রাজনীতিতে বিলবোর্ডের ব্যবহার by ড. সৈয়দ রাশিদুল হাসান
বিলবোর্ডও
যে রাজনীতি চর্চার একটা মাধ্যম হতে পারে, এটা কখনোই আমার চিন্তার মধ্যে
আসেনি। বিলবোর্ড গণযোগাযোগের একটি স্বীকৃত মাধ্যম। এ মাধ্যম ব্যবহার করে যে
কেউ তার পণ্য, সেবা, চিন্তা কিংবা ধারণার প্রচার ও প্রসার করতেই পারেন।
আওয়ামী লীগ তাদের ভাষায় গত সাড়ে চার বছরে তাদের অর্জনকে মানুষের মনে
আরেকবার গেঁথে দেয়ার জন্য বিজ্ঞাপনের সব মাধ্যম ছেড়ে বিলবোর্ডকেই বেছে নিল।
কেন নিল তা বলতে পারব না। তবে তাদের পক্ষ থেকে নিশ্চয়ই যুক্তি আছে। আমি
মার্কেটিংয়ের লোক হয়ে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রচার ও প্রসারে বিলবোর্ডের
ব্যবহারের বিপক্ষে কোনো যুক্তি দাঁড় করাতে পারব না। তাহলে এটা নিয়ে এত কথা
হচ্ছে কেন? বিরোধী দলসহ অনেক দল ও গোষ্ঠী এহেন প্রচারের বিপক্ষে রীতিমতো
যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। আবার কেউ কেউ বলছেন, আওয়ামী লীগ সঠিক পথেই হাঁটছে।
পক্ষে-বিপক্ষে কোনোটাতেই যাব না। তবে এ কথা অনস্বীকার্য, আওয়ামী লীগ
প্রচারমাধ্যম হিসেবে বিলবোর্ডের গুরুত্ব বাড়িয়ে দিল অনেকখানি।
জানি না, আওয়ামী লীগকে বিলবোর্ড ব্যবহারের এ বুদ্ধি দিল কে বা কারা। বর্তমানে আওয়ামী লীগ যে পর্যায়ে আছে, তাতে তার প্রচার ও প্রসারের জন্য বিলবোর্ডের ব্যবহার কি সঠিক সিদ্ধান্ত? মার্কেটিংয়ের যে কোনো বিশেষজ্ঞকে নিরপেক্ষভাবে মতামত দিতে বললে অবশ্যই একটাই উত্তর পাওয়া যাবে এবং তা হল ‘না’। গণযোগাযোগের একটা ব্যাকরণ আছে। বর্তমানে আওয়ামী লীগের বিলবোর্ড ব্যবহার কোনোমতেই এ ব্যাকরণের মধ্যে পড়ে না। মানুষের মনে আওয়ামী লীগ সম্বন্ধে প্রচণ্ড নেগেটিভ মনোভাব আছে। এটা প্রমাণ হয়েছে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পাঁচ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে। নজিরবিহীন লুটপাট, পদ্মা সেতু দুর্নীতি, শেয়ারবাজার কারসাজি, ব্যাংক জালিয়াতি, হত্যা-গুম আর নিরীহ আলেম ও শিক্ষানবিস আলেমদের হত্যা-হয়রানির ঘটনাগুলোর জন্য আওয়ামী লীগের যে ক্ষতি হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠে ২০০৮-০৯ সালের অবস্থায় ফিরে যাওয়া দু-তিনশ’ কিংবা দু-তিন লাখ বিলবোর্ড দিয়ে সম্ভব নয়।
যাই হোক, আমার কথাগুলো আওয়ামী ঘরানার মানুষ মেনে নিতে চাইবেন না। সেক্ষেত্রে আমার প্রশ্ন হচ্ছে, আওয়ামী লীগ কি এতটাই দুর্বল হয়ে গেছে যে, বিএনপি মহাসচিব সেগুলো সরানোর কথা বলার পরপরই স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বিলবোর্ডের লেখাগুলো সরিয়ে ফেলা হল? মানুষ এত বোকা নয় যে, আমার ভাবনাটা তারা গ্রহণ করে ফেলবেন। ভেতরের সংবাদ কী জানি না, তবে এতটুকু বলা যেতে পারে, আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীর স্বভাব অনুযায়ীই তারা বিলবোর্ডগুলোকে সরকারি খাসজমি কিংবা সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর মনে করে রাতারাতি দখল করে ফেলেছিল। যদি তাই হয় তবে বলা যেতে পারে, পাহাড়সম দুর্নীতিকে ঢাকতে গিয়ে আরেক দুর্নীতির জন্ম দিয়ে ফেলল আওয়ামী লীগ। আর মাঝখানে লাভের গুড় কে খেল? বিলবোর্ডের কথা আর ছবিগুলো লেখার জন্য সরকারি কোষাগার থেকে যাকে বা যাদের লাখো কোটি টাকা দিতে হল, নিশ্চয়ই সেই সৌভাগ্যবান ব্যক্তি কিংবা ব্যক্তিদের পকেটে গেল লাভের গুড়। আওয়ামী লীগ যে ইমেজ সংকটে ভুগছে, এখন তার জন্য ইমেজ ফিরিয়ে আনার কৌশল হিসেবে জবরদখল করা বিলবোর্ডের ব্যবহার বুমেরাং হয়েই ফিরে এসেছে। আওয়ামী লীগ একটি রাজনৈতিক দল। রাজনীতি হয়তো তারা ভালো বুঝতে পারে, কিন্তু মার্কেটিং তো ভিন্ন জিনিস। এটা তাদের জানতে হবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিলিয়ন ডলার খরচ করে প্রেসিডেন্ট প্রার্থীরা প্রচার বিশেষজ্ঞ ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভাড়া করে। তারাই ঠিক করে দেয় প্রার্থী কোথায় কখন যাবে, কী কাপড়-চোপড় পরবে, কী কথা বলবে তাদের বক্তৃতায়, কোথায় কী বলে সম্বোধন করবে, এহেন আরও অনেক কিছু। আমাদের রাজনীতিকরা মনে করেন, তারা সবকিছুরই ওস্তাদ। তাই তারা মাঝে মধ্যে এমনই ভুল করে ফেলেন, যার জন্য খেসারত দিতে হয় পুরো দলকেই।
এবার অন্য পক্ষের কথায় আসি। আওয়ামী লীগ বিলবোর্ড ব্যবহার করেছে তো কী হয়েছে- আওয়ামী দুঃশাসন, নিপীড়ন, অত্যাচার আর হেফাজতের ওপর আইন-শৃংখলা বাহিনীর হামলার চিত্র ধরে তাদের পঞ্চাশটি বিলবোর্ডের বিপরীতে বিরোধী দল যদি একটি বিলবোর্ড টাঙিয়ে দিত, তাহলে তাদের লাভের পরিমাণ হতো আকাশসম। বিরোধী দলকেও শিখতে হবে রাজনৈতিক প্রচার কৌশল। মারের বদলে মার, কথার বিপরীতে কথা দিয়ে সব সময় কাজ হয় না। তাতে লাভ হয় না খুব বেশি। প্রচার কৌশল ঠিক করতে হবে অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায়। বুদ্ধি দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার উপায় খুঁজতে হবে। তাদের শিক্ষার জন্য একটা গল্প দিয়ে শেষ করব। লন্ডনের কোনো এক বাজারে এক মাংস বিক্রেতা তার মাংসের মান সম্বন্ধে উচ্চ ধারণা দেয়ার কৌশল হিসেবে দোকানে একটা ব্যানার ঝুলিয়ে রাখল। ব্যানারে লেখা ছিল ‘কুইন’স শেফ বায়’জ (কেনা) মিট ফ্রম হেয়ার’। রানীর বাবুর্চি এখান থেকে রানীর জন্য মাংস কেনে। ক্রেতারা হুমড়ি খেয়ে পড়ল সেই দোকানে। এ অবস্থায় অপরাপর মাংস বিক্রেতারা বিপদেই পড়ল। কী করবে তারা? না, কোনো মারামারি নয়, কিংবা সেই ব্যানারটি রাতের আঁধারে ছিঁড়ে ফেলাও নয়। ঠাণ্ডা মাথায় আরেক বিক্রেতা তার দোকানে একটা ব্যানার টাঙিয়ে দিল। সেই ব্যানারে লেখা ছিল ‘গড সেভ দ্য কুইন’। আল্লাহ রানীকে বাঁচিয়ে রাখুন। কী অপূর্ব কৌশল। সুতরাং বিরোধী দলকে আরও কৌশলী হতে হবে। বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা সব সময় কাজে লাগে না, লাগলেও লাভের গুড় খাওয়া যায় না।
ড. সৈয়দ রাশিদুল হাসান : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক
জানি না, আওয়ামী লীগকে বিলবোর্ড ব্যবহারের এ বুদ্ধি দিল কে বা কারা। বর্তমানে আওয়ামী লীগ যে পর্যায়ে আছে, তাতে তার প্রচার ও প্রসারের জন্য বিলবোর্ডের ব্যবহার কি সঠিক সিদ্ধান্ত? মার্কেটিংয়ের যে কোনো বিশেষজ্ঞকে নিরপেক্ষভাবে মতামত দিতে বললে অবশ্যই একটাই উত্তর পাওয়া যাবে এবং তা হল ‘না’। গণযোগাযোগের একটা ব্যাকরণ আছে। বর্তমানে আওয়ামী লীগের বিলবোর্ড ব্যবহার কোনোমতেই এ ব্যাকরণের মধ্যে পড়ে না। মানুষের মনে আওয়ামী লীগ সম্বন্ধে প্রচণ্ড নেগেটিভ মনোভাব আছে। এটা প্রমাণ হয়েছে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পাঁচ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে। নজিরবিহীন লুটপাট, পদ্মা সেতু দুর্নীতি, শেয়ারবাজার কারসাজি, ব্যাংক জালিয়াতি, হত্যা-গুম আর নিরীহ আলেম ও শিক্ষানবিস আলেমদের হত্যা-হয়রানির ঘটনাগুলোর জন্য আওয়ামী লীগের যে ক্ষতি হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠে ২০০৮-০৯ সালের অবস্থায় ফিরে যাওয়া দু-তিনশ’ কিংবা দু-তিন লাখ বিলবোর্ড দিয়ে সম্ভব নয়।
যাই হোক, আমার কথাগুলো আওয়ামী ঘরানার মানুষ মেনে নিতে চাইবেন না। সেক্ষেত্রে আমার প্রশ্ন হচ্ছে, আওয়ামী লীগ কি এতটাই দুর্বল হয়ে গেছে যে, বিএনপি মহাসচিব সেগুলো সরানোর কথা বলার পরপরই স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বিলবোর্ডের লেখাগুলো সরিয়ে ফেলা হল? মানুষ এত বোকা নয় যে, আমার ভাবনাটা তারা গ্রহণ করে ফেলবেন। ভেতরের সংবাদ কী জানি না, তবে এতটুকু বলা যেতে পারে, আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীর স্বভাব অনুযায়ীই তারা বিলবোর্ডগুলোকে সরকারি খাসজমি কিংবা সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর মনে করে রাতারাতি দখল করে ফেলেছিল। যদি তাই হয় তবে বলা যেতে পারে, পাহাড়সম দুর্নীতিকে ঢাকতে গিয়ে আরেক দুর্নীতির জন্ম দিয়ে ফেলল আওয়ামী লীগ। আর মাঝখানে লাভের গুড় কে খেল? বিলবোর্ডের কথা আর ছবিগুলো লেখার জন্য সরকারি কোষাগার থেকে যাকে বা যাদের লাখো কোটি টাকা দিতে হল, নিশ্চয়ই সেই সৌভাগ্যবান ব্যক্তি কিংবা ব্যক্তিদের পকেটে গেল লাভের গুড়। আওয়ামী লীগ যে ইমেজ সংকটে ভুগছে, এখন তার জন্য ইমেজ ফিরিয়ে আনার কৌশল হিসেবে জবরদখল করা বিলবোর্ডের ব্যবহার বুমেরাং হয়েই ফিরে এসেছে। আওয়ামী লীগ একটি রাজনৈতিক দল। রাজনীতি হয়তো তারা ভালো বুঝতে পারে, কিন্তু মার্কেটিং তো ভিন্ন জিনিস। এটা তাদের জানতে হবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিলিয়ন ডলার খরচ করে প্রেসিডেন্ট প্রার্থীরা প্রচার বিশেষজ্ঞ ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভাড়া করে। তারাই ঠিক করে দেয় প্রার্থী কোথায় কখন যাবে, কী কাপড়-চোপড় পরবে, কী কথা বলবে তাদের বক্তৃতায়, কোথায় কী বলে সম্বোধন করবে, এহেন আরও অনেক কিছু। আমাদের রাজনীতিকরা মনে করেন, তারা সবকিছুরই ওস্তাদ। তাই তারা মাঝে মধ্যে এমনই ভুল করে ফেলেন, যার জন্য খেসারত দিতে হয় পুরো দলকেই।
এবার অন্য পক্ষের কথায় আসি। আওয়ামী লীগ বিলবোর্ড ব্যবহার করেছে তো কী হয়েছে- আওয়ামী দুঃশাসন, নিপীড়ন, অত্যাচার আর হেফাজতের ওপর আইন-শৃংখলা বাহিনীর হামলার চিত্র ধরে তাদের পঞ্চাশটি বিলবোর্ডের বিপরীতে বিরোধী দল যদি একটি বিলবোর্ড টাঙিয়ে দিত, তাহলে তাদের লাভের পরিমাণ হতো আকাশসম। বিরোধী দলকেও শিখতে হবে রাজনৈতিক প্রচার কৌশল। মারের বদলে মার, কথার বিপরীতে কথা দিয়ে সব সময় কাজ হয় না। তাতে লাভ হয় না খুব বেশি। প্রচার কৌশল ঠিক করতে হবে অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায়। বুদ্ধি দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার উপায় খুঁজতে হবে। তাদের শিক্ষার জন্য একটা গল্প দিয়ে শেষ করব। লন্ডনের কোনো এক বাজারে এক মাংস বিক্রেতা তার মাংসের মান সম্বন্ধে উচ্চ ধারণা দেয়ার কৌশল হিসেবে দোকানে একটা ব্যানার ঝুলিয়ে রাখল। ব্যানারে লেখা ছিল ‘কুইন’স শেফ বায়’জ (কেনা) মিট ফ্রম হেয়ার’। রানীর বাবুর্চি এখান থেকে রানীর জন্য মাংস কেনে। ক্রেতারা হুমড়ি খেয়ে পড়ল সেই দোকানে। এ অবস্থায় অপরাপর মাংস বিক্রেতারা বিপদেই পড়ল। কী করবে তারা? না, কোনো মারামারি নয়, কিংবা সেই ব্যানারটি রাতের আঁধারে ছিঁড়ে ফেলাও নয়। ঠাণ্ডা মাথায় আরেক বিক্রেতা তার দোকানে একটা ব্যানার টাঙিয়ে দিল। সেই ব্যানারে লেখা ছিল ‘গড সেভ দ্য কুইন’। আল্লাহ রানীকে বাঁচিয়ে রাখুন। কী অপূর্ব কৌশল। সুতরাং বিরোধী দলকে আরও কৌশলী হতে হবে। বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা সব সময় কাজে লাগে না, লাগলেও লাভের গুড় খাওয়া যায় না।
ড. সৈয়দ রাশিদুল হাসান : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক
No comments