‘শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে ন্যায়বিচার পদানত হতে দেয়া যায় না’ -সৈয়দ আবুল মকসুদ
বিশিষ্ট লেখক ও কলামনিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ
বলেছেন, একটি নির্বাচিত সরকারের বৈধতা নিয়ে বিভিন্ন দেশের পার্লামেন্টে
সালিশ-বিচার হচ্ছে, বৈধতা, অবৈধতার প্রশ্ন উঠছে। এটাই প্রমাণ করে এই
নির্বাচনে গোলমাল আছে।
তিনি বলেন, একটি স্বৈরাচারী সরকার
মেনে নেয়া যায় কিন্তু কোন তাঁবেদার মানা যায় না, অর্থনৈতিক সঙ্কট মানা
গেলেও অগণতন্ত্রিক অনাচার মেনে নেয়া যায় না। শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে
ন্যায়বিচার পদানত হতে দেয়া যায় না। সংলাপের জন্য জামায়াত ছাড়ার শর্তকে
মূল্যহীন উল্লেখ করে তিনি বলেন, জামায়াতের সাংবিধানিক অবস্থান কি তা আগে
সরকার ঠিক করুক। যদি জামায়াত আইনগতভাবে নিষিদ্ধ হয়ে যায় তা হলে আপনা আপনিই
জামায়াত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে বিএনপি। মানবজমিনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে
তিনি বলেন, দেশের সঙ্কটের জন্য প্রধান দুই দল, অপ্রধান দলসমূহ, একশ্রেণীর
গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের দালালি ভূমিকা দায়ী। গত নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত
সরকার আইনসম্মত কিনা, বৈধ কিনা- এমন প্রশ্ন উঠছে। এর আগে বাংলাদেশের আর কোন
নির্বাচিত সরকার নিয়ে এই প্রশ্ন কেউ করেননি। এসব প্রশ্ন ওঠে সামরিক
শাসকদের সম্পর্কে। সামরিক শাসকরা অসাংবিধানিক শাসক বা জবরদখলের শাসক।
কিন্তু একটি নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার সম্পর্কে যখন আইনগত বৈধতার
প্রশ্ন ওঠে তখন বুঝতে হবে কোথাও না কোথাও গোলমাল হয়েছে। হয় নির্বাচনে আইনগত
গোলমাল হয়েছে, নয়তো অন্য কোন জায়গায় সমস্যা হয়েছে। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন
সম্পর্কে সরকারি দলের নেতারাই বলছেন- ‘সংবিধান রক্ষার নির্বাচন’, ‘নিয়ম
রক্ষার নির্বাচন’, ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার নির্বাচন’ ইত্যাদি। যদি
ধরে নিই সরকারের পক্ষ থেকে যা বলা হয়েছে সেটাই ঠিক- তাহলে সমস্যা কোথায়?
তখন দেখা যাচ্ছে, আইনি সব বিষয়ই ঠিক আছে, কিন্তু কয়েকটি দল সেই নির্বাচনে
অংশ নেয়নি। বেশ, তা না নিতে পারে। কিন্তু সেই দলগুলো কারা? বাংলাদেশে ৪০টির
বেশি নিবন্ধিত দল রয়েছে। সবদলকেই নির্বাচনে আসতে হবে তা সংবিধানে লেখা
নেই। বেআইনি যদি নাও হয়ে থাকে, কিন্তু অনৈতিক কাজ করেছে ১৪ দলীয় মহাজোট
নিযুক্ত ও মহাজোটপন্থি নির্বাচন কমিশন।
তিনি বলেন, শতকরা ৫২ ভাগ ভোটারকে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগই দেয়া হলো না। তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ১৫৩ জন প্রার্থী নির্বাচিত হয়ে গেলেন। বাকি যে ১৪৭ আসন সেখানে ভোট পড়ল ১০-১২ শতাংশ। বহু কেন্দ্রে একটি ভোটও পড়েনি। এই নির্বাচনকে আপনি কিভাবে বলবেন আইনগতভাবে বৈধ? নৈতিকভাবে বৈধ বললে তো নৈতিকতা শব্দটিকেই অসম্মান করা হয়। তারপরেও যদি আমরা বলি এবং বলবোই যে, সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে এসেছে। তখনই আসে গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্ন। এভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত একটি সরকারকে কেউ গ্রহণযোগ্য মনে করে না। তবে কেউ গ্রহণযোগ্য মনে করুক বা না করুক কোন সরকার যখন প্রশাসনের মাধ্যমে রাষ্ট্র চালায় তাকে মেনে নিতে হবে, তাই নির্বাচনের পর গঠিত বর্তমান সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, ফ্রান্স, জার্মানি প্রভৃতি দেশ অভিনন্দন না জানালেও অর্থাৎ গ্রহণযোগ্য মনে না করলেও সরকারের সঙ্গে স্বাভাবিক কাজকর্ম চালিয়ে যেতে অস্বীকার করেনি। সঙ্গে সঙ্গে তারা তাগিদ দিচ্ছে- অতি দ্রুত আর একটি নির্বাচন করা। যে নির্বাচনে অধিকাংশ মানুষের ভোট প্রয়োগের সুযোগ থাকবে। সত্যিকারের জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত হবে একটি সরকার একটি পার্লামেন্ট।
এখন দুই দলের মধ্যে সমঝোতা আদৌ সম্ভব কি না এমন প্রশ্নে বিশিষ্ট এ নাগরিক বলেন, হানাহানি-মারামারি ও দেশী-বিদেশী চাপ সত্ত্বেও সমঝোতা হয়নি দু’টি পক্ষের মধ্যে। ভবিষ্যতে যে হবে তার শতকরা এক ভাগও নিশ্চয়তা নেই। বিশেষ করে যে ইস্যু থেকে বিরোধের সৃষ্টি, সেই ইস্যুর ন্যায্যতা যদি সরকারি পক্ষ স্বীকার না করে তা হলে তো তারা আলোচনা বা সংলাপেই বসবেন না। অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দলও যদি কোন কোন বিষয়ে ছাড় দিতে না চায় তা হলে সরকারের পক্ষেও অনড় থাকাই স্বাভাবিক। যার পরিণাম সমঝোতা না হওয়া। একটি নির্দলীয় এবং মোটের উপর নিরপেক্ষ একটি অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচন হোক- সেটাই অধিকাংশ মানুষের আশঙ্কা এবং দাতাগোষ্ঠীর চাপ। তা হলে ধারণা করা যায়, ১৪ দলীয় মহাজোটের পুনঃনির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন সম্ভব নয়। সুতরাং তারা তাতে সম্মত হবে না। ভারতের মিডিয়া ও কর্মকর্তাদের কথাবার্তা থেকে জানা গেছে তারা শেখ হাসিনার সরকারকেই ক্ষমতায় দেখতে চান। সেই মোতাবেকই নির্বাচন হয়েছে এবং গঠিত হয়েছে সরকার। সুতরাং, সমঝোতা আলোচনার মাধ্যমে কিভাবে হবে? তারপরেও বড় দলগুলোর নেতারা যদি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাস করতেন তা হলে নিজেদের ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতির বাইরে গিয়ে দেশের স্বার্থে তারা একটি সমঝোতার পথ বের করতেন। এখন মন্ত্রীরা বলছেন, পাঁচ বছর পরে নির্বাচন হবে। এর আগে নির্বাচনের কোন সম্ভাবনা নাই। তা যদি না থাকে, তা হলে সমঝোতা কি?
দেশে যে একটা সর্বাত্মক সঙ্কট আছে, তা কি নেতারা উপলব্ধি করেন? বর্তমানে পৃথিবীর কাছে বাংলাদেশের মুখ দেখাবার উপায় নেই। এই দেশের কংগ্রেসে, ওই দেশের পার্লামেন্টে, প্রভৃতি জায়গায় বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, বিচার-সালিশ হচ্ছে, প্রস্তাব পাস হচ্ছে, আরও কতো কি হচ্ছে- কিন্তু সরকার তা তিন তুড়িতে উড়িয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশ আজ অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি সঙ্কটে আবর্তিত। স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে অস্তিত্বের সঙ্কটে। জনগণ বুঝতে পারছে, নেতারা বুঝতে পারছেন না- তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। আমরা অতীতে অনেক সঙ্কট পার হয়ে এসেছি। নেতারাই তা সমাধান করেছেন। আজকের সঙ্কট আর যে কোন সঙ্কটের চেয়ে গভীর। একাত্তরে মানুষ অকাতরে জীবন দিয়েছিল, অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করেছিল, কিন্তু তাদের সামনে স্বপ্ন ছিল তারা তার বিনিময়ে পাবে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। সেই রাষ্ট্রে থাকবে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার। মানুষে মানুষে বৈষম্য থাকবে কম। আজ কি দেখছি। একাত্তরের চেতনার লেশমাত্র নেই কোথাও।
তিনি বলেন, সরকারি ও বিরোধী দলের বড় বড় নেতারা দায়িত্বজ্ঞানহীন কথাবার্তা বলছেন। অতীতে অনেক রকম সমস্যা ছিল কিন্তু স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে কোন সংশয় ছিল না। আজ মানুষের সেটা নিয়েই সবচেয়ে বড় উদ্বেগ। এ অবস্থায় শুধু একটি সুযোগ্য নেতৃত্বের অধীনে ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলনই রাষ্ট্রকে আবার স্বাভাবিক জায়গায় নিয়ে যেতে পারে বলে মত দেন তিনি। আলোচনার জন্য ‘জামায়াত’ ছাড়ার শর্ত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এসব শর্তের কোন মূল্য নেই। সমঝোতার ইচ্ছা থাকলে বসেই অনেক বিষয়ের ফয়সালা সম্ভব। জামায়াত ইস্যু নিয়েও আলোচনা হতে পারে। অন্যান্য বিষয়েও আলোচনা হতে পারে। কোন পক্ষেরই শর্ত দিয়ে অনড় থাকা ঠিক নয়।
জাতীয় পার্টির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গণতন্ত্রের মাপকাঠিতে যেভাবে সংসদ নির্বাচন হয়েছে সেটা অগ্রহণযোগ্য। তাছাড়া গঠনের পরে জাতীয় পার্টির সঙ্গে সরকারের যে সম্পর্ক তাতে তাকে কোনক্রমেই বিরোধী দলের পর্যায়ে ফেলা যায় না। রওশন এরশাদকে বিরোধী দলের নেতার মর্যাদা দেয়া আর এরশাদকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত করা সম্পূর্ণ এক গোঁজামিলের ব্যাপার। নির্বাচিত হলেও, যতো কম ভোটেই নির্বাচিত হোক, এই সংসদকে গণতান্ত্রিক সংসদ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় না। একে ভবিষ্যতে ইতিহাসবিদরা অত্যন্ত খারাপভাবে চিত্রিত করবে বলেই আমার বিশ্বাস।
তিনি বলেন, বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করেও জাতীয় পার্টিকে নিয়ে সংসদীয় রীতিনীতি সম্মত একটি পার্লামেন্ট প্রতিষ্ঠা করা যেত। জাতীয় পার্টিকে প্রকাশ্যে একটি বিরোধীদলের রূপ দিতে পারতো। তলে তলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে তার যতোই বোঝাপড়া থাক। কিন্তু এখন যা করা হয়েছে তা গণতন্ত্রকে কলঙ্কিত করা ছাড়া আর কিছু নয়।
এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী কে- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমরা বড় দুই দলের কাছেই দেশটিকে ইজারা দিয়ে রেখেছি। সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার না করে যতোভাবে অপব্যবহার করা সম্ভব তা তারা করে আসছে। এই অবস্থায় ছোট দলগুলোর একটি গঠনমূলক ভূমিকা থাকতে পারত। কিন্তু তারা রুটিন সভা, সংবাদ সম্মেলন সেগুলো করেই মনে করছে তাদের দায়িত্ব পালন হলো। ছোট দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ চাপ থাকলে, আওয়ামী লীগ-বিএনপি স্বৈরাচারী হতে পারতো না। এবং আর যে দু’টি দল-জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী তারাও বড় দুই দলের লেজুড় হয়ে ক্ষমতায় ভাগ বসাতে পারতো না। বড় দুই দলের সঙ্গে মাঝারি ওই দুই দল, যুক্ত হয়ে নানান অপকীর্তি করে এখন গণতন্ত্রকে একেবারে কবর দিয়ে দিলো। তিনি বলেন, বিকল্প ধারা, কমিউনিস্ট পার্টি, বাসদ, গণফোরাম, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, জেএসডি প্রভৃতি দল সংঘবদ্ধ থাকলে তা খুব ছোট রাজনৈতিক শক্তি নয়। কিন্তু তারা এখন আর কোন সংগ্রামী সংগঠন নয়। নেতারা সভা-সমাবেশে বক্তব্য দিচ্ছেন, কিন্তু জনগণকে সংগঠিত করার চেষ্টা তাদের নেই। তা থাকলে এবং তাদের যদি এই বড় দুই দলের সঙ্গে কোনরকম জোট থাকতো তাহলে, এই বড় দুই দল, যা-খুশি তাই করতে পারতো না। এখন অপ্রধান দলগুলোর নিষ্ক্রীয়তার সুযোগে বড় দুই দল স্বেচ্ছাচারী, অগণতান্ত্রিক শক্তি পরিণত হয়েছে। আজকে দেশের এই দুর্দশার জন্য অপ্রধান দলগুলোও কম দায়ী নয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সারা পৃথিবীতে রাজনৈতিক সংগঠনের বাইরে নাগরিক সমাজ, অন্যরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আমাদের দেশী নাগরিক সমাজ স্বাধীনতার আগে এবং আশির দশক পর্যন্ত রাজনৈতিক ব্যাপারে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তারা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে তাদেরকে সহযোগিতা দিয়েছে। নব্বইয়ের দশক থেকে নাগরিকরা সমাজের বুদ্ধিজীবীরা দুই বড় দলের ব্যাপারে বিভক্ত হয়ে গেছে। তারা উঁচু চিন্তা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। অধিকাংশই ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে জাতীয় স্বার্থকে বিসর্জন দিয়েছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদদের এমন নির্লজ্জ দালালিমূলক ভূমিকা আর কখনও দেখা যায়নি। নামকরা বুদ্ধিজীবীরা সরকারকে অন্ধভাবে সমর্থন করে যাচ্ছেন। একদিন ইতিহাসের কাঠগড়ায় তাদের দাঁড়াতে হবে। দেশী বিদেশী শক্তির এজেন্ট হিসেবে তাদের যে ভূমিকা তা পাকিস্তান বাহিনীর দালালদের প্রায় কাছাকাছি। এই অবস্থাটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক। আজ বাংলাদেশে বহুজাতিক কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকতা করতে একশ্রেণীর মিডিয়াকে খুবই তৎপর দেখা যায়। জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় যখন বাম ও অন্যান্য দলগুলো আন্দোলন করে সেসব সংবাদ তারা সুকৌশলে চেপে যায়। ফলে সাধারণ মানুষের আবেগ-অনুভূতি সঠিকভাবে প্রচারিত হতে পারছে না। সুতরাং আজকের যে সঙ্কট, এই সঙ্কটের জন্য প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো যেমন দায়ী অপ্রধান রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজও কম দায়ী নয়।
No comments