ক্ষতিগ্রস্ত আওয়ামী লীগ এবং পরাজিত শেখ হাসিনা by আমীর খসরু
একের
পর এক নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ, ওয়াদার বরখেলাপ এবং আইন-শৃঙ্খলা
পরিস্থিতির অবনতি, নানাবিধ দুর্নীতি - কেলেঙ্কারি, লুটপাটসহ সামগ্রিক
দুঃশাসনের কারণে শেখ হাসিনার সরকার ক্রমাগত জনসমর্থন হারাচ্ছিল এ কথা ঠিক,
জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছিল তাও বলা হচ্ছিল। কিন্তু বাস্তবে অবস্থা যে এতই করুণ
তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার সরকার, দল কখনই স্বীকার করেনি। জনপ্রিয়তা
যে একেবারেই তলানিতে এসে ঠেকেছে তা ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটি না হলে বুঝতে
পারা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হতো না। বোঝা সম্ভব হতো না জনপ্রিয়তার এমন
দুর্দশাগ্রস্ত পরিস্থিতি। দলের কিংবা মহাজোটে যারা রয়েছে তারাও এখন স্বীকার
করতে বাধ্য হবে জনপ্রিয়তাহীন ‘নড়বড়ে’ ঘরে তাদের বসবাস। ৫ জানুয়ারি
নির্বাচন নিয়ে ইতোমধ্যে নানা বিচার-বিশ্লেষণ হয়েছে, কাজেই সে সব বিস্তারিত
হিসাব-পত্রে না গিয়ে বলা যায়, ক্ষমতাসীন দল এবং এর জোট সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা
যে এমন একটি নির্বাচনে ভোট দিতে যাবে না তা বিশ্বাস করাও কঠিন হচ্ছিল। শেখ
হাসিনা এবং তার মন্ত্রণাদাতাদের ধারণা ছিল, অন্তত অতীত দুটো নির্বাচন
অর্থাৎ ২০০৮ এবং ২০০১-এর গড় ভোট প্রাপ্তি ধরলেও আওয়ামী লীগের নিজস্ব ভোট
রয়েছে ৩০ থেকে ৩২ শতাংশের কম-বেশি। এছাড়া যুদ্ধাপরাধের বিচার এবং
মুক্তিযুদ্ধসহ নানাবিধ চেতনার সমর্থকদের কারণে ওই ভোটের সঙ্গে উদার ধারার
ভোটারদের ভোট সংখ্যা যোগ দিলে তা আরো বেড়ে যাবে বলেই ধারণা করেছিলেন স্বয়ং
শেখ হাসিনা। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী তরুণদের মনে
যুদ্ধাপরাধের বিচার তাদের চিন্তায়-চেতনায় বড় ধরনের নাড়া দিয়েছে। এই তরুণদের
ভোটের হিসেবও আওয়ামী লীগ ধরে নিয়েছিল ওই হিসাবের মধ্যে। আওয়ামী লীগ ধারণা
করেছিল “২০২১-এর রূপকল্প” তরুণদের আন্দোলিত এবং মোহাচ্ছন্ন করে ফেলেছে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী তরুণরা যুদ্ধাপরাধের বিচারে নিঃসন্দেহে
আনন্দিত ও আন্দোলিত হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তাদের সন্দেহ খোদ
আওয়ামী লীগকে নিয়ে। কারণ কাদের মোল্লার বিচারের রায়ের সময় সরকারের পক্ষ
থেকে জামায়াতের সঙ্গে যে আঁতাত প্রচেষ্টা এবং যুদ্ধাপরাধের বিচারে সরকার
আসলেই আন্তরিক নয় - তা তারা আগেই বুঝে ফেলেছে। এ কারণেই চাপ হিসেবে গণজাগরণ
মঞ্চসহ নানা প্রচেষ্টা জন্ম নিয়েছিল ওই আঁতাত ঠেকানোর জন্য। ওই যে ধাক্কা
তা তরুণদের মনে দগ-দগে ঘা হিসেবে এখনো রয়ে গেছে। এ কারণে তরুণদের সমর্থন
আওয়ামী লীগ তো পায়ইনি বরং প্রতিশ্রুতি, ওয়াদা ভঙ্গ, দুর্নীতি, শেয়ারবাজার
কেলেঙ্কারিসহ সামগ্রিক দুঃশাসনের কারণে তারা আওয়ামী লীগের ওপরে ভীষণভাবে
বিতশ্রদ্ধ। প্রথমবারের মতো ভোটাররা এবার নিজ চোখে দেখে বুঝতে পেরেছে আওয়ামী
লীগের শাসন কি এবং কেমন হয়। এছাড়া বেকারত্ব হ্রাসের যে মোহনীয় স্লোগান
দেয়া হয়েছিল তা যে শ্রেফ কথার কথা তাও তারা বুঝতে পেরেছে। কাজেই তরুণদের
মধ্যে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠার বদলে বরং বৈরী সম্পর্কই তৈরি হয়েছে
এবং এখনো তা বিদ্যমান রয়েছে। ভবিষ্যতে এটি বাড়বে বৈ কমবে না।
ব্যবসায়ীদের একাংশের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সখ্যতার সম্পর্ক অনেক দিনের। বিশেষ করে যারা ধনাঢ্য কৃষক, মধ্যবিত্ত, পেটিবুর্জোয়া শ্রেণী থেকে আগত তাদের সঙ্গে এ সম্পর্কটির সূচনা হয়েছিল স্বাধীনতার ঠিক পরপরই। কিন্তু বর্তমানে দেশের বিদ্যমান ব্যবসায়িক ও আর্থিক পরিস্থিতি এবং একশ্রেণীর আওয়ামী সমর্থকদের ব্যবসা-বাণিজ্য দখলে তারা হয়ে পড়ে ভীত-সন্ত্রস্ত। অসহায় হয়ে পড়েছেন বিনিয়োগ পরিস্থিতি, গ্যাস-বিদ্যুৎসহ সার্বিক অবকাঠামো উন্নয়নে আওয়ামী লীগ সরকারের অক্ষমতায় এবং ব্যর্থতায়। প্রশাসনসহ সর্বত্রই দলীয়করণে আপন-আপন পেশাজীবীদের সামান্য কোনো মোহ যদি আওয়ামী লীগের ওপরে থেকেই থাকে তা ভঙ্গ হয়েছে ব্যাপক মাত্রায়, অনেক আগেই। গ্রামীণ জনপদে আওয়ামী লীগ এখন একটি আতঙ্কের নাম। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী-সমর্থকদের অত্যাচার-নির্যাতন, সার-কীটনাশক সম্পর্কে দেয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ এবং উৎপাদিত পণ্যের বাজার মূল্যে না পেয়ে তারা এমন মাত্রায় আতঙ্কিত যে অতীতে আর এমনটি তাদের ক্ষেত্রে ঘটেনি।
শেখ হাসিনার শাসন দেশের জন্য যতোটা ক্ষতির কারণ হয়েছে, তার চেয়েও বেশি ক্ষতি হয়ে গেছে দীর্ঘদিনের দল আওয়ামী লীগের। সামগ্রিক পরিস্থিতিতে দলের হ্রাস আছে, স্ফীতি নেই। দলে যারা নতুন এসেছেন, তাদের সংখ্যা একেবারে কম নয়, তারা আদর্শিক কারণে নয়, বরং ক্ষমতার মোহ এবং প্রাপ্তির প্রত্যাশাই এসে জুটেছে। তারা এসে উঠে গেছে অনেক উপরে, দলের পোঢ় খাওয়া দীর্ঘকালের নেতা-কর্মীদের কনুই দিয়ে ধাক্কা মেরে, অন্য জোরে। আওয়ামী লীগ এখন আর পোঢ় খাওয়া নেতা-কর্মী নির্ভর না হয়ে বরং হয়ে উঠেছে সুযোগ সন্ধানী সাইবেরিয়ান পাখীদের মতো নেতা এবং আমলা নির্ভর। আওয়ামী লীগের মতো কোনো রাজনৈতিক দলের এমন আমলা নির্ভর হয়ে পড়াটা যে কতোটা বিপজ্জনক তা আওয়ামী লীগ এখনও বুঝতে পারছে বলে মনে হয় না। বরং এদের আওয়ামী লীগে অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টির জন্য নির্দিষ্ট মেয়াদে দলের সদস্য থাকার পরেই নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ থাকার ব্যবস্থাটিও নির্বাচনী ব্যবস্থা থেকে তুলে দেয়া হয়েছে। এটা আওয়ামী লীগ তো অবশ্যই, পুরো রাজনীতির জন্যই এক দুঃসংবাদ। এক হিসাবে দেখা যায়, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে নির্বাচিতদের মধ্যে ব্যবসায়ী-শিল্পপতির সংখ্যা ছিল শতকরা ৪ শতাংশের নিচে। এখন তা ৭০ শতাংশেরও বেশি হবে।
দুর্নীতি, কেলেঙ্কারি এবং ভাগ-বাটোয়ারা, সম্পদের স্ফীতির কারণে আওয়ামী লীগের নব্য এবং পুরনো বিভাজনের পাশাপাশি আরেকটি বিভাজন তৈরি হয়েছে। অর্থাৎ যারা পেয়েছেন এবং যারা পাননি। বিগত ৫ বছরে যাদের সম্পদের স্ফীতি ঘটেছে তারা একদিকে এবং যারা কিছুই পাননি বা চাননি তারা অন্য পক্ষে। এভাবে পক্ষ-বিপক্ষের বিভাজন সৃষ্টি হওয়ায় আসল ক্ষতি হয়েছে খোদ আওয়ামী লীগ নামক দলটির। কারণ এখন আওয়ামী লীগ যদি কোনো সঙ্কটে পরে তখন যারা নব্য কিংবা ক্ষমতাবান অথবা যাদের সম্পদের স্ফীতি ঘটেছে বহুগুণে তারা কেন রাস্তায় নামবেন বা সঙ্কট মোকাবেলায় সক্রিয় থাকবেন? কারণ তাদের প্রাপ্ত সম্পদ রক্ষা দল রক্ষার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে। আর যারা বঞ্চিত তারাই বা কেন নামবেন রাস্তায় বা সঙ্কট মোকাবেলায়?
আওয়ামী লীগেও পরিবার এবং উত্তরাধিকারের রাজনীতি নিয়ে ইতোমধ্যে অনানুষ্ঠানিক কেন্দ্রগুলোর উত্থান হয়েছে। এসব কেন্দ্রকে ঘিরে নতুন নতুন উপকেন্দ্রেরও জন্ম হচ্ছে। এ সম্পর্কে ভবিষ্যতে বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে।
এ সব প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, ক্ষমতার কর্তৃত্ব, সম্পদের অংশীদারিত্ব নিয়ে ভাগাভাগি, নব্য-পুরনোসহ নানা কারণে বিভাজন সৃষ্টির জন্য আওয়ামী লীগের ইতোমধ্যেই যথেষ্ট ক্ষতি হয়ে গেছে। সুষ্ঠু ধারায় রাজনীতি করলে, উইনার টেকস অল অর্থাৎ ক্ষমতায় যিনি থাকবেন তিনি সবটাই নিয়ে নেবেন- এমন ধারণার রাজনীতি না করে সামান্য সুশাসনকে প্রাধান্য দিয়ে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনকেন্দ্রীক রাজনীতি করলে দলটির এ পরিস্থিতি হতো না। এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে দলটি কবে পারবে তা বলা কঠিন।
২০০৮-এ নির্বাচনের পরে ক্ষমতা গ্রহণের প্রথমদিন থেকেই বোঝা যাচ্ছিল আওয়ামী লীগ জয়ী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বড়মাত্রায় বিজয়ী হয়েছে পার্শ্ববর্তী দেশটি। করিডোরের নামে ট্রানজিট, বন্দর ব্যবহার, নৌ-সড়ক, রেলপথ উন্মুক্ত করে দেয়া, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদানের মধ্যদিয়ে এবং সীমান্ত হত্যার প্রতিবাদ না করাসহ বিভিন্ন কারণে ক্রমেই স্পষ্ট হয়েছিল, পার্শ্ববর্তীর বিজয়ের আসল রহস্য কি? আসলে তারা কি চায়? কিন্তু ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ও পড়ে এটা ভালো করেই দেশের মানুষ বুঝতে পেরেছে শাসক বাস্তবে কতোটা নতজানু এবং এ কারণে কতোটা অসহায় হয়ে পড়েছে এই ভূখণ্ডটি এবং এর মানুষ। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব আসলেই কতোটা স্বাধীন এবং সার্বভৌম? একটি ভূখন্ড, জনগোষ্ঠী আর জনগণের মধ্যে রাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্খা এবং এটি বিদ্যমান থাকাটাই স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের আসল গ্যারান্টি নয়। বাংলাদেশ তার স্বাধীন স্বকীয় সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারছে কিনা তাই হচ্ছে মূল বিষয়, মৌল উপাদান। যদি স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধাগ্রস্ত হতে হয় বা অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়ে তাহলে সে দেশটি কি স্বাধীন এবং সার্বভৌম?
৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দুনিয়ার যে কারো সঙ্গে কোনো সঙ্কট দেখা দিলেই তখন হয় বিরোধী দল অথবা ড. ইউনূসকে দায়ী করা হতো। আর একদল বুদ্ধি প্রতিবন্ধী দলদাস বুদ্ধিজীবী এবং বাক্সজীবী সে সব কথা অতি উচ্চস্বরে প্রচার করতো। কিন্তু ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে গেছে বিষয়টি ব্যক্তির বা দলের নয় - বিষয়গুলো ওই সব দেশের নীতিমালা এবং আকাঙ্খার প্রতিফলন। শুধু পশ্চিমা নয়, মধ্যপ্রাচ্যসহ তামাম দুনিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের এখন কোনো সুসম্পর্ক নেই। বাংলাদেশকে যে কৌশলে একঘরে ফেলা হয়েছে এ সরকারের বহিদেশীয় মন্ত্রণাদাতা, তা এখন সরকার প্রধান মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারলেও করার কিছু নেই। বরং মনে করা হচ্ছে তারাই সব ঠিক করে দেবে। এটির সম্ভাবনা খুবই কম। যে কারণে এখন আন্তর্জাতিক বৈধতার সন্ধানে এই সরকারটিকে ছুটতে হচ্ছে দেশ থেকে দেশে অভিনন্দন বার্তা জোগাড়ের জন্য। সরকার আপাত তৃপ্ত চীন এবং রাশিয়ার অভিনন্দন বার্তায়। তবে আসল বিষয় হচ্ছে, এ দুটো দেশের অভিনন্দন বার্তা যে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থেই তা অনেকেই বুঝতে পারছেন।
বর্তমান দুনিয়ায় প্রতিনিধিত্বশীল শাসন ব্যবস্থায় ক্ষমতা বিকেন্দ্রায়নের মধ্যে দিয়ে সমন্বিত উদ্যোগে সরকার পরিচালনা করতে হয়। তাহলে সরকারটির ভালো-মন্দ, সাফল্যে বা ব্যর্থতার দায় সবার উপরেই বর্তায়। যদিও টিম লিডার বা সরকার প্রধান হিসেবে কিছুটা বেশী দায় তো থাকবেই। কিন্তু বাংলাদেশের সরকার ব্যবস্থাগুলো যেহেতু অতিমাত্রায় কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার অর্থাৎ এক ব্যক্তি কেন্দ্রিক ও কর্তৃত্বেরই পরিচালিত সে কারণে সরকারটির পুরো দায়দায়িত্ব ওই একজনকেই পুরোটা নিতে হয়। কাজেই ৫ জানুয়ারির নির্বাচনসহ পুরো সরকারের ব্যর্থতার দায় একজনকেই বহন করতে হচ্ছে। একমাত্র তিনিই চিন্তাযুক্ত সামগ্রিক পরিস্থিতি, বিশেষ করে ভবিষ্যৎ নিয়ে।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তাদের বিজয় হয়েছে। চিন্তা করলে দেখা যাবে, আসলে শেখ হাসিনাই পরাজিত হয়েছেন - আর কেউই নয়। তার পরিবারের বা দলেরও কেউ নয়। পরাজয়ের নানা কারণ ইতোমধ্যে বলা হয়েছে। তবে একটি বিষয় চিন্তা করুন - যে শেখ হাসিনা বিএনপি এবং খালেদা জিয়াকে ১৯৯৬-এর নির্বাচনটি নিয়ে যারপরনাই সমালোচনা করতে পারতেন, কিন্তু এখন তার পক্ষে সেটি আর সম্ভব হচ্ছে না। হবেও না আর কোনোদিন। তাহলে কে পরাজিত হয়েছেন?
ব্যবসায়ীদের একাংশের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সখ্যতার সম্পর্ক অনেক দিনের। বিশেষ করে যারা ধনাঢ্য কৃষক, মধ্যবিত্ত, পেটিবুর্জোয়া শ্রেণী থেকে আগত তাদের সঙ্গে এ সম্পর্কটির সূচনা হয়েছিল স্বাধীনতার ঠিক পরপরই। কিন্তু বর্তমানে দেশের বিদ্যমান ব্যবসায়িক ও আর্থিক পরিস্থিতি এবং একশ্রেণীর আওয়ামী সমর্থকদের ব্যবসা-বাণিজ্য দখলে তারা হয়ে পড়ে ভীত-সন্ত্রস্ত। অসহায় হয়ে পড়েছেন বিনিয়োগ পরিস্থিতি, গ্যাস-বিদ্যুৎসহ সার্বিক অবকাঠামো উন্নয়নে আওয়ামী লীগ সরকারের অক্ষমতায় এবং ব্যর্থতায়। প্রশাসনসহ সর্বত্রই দলীয়করণে আপন-আপন পেশাজীবীদের সামান্য কোনো মোহ যদি আওয়ামী লীগের ওপরে থেকেই থাকে তা ভঙ্গ হয়েছে ব্যাপক মাত্রায়, অনেক আগেই। গ্রামীণ জনপদে আওয়ামী লীগ এখন একটি আতঙ্কের নাম। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী-সমর্থকদের অত্যাচার-নির্যাতন, সার-কীটনাশক সম্পর্কে দেয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ এবং উৎপাদিত পণ্যের বাজার মূল্যে না পেয়ে তারা এমন মাত্রায় আতঙ্কিত যে অতীতে আর এমনটি তাদের ক্ষেত্রে ঘটেনি।
শেখ হাসিনার শাসন দেশের জন্য যতোটা ক্ষতির কারণ হয়েছে, তার চেয়েও বেশি ক্ষতি হয়ে গেছে দীর্ঘদিনের দল আওয়ামী লীগের। সামগ্রিক পরিস্থিতিতে দলের হ্রাস আছে, স্ফীতি নেই। দলে যারা নতুন এসেছেন, তাদের সংখ্যা একেবারে কম নয়, তারা আদর্শিক কারণে নয়, বরং ক্ষমতার মোহ এবং প্রাপ্তির প্রত্যাশাই এসে জুটেছে। তারা এসে উঠে গেছে অনেক উপরে, দলের পোঢ় খাওয়া দীর্ঘকালের নেতা-কর্মীদের কনুই দিয়ে ধাক্কা মেরে, অন্য জোরে। আওয়ামী লীগ এখন আর পোঢ় খাওয়া নেতা-কর্মী নির্ভর না হয়ে বরং হয়ে উঠেছে সুযোগ সন্ধানী সাইবেরিয়ান পাখীদের মতো নেতা এবং আমলা নির্ভর। আওয়ামী লীগের মতো কোনো রাজনৈতিক দলের এমন আমলা নির্ভর হয়ে পড়াটা যে কতোটা বিপজ্জনক তা আওয়ামী লীগ এখনও বুঝতে পারছে বলে মনে হয় না। বরং এদের আওয়ামী লীগে অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টির জন্য নির্দিষ্ট মেয়াদে দলের সদস্য থাকার পরেই নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ থাকার ব্যবস্থাটিও নির্বাচনী ব্যবস্থা থেকে তুলে দেয়া হয়েছে। এটা আওয়ামী লীগ তো অবশ্যই, পুরো রাজনীতির জন্যই এক দুঃসংবাদ। এক হিসাবে দেখা যায়, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে নির্বাচিতদের মধ্যে ব্যবসায়ী-শিল্পপতির সংখ্যা ছিল শতকরা ৪ শতাংশের নিচে। এখন তা ৭০ শতাংশেরও বেশি হবে।
দুর্নীতি, কেলেঙ্কারি এবং ভাগ-বাটোয়ারা, সম্পদের স্ফীতির কারণে আওয়ামী লীগের নব্য এবং পুরনো বিভাজনের পাশাপাশি আরেকটি বিভাজন তৈরি হয়েছে। অর্থাৎ যারা পেয়েছেন এবং যারা পাননি। বিগত ৫ বছরে যাদের সম্পদের স্ফীতি ঘটেছে তারা একদিকে এবং যারা কিছুই পাননি বা চাননি তারা অন্য পক্ষে। এভাবে পক্ষ-বিপক্ষের বিভাজন সৃষ্টি হওয়ায় আসল ক্ষতি হয়েছে খোদ আওয়ামী লীগ নামক দলটির। কারণ এখন আওয়ামী লীগ যদি কোনো সঙ্কটে পরে তখন যারা নব্য কিংবা ক্ষমতাবান অথবা যাদের সম্পদের স্ফীতি ঘটেছে বহুগুণে তারা কেন রাস্তায় নামবেন বা সঙ্কট মোকাবেলায় সক্রিয় থাকবেন? কারণ তাদের প্রাপ্ত সম্পদ রক্ষা দল রক্ষার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে। আর যারা বঞ্চিত তারাই বা কেন নামবেন রাস্তায় বা সঙ্কট মোকাবেলায়?
আওয়ামী লীগেও পরিবার এবং উত্তরাধিকারের রাজনীতি নিয়ে ইতোমধ্যে অনানুষ্ঠানিক কেন্দ্রগুলোর উত্থান হয়েছে। এসব কেন্দ্রকে ঘিরে নতুন নতুন উপকেন্দ্রেরও জন্ম হচ্ছে। এ সম্পর্কে ভবিষ্যতে বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে।
এ সব প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, ক্ষমতার কর্তৃত্ব, সম্পদের অংশীদারিত্ব নিয়ে ভাগাভাগি, নব্য-পুরনোসহ নানা কারণে বিভাজন সৃষ্টির জন্য আওয়ামী লীগের ইতোমধ্যেই যথেষ্ট ক্ষতি হয়ে গেছে। সুষ্ঠু ধারায় রাজনীতি করলে, উইনার টেকস অল অর্থাৎ ক্ষমতায় যিনি থাকবেন তিনি সবটাই নিয়ে নেবেন- এমন ধারণার রাজনীতি না করে সামান্য সুশাসনকে প্রাধান্য দিয়ে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনকেন্দ্রীক রাজনীতি করলে দলটির এ পরিস্থিতি হতো না। এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে দলটি কবে পারবে তা বলা কঠিন।
২০০৮-এ নির্বাচনের পরে ক্ষমতা গ্রহণের প্রথমদিন থেকেই বোঝা যাচ্ছিল আওয়ামী লীগ জয়ী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বড়মাত্রায় বিজয়ী হয়েছে পার্শ্ববর্তী দেশটি। করিডোরের নামে ট্রানজিট, বন্দর ব্যবহার, নৌ-সড়ক, রেলপথ উন্মুক্ত করে দেয়া, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদানের মধ্যদিয়ে এবং সীমান্ত হত্যার প্রতিবাদ না করাসহ বিভিন্ন কারণে ক্রমেই স্পষ্ট হয়েছিল, পার্শ্ববর্তীর বিজয়ের আসল রহস্য কি? আসলে তারা কি চায়? কিন্তু ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ও পড়ে এটা ভালো করেই দেশের মানুষ বুঝতে পেরেছে শাসক বাস্তবে কতোটা নতজানু এবং এ কারণে কতোটা অসহায় হয়ে পড়েছে এই ভূখণ্ডটি এবং এর মানুষ। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব আসলেই কতোটা স্বাধীন এবং সার্বভৌম? একটি ভূখন্ড, জনগোষ্ঠী আর জনগণের মধ্যে রাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্খা এবং এটি বিদ্যমান থাকাটাই স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের আসল গ্যারান্টি নয়। বাংলাদেশ তার স্বাধীন স্বকীয় সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারছে কিনা তাই হচ্ছে মূল বিষয়, মৌল উপাদান। যদি স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধাগ্রস্ত হতে হয় বা অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়ে তাহলে সে দেশটি কি স্বাধীন এবং সার্বভৌম?
৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দুনিয়ার যে কারো সঙ্গে কোনো সঙ্কট দেখা দিলেই তখন হয় বিরোধী দল অথবা ড. ইউনূসকে দায়ী করা হতো। আর একদল বুদ্ধি প্রতিবন্ধী দলদাস বুদ্ধিজীবী এবং বাক্সজীবী সে সব কথা অতি উচ্চস্বরে প্রচার করতো। কিন্তু ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে গেছে বিষয়টি ব্যক্তির বা দলের নয় - বিষয়গুলো ওই সব দেশের নীতিমালা এবং আকাঙ্খার প্রতিফলন। শুধু পশ্চিমা নয়, মধ্যপ্রাচ্যসহ তামাম দুনিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের এখন কোনো সুসম্পর্ক নেই। বাংলাদেশকে যে কৌশলে একঘরে ফেলা হয়েছে এ সরকারের বহিদেশীয় মন্ত্রণাদাতা, তা এখন সরকার প্রধান মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারলেও করার কিছু নেই। বরং মনে করা হচ্ছে তারাই সব ঠিক করে দেবে। এটির সম্ভাবনা খুবই কম। যে কারণে এখন আন্তর্জাতিক বৈধতার সন্ধানে এই সরকারটিকে ছুটতে হচ্ছে দেশ থেকে দেশে অভিনন্দন বার্তা জোগাড়ের জন্য। সরকার আপাত তৃপ্ত চীন এবং রাশিয়ার অভিনন্দন বার্তায়। তবে আসল বিষয় হচ্ছে, এ দুটো দেশের অভিনন্দন বার্তা যে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থেই তা অনেকেই বুঝতে পারছেন।
বর্তমান দুনিয়ায় প্রতিনিধিত্বশীল শাসন ব্যবস্থায় ক্ষমতা বিকেন্দ্রায়নের মধ্যে দিয়ে সমন্বিত উদ্যোগে সরকার পরিচালনা করতে হয়। তাহলে সরকারটির ভালো-মন্দ, সাফল্যে বা ব্যর্থতার দায় সবার উপরেই বর্তায়। যদিও টিম লিডার বা সরকার প্রধান হিসেবে কিছুটা বেশী দায় তো থাকবেই। কিন্তু বাংলাদেশের সরকার ব্যবস্থাগুলো যেহেতু অতিমাত্রায় কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার অর্থাৎ এক ব্যক্তি কেন্দ্রিক ও কর্তৃত্বেরই পরিচালিত সে কারণে সরকারটির পুরো দায়দায়িত্ব ওই একজনকেই পুরোটা নিতে হয়। কাজেই ৫ জানুয়ারির নির্বাচনসহ পুরো সরকারের ব্যর্থতার দায় একজনকেই বহন করতে হচ্ছে। একমাত্র তিনিই চিন্তাযুক্ত সামগ্রিক পরিস্থিতি, বিশেষ করে ভবিষ্যৎ নিয়ে।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তাদের বিজয় হয়েছে। চিন্তা করলে দেখা যাবে, আসলে শেখ হাসিনাই পরাজিত হয়েছেন - আর কেউই নয়। তার পরিবারের বা দলেরও কেউ নয়। পরাজয়ের নানা কারণ ইতোমধ্যে বলা হয়েছে। তবে একটি বিষয় চিন্তা করুন - যে শেখ হাসিনা বিএনপি এবং খালেদা জিয়াকে ১৯৯৬-এর নির্বাচনটি নিয়ে যারপরনাই সমালোচনা করতে পারতেন, কিন্তু এখন তার পক্ষে সেটি আর সম্ভব হচ্ছে না। হবেও না আর কোনোদিন। তাহলে কে পরাজিত হয়েছেন?
No comments