বিএনপি ও ব্লেম গেম
বিএনপির প্রতি অভিযোগ আর উপদেশের বন্যা বইছে দেশে। সঙ্গে আছে হুমকিও। বিএনপিকে জামায়াত ছাড়তে হবে, ছাড়তে হবে জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষকতা আর সহিংসতা। বিএনপিকে ক্ষমা চাইতে হবে, খেসারত দিতে হবে, নেতৃত্বের কমান্ড ঠিক করতে হবে। বিএনপি গণতন্ত্রের ক্লাব থেকে বের হয়ে গেছে, সাম্প্রদায়িক হামলায় ইন্ধন দিচ্ছে, বিএনপি স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি, বিএনপির নেত্রীর বক্তব্য রাষ্ট্রদ্রোহমূলক। ৫ জানুয়ারি একটি প্রহসনমূলক ও প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন করার পর আওয়ামী লীগ নয়, বেশি করে তোপের মুখে পড়ছে উল্টো বিএনপি। অতীত ছিল পুরোপুরি ভিন্ন। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিএনপি একটি প্রহসনমূলক নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করার পর শেখ হাসিনা সেই সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করেন এবং সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও বাহিনীকে খালেদা জিয়ার সরকারের কোনো নির্দেশ না মানার আহ্বান জানান। তাঁর দল, জাতীয় পার্টি আর জামায়াত মিলে লাগাতার হরতাল আর আন্দোলন করে তখন খালেদা জিয়ার ‘অবৈধ’ সরকারকে দুই মাসের মধ্যে হটাতে পেরেছিল। অথচ ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের চেয়েও প্রহসনমূলক নির্বাচন করার পর খালেদা জিয়াকে প্রথমেই সরকারকে ছয় মাসের সময় দিয়ে দিতে হয়েছে। জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে পিছু হটতে হয়েছে, সহিংসতা ছাড়ার ইঙ্গিত দিতে হয়েছে,
এমনকি ২৯ জানুয়ারি নতুন সংসদ বসার দিনটিতে একটি সাদামাটা কর্মসূচি ঘোষণার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে হয়েছে। বিএনপির এই নরম রাজনীতির পরও বিএনপির নেতাদের বক্তব্য নতুন নির্বাচনের আলোচনা শুরু করার জন্য যথেষ্ট ‘সহায়ক’ কি না, তা নিয়ে নানাভাবে অভিযোগ করছে আওয়ামী লীগ! নাগরিক সমাজের একটি বড় অংশও তা-ই করছে। আগের পর্বে তাদের কট্টর সমালোচনার বিষয়বস্তু ছিল ১৯৯৬ সালের প্রহসনমূলক নির্বাচন, সেই নির্বাচন ঠেকাতে তখনকার আওয়ামী লীগ আর জামায়াতের সহিংসতা নয়। এখন তারা তীব্রভাবে সমালোচনা করছে ২০১৪ সালের প্রহসনমূলক নির্বাচনের নয়, বরং এই নির্বাচন ঠেকাতে বিএনপি-জামায়াতের সহিংস আন্দোলনের ধরনকে। ব্লেম গেম হোক আর প্রচারণা কৌশলে হোক, বিএনপি এখনো কুলিয়ে উঠতে পারছে না আওয়ামী লীগের সঙ্গে। দমনমূলক আইনের মাধ্যমে বিএনপির প্রতি সহানুভূতিশীল পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল একের পর এক বন্ধ করে, বিরাজমান গণমাধ্যমকে ভয়ের আবহের মধ্যে রেখে, জামায়াত ও জঙ্গিবিরোধী সেন্টিমেন্ট চতুরভাবে ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ প্রচার-প্রচারণায় হারিয়ে দিচ্ছে বিএনপিকে। সরকারকে দ্রুত নির্বাচন দিতে বাধ্য করার সংগ্রামে সফল হতে হলে বিএনপিকে এই দোষারোপ-যুদ্ধে টিকে থাকার কৌশল বের করে হবে।
২. প্রচার-প্রচারণায় আওয়ামী লীগের এগিয়ে থাকা অবশ্য বিস্ময়কর কিছু নয়। স্বাধীনতাসংগ্রামে দলটির অতুলনীয় অবদানের কারণে বাংলাদেশের সরব নাগরিক সমাজের একটি বড় অংশের চিরস্থায়ী সমর্থন দলটির প্রতি রয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মভিত্তিক শক্তিগুলোর প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন বিএনপির জোরালো উদ্ভব হলে এবং পরে কমিউনিস্ট বিশ্বের পতন ঘটলে বাম ঘরানার অধিকাংশ আওয়ামী লীগ সমালোচকও আওয়ামী লীগের কট্টর সমর্থক হয়ে ওঠেন নানা পর্যায়ে। এরশাদ-উত্তর রাজনীতিতে বিএনপি রাখঢাকহীনভাবে জামায়াতের সঙ্গে নৈকট্য গড়ে তুললে নাগরিক সমাজের মধ্যে বিএনপির প্রতি বিরাগ বৃদ্ধি পায়। ২০০৯ সালের নির্বাচনের পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাস্তবায়নের দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করে, জামায়াত ও উগ্রবাদীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়ে আওয়ামী লীগ প্রচারণাযুদ্ধে বিএনপিকে আরও কোণঠাসা করে ফেলে। অবস্থা একপর্যায়ে এমন হয়ে দাঁড়ায় যে আওয়ামী লীগের যেকোনো সমালোচনা মানে যুদ্ধাপরাধী ও জামায়াতের পক্ষ গ্রহণ—এমন একটি প্রচারণাযুদ্ধ সরকার নাগরিক সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে বা চাপিয়ে দিতে সক্ষম হয়। এই যুদ্ধে আওয়ামী লীগবিরোধীদের বিপক্ষে সোচ্চার হয়ে ওঠেন এমন কিছু বিখ্যাত ব্যক্তিও, যাঁরা নিজেরাই তরুণ বয়সে আওয়ামী লীগের অন্ধ সমালোচক ছিলেন। গত এক দশকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির অনুকূল পরিস্থিতি আওয়ামী লীগের জন্য প্রচারণাযুদ্ধ আরও সহজ করে ফেলে। ওয়ান-ইলেভেন উত্তর বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর কাছে মুসলিম বিশ্বের দুর্বল রাষ্ট্রগুলোতে গণতন্ত্রের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ইসলামি জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সেসব রাষ্ট্রের দলগুলোর মধ্যে কোনটি সবচেয়ে কট্টর অবস্থান নিচ্ছে, সেই প্রশ্নটি। গণতন্ত্রের চর্চার হূদয়ের চেয়ে তাদের জন্য মূল্যবান হয়ে ওঠে জঙ্গিবাদ দমনের হুংকার। এই হুংকার কতটা আদর্শিক কারণে, কতটা রাজনৈতিক সুবিধাবাদের চিন্তা থেকে, তার বিচার-বিবেচনাও খুব একটা করা হয় না অনেক ক্ষেত্রে। এই পরিস্থিতিতে গত পাঁচ বছর ইসলামি জঙ্গিবাদ দমন, বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মূলোৎপাটন এবং যুদ্ধাপরাধী ইসলামি রাজনীতিকদের শক্ত বিচার করে আওয়ামী লীগ দেশের মতো আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও সমর্থন আদায় করে নিতে সক্ষম হয়।
২. প্রচার-প্রচারণায় আওয়ামী লীগের এগিয়ে থাকা অবশ্য বিস্ময়কর কিছু নয়। স্বাধীনতাসংগ্রামে দলটির অতুলনীয় অবদানের কারণে বাংলাদেশের সরব নাগরিক সমাজের একটি বড় অংশের চিরস্থায়ী সমর্থন দলটির প্রতি রয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মভিত্তিক শক্তিগুলোর প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন বিএনপির জোরালো উদ্ভব হলে এবং পরে কমিউনিস্ট বিশ্বের পতন ঘটলে বাম ঘরানার অধিকাংশ আওয়ামী লীগ সমালোচকও আওয়ামী লীগের কট্টর সমর্থক হয়ে ওঠেন নানা পর্যায়ে। এরশাদ-উত্তর রাজনীতিতে বিএনপি রাখঢাকহীনভাবে জামায়াতের সঙ্গে নৈকট্য গড়ে তুললে নাগরিক সমাজের মধ্যে বিএনপির প্রতি বিরাগ বৃদ্ধি পায়। ২০০৯ সালের নির্বাচনের পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাস্তবায়নের দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করে, জামায়াত ও উগ্রবাদীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়ে আওয়ামী লীগ প্রচারণাযুদ্ধে বিএনপিকে আরও কোণঠাসা করে ফেলে। অবস্থা একপর্যায়ে এমন হয়ে দাঁড়ায় যে আওয়ামী লীগের যেকোনো সমালোচনা মানে যুদ্ধাপরাধী ও জামায়াতের পক্ষ গ্রহণ—এমন একটি প্রচারণাযুদ্ধ সরকার নাগরিক সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে বা চাপিয়ে দিতে সক্ষম হয়। এই যুদ্ধে আওয়ামী লীগবিরোধীদের বিপক্ষে সোচ্চার হয়ে ওঠেন এমন কিছু বিখ্যাত ব্যক্তিও, যাঁরা নিজেরাই তরুণ বয়সে আওয়ামী লীগের অন্ধ সমালোচক ছিলেন। গত এক দশকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির অনুকূল পরিস্থিতি আওয়ামী লীগের জন্য প্রচারণাযুদ্ধ আরও সহজ করে ফেলে। ওয়ান-ইলেভেন উত্তর বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর কাছে মুসলিম বিশ্বের দুর্বল রাষ্ট্রগুলোতে গণতন্ত্রের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ইসলামি জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সেসব রাষ্ট্রের দলগুলোর মধ্যে কোনটি সবচেয়ে কট্টর অবস্থান নিচ্ছে, সেই প্রশ্নটি। গণতন্ত্রের চর্চার হূদয়ের চেয়ে তাদের জন্য মূল্যবান হয়ে ওঠে জঙ্গিবাদ দমনের হুংকার। এই হুংকার কতটা আদর্শিক কারণে, কতটা রাজনৈতিক সুবিধাবাদের চিন্তা থেকে, তার বিচার-বিবেচনাও খুব একটা করা হয় না অনেক ক্ষেত্রে। এই পরিস্থিতিতে গত পাঁচ বছর ইসলামি জঙ্গিবাদ দমন, বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মূলোৎপাটন এবং যুদ্ধাপরাধী ইসলামি রাজনীতিকদের শক্ত বিচার করে আওয়ামী লীগ দেশের মতো আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও সমর্থন আদায় করে নিতে সক্ষম হয়।
আওয়ামী লীগ যদি মানবাধিকার লঙ্ঘনের মাত্রা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখত এবং ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ও গুরুত্বপূর্ণ আরও কয়েকটি দলকে বিতর্কহীনভাবে অংশ নেওয়াতে পারত, তাহলে এই নির্বাচন নিয়ে দেশে-বিদেশে যে সমালোচনা হচ্ছে এখন, তাও আর হতো না অনেকাংশে। আওয়ামী লীগের জন্য সমস্যা হচ্ছে ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের জনবিচ্ছিন্নতা, কারচুপি এবং অনিয়ম খুবই দৃষ্টিকটু রকমের হয়ে গেছে। এই নির্বাচনে খুবই অল্পসংখ্যক ভোটার ভোট দিয়েছে। এই নির্বাচন যে আওয়ামী লীগের বহু সমর্থকও বর্জন করেছে, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে দেশের অর্ধশতাধিক কেন্দ্রে একটি ভোটও না পড়া! এতে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার যে রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে, তা কোনো দুর্বল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও কখনো ঘটেনি। এমন একটি জনবিচ্ছিন্ন নির্বাচন করতেও সরকারকে চরমভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করতে হয়েছে। নির্বাচনের আগের তিন মাসে সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর হাতে যত লোক মারা গেছে, তা অতীতের যেকোনো সময়ের নির্বাচনের চেয়ে অনেক বেশি। এই মৃত্যু এখনো অব্যাহত আছে এবং অনেক ক্ষেত্রে তা ঘটছে এমনভাবে যে তাকে স্রেফ হত্যাকাণ্ড ছাড়া অন্য কিছু ভাবা কঠিন। এর পাশাপাশি সরকার যেভাবে বিরোধী দলের কার্যালয় অবরুদ্ধ এবং বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর ঢালাও মামলা ও হামলা করেছে, অতীতে এতটা কখনো হয়নি। সরকার একতরফা নির্বাচন করতে বেপরোয়া ছিল এবং এ জন্য যেকোনো ধরনের শক্তি প্রয়োগেও তারা পিছপা হয়নি। কিন্তু এত কিছুর পরও এই নির্বাচনের অসারতা ঢাকতে পারেনি সরকার। প্রচারণাযুদ্ধে আওয়ামী লীগ বহুদূর এগিয়ে না থাকলে এমন একটি নির্বাচন করার পর পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকব, এ কথা ঠাট্টা করেও বলার সাহস পেত না আওয়ামী লীগের কেউ।
৩. বিএনপির নেতারা হয়তো ভাবছেন যে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আসল জয় হয়েছে তাঁদের। তাঁরা দলের এবং জোটের ঐক্য ধরে রাখতে পেরেছেন, আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিকভাবে নিঃসঙ্গ করতে পেরেছেন, আন্তর্জাতিকভাবে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে অগ্রহণযোগ্য বলে প্রমাণিত করতে পেরেছেন। সবচেয়ে বড় যা সাফল্য আওয়ামী লীগের দলীয় সরকারের অধীনে যে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব না, তা তাঁরা হাতে-কলমে প্রমাণ করতে পেরেছেন। এই সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রস্তাবে নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং ব্রিটেনের হাউস অব কমন্সের প্রস্তাবে সরাসরিভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তাতে আসলে তেমন লাভ হলো কি? সত্যিই কি আওয়ামী লীগকে দ্রুত কোনো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিতে রাজি বা বাধ্য করাতে পারবে বিএনপি? আমি মনে করি বিএনপির জন্য এটি করা কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি অতীতে এরশাদ ও হাসিনার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে দুবার ক্ষমতায় আসতে পেরেছিল। কিন্তু তখন খালেদা জিয়া নেত্রী হিসেবে বেশি সক্রিয় ও ওয়াকিবহাল ছিলেন, বিএনপির নেতৃত্বের একটি বিরাট অংশকে তখনো বয়স, জেলে যাওয়ার ভীতি ও সম্পত্তি রক্ষার চিন্তা কাবু করে ফেলেনি। সর্বোপরি বিএনপির তখন ছিল রাজপথে জান-প্রাণ সংগ্রাম করার মতো নিবেদিতপ্রাণ একটি ছাত্র ও যুব সংগঠন। গত পাঁচ বছরে বিএনপির নেতারা একমাত্র স্বেচ্ছাসেবক দল ছাড়া বাকি কোনো সংগঠনকে শক্তিশালী হিসেবে দাঁড় করাতে পারেননি। বিএনপিকে তাই নিজের শক্তি পুনরুদ্ধার করতে হবে। আন্দোলন-সংগ্রামের পাশাপাশি সারা দেশে, বিশেষ করে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে এবং ঢাকা শহরে নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে হবে। বিএনপিকে অবশ্যই জামায়াতের সঙ্গে তার সম্পর্ক থাকবে কি না বা তার ধরন কী হবে, তা নিয়েও গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে।
৩. বিএনপির নেতারা হয়তো ভাবছেন যে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আসল জয় হয়েছে তাঁদের। তাঁরা দলের এবং জোটের ঐক্য ধরে রাখতে পেরেছেন, আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিকভাবে নিঃসঙ্গ করতে পেরেছেন, আন্তর্জাতিকভাবে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে অগ্রহণযোগ্য বলে প্রমাণিত করতে পেরেছেন। সবচেয়ে বড় যা সাফল্য আওয়ামী লীগের দলীয় সরকারের অধীনে যে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব না, তা তাঁরা হাতে-কলমে প্রমাণ করতে পেরেছেন। এই সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রস্তাবে নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং ব্রিটেনের হাউস অব কমন্সের প্রস্তাবে সরাসরিভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তাতে আসলে তেমন লাভ হলো কি? সত্যিই কি আওয়ামী লীগকে দ্রুত কোনো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিতে রাজি বা বাধ্য করাতে পারবে বিএনপি? আমি মনে করি বিএনপির জন্য এটি করা কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি অতীতে এরশাদ ও হাসিনার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে দুবার ক্ষমতায় আসতে পেরেছিল। কিন্তু তখন খালেদা জিয়া নেত্রী হিসেবে বেশি সক্রিয় ও ওয়াকিবহাল ছিলেন, বিএনপির নেতৃত্বের একটি বিরাট অংশকে তখনো বয়স, জেলে যাওয়ার ভীতি ও সম্পত্তি রক্ষার চিন্তা কাবু করে ফেলেনি। সর্বোপরি বিএনপির তখন ছিল রাজপথে জান-প্রাণ সংগ্রাম করার মতো নিবেদিতপ্রাণ একটি ছাত্র ও যুব সংগঠন। গত পাঁচ বছরে বিএনপির নেতারা একমাত্র স্বেচ্ছাসেবক দল ছাড়া বাকি কোনো সংগঠনকে শক্তিশালী হিসেবে দাঁড় করাতে পারেননি। বিএনপিকে তাই নিজের শক্তি পুনরুদ্ধার করতে হবে। আন্দোলন-সংগ্রামের পাশাপাশি সারা দেশে, বিশেষ করে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে এবং ঢাকা শহরে নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে হবে। বিএনপিকে অবশ্যই জামায়াতের সঙ্গে তার সম্পর্ক থাকবে কি না বা তার ধরন কী হবে, তা নিয়েও গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে।
দলটির অতীত অভিজ্ঞতা এ ক্ষেত্রে সুখের নয়। ১৯৮৬ সালে বিএনপিকে আকস্মিকভাবে একঘরে করে আওয়ামী লীগ জামায়াতের সঙ্গে নিয়ে নির্বাচন করেছিল, ১৯৯৫-৯৬ সালে আওয়ামী লীগ জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপির বিরুদ্ধে সহিংস আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। কাজেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ হলে পুনর্গঠিত বা ‘সাফসুতরো’ জামায়াতের সঙ্গে প্রয়োজনে পুনরায় সমঝোতার চেষ্টা করবে না আওয়ামী লীগ, এই গ্যারান্টি দেওয়া যাবে কি সুনিশ্চিতভাবে? সত্যি সত্যি বিএনপি-আওয়ামী লীগ সংলাপ হলে এবং তাতে এ ধরনের লিখিত কোনো সমঝোতা হলে অবশ্যই জামায়াতকে ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত বিএনপির। জামায়াতকে বাদ দিলে বিএনপির ভোট খুব একটা বাড়বে কি না জানি না, তবে দলের ইমেজ তাতে বহু গুণ বৃদ্ধি পাবে। জামায়াতহীন বিএনপিকে প্রচারণাযুদ্ধে নাকাল করা কঠিন হবে আওয়ামী লীগের জন্য। সবচেয়ে যা গুরুত্বপূর্ণ এতে সুষ্ঠু নির্বাচন প্রশ্নে উদারনৈতিক এবং বাম দলগুলোর সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের সম্ভাবনাও সৃষ্টি হবে। বিএনপির সঙ্গে উদারপন্থীদের ঐক্য সুশাসনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এবং অপপ্রচারের হুমকি দূরীকরণে বিএনপির সামর্থ্য বৃদ্ধি করবে। সাংগঠনিক সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রচারণাযুদ্ধে টিকে থাকতে হলে আর কী কী করতে হবে, তা বিএনপিকে গভীরভাবে চিন্তা করে বের করতে হবে। না হলে বাংলাদেশে সত্যিকারের একটি নির্বাচনের সম্ভাবনা ক্রমেই আরও ক্ষীণ হয়ে উঠবে।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments