বাংলাদেশে অর্থহীন নির্বাচন- কূলদীপ নায়ার
ভাগ্যের পালাবদল হয়, কোন সন্দেহ নেই। আজ যে শাসক, কাল সে প্রতিপক্ষ। তারপরও
বাংলাদেশে রাজনীতিতে বংশানুক্রমিক প্রতিহিংসা দৃশ্যমান। একজন স্বৈরশাসক তো
খারাপ বটেই।
কিন্তু সেটা আরও খারাপ হয় যখন তিনি ক্ষমতা ছাড়তে চান না। এটা
বাংলাদেশের অত্যন্ত জটিল এক সমস্যা। পাকিস্তানভিত্তিক প্রভাবশালী দৈনিক
‘পাকিস্তান অবজারভারে’র অনলাইন সংস্করণে ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক,
কলামনিস্ট, মানবাধিকার কর্মী ও লেখক কুলদীপ নায়ার ‘পয়েন্টলেস পোলস ইন
বাংলাদেশ’ বা ‘বাংলাদেশে অর্থহীন নির্বাচন’ শিরোনামে একটি বিশ্লেষণধর্মী
লেখা লিখেছেন। কুলদীপ নায়ার লিখেছেন, বিরোধী দলগুলো নির্দলীয় সরকারের অধীনে
অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়েছিল। এর পরিবর্তে হাসিনা তার
সরকারের অধীনেই নির্বাচন সম্পন্ন করে। এর আগে সংবিধান সংশোধন করে বাতিল
করা হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। প্রহসনের এ নির্বাচনে, একটিও ভোট পড়ার
আগে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন ১৫৪ জন প্রার্থী। আর একতরফা ভোটে
আরও ১০৩ জন। তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশের একটি দৈনিক সংবাদপত্রের চালানো
মতামত জরিপে দেখা গেছে, ৭৭ শতাংশ মানুষই নির্বাচনের বিপক্ষে। বিএনপিসহ
অধিকাংশ দল যখন নির্বাচন বর্জন করেছে ও নতুন সরকারকে মেনে নিতে অস্বীকৃতি
জানিয়েছে, তখন হাসিনার এ বিজয় তেমন কোন অর্থ বহন করে না। এদিকে জামায়াতে
ইসলামী তাদের নীতি অনুসরণ করে সমাজে মেরুকরণ ও মৌলবাদ ছড়িয়ে দিচ্ছে।
জামায়াতের মতো সংঘবদ্ধ দল সমাজের বুদ্ধিজীবী সমপ্রদায়ের মধ্যেও অনুপ্রবেশ
করেছে। ক্যাডারদের দিয়ে সহিংসতাই তাদের অবদান। কুলদীপ নায়ার আরও লিখেছেন,
দুর্ভাগ্যবশত ভারত পরিষ্কারভাবেই হাসিনার পাশে দাঁড়িয়েছে। কোন সন্দেহ নেই,
হাসিনা তার পিতা ও বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের মতোই
ধর্মনিরপেক্ষ ও তিনি একনিষ্ঠভাবেই মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক। কিন্তু যে কোন
মূল্যে তার ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার দৃঢ় সঙ্কল্প সব আদর্শকে হাওয়ায় মিলিয়ে
দিয়েছে। নয়া দিল্লির উচিত ছিল একটি সৌহার্দমূলক ভূমিকা পালন করা। শুরুর
দিকে নয়া দিল্লি সেটাই করেছিল। কিন্তু এখন তাদের একচোখা নীতি বা ভূমিকা
পরিলক্ষিত হচ্ছে। বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব ছড়িয়ে পড়ছে এবং প্রায় ৮০ লাখ
হিন্দু জনগোষ্ঠী তার উত্তাপ অনুভব করছে। ভারতের যদি কারও প্রতি অনুরাগ বা
সমর্থন জানাতেই হয়, তবে তার উচিত তৃতীয় ফ্রন্ট হিসেবে বাংলাদেশের প্রথম
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন ও নোবেল জয়ী ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসকে
সমর্থন দেয়া। কলামের শুরুতে নায়ার লিখেছেন, বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী
মওদুদ আহমেদ যখন ঢাকার একটি হোটেল থেকে বের হচ্ছিলেন, তখন তাকে গ্রেপ্তার
করে পুলিশ। তার অপরাধ তিনি দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার
নেতৃত্বাধীন প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) একজন
শীর্ষস্থানীয় নেতা। আওয়ামী লীগ প্রধান ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনা তাদের দুই জনকেই অত্যন্ত অপছন্দ করেন। মওদুদ শেষবার আটক হয়েছিলেন
জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনের সময়। এখন এরশাদও কার্যত আটক। এরশাদ ও তার দল
জাতীয় পার্টি প্রধানমন্ত্রীকে সমর্থন না দেয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত
নিয়েছিলেন। যুদ্ধাপরাধ বিচার নিয়ে কুলদীপ নায়ার বলেন, যে দলের অধীনে দেশ
স্বাধীন হয়েছে, তাদের উচিত যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা। তা সত্ত্বেও
৮০ বছরের বেশি বয়সী কোন ব্যক্তিকে ফাঁসিতে ঝোলানোর যৌক্তিকতা খুবই
সামান্য। পাকিস্তানের পার্লামেন্টে কাদের মোল্লাকে শহীদ আখ্যা দিয়ে
সর্বসম্মতভাবে যে বিলটি পাস করা হয়, তাতে পাকিস্তানের পক্ষপাতিত্বমূলক
মনোভাবের বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করে। অনুশোচনা প্রকাশের পরিবর্তে পাকিস্তান
এমনভাবে ভূমিকা অবলম্বন করে চলেছে যেন তারা তাদের কৃতকর্মের ব্যাপারে
অনুতপ্ত নয়। বাংলাদেশের ব্যাপারে ভুল নীতি অনুসরণ করছে পাকিস্তান।
পাকিস্তান বারবার প্রমাণ করছে যে, তারা কায়েদ-এ-আজম মোহাম্মদ আলি জিন্নাহর
প্রত্যাশার কাছাকাছি পৌঁছতে পারেনি। তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে অন্য রাষ্ট্রের
সম্পর্কে রাজনীতিকে না জড়ানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন। আফগানিস্তান ও কাশ্মীরের
বিরুদ্ধে লড়াই করতে তালেবানকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল ইসলামাবাদ। সেই
তালেবানরাই এখন পাকিস্তানের স্থিতিশীলতাকে বিপন্ন করে তুলছে। পাকিস্তানে
মৌলবাদ বেড়ে চলেছে ও নিরপেক্ষ কণ্ঠস্বর সেখানে প্রায় নেই বললেই চলে।
আইনজীবীরা যখন পাঞ্জাব প্রদেশের গভর্নর তাসির হত্যা মামলায় অভিযুক্তের ওপর
ফুলের পাপড়ি ছিটায়, তাতেই পাকিস্তানে জঙ্গিবাদ যে কতটা গভীরে প্রবেশ করেছে
তা প্রকাশ পায়। কুলদীপ নায়ার বলেন, সবচেয়ে আতঙ্কজনক বিষয়টি হচ্ছে,
বাংলাদেশে একটানা চলতে থাকা সহিংসতা। নির্বাচন বয়কটে বিভিন্ন কর্মসূচি ও
হরতালে বহু মানুষ নিহত হয়েছেন। এটা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে প্রভাবিত করবেই,
যেখানে গত ৫ বছর ধরে ৬ শতাংশ হারে সুষম প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। বেকারত্ব,
দরিদ্রতা ও মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে। খালেদা বা হাসিনা কেউই এ পরিস্থিতি নিয়ে
উদ্বিগ্ন নন যা দিন দিন আরও অবনতির দিকে ধাবিত হচ্ছে।
No comments