অধ্যাপক ইউনূস ও মেজর মান্নানের মেয়ের আংটি বদল by বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম
ঢাকা থেকে ঈদে বাড়ি যেতে চেয়েছিলাম ৫ই
আগস্ট। শবেকদরের রাত কাটাতে চেয়েছিলাম টাঙ্গাইলে। শবে কদর একজন মুসলমানের
কাছে হাজার মাসের ইবাদতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।
যতই ঢাকায় বসবাস
করি বাড়ি বাড়ি মনে হয় না, কেমন যেন বাসা বাসা মনে হয়। নাড়ির টান অনুভব করি
বাড়ি গেলে। হাত খালি ছিল, বাড়ি গেলেই নানাজন হাত পাতবে, তাদের দাবি পূরণ
করতে হবে। কয়েক জনের কাছে টাকা-পয়সা চেয়েছিলাম। তারাও যথেষ্ট সাহায্য
করেছে। কিন্তু ৫ তারিখে নয়, সেটা করেছে ৬ তারিখ। তাই ৬ই আগস্ট ইফতার শেষে
৮টার দিকে যাত্রা করেছিলাম। টাঙ্গাইল পৌঁছতে খুব একটা সময় লাগেনি। ১ ঘণ্টা
৪০-৪৫ মিনিটে পৌঁছেছিলাম। তা-ও আবার রাস্তায় ১০ মিনিট নষ্ট হয়েছে।
স্বাধীনতার পর রাস্তা খারাপ ছিল, গাড়ি ছিল আরও খারাপ। তারপরও ১ ঘণ্টা ২০-২৫
মিনিটে হরহামেশা যাতায়াত করতাম। এখনকার গাড়ি তখনকার গাড়ি থেকে শত গুণ
উন্নত, রাস্তাঘাট ভাল, অনেক প্রশস্ত। কিন্তু ব্যবস্থাপনায় ত্রুটির কারণে
অনেক বেশি সময় লাগে। সেদিন অসংখ্য পুলিশ সদস্য ছিল, রাস্তায় কোন গাড়ি
দাঁড়াতে দেয়নি। ভাবছিলাম যোগাযোগ মন্ত্রীকে একটা ধন্যবাদ দেবো। কিন্তু
পরদিন বলি কি করে, ৮-১০ ঘণ্টা পরেই সব উল্টে পাল্টে গেল। রাত পৌনে ১০টায়
টাংগাইল পৌঁছেছিলাম। প্রতিদিন সকাল ৭টা-সাড়ে ৭টায় পত্রিকা পাই। বছর বিশেক
একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। একবেলা খাবার না হলে মনে পড়ে না। কিন্তু সকালে
পত্রিকা ছাড়া খালি খালি লাগে। সকালে উঠে পত্রিকা পেলাম না। কি ব্যাপার!
পত্রিকার গাড়ি চন্দ্রাতে আটকে আছে। সকালের পত্রিকা সন্ধ্যায় পেলাম।
মন্ত্রীকে যানজট না থাকায় ধন্যবাদ দেয়ার উৎসাহ হারিয়ে ফেললাম। সেই যে যানজট
শুরু হয়েছিল ৯ই আগস্ট, ঈদের দিন পর্যন্ত ছিল। ১০, ১১ রাস্তায় কিছুটা চাপ
কম ছিল। ১৩, ১৪ জামায়াতের হরতাল। ১২ তারিখ টিভি চ্যানেলে কয়েকটা সাক্ষাৎকার
দিতে ঢাকা এসেছিলাম। রাস্তা ফাঁকাই ছিল। ১৪ তারিখ সকালে হরতালের মধ্যেই
নির্বিঘ্নে টাঙ্গাইল ফিরেছিলাম। হরতালে আমার সমর্থন নেই। তাই তার মধ্যেই
গিয়েছিলাম। ১৫ই আগস্ট আমার জীবনের এক নিষ্ঠুর কালো দিন। কোন কিছুই ভাল লাগে
না। প্রায় ৩৫ বছর ১৫ই আগস্ট সারাদিন ঘরের দরজা খুলিনি, পানিও স্পর্শ
করিনি। এখন আর কেন যেন তেমন তাগিদ পাই না। এখন বেলা ১২টার পর ঘর থেকে
বেরিয়ে যা পারি মুখে দেই। কারণ কিছু বছর ধরে ডায়াবেটিসে ধরেছে। এ পর্যন্ত
কোনদিন সুগার নীল হয়নি। কিন্তু একটা আশঙ্কা তো আছেই। সেদিন আবার মানবজমিন-এ
দেখলাম, বিদেশী কে একজন খাবার নিয়ন্ত্রণ করে ১১ দিনেই ডায়াবেটিস নামের
অসুখটিকে চিরবিদায় দিয়েছে। পত্রিকাটি রেখে দিয়েছি। আগামীকাল অথবা পরশু আমার
ডায়াবেটিস চিকিৎসক খাজা নাজিমুদ্দিনের কাছে যাবো পরামর্শ নিতে। সহধর্মিণী
নাসরীন সিদ্দিকী ছেলেমেয়ে নিয়ে ১৫ তারিখ বেলা ১টায় ঢাকার দিকে পাড়ি
জমিয়েছিল। নিজে সারাদিন গাড়িতে থাকি তেমন চিন্তা হয় না। পরিবার পরিজন যখনই
গাড়িতে সওয়ার হয় স্বস্তি পাই না। গাড়ির চালক হোসেন, যীশু, মান্নান সবাই
অভিজ্ঞ, ধীরস্থির। কেউ প্রায় ৪০ বছর ধরে আছে। কিন্তু রাস্তাঘাটের অবস্থা
দেখে তবু একটা অস্বস্তি লেগেই থাকে। ঔরসজাত দীপ-কুঁড়ি বড় হয়েছে। কিন্তু
আল্লাহর দান কুশিমনি বেশ ছোট। বাইরে গেলে ওর কথা মন থেকে আড়াল করতে পারি
না। আল্লাহর রহমতে তারা সহিসালামতে ২-সোয়া ২ ঘণ্টায় ঢাকা পৌঁছেছিল। এর কয়েক
ঘণ্টা পরেই শুরু হয় মহাজট- যা এখনও চলছে।
১৯৭১-এর ১৬ই আগস্ট সম্মুখ যুদ্ধে ধলাপাড়ার মাকরাইয়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলাম। বাঁচার তেমন আশাই ছিল না। কেন আল্লাহর দয়ায় আজও বেঁচে আছি তিনিই জানেন। প্রতি বছর মাকরাইয়ে যাই, এ বছর যেতে পারিনি। কারণ পরম সুহৃদ মেজর (অব.) আবদুল মান্নানের মেয়ের আংটি বদল, বিয়ে আরও অনেক দূর। তবু সেখানে গিয়েছিলাম বা অন্তরের টানে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম। মানুষের আন্তরিকতা যে কত শক্তিশালী সেটা দু’একজন গরিব মানুষের দেখেছি, দু’চারজন ধনবানেরও দেখেছি। তাদের মধ্যে মেজর (অব.) আবদুল মান্নান অন্যতম। এমনিতে ধনবানদের আমার তেমন ভাল লাগে না। কিন্তু কি করে যেন মেজর মান্নান সেই বেরিয়ারটা অতিক্রম করেছেন। যতবার তার কাছে গেছি কখনও ছাড়তে চাননি। সময় নষ্ট হচ্ছে বলে উঠে পড়তে চাইলেও উঠতে দেননি। কত কোটি কোটি টাকার কাজ আমার মতো অকর্মা মানুষের জন্য পড়ে থাকে। প্রথম প্রথম মনে হতো লৌকিকতা করছেন। কিন্তু গত কয়েক বছর দেখে দেখে মনে হয় আমাকে পাশে পেলে তিনি বড় প্রশান্ত হন, স্বস্তি পান। ব্যবসার ঝামেলা থেকে কিছু সময় অন্য চিন্তা করতে পারেন। আমি আদার ব্যাপারী জাহাজের খবর কি-ই বা জানি। তবু মাঝে সাজে আপন মনে করে কষ্টের কথা বলে হালকা হতে চেষ্টা করেন, সেটা সব ধরনের কথা। আমারও বেশ ভাল লাগে। জীবনে কত কষ্ট করেছি, এখনও কত শঙ্কায় থাকি। কেউ হাত পাতলে হাত ভরে দিতে পারি না, সে এক জ্বালা। যারা এক সময় হাত পেতে চলতো তারা এখন আমাদের সম্পদের নিচে সমাধি করতে চায়, সে-ও আরেক জ্বালা। ক্ষমতাবান কেউ কেউ এমন ব্যস্ত থাকেন ফোন ধরেন না। আবার কখনও প্রয়োজন হলে ৭ বার ফোন করে বিরক্ত করেন। এসবের বাইরের মানুষ মেজর (অব.) আবদুল মান্নান। ১৬ তারিখ আমার মরণদিন। তা-ও তার মেয়ের বিয়ের আংটি বদলে যোগ দিতে বেলা ২টায় টাঙ্গাইল থেকে রওনা হয়েছিলাম। রাস্তায় গাড়ি আর গাড়ি। গোড়াই হয়ে না এসে ভাতকুড়া, বাসাইল, সখিপুর, ভালুকার সিডস্টোর হয়ে দু’এক ঘণ্টা কম লাগবে ভেবে সিডস্টোরের রাস্তা ধরেছিলাম। গ্রামে এক প্রবাদ আছে, ‘তাড়াতাড়ি যেতে চাও তো ঘুরে যাও’। সে কারণেই ঘোরা পথ ধরেছিলাম। কিন্তু তাড়াতাড়ি হয়েছে কিনা বলতে পারবো না। জয়দেবপুর চৌরাস্তায় সে যে কি ভিড়, দেড়-দুই কিলোমিটারে দেড়-দুই ঘণ্টা লেগেছে। ৮টার দাওয়াতে ৯টা ৪০ মিনিটে সোনারগাঁওয়ের বলরুমে গিয়েছিলাম। খুব মার্জিত চমৎকার ব্যবস্থাপনা। গেইটে জাহাঙ্গীর দাঁড়িয়ে ছিল। হলের দরজায় মেজর মান্নান। বহুদিন পর তাকে বড় হাসিখুশি মনে হচ্ছিল। তার তিন মেয়ে, এক ছেলে। আমার দুই মেয়ে, এক ছেলে। ১৬ তারিখ আমারও প্রথম মনে হলো, আমার মেয়ের বিয়ের দিনে আমারও কি অমন আনন্দ হবে? গিয়ে দেখি ১ নম্বর টেবিলে জনাব হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। পাশের টেবিলে ড. কামাল হোসেন, তার স্ত্রী ও আরেক পাশে প্রাক্তন জ্বালানি মন্ত্রী জেনারেল নুরউদ্দীন। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পাশে আমাদের বসানো হয়। ডানে কুশিমনি, তারপর তার মা নাসরীন। এরশাদ সাহেবের বামে এফবিসিসিআই’র প্রাক্তন সভাপতি ফরিদপুরের এ.কে. আজাদ। যার সংবর্ধনা নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বেয়াই মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে বিরোধিতার কারণে সব কয়টা দৈনিকের প্রথম পাতায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বা বিরোধী দলের নেত্রীর চেয়ে বড় বড় করে ছবি আসায় বর্তমানে বেশ আলোচিত। অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে আমাদের একমাত্র নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এসেছিলেন। কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে আমি এই তাকে প্রথম দেখলাম। হয়তো আরও অনেক অনুষ্ঠানে গেছেন কিন্তু আমি দেখিনি। ড. কামাল হোসেন এবং প্রাক্তন মন্ত্রী জেনারেল নুরউদ্দীনের মাঝে তিনি বসেছিলেন। অধ্যাপক ইউনূস এবং ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে কথা বলে আমরা একটু আগেই চলে এসেছিলাম। আমাদের আগে জনাব এরশাদ চলে গিয়েছিলেন।
ক’দিন আগে আমার প্রিয় এক কর্মী বর্তমান সাংবাদিক সাগর আনোয়ার এক সাক্ষাৎকার নিতে এসেছিল। তার প্রশ্ন ছিল, কোন কোন বিদেশী রাষ্ট্র তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য বা ষড়যন্ত্র সফল করতে অধ্যাপক ইউনূসকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছেন কিনা? অল্পবয়সী মানুষ তাই তার সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ইউনূস সম্পর্কে আমার বক্তব্য পরিষ্কার হয়নি। সে আমার বরাত দিয়ে উল্লেখ করেছে, ‘যদি বিদেশী কোন রাষ্ট্র ষড়যন্ত্র করে, তবে ড. ইউনূসকে দিয়ে লাভবান হবে না। অধ্যাপক ইউনূস ষড়যন্ত্রের মাধ্যম হওয়ার উপযুক্ত নন। এমনটাই মনে করেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধের কাদেরিয়া বাহিনীর সর্বাধিনায়ক বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী।’ আসলে অধ্যাপক ইউনূসকে আগে কখনও ঝেঁকে দেখিনি, অধ্যয়ন করিনি। গ্রামীণ ব্যাংকের ঘটনার পর তাকে পরতে পরতে উলটেপালটে দেখার চেষ্টা করেছি। আমারও এক সময় মনে হয়েছিল, ঘুষ টুষ দিয়ে তারা নোবেল পেয়েছেন। কিন্তু ক’বছর নাড়াচাড়া করে আমার উপলব্ধি হয়েছে, কেউ তাকে দয়া করে নোবেল দেয়নি। তার যোগ্যতাকে সম্মান জানাতে নোবেল কমিটি বাধ্য হয়েছে। আর বিদেশী রাষ্ট্রের কোন এজেন্ডার বাহন হওয়ার মতো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তার নেই। সাদাসিধে, খোলামেলা নিরহঙ্কার খাঁটি বাঙালি তিনি। তার মধ্যে দেশপ্রেমের স্ফূরণ দেখে আমি অভিভূত। অমন মানুষ অন্যের উদ্দেশ্য সাধনের বাহক হতে পারেন না। তাই ওকথা বলেছি, অধ্যাপক ইউনূসকে জাতীয়ভাবেই আমাদের সম্মান করা উচিত। তাকে আর বিব্রত করা উচিত না। তার মেধাকে কাজে লাগালে জাতি উপকৃত হবে। এই জাতীয় কল্যাণব্রতী মানুষটাকে নাজেহাল করতে গিয়ে আমরাই যে বড় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। এ চেতনা ক্ষমতাসীনদের কবে হবে সেটা তারাই জানেন। তবে যত তাড়াতাড়ি হবে ততই কল্যাণ বা মঙ্গল।
মহাজোট সরকারের এটাই ছিল সরকারিভাবে বা রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর শেষ শোক পালন। তারা আর সরকারিভাবে শোক পালন করতে পারবে কিনা ভবিতব্যই জানে। তবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রীয় শোক পালনে দলাদলির কোন মানে হয় না। যারা অমন করবেন তাদের মহাকালের কলঙ্ক অবশ্যই গ্রাস করবে। কারণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কালোত্তীর্ণ বাংলার জনগণ তথা বিশ্বের নিপীড়িত মানবতার অগ্রদূত। শ্রমজীবী নিগৃহীত মানুষের বন্ধু। আমরা তাকে বঙ্গবন্ধু বললেও তিনি তার আপন মহিমায় মানবতার বন্ধু, বিশ্ব বন্ধু। কিন্তু অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গ সংগঠন ছাড়া ১৫ই আগস্টে মহাজোটের অন্য শরিকদের কোন উচ্চবাচ্য দেখা গেল না। কেমন যেন কোচ কাটা ছুরির মতো সব লুকিয়ে থাকলো।
বছর আড়াই আগে প্রধান বিরোধী দলের নেতা বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে দু’ঘণ্টার কয়েক মিনিট কম একান্তে আলোচনা হয়েছিল। চারদলীয় জোটের শক্তি বৃদ্ধির জন্য তাদের আমাকে চাই। ওরকম আওয়ামীদেরও চাই। আলোচনার এক পর্যায়ে বলেছিলাম, স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত সঙ্গে থাকলে আমার পক্ষে পাশে থাকা সম্ভব নয়। তাছাড়া, যৌবনে প্রেম করিনি, বঙ্গবন্ধুকে ভালবেসেছি, না চাইতেও তার সঙ্গে একটা প্রেমের অনুভূতির মিশ্রণ ঘটেছে। জীবিত মুজিবের চেয়ে মৃত মুজিব বেশি আমার হৃদয় জুড়ে। বিধবার সাজ না ধরলেও আমার সমস্ত অন্তর জুড়ে আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। তাই আপনার জোট তাকে নিয়ে যখন যা খুশি বললে আমার পক্ষে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করা সম্ভব না। তাছাড়া, ১৫ই আগস্ট শোকে আমরা যখন মুহ্যমান, জাতির মহা রক্তক্ষরণের ক্ষণে আপনার শুভ জন্মদিন পালন বড় নিষ্ঠুরভাবে হৃদয়ে আঘাত করে। তাই ওটা থেকে বিরত থাকতে হবে। তিনি বলেছিলেন, অমন একজন মহান নেতার নির্মম মৃত্যুদিনে ঘটা করে জন্মদিন পালন করতে আমিও উৎসাহী না। কিন্তু দশের চক্রে ভগবান ভূতের মতো অবস্থা। দলীয় নেতাকর্মীরা করে, দেশের যে রাজনৈতিক অবস্থা তাতে তাদের একেবারে ফিরাই কি করে? তবে আমি মনে রাখবো। জানি না কতটা মনে রেখেছেন। কিন্তু ওর পরের বছর জন্মদিন পালন করেননি। জন্মদিনে ছিলেন সৌদি আরবে। গত বছর ছিল মাহে রমজান। এবছরও নিজে কেক কাটেননি, দলের নেতারা কেটেছেন। জানি না তার নিজে কেক না কাটা বা তাতে অংশ না নেয়া কতটা শ্রদ্ধা বা কৌশল। তবে আওয়ামী লীগ ফেটে পড়েছে। যারা বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর দিনে ঘটা করে জন্মদিন পালন করে, আনন্দ করে তাদের সঙ্গে আবার সমঝোতা কি? শুধু ছোটখাটো নেতারা বলেননি, স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন। দেখাই যাক কত ধানে কত চাল। আমার বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী পবিত্র সংসদে বলেছেন, তিনি আর নির্বাচন করবেন না। না করলে যাওয়ারকালে তবু একটু সম্মান নিয়ে যাবেন। আর নেত্রীর কথায় যদি নির্বাচন করেন লোকজন বলবে, যেমন মদখোরের ‘রাত কি বাত, বাত কি বাত’ মানে নেশার ঘোরে রাতের কথা কথার কথা, তার কোন মূল্য নেই। তেমনি আওয়ামী নেতাদের কথার কোন মূল্য নেই। খালেদা জিয়া নিজে কেক কাটেননি তা-ও এমন বাগাড়ম্বর, কোন সমঝোতা করবেন না। নিজে কেক কেটে ঘটা করে জন্মদিন পালন করলে মনে হয় সব নেতা আত্মহত্যা করতেন। কোন সমঝোতা না হলে কার ক্ষতি? সব থেকে বেশি দেশের, তারপরই আওয়ামীপন্থিদের। কথাটা একটু হৃদয়ঙ্গম করতে চেষ্টা করবেন। আর জিয়াউর রহমানের হত্যার দিনে আওয়ামীদের কি এবং কেমন করা উচিত সেটাও ভাবার মনে হয় সময় এসেছে ...।
১৯৭১-এর ১৬ই আগস্ট সম্মুখ যুদ্ধে ধলাপাড়ার মাকরাইয়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলাম। বাঁচার তেমন আশাই ছিল না। কেন আল্লাহর দয়ায় আজও বেঁচে আছি তিনিই জানেন। প্রতি বছর মাকরাইয়ে যাই, এ বছর যেতে পারিনি। কারণ পরম সুহৃদ মেজর (অব.) আবদুল মান্নানের মেয়ের আংটি বদল, বিয়ে আরও অনেক দূর। তবু সেখানে গিয়েছিলাম বা অন্তরের টানে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম। মানুষের আন্তরিকতা যে কত শক্তিশালী সেটা দু’একজন গরিব মানুষের দেখেছি, দু’চারজন ধনবানেরও দেখেছি। তাদের মধ্যে মেজর (অব.) আবদুল মান্নান অন্যতম। এমনিতে ধনবানদের আমার তেমন ভাল লাগে না। কিন্তু কি করে যেন মেজর মান্নান সেই বেরিয়ারটা অতিক্রম করেছেন। যতবার তার কাছে গেছি কখনও ছাড়তে চাননি। সময় নষ্ট হচ্ছে বলে উঠে পড়তে চাইলেও উঠতে দেননি। কত কোটি কোটি টাকার কাজ আমার মতো অকর্মা মানুষের জন্য পড়ে থাকে। প্রথম প্রথম মনে হতো লৌকিকতা করছেন। কিন্তু গত কয়েক বছর দেখে দেখে মনে হয় আমাকে পাশে পেলে তিনি বড় প্রশান্ত হন, স্বস্তি পান। ব্যবসার ঝামেলা থেকে কিছু সময় অন্য চিন্তা করতে পারেন। আমি আদার ব্যাপারী জাহাজের খবর কি-ই বা জানি। তবু মাঝে সাজে আপন মনে করে কষ্টের কথা বলে হালকা হতে চেষ্টা করেন, সেটা সব ধরনের কথা। আমারও বেশ ভাল লাগে। জীবনে কত কষ্ট করেছি, এখনও কত শঙ্কায় থাকি। কেউ হাত পাতলে হাত ভরে দিতে পারি না, সে এক জ্বালা। যারা এক সময় হাত পেতে চলতো তারা এখন আমাদের সম্পদের নিচে সমাধি করতে চায়, সে-ও আরেক জ্বালা। ক্ষমতাবান কেউ কেউ এমন ব্যস্ত থাকেন ফোন ধরেন না। আবার কখনও প্রয়োজন হলে ৭ বার ফোন করে বিরক্ত করেন। এসবের বাইরের মানুষ মেজর (অব.) আবদুল মান্নান। ১৬ তারিখ আমার মরণদিন। তা-ও তার মেয়ের বিয়ের আংটি বদলে যোগ দিতে বেলা ২টায় টাঙ্গাইল থেকে রওনা হয়েছিলাম। রাস্তায় গাড়ি আর গাড়ি। গোড়াই হয়ে না এসে ভাতকুড়া, বাসাইল, সখিপুর, ভালুকার সিডস্টোর হয়ে দু’এক ঘণ্টা কম লাগবে ভেবে সিডস্টোরের রাস্তা ধরেছিলাম। গ্রামে এক প্রবাদ আছে, ‘তাড়াতাড়ি যেতে চাও তো ঘুরে যাও’। সে কারণেই ঘোরা পথ ধরেছিলাম। কিন্তু তাড়াতাড়ি হয়েছে কিনা বলতে পারবো না। জয়দেবপুর চৌরাস্তায় সে যে কি ভিড়, দেড়-দুই কিলোমিটারে দেড়-দুই ঘণ্টা লেগেছে। ৮টার দাওয়াতে ৯টা ৪০ মিনিটে সোনারগাঁওয়ের বলরুমে গিয়েছিলাম। খুব মার্জিত চমৎকার ব্যবস্থাপনা। গেইটে জাহাঙ্গীর দাঁড়িয়ে ছিল। হলের দরজায় মেজর মান্নান। বহুদিন পর তাকে বড় হাসিখুশি মনে হচ্ছিল। তার তিন মেয়ে, এক ছেলে। আমার দুই মেয়ে, এক ছেলে। ১৬ তারিখ আমারও প্রথম মনে হলো, আমার মেয়ের বিয়ের দিনে আমারও কি অমন আনন্দ হবে? গিয়ে দেখি ১ নম্বর টেবিলে জনাব হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। পাশের টেবিলে ড. কামাল হোসেন, তার স্ত্রী ও আরেক পাশে প্রাক্তন জ্বালানি মন্ত্রী জেনারেল নুরউদ্দীন। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পাশে আমাদের বসানো হয়। ডানে কুশিমনি, তারপর তার মা নাসরীন। এরশাদ সাহেবের বামে এফবিসিসিআই’র প্রাক্তন সভাপতি ফরিদপুরের এ.কে. আজাদ। যার সংবর্ধনা নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বেয়াই মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে বিরোধিতার কারণে সব কয়টা দৈনিকের প্রথম পাতায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বা বিরোধী দলের নেত্রীর চেয়ে বড় বড় করে ছবি আসায় বর্তমানে বেশ আলোচিত। অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে আমাদের একমাত্র নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এসেছিলেন। কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে আমি এই তাকে প্রথম দেখলাম। হয়তো আরও অনেক অনুষ্ঠানে গেছেন কিন্তু আমি দেখিনি। ড. কামাল হোসেন এবং প্রাক্তন মন্ত্রী জেনারেল নুরউদ্দীনের মাঝে তিনি বসেছিলেন। অধ্যাপক ইউনূস এবং ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে কথা বলে আমরা একটু আগেই চলে এসেছিলাম। আমাদের আগে জনাব এরশাদ চলে গিয়েছিলেন।
ক’দিন আগে আমার প্রিয় এক কর্মী বর্তমান সাংবাদিক সাগর আনোয়ার এক সাক্ষাৎকার নিতে এসেছিল। তার প্রশ্ন ছিল, কোন কোন বিদেশী রাষ্ট্র তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য বা ষড়যন্ত্র সফল করতে অধ্যাপক ইউনূসকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছেন কিনা? অল্পবয়সী মানুষ তাই তার সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ইউনূস সম্পর্কে আমার বক্তব্য পরিষ্কার হয়নি। সে আমার বরাত দিয়ে উল্লেখ করেছে, ‘যদি বিদেশী কোন রাষ্ট্র ষড়যন্ত্র করে, তবে ড. ইউনূসকে দিয়ে লাভবান হবে না। অধ্যাপক ইউনূস ষড়যন্ত্রের মাধ্যম হওয়ার উপযুক্ত নন। এমনটাই মনে করেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধের কাদেরিয়া বাহিনীর সর্বাধিনায়ক বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী।’ আসলে অধ্যাপক ইউনূসকে আগে কখনও ঝেঁকে দেখিনি, অধ্যয়ন করিনি। গ্রামীণ ব্যাংকের ঘটনার পর তাকে পরতে পরতে উলটেপালটে দেখার চেষ্টা করেছি। আমারও এক সময় মনে হয়েছিল, ঘুষ টুষ দিয়ে তারা নোবেল পেয়েছেন। কিন্তু ক’বছর নাড়াচাড়া করে আমার উপলব্ধি হয়েছে, কেউ তাকে দয়া করে নোবেল দেয়নি। তার যোগ্যতাকে সম্মান জানাতে নোবেল কমিটি বাধ্য হয়েছে। আর বিদেশী রাষ্ট্রের কোন এজেন্ডার বাহন হওয়ার মতো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তার নেই। সাদাসিধে, খোলামেলা নিরহঙ্কার খাঁটি বাঙালি তিনি। তার মধ্যে দেশপ্রেমের স্ফূরণ দেখে আমি অভিভূত। অমন মানুষ অন্যের উদ্দেশ্য সাধনের বাহক হতে পারেন না। তাই ওকথা বলেছি, অধ্যাপক ইউনূসকে জাতীয়ভাবেই আমাদের সম্মান করা উচিত। তাকে আর বিব্রত করা উচিত না। তার মেধাকে কাজে লাগালে জাতি উপকৃত হবে। এই জাতীয় কল্যাণব্রতী মানুষটাকে নাজেহাল করতে গিয়ে আমরাই যে বড় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। এ চেতনা ক্ষমতাসীনদের কবে হবে সেটা তারাই জানেন। তবে যত তাড়াতাড়ি হবে ততই কল্যাণ বা মঙ্গল।
মহাজোট সরকারের এটাই ছিল সরকারিভাবে বা রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর শেষ শোক পালন। তারা আর সরকারিভাবে শোক পালন করতে পারবে কিনা ভবিতব্যই জানে। তবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রীয় শোক পালনে দলাদলির কোন মানে হয় না। যারা অমন করবেন তাদের মহাকালের কলঙ্ক অবশ্যই গ্রাস করবে। কারণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কালোত্তীর্ণ বাংলার জনগণ তথা বিশ্বের নিপীড়িত মানবতার অগ্রদূত। শ্রমজীবী নিগৃহীত মানুষের বন্ধু। আমরা তাকে বঙ্গবন্ধু বললেও তিনি তার আপন মহিমায় মানবতার বন্ধু, বিশ্ব বন্ধু। কিন্তু অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গ সংগঠন ছাড়া ১৫ই আগস্টে মহাজোটের অন্য শরিকদের কোন উচ্চবাচ্য দেখা গেল না। কেমন যেন কোচ কাটা ছুরির মতো সব লুকিয়ে থাকলো।
বছর আড়াই আগে প্রধান বিরোধী দলের নেতা বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে দু’ঘণ্টার কয়েক মিনিট কম একান্তে আলোচনা হয়েছিল। চারদলীয় জোটের শক্তি বৃদ্ধির জন্য তাদের আমাকে চাই। ওরকম আওয়ামীদেরও চাই। আলোচনার এক পর্যায়ে বলেছিলাম, স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত সঙ্গে থাকলে আমার পক্ষে পাশে থাকা সম্ভব নয়। তাছাড়া, যৌবনে প্রেম করিনি, বঙ্গবন্ধুকে ভালবেসেছি, না চাইতেও তার সঙ্গে একটা প্রেমের অনুভূতির মিশ্রণ ঘটেছে। জীবিত মুজিবের চেয়ে মৃত মুজিব বেশি আমার হৃদয় জুড়ে। বিধবার সাজ না ধরলেও আমার সমস্ত অন্তর জুড়ে আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। তাই আপনার জোট তাকে নিয়ে যখন যা খুশি বললে আমার পক্ষে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করা সম্ভব না। তাছাড়া, ১৫ই আগস্ট শোকে আমরা যখন মুহ্যমান, জাতির মহা রক্তক্ষরণের ক্ষণে আপনার শুভ জন্মদিন পালন বড় নিষ্ঠুরভাবে হৃদয়ে আঘাত করে। তাই ওটা থেকে বিরত থাকতে হবে। তিনি বলেছিলেন, অমন একজন মহান নেতার নির্মম মৃত্যুদিনে ঘটা করে জন্মদিন পালন করতে আমিও উৎসাহী না। কিন্তু দশের চক্রে ভগবান ভূতের মতো অবস্থা। দলীয় নেতাকর্মীরা করে, দেশের যে রাজনৈতিক অবস্থা তাতে তাদের একেবারে ফিরাই কি করে? তবে আমি মনে রাখবো। জানি না কতটা মনে রেখেছেন। কিন্তু ওর পরের বছর জন্মদিন পালন করেননি। জন্মদিনে ছিলেন সৌদি আরবে। গত বছর ছিল মাহে রমজান। এবছরও নিজে কেক কাটেননি, দলের নেতারা কেটেছেন। জানি না তার নিজে কেক না কাটা বা তাতে অংশ না নেয়া কতটা শ্রদ্ধা বা কৌশল। তবে আওয়ামী লীগ ফেটে পড়েছে। যারা বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর দিনে ঘটা করে জন্মদিন পালন করে, আনন্দ করে তাদের সঙ্গে আবার সমঝোতা কি? শুধু ছোটখাটো নেতারা বলেননি, স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন। দেখাই যাক কত ধানে কত চাল। আমার বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী পবিত্র সংসদে বলেছেন, তিনি আর নির্বাচন করবেন না। না করলে যাওয়ারকালে তবু একটু সম্মান নিয়ে যাবেন। আর নেত্রীর কথায় যদি নির্বাচন করেন লোকজন বলবে, যেমন মদখোরের ‘রাত কি বাত, বাত কি বাত’ মানে নেশার ঘোরে রাতের কথা কথার কথা, তার কোন মূল্য নেই। তেমনি আওয়ামী নেতাদের কথার কোন মূল্য নেই। খালেদা জিয়া নিজে কেক কাটেননি তা-ও এমন বাগাড়ম্বর, কোন সমঝোতা করবেন না। নিজে কেক কেটে ঘটা করে জন্মদিন পালন করলে মনে হয় সব নেতা আত্মহত্যা করতেন। কোন সমঝোতা না হলে কার ক্ষতি? সব থেকে বেশি দেশের, তারপরই আওয়ামীপন্থিদের। কথাটা একটু হৃদয়ঙ্গম করতে চেষ্টা করবেন। আর জিয়াউর রহমানের হত্যার দিনে আওয়ামীদের কি এবং কেমন করা উচিত সেটাও ভাবার মনে হয় সময় এসেছে ...।
No comments