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com
No comments