মিসরে ১৪ আগস্টের গণহত্যা সামরিক বাহিনী ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের যৌথ অপকর্ম by বদরুদ্দীন উমর
সামরিক
বাহিনীর মাধ্যমে তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ‘গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার যে
নীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে বিভিন্ন সময়ে
সুযোগ-সুবিধামতো কার্যকর করে এসেছে তারই সর্বশেষ দৃষ্টান্ত এখন আমরা দেখছি
মিসরে সম্প্রতি সংঘটিত সামরিক অভ্যুত্থান ও তার পরবর্তী পর্যায়ের
পরিস্থিতির মধ্যে। প্রেসিডেন্ট নাসেরের মৃত্যুর পর মিসর থেকে বাস্তবত
বহিষ্কৃত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে সাদাত ও পরে মোবারকের মাধ্যমে সেখানে
নিজেদের আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। তারা উভয়েই সামরিক বাহিনীর
মাধ্যমেই দেশ শাসন করেছিলেন। নাসের নিজেও ছিলেন সামরিক বাহিনীর লোক। কিন্তু
তার সঙ্গে তাদের পার্থক্য ছিল এই যে, নাসের যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে
মিসরের সামরিক বাহিনীর ওপর কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে দেননি, সেখানে
সাদাত ও মোবারক সামরিক বাহিনীতে মার্কিন অনুপ্রবেশকে স্বাগত জানিয়ে তাদের
ওপরই নির্ভরশীল হয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট সাদাতের আমলে এই নীতির সূত্রপাত ও
বিকাশ ঘটেছিল এবং সে কারণে মোবারক প্রথম থেকেই নির্ভরশীল হয়েছিলেন মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রের ওপর। অভ্যন্তরীণভাবে সামরিক বাহিনী এবং তার বাইরে মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রের ওপর একান্তভাবে নির্ভরশীল থেকেই মোবারক তার ৩০ বছরের শাসন
পরিচালনা করেছিলেন। যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক ও অন্যান্য
প্রক্রিয়ায় সামরিক বাহিনীর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল সে কারণে বলা
চলে, একটি সামরিক একনায়কতন্ত্রের অধীনে মিসর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি
মক্কেল দেশ হিসেবেই পরিচালিত হতো।
মোবারকের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ২০১১ সালের জানুয়ারিতে মিসরে যে গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল, সেটা যাতে সরাসরি সামরিক বাহিনী ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে না যায়, এজন্য মার্কিন সরকার তাদের গোলাম প্রেসিডেন্ট মোবারককে রক্ষায় মিসরে সামরিক বাহিনী ব্যবহারের বিরুদ্ধে ছিল। এজেন্ট হিসেবে অকার্যকর হয়ে যাওয়ায় মোবারককে রক্ষার কোনো প্রয়োজনও আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের থাকেনি। এ কারণে সে সময় সামরিক বাহিনী জনগণের বিরুদ্ধে না গিয়ে বস্তুত নিরপেক্ষ ছিল। এর ফলে মোবারক-পরবর্তী পর্যায়ে সামরিক বাহিনীর পক্ষে দেশ পরিচালনার কাজ হাতে নেয়া সম্ভব হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে মুসলিম ব্রাদারহুডসহ জনগণের কোনো অংশই দাঁড়ায়নি। ২০১১ সালের এই গণঅভ্যুত্থানের সময় মুসলিম ব্রাদারহুডই ছিল একমাত্র সংগঠিত দল। প্রেসিডেন্ট নাসের মুসলিম ব্রাদারহুড ও কমিউনিস্ট পার্টি উভয়কেই বেআইনি ঘোষণা করে তাদের ওপর দমন-পীড়ন করেছিলেন। উল্লেখ্য, নাসের যখন মিসরে কমিউনিস্ট পার্টি ধ্বংস করছিলেন, ঠিক তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা ক্রুশ্চেভের সঙ্গে তার সম্পর্ক খুব ভালো ও উষ্ণ ছিল। প্রকৃতপক্ষে মিসরের মস্কোপন্থী পার্টিটিকে ধ্বংস করে নাসেরের সঙ্গে সখ্যের সম্পর্ক তৈরি করতে ক্রুশ্চেভের কোনো অসুবিধা হয়নি। সোভিয়েত ইউনিয়নের এই নীতির ফলে নাসেরের সময়ে মিসরীয় কমিউনিস্ট পার্টি নিজেকে রক্ষা করতে ও পরবর্তী সময়ে আবার সংগঠিত করতে সক্ষম হয়নি। কিন্তু মুসলিম ব্রাদারহুড নাসেরের সময় প্রায় বিলুপ্ত অবস্থায় যাওয়া সত্ত্বেও তারা নিজেদের একটা সাংগঠনিক কাঠামো বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিল এবং পরে প্রেসিডেন্ট সাদাত ও মোবারকের সময় অনেকখানি শক্তি সঞ্চয় করেছিল। একটি সামরিক কুচকাওয়াজ পরিদর্শনকালে মুসলিম ব্রাদারহুডই সাদাতকে হত্যা করেছিল। যাই হোক, ২০১১ সালে সংগঠিত দল হিসেবে মুসলিম ব্রাদারহুড একটা সুবিধাজনক অবস্থায় ছিল। এ কারণে পরে মিসরের ইতিহাসে প্রথম প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্টারি নির্বাচনের সময় মুসলিম ব্রাদারহুডের অঘোষিত প্রার্থী হিসেবে তাদের দলের অন্যতম নেতা মুহম্মদ মুরসির পক্ষে নির্বাচনে জয়লাভ সম্ভব হয়েছিল।
মুসলিম ব্রাদারহুড একটি প্রতিক্রিয়াশীল এবং ইসলামী মৌলবাদী রাজনৈতিক দল। মোবারক ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতার ক্ষেত্রে কমিউনিস্টসহ অন্য কোনো দলের কার্যকর প্রভাবের অনুপস্থিতিতে তারাই বিরোধী শক্তি হিসেবে সংগঠিত হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও অসংগঠিত হলেও মিসরে ধর্মবিযুক্ত (secular) শক্তিগুলোর প্রভাব জনগণের মধ্যে যথেষ্ট ছিল। কাজেই নির্বাচনে মুসলিম ব্রাদারহুডের জয় সত্ত্বেও মুরসির বিরুদ্ধে ভোটের সংখ্যা বিশাল ছিল। এদিক দিয়ে উভয়ের অবস্থান ছিল কাছাকাছি। ক্ষমতায় বসার পর মুরসি মিসরের মূল সমস্যাগুলো সমাধানের উদ্দেশ্যে বিরোধীদের সঙ্গে কোনো আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতার নীতি অনুসরণ না করায় এদিক দিয়ে তার কোনো সাফল্য বা অগ্রগতি ছিল না। উপরন্তু তিনি সমগ্র প্রশাসন এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে নিজের দল মুসলিম ব্রাদারহুডের লোকদের ক্ষমতায় বসিয়ে নিরঙ্কুশভাবে একদলীয় শাসন কায়েমের দিকে অগ্রসর হয়েছিলেন। স্বাভাবিকভাবে তারা মুরসির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সারাদেশে মুসলিম ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সংগঠিত করতে নিযুক্ত হন। এই বিক্ষোভ খুব ব্যাপক ও শক্তিশালী হওয়ার মুহূর্তে মিসরে সামরিক বাহিনী এক অঘোষিত অভ্যুত্থান ঘটিয়ে মুরসির সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজেদের তত্ত্বাবধানে একটি তথাকথিত বেসামরিক সরকার গঠন করেছে। এ সরকারের প্রত্যেকটি লোক মার্কিনপন্থী ও তাদের সহযোগী। সহসভাপতি এল বারাদি ও প্রধানমন্ত্রী হাজেম এল বেবলাউয়ী এই লোকদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
যেহেতু মুসলিম ব্রাদারহুড একটি সংগঠিত দল এবং জনগণের মধ্যে তার সমর্থনও ব্যাপক, সে কারণে তারা নিজেদের সরকার উৎখাতের বিরুদ্ধে মিসরজুড়ে আন্দোলন শুরু করে তাদের সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি জানাচ্ছে এবং সরকারের সঙ্গে অর্থাৎ মূলত সামরিক বাহিনীর সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হচ্ছে, যে সংঘর্ষে সামরিক বাহিনীর সমর্থনে মুসলিম বাদ্রারহুডবিরোধী নানা দল, গ্র“প ও লোকজন সমবেত হয়েছে। সামরিক বাহিনীকে এভাবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করার পেছনে যে মার্কিন চক্রান্ত আছে এবং তা ভালোভাবেই কার্যকর করা হয়েছে, এটা যুক্তরাষ্ট্রের এখনকার অবস্থান থেকে ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছে। নিজেরা এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে গণহত্যার জন্য কুম্ভীরাশ্র“ বর্ষণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী নীতি ও কৌশলের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটা বিশ্বের বহু দেশে বারবার দেখা গেছে। মিসরের সামরিক বাহিনীর অভ্যুত্থানের পেছনে যে তাদের চক্রান্ত আছে, এর প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে সেখানকার সামরিক বাহিনীকে বাৎসরিক ১৩০ কোটি ডলারের সামরিক সাহায্য বন্ধ না করার পক্ষে তাদের ঘোষণা এবং এ মুহূর্তেও মিসরের সামরিক বাহিনীকে এফ ১৬ যুদ্ধবিমান সরবরাহের ব্যবস্থা থেকে। এটা এমন এক ব্যাপার, যার বিরুদ্ধে ফ্রান্সসহ কতগুলো ইউরোপীয় দেশ প্রতিবাদ জানিয়েছে, খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের প্রধান প্রধান সংবাদপত্রও এই মার্কিন অবস্থানের বিরোধিতা করে মিসরের সামরিক বাহিনীকে সাহায্য বন্ধের দাবি জানিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই যে মিসরের এই সামরিক অভ্যুত্থানের কলকাঠি নেড়েছে, এর অন্য একটি প্রমাণ হল- মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তাঁবেদার রাষ্ট্রগুলো কর্তৃক এর পক্ষ সমর্থন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক মিত্র রাষ্ট্র ও সাম্রাজ্যবাদী প্রচার মাধ্যমেও যখন এই অভ্যুত্থানের সমালোচনা ও বিরোধিতা করা হচ্ছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বলা হচ্ছে সামরিক বাহিনীকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য না করার, সেখানে এই আরব দেশগুলো কর্তৃক একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ আরব রাষ্ট্রে মার্কিন সমর্থিত সামরিক অভ্যুত্থানকে সমর্থন করা থেকে বোঝার অসুবিধা নেই যে, উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এখনও কত শক্তিশালীভাবে তার থাবা বিস্তার করে আছে।
মুসলিম ব্রাদারহুডের সমর্থকদের তাদের প্রতিরোধ বন্ধ করার জন্য সামরিক বাহিনীর নির্দেশ সত্ত্বেও তারা প্রতিরোধ অব্যাহত রেখে কায়রো ও অন্যান্য শহরে অবস্থান বজায় রাখায় ১৪ আগস্ট সামরিক বাহিনী সারাদেশে তাদের ওপর এক ব্যাপক ও ভয়ংকর সশস্ত্র হামলা করে অসংখ্য লোক হত্যা করেছে। সামরিক বাহিনীর নিজের স্বীকৃতি অনুযায়ী নিহত ও আহতের সংখ্যা যথাক্রমে ৬৩৮ ও ৩৯৯৪। কিন্তু মুসলিম ব্রাদারহুডের দাবি, তিন হাজারের বেশি লোক নিহত হয়েছে এবং আহত হয়েছে প্রায় অর্ধলক্ষ। এভাবে যে হত্যাকাণ্ড করা হয়েছে তাকে গণহত্যা ছাড়া অন্য কোনোভাবে আখ্যায়িত করা যায় না। মুসলিম ব্রাদারহুড একটি প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মীয় মৌলবাদী দল হলেও তাদের বিরুদ্ধে এই আক্রমণ ও গণহত্যা গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন কারও সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। মিসরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতিয়ার সেখানকার সামরিক বাহিনী এবং তাদের দ্বারা ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত বর্তমান সরকার যেভাবে মুসলিম ব্রাদারহুডের বিরোধিতা মোকাবেলা করার জন্য দাঁড়িয়েছে, তাতে পরিস্থিতি এখন ঘোরতর আকার ধারণ করেছে। এর পরিণতি গৃহযুদ্ধ ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না। ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া ইত্যাদি দেশে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যেভাবে হস্তক্ষেপ করে দেশগুলোকে নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করেছে এবং এখনও করছে, সেভাবেই তারা এখন মিসরে সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে এমন এক চরম নৈরাজ্য পরিস্থিতি তৈরির চক্রান্ত এগিয়ে নিচ্ছে, যেখানে সামরিক বাহিনী ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কোনো গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিচালনা পরিণত হবে এক চরম দুরূহ ব্যাপারে। ‘আরব বসন্ত’ নামে তাদেরই দ্বারা আখ্যায়িত গণজাগরণ স্তব্ধ ও নির্মূল করার ক্ষেত্রে এটাই হল মিসরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বর্তমান কৌশল।
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
মোবারকের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ২০১১ সালের জানুয়ারিতে মিসরে যে গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল, সেটা যাতে সরাসরি সামরিক বাহিনী ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে না যায়, এজন্য মার্কিন সরকার তাদের গোলাম প্রেসিডেন্ট মোবারককে রক্ষায় মিসরে সামরিক বাহিনী ব্যবহারের বিরুদ্ধে ছিল। এজেন্ট হিসেবে অকার্যকর হয়ে যাওয়ায় মোবারককে রক্ষার কোনো প্রয়োজনও আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের থাকেনি। এ কারণে সে সময় সামরিক বাহিনী জনগণের বিরুদ্ধে না গিয়ে বস্তুত নিরপেক্ষ ছিল। এর ফলে মোবারক-পরবর্তী পর্যায়ে সামরিক বাহিনীর পক্ষে দেশ পরিচালনার কাজ হাতে নেয়া সম্ভব হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে মুসলিম ব্রাদারহুডসহ জনগণের কোনো অংশই দাঁড়ায়নি। ২০১১ সালের এই গণঅভ্যুত্থানের সময় মুসলিম ব্রাদারহুডই ছিল একমাত্র সংগঠিত দল। প্রেসিডেন্ট নাসের মুসলিম ব্রাদারহুড ও কমিউনিস্ট পার্টি উভয়কেই বেআইনি ঘোষণা করে তাদের ওপর দমন-পীড়ন করেছিলেন। উল্লেখ্য, নাসের যখন মিসরে কমিউনিস্ট পার্টি ধ্বংস করছিলেন, ঠিক তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা ক্রুশ্চেভের সঙ্গে তার সম্পর্ক খুব ভালো ও উষ্ণ ছিল। প্রকৃতপক্ষে মিসরের মস্কোপন্থী পার্টিটিকে ধ্বংস করে নাসেরের সঙ্গে সখ্যের সম্পর্ক তৈরি করতে ক্রুশ্চেভের কোনো অসুবিধা হয়নি। সোভিয়েত ইউনিয়নের এই নীতির ফলে নাসেরের সময়ে মিসরীয় কমিউনিস্ট পার্টি নিজেকে রক্ষা করতে ও পরবর্তী সময়ে আবার সংগঠিত করতে সক্ষম হয়নি। কিন্তু মুসলিম ব্রাদারহুড নাসেরের সময় প্রায় বিলুপ্ত অবস্থায় যাওয়া সত্ত্বেও তারা নিজেদের একটা সাংগঠনিক কাঠামো বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিল এবং পরে প্রেসিডেন্ট সাদাত ও মোবারকের সময় অনেকখানি শক্তি সঞ্চয় করেছিল। একটি সামরিক কুচকাওয়াজ পরিদর্শনকালে মুসলিম ব্রাদারহুডই সাদাতকে হত্যা করেছিল। যাই হোক, ২০১১ সালে সংগঠিত দল হিসেবে মুসলিম ব্রাদারহুড একটা সুবিধাজনক অবস্থায় ছিল। এ কারণে পরে মিসরের ইতিহাসে প্রথম প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্টারি নির্বাচনের সময় মুসলিম ব্রাদারহুডের অঘোষিত প্রার্থী হিসেবে তাদের দলের অন্যতম নেতা মুহম্মদ মুরসির পক্ষে নির্বাচনে জয়লাভ সম্ভব হয়েছিল।
মুসলিম ব্রাদারহুড একটি প্রতিক্রিয়াশীল এবং ইসলামী মৌলবাদী রাজনৈতিক দল। মোবারক ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতার ক্ষেত্রে কমিউনিস্টসহ অন্য কোনো দলের কার্যকর প্রভাবের অনুপস্থিতিতে তারাই বিরোধী শক্তি হিসেবে সংগঠিত হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও অসংগঠিত হলেও মিসরে ধর্মবিযুক্ত (secular) শক্তিগুলোর প্রভাব জনগণের মধ্যে যথেষ্ট ছিল। কাজেই নির্বাচনে মুসলিম ব্রাদারহুডের জয় সত্ত্বেও মুরসির বিরুদ্ধে ভোটের সংখ্যা বিশাল ছিল। এদিক দিয়ে উভয়ের অবস্থান ছিল কাছাকাছি। ক্ষমতায় বসার পর মুরসি মিসরের মূল সমস্যাগুলো সমাধানের উদ্দেশ্যে বিরোধীদের সঙ্গে কোনো আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতার নীতি অনুসরণ না করায় এদিক দিয়ে তার কোনো সাফল্য বা অগ্রগতি ছিল না। উপরন্তু তিনি সমগ্র প্রশাসন এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে নিজের দল মুসলিম ব্রাদারহুডের লোকদের ক্ষমতায় বসিয়ে নিরঙ্কুশভাবে একদলীয় শাসন কায়েমের দিকে অগ্রসর হয়েছিলেন। স্বাভাবিকভাবে তারা মুরসির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সারাদেশে মুসলিম ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সংগঠিত করতে নিযুক্ত হন। এই বিক্ষোভ খুব ব্যাপক ও শক্তিশালী হওয়ার মুহূর্তে মিসরে সামরিক বাহিনী এক অঘোষিত অভ্যুত্থান ঘটিয়ে মুরসির সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজেদের তত্ত্বাবধানে একটি তথাকথিত বেসামরিক সরকার গঠন করেছে। এ সরকারের প্রত্যেকটি লোক মার্কিনপন্থী ও তাদের সহযোগী। সহসভাপতি এল বারাদি ও প্রধানমন্ত্রী হাজেম এল বেবলাউয়ী এই লোকদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
যেহেতু মুসলিম ব্রাদারহুড একটি সংগঠিত দল এবং জনগণের মধ্যে তার সমর্থনও ব্যাপক, সে কারণে তারা নিজেদের সরকার উৎখাতের বিরুদ্ধে মিসরজুড়ে আন্দোলন শুরু করে তাদের সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি জানাচ্ছে এবং সরকারের সঙ্গে অর্থাৎ মূলত সামরিক বাহিনীর সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হচ্ছে, যে সংঘর্ষে সামরিক বাহিনীর সমর্থনে মুসলিম বাদ্রারহুডবিরোধী নানা দল, গ্র“প ও লোকজন সমবেত হয়েছে। সামরিক বাহিনীকে এভাবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করার পেছনে যে মার্কিন চক্রান্ত আছে এবং তা ভালোভাবেই কার্যকর করা হয়েছে, এটা যুক্তরাষ্ট্রের এখনকার অবস্থান থেকে ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছে। নিজেরা এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে গণহত্যার জন্য কুম্ভীরাশ্র“ বর্ষণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী নীতি ও কৌশলের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটা বিশ্বের বহু দেশে বারবার দেখা গেছে। মিসরের সামরিক বাহিনীর অভ্যুত্থানের পেছনে যে তাদের চক্রান্ত আছে, এর প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে সেখানকার সামরিক বাহিনীকে বাৎসরিক ১৩০ কোটি ডলারের সামরিক সাহায্য বন্ধ না করার পক্ষে তাদের ঘোষণা এবং এ মুহূর্তেও মিসরের সামরিক বাহিনীকে এফ ১৬ যুদ্ধবিমান সরবরাহের ব্যবস্থা থেকে। এটা এমন এক ব্যাপার, যার বিরুদ্ধে ফ্রান্সসহ কতগুলো ইউরোপীয় দেশ প্রতিবাদ জানিয়েছে, খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের প্রধান প্রধান সংবাদপত্রও এই মার্কিন অবস্থানের বিরোধিতা করে মিসরের সামরিক বাহিনীকে সাহায্য বন্ধের দাবি জানিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই যে মিসরের এই সামরিক অভ্যুত্থানের কলকাঠি নেড়েছে, এর অন্য একটি প্রমাণ হল- মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তাঁবেদার রাষ্ট্রগুলো কর্তৃক এর পক্ষ সমর্থন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক মিত্র রাষ্ট্র ও সাম্রাজ্যবাদী প্রচার মাধ্যমেও যখন এই অভ্যুত্থানের সমালোচনা ও বিরোধিতা করা হচ্ছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বলা হচ্ছে সামরিক বাহিনীকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য না করার, সেখানে এই আরব দেশগুলো কর্তৃক একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ আরব রাষ্ট্রে মার্কিন সমর্থিত সামরিক অভ্যুত্থানকে সমর্থন করা থেকে বোঝার অসুবিধা নেই যে, উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এখনও কত শক্তিশালীভাবে তার থাবা বিস্তার করে আছে।
মুসলিম ব্রাদারহুডের সমর্থকদের তাদের প্রতিরোধ বন্ধ করার জন্য সামরিক বাহিনীর নির্দেশ সত্ত্বেও তারা প্রতিরোধ অব্যাহত রেখে কায়রো ও অন্যান্য শহরে অবস্থান বজায় রাখায় ১৪ আগস্ট সামরিক বাহিনী সারাদেশে তাদের ওপর এক ব্যাপক ও ভয়ংকর সশস্ত্র হামলা করে অসংখ্য লোক হত্যা করেছে। সামরিক বাহিনীর নিজের স্বীকৃতি অনুযায়ী নিহত ও আহতের সংখ্যা যথাক্রমে ৬৩৮ ও ৩৯৯৪। কিন্তু মুসলিম ব্রাদারহুডের দাবি, তিন হাজারের বেশি লোক নিহত হয়েছে এবং আহত হয়েছে প্রায় অর্ধলক্ষ। এভাবে যে হত্যাকাণ্ড করা হয়েছে তাকে গণহত্যা ছাড়া অন্য কোনোভাবে আখ্যায়িত করা যায় না। মুসলিম ব্রাদারহুড একটি প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মীয় মৌলবাদী দল হলেও তাদের বিরুদ্ধে এই আক্রমণ ও গণহত্যা গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন কারও সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। মিসরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতিয়ার সেখানকার সামরিক বাহিনী এবং তাদের দ্বারা ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত বর্তমান সরকার যেভাবে মুসলিম ব্রাদারহুডের বিরোধিতা মোকাবেলা করার জন্য দাঁড়িয়েছে, তাতে পরিস্থিতি এখন ঘোরতর আকার ধারণ করেছে। এর পরিণতি গৃহযুদ্ধ ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না। ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া ইত্যাদি দেশে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যেভাবে হস্তক্ষেপ করে দেশগুলোকে নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করেছে এবং এখনও করছে, সেভাবেই তারা এখন মিসরে সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে এমন এক চরম নৈরাজ্য পরিস্থিতি তৈরির চক্রান্ত এগিয়ে নিচ্ছে, যেখানে সামরিক বাহিনী ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কোনো গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিচালনা পরিণত হবে এক চরম দুরূহ ব্যাপারে। ‘আরব বসন্ত’ নামে তাদেরই দ্বারা আখ্যায়িত গণজাগরণ স্তব্ধ ও নির্মূল করার ক্ষেত্রে এটাই হল মিসরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বর্তমান কৌশল।
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
No comments