মনের কোণে হীরে-মুক্তো-নির্দেশ নির্দেশনা নির্বাহী পর্যায়ে কেমন হালে রয়েছে by ড. সা'দত হুসাইন
সংসদ সদস্য (এমপি) গোলাম মাওলা রনি
অনেকেরই প্রিয় ব্যক্তিত্ব। তিনি একজন সুলেখকও বটে। নিয়মিতভাবে টেলিভিশনের
টক শোতে অংশ নিয়ে আসর মাতিয়ে রাখেন। এর মাধ্যমে পুরোপুরি না হলেও
সেলিব্রিটির পর্যায়ে প্রায় পৌঁছে গেছেন।
সরকারদলীয় এমপি
বিধায় তাঁর বক্তব্য চূড়ান্ত বিশ্লেষণে দলীয় অবস্থানের পক্ষে যায়। তবে তাঁকে
দলকানা মনে হয় না। দেশ ও রাজনীতির সামগ্রিক সমস্যা কিছুটা নৈর্ব্যক্তিক
দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেন; সবার কাছে গ্রহণযোগ্য মোড়কে উপস্থাপন করার চেষ্টা
করেন। নির্বাহী পর্যায়ে সরকারি সিদ্ধান্তের বেহাল অবস্থা দেখে সম্প্রতি
তিনি হতাশা এবং ক্ষোভ ব্যক্ত করে দৈনিক পত্রিকায় একটি সংলেখ প্রকাশ করেন।
তাঁর মূল বক্তব্য ছিল যে, সরকারি সিদ্ধান্তকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বা একে
পাশ কাটিয়ে ওপর-নিচের যোগসাজশে এক শ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তা নিজের
ইচ্ছা-অনিচ্ছা এবং সুবিধা অনুযায়ী কাজ করেন। এ জন্য তাঁদের কোনোভাবে
দায়বদ্ধ করা হয় না, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না; একে অপরকে
সমর্থন দিয়ে, অজুহাতের ফুলঝুরি ছড়িয়ে দিব্যি আরামে তাঁরা পার পেয়ে যান।
সরকারি সিদ্ধান্ত মুখথুবড়ে পড়ে থাকে। প্রশাসন চিরায়ত ধারায় চলতে থাকে।
আপাতত এ ধারা পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই।
সরকারি সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনের দায়ে যেসব কর্মকর্তাকে দায়ী করে রনি তাঁর বক্তব্য প্রকাশ করেছেন তাঁদের মধ্যে দু-একজন নরম ভাষায় ইনিয়ে-বিনিয়ে এর প্রতিবাদ করেছেন। তাঁদের বক্তব্যও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিশদ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটিত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে যথাযথ তদন্ত হওয়া সমীচীন হবে বলে আমি মনে করি। তবে এ নিবন্ধে কে দোষী, কে নির্দোষ সে সম্পর্কে আমি আলোচনা করতে যাচ্ছি না। এ নিবন্ধে আলোচনার মূল বিষয় হচ্ছে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে নীতিনির্ধারক কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত এবং তাঁদের নির্দেশ-নির্দেশনা নির্বাহী পর্যায়ে অবিকৃত অবস্থায় যথা দ্রুততার সঙ্গে বাস্তবায়িত হয় কি না। না হলে বাস্তবায়ন পর্যায়ে এসব সিদ্ধান্তের হাল কী হয়; এর কারণ কী? নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্ত অবিকৃত অবস্থায় দ্রুততার সঙ্গে বাস্তবায়নের জন্য কি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে?
সিদ্ধান্তগুলো যে পর্যায়েই গৃহীত হোক না কেন তার বাস্তবায়নের দায়িত্ব থাকে কর্মকর্তা বা নির্বাহীর ওপর। সরকারি, আধাসরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এমনকি রাজনৈতিক দল সবার জন্য এ কথা সত্য। বাস্তবায়নের দায়িত্বে যিনি থাকেন, তাঁর কাছে অনেক ক্ষমতা স্বাভাবিকভাবে চলে আসে। তিনি যদি প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে এ নির্দেশ পালন করবেন না এমনটি জানিয়ে দেন তবে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন এ অভিযোগ এনে তার বিপক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। কিন্তু তিনি যদি প্রকাশ্যে আনুগত্য দেখিয়ে ভেতরে ভেতরে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে শ্লথ করে দেন অথবা মূল সিদ্ধান্তকে বিকৃত করে কর্ম সম্পাদন করতে থাকেন, তবে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। আইনকানুনের বেড়াজালে সহজেই তিনি নিজেকে বাঁচিয়ে চলতে পারেন।
ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে গৃহীত সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন নির্ভর করে বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সদিচ্ছা, দক্ষতা ও সততার ওপর। একটি সিদ্ধান্ত যখন বাস্তবায়নের জন্য নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে যায় তখন তাঁর তিন ধরনের প্রতিক্রিয়া হতে পারে। সিদ্ধান্তটি তাঁর পছন্দনীয় হতে পারে, ফলত এটি বাস্তবায়নের জন্য তিনি আগ্রহী হবেন। সিদ্ধান্তটি তাঁর কাছে গতানুগতিক মনে হতে পারে, এর পক্ষে-বিপক্ষে তাঁর কোনো প্রতিক্রিয়া নাও হতে পারে; সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ব্যাপারে তিনি মধ্যমপন্থা অবলম্বন করে উদাসীন থাকতে পারেন। আবার সিদ্ধান্তটি তাঁর অপছন্দনীয় হতে পারে; প্রথম থেকেই তিনি এর বাস্তবায়ন ঠেকাতে, শ্লথ করতে বা একে বিকৃতভাবে বাস্তবায়ন করতে সচেষ্ট হতে পারেন। নির্বাহী কর্মকর্তার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের গতি-প্রকৃতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ ছাড়া রয়েছে বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দক্ষতার পর্যায়। অনেক সময় দেখা যায়, বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী বুঝতে পারছেন না নীতিনির্ধারক পর্যায়ে গৃহীত সিদ্ধান্ত কিভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য যে কৌশল ও পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করতে হবে সে সম্পর্কে হয়তো তাঁদের ধারণা নেই অথবা ধারণা থাকলেও প্রয়োজনীয় কাজগুলো সম্পন্ন করার মতো তাঁদের সাধ্য নেই। নিজেদের অপারগতা তাঁরা সব সময় প্রকাশ করতে চান না; সিদ্ধান্ত দানকারী মহল অনবহিত থাকেন, সিদ্ধান্ত অবাস্তবায়িত থেকে যায়।
কিছু দৃষ্টান্ত এখানে প্রাসঙ্গিক হতে পারে। বেতন কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে মোটামুটি পাঁচ বছর অন্তর সরকারি, আধাসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন উচ্চতর স্কেলে নির্ধারণ করার সরকারি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সব পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এতে উপকৃত হন। বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছে এ সিদ্ধান্ত খুবই পছন্দনীয়। সরকারের চূড়ান্ত পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার অব্যবহিত পরই এ সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং খুব দ্রুত এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়ে যায়। বেতন কমিশনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের গতি-প্রক্রিয়া দেখলে কেউ এমন কথা বলতে পারবে না যে, সরকারি দপ্তরে কাজকর্ম দ্রুত সম্পন্ন হয় না। একই দ্রুততায় সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয় কর্মকর্তাদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে। বাংলাদেশে কয়েক দশক ধরে ব্যাচওয়ারি প্রমোশন হয়ে থাকে। বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তারা, তাঁদের বন্ধুবান্ধব অথবা সহকর্মীরা সাধারণত এ সিদ্ধান্তে উপকৃত হয়ে থাকেন। পদোন্নতির সিদ্ধান্ত চূড়ান্তভাবে গৃহীত হওয়ার পর বিদ্যুৎবেগে তা বাস্তবায়িত হয়ে যায়। এখানে কোনো কিছু পড়ে থাকে না, বিধি-বিধানের ছোটখাটো জটিলতা থাকলে তা ক্ষিপ্রতার সঙ্গে ডিঙিয়ে পদোন্নতির সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়। কোনো ভৌত অবকাঠামোসংক্রান্ত প্রকল্পে বাস্তবায়নকারী নির্বাহী কর্মকর্তার এলাকা যদি সরাসরি উপকৃত হয়, তবে সে প্রকল্প দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন হবে; এতে কোনো সন্দেহ নেই।
যে সিদ্ধান্তের ফলে বাস্তবায়নকারী নির্বাহীরা উপকৃত না হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না, সে কাজ তাঁদের খুব পছন্দনীয় না হলেও অপছন্দনীয়ও নয়। এ ধরনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ব্যাপারে নির্বাহীরা বাড়তি উদ্যোগ গ্রহণ করে না, তবে এর বাস্তবায়নে তেমন কোনো প্রতিবন্ধকতাও সৃষ্টি করেন না। একে রুটিনকাজ মনে করে গতানুগতিক ধারায় কর্ম সম্পাদন করে যান। উদাহরণ- উপজেলা সৃষ্টি এবং ফটোসংবলিত ভোটার তালিকা ও জাতীয় আইডি কার্ড প্রবর্তন। এ ক্ষেত্রে সরকারের সিদ্ধান্ত সুনির্দিষ্ট ছিল এবং সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সরকারের আন্তরিকতা ছিল। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে নির্বাহী কর্মকর্তারা উৎসাহী না হলেও সিদ্ধান্তগুলো তাঁদের অপছন্দনীয় ছিল না। ফলত সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়িত হয়েছে। এতে বড় রকমের কোনো বিলম্ব ঘটেনি। কিন্তু বিভিন্ন সংস্থার সদর দপ্তর ঢাকার বাইরে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নির্বাহী কর্মকর্তাদের চরম অপছন্দনীয় ছিল। তাঁরা ভেতরে ভেতরে এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করতে থাকেন। প্রথমে বিভিন্ন অজুহাতে ঢাকায় লিয়াজোঁ অফিসের নামে বাড়ি ভাড়া করে মাসের বেশির ভাগ সময় এ অফিসে বসে কাজ চালাতে থাকেন। সরকার পরিবর্তনের পর নতুন সরকার পূর্বতন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ততটা আন্তরিক ও উৎসাহী ছিল না। এ সুযোগ নির্বাহী কর্মকর্তারা পূর্বতন সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন থেকে সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকেন এবং মফস্বলের অফিস পরিত্যাগ করে ঢাকায় স্থায়ীভাবে অফিস করা শুরু করেন। ঢাকার বাইরের অফিস স্থানান্তরের সিদ্ধান্তটি ধীরে ধীরে বিস্মৃত হয়ে যায়। সংগঠনের নেতৃত্ব বদলের পর অবিকৃতভাবে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পথে পূর্বতন নেতার সিদ্ধান্তের প্রতি উদাসীনতা, অবজ্ঞা এবং ক্ষেত্রবিশেষে বিরোধিতা বড় রকমের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। সরকারি-আধাসরকারি সংস্থার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এভাবেই বিলম্ব ও বিকৃতি ঘটে।
সিদ্ধান্ত সুনির্দিষ্ট না হওয়া, অস্পষ্ট হওয়া, দ্ব্যর্থবোধক হওয়া ও সিদ্ধান্তে বিভিন্ন প্রকার অভ্যন্তরীণ অসংগতি নির্বাহী পর্যায়ে সিদ্ধান্তকে বিকৃত করার এবং এর বাস্তবায়ন বিলম্বিত করার সুযোগ করে দেয়। সরকারি-আধাসরকারি সংস্থায় একই বিষয়ে বহু আদেশ-নির্দেশ জারি করা হয়। এর মধ্যে অনেক আদেশ-নির্দেশ সাংঘর্ষিক হয়ে থাকে। আগের নির্দেশসহ সর্বশেষ জারীকৃত নির্দেশের পরিপন্থী অন্য সব নির্দেশ যে বাতিল বলে গণ্য হবে এমনটি হয়তো বা স্পষ্ট করে লেখা থাকে না। সর্বশেষ নির্দেশ সব নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে নিশ্চিতভাবে পৌঁছানো হয় না। সে সুযোগে নির্বাহী কর্মকর্তা আগে জারি করা কোনো একটি আদেশের বরাত দিয়ে তাঁর ইচ্ছামতো কাজ করে ফেলেন। যে আদেশটি তাঁর বিপক্ষে যাবে কারসাজি করে তা তাঁর অফিস বা নথি থেকে সরিয়ে ফেলেন। রনির এ কেসে তেমন কিছু ঘটেছে কি না, তা তিনি অনুপুঙ্খ পর্যালোচনা করে দেখতে পারেন। দু-একজন কর্মকর্তার প্রতিবাদলিপিতে সে রকম সম্ভাবনার আভাস পাওয়া যায়।
নীতিনির্ধারকদের নির্দেশ-নির্দেশনা নির্বাহী পর্যায়ে অবিকৃত অবস্থায় যথাসময়ে বাস্তবায়ন করার জন্য নীতিনির্ধারকদেরই মূল উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এ জন্য তাঁদের কর্মপরিকল্পনাগুলোর বাস্তবায়ন পরিধারণের (Monitoring) কৌশল রপ্ত করতে হবে। প্রয়োজনবোধে যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ নিতে হবে। বাস্তবায়নের দায়িত্বে নির্বাহী কর্মকর্তারা প্রকল্প বা কর্মসূচির অগ্রগতি সম্পর্কে নীতিনির্ধারকদের নানাভাবে বিভ্রান্ত করতে পারেন। বিভ্রান্ত হওয়ার বড় কারণ নীতিনির্ধারকদের সপ্রতিভতার (alertness) অভাব এবং কিছু সময় ব্যয় করে বিষয়ের গভীরে যেতে অনীহা। অনেক পর্যালোচনা সভায় উপস্থিত থেকে আমি দেখেছি মিনিট দশেক যাওয়ার পরই সভার মূল ব্যক্তিরা কেমন যেন ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন, নানা হিসাব-নিকাশ এবং পরিসংখ্যানের তোড়ে তাঁরা বিষয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। পর্যালোচনা সভায় আমি খুব কম ব্যক্তিকেই বই-পুস্তক, কাগজপত্র এবং ক্যালকুলেটর সহযোগে আলোচনা করতে দেখেছি। পরিবেশিত তথ্যাদি সত্য বিবেচনা করে সন্তুষ্টচিত্তে সভা ত্যাগ করেছেন। অথচ এ তথ্য ছিল অসত্য, অপ্রাসঙ্গিক ও বিভ্রান্তিকর। সে জন্য প্রকল্প উদ্বোধনের তারিখ বারবার পেছানো হয়, আয়-উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয় না, সামাজিক প্রকল্প কর্মসূচি শেষ হওয়ার পর উপকারভোগীদের খোঁজ পাওয়া যায় না। যে নিয়ম-পদ্ধতিতে কর্মসূচি সম্পন্ন হওয়ার কথা বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে তার কোনো মিল থাকে না।
সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের প্রকৃত অবস্থা শুধু অকুস্থল পরিদর্শনের মাধ্যমেই জানা যায়। নীতিনির্ধারকদেরকে নিজে অথবা বিশ্বস্ত ব্যক্তির মাধ্যমে অকুস্থল পরিদর্শনের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের প্রকৃত তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। সমস্যা চিহ্নিত হলে তা সমাধানের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে, নির্বাহী কর্মকর্তাকে প্রয়োজন মতো সহযোগিতা, সমর্থন জোগাতে হবে। তবেই সিদ্ধান্ত সন্তোষজনকভাবে অবিকৃত অবস্থায় বাস্তবায়িত হবে। অন্যথায় দেখা যাবে জনগণের অর্থে নির্মিত গণশৌচাগারের মধ্যে খাবার হোটেল চলছে (কালের কণ্ঠ, ১০ জুন ২০১৩)।
লেখক : পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান ও
সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব
সরকারি সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনের দায়ে যেসব কর্মকর্তাকে দায়ী করে রনি তাঁর বক্তব্য প্রকাশ করেছেন তাঁদের মধ্যে দু-একজন নরম ভাষায় ইনিয়ে-বিনিয়ে এর প্রতিবাদ করেছেন। তাঁদের বক্তব্যও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিশদ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটিত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে যথাযথ তদন্ত হওয়া সমীচীন হবে বলে আমি মনে করি। তবে এ নিবন্ধে কে দোষী, কে নির্দোষ সে সম্পর্কে আমি আলোচনা করতে যাচ্ছি না। এ নিবন্ধে আলোচনার মূল বিষয় হচ্ছে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে নীতিনির্ধারক কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত এবং তাঁদের নির্দেশ-নির্দেশনা নির্বাহী পর্যায়ে অবিকৃত অবস্থায় যথা দ্রুততার সঙ্গে বাস্তবায়িত হয় কি না। না হলে বাস্তবায়ন পর্যায়ে এসব সিদ্ধান্তের হাল কী হয়; এর কারণ কী? নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্ত অবিকৃত অবস্থায় দ্রুততার সঙ্গে বাস্তবায়নের জন্য কি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে?
সিদ্ধান্তগুলো যে পর্যায়েই গৃহীত হোক না কেন তার বাস্তবায়নের দায়িত্ব থাকে কর্মকর্তা বা নির্বাহীর ওপর। সরকারি, আধাসরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এমনকি রাজনৈতিক দল সবার জন্য এ কথা সত্য। বাস্তবায়নের দায়িত্বে যিনি থাকেন, তাঁর কাছে অনেক ক্ষমতা স্বাভাবিকভাবে চলে আসে। তিনি যদি প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে এ নির্দেশ পালন করবেন না এমনটি জানিয়ে দেন তবে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন এ অভিযোগ এনে তার বিপক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। কিন্তু তিনি যদি প্রকাশ্যে আনুগত্য দেখিয়ে ভেতরে ভেতরে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে শ্লথ করে দেন অথবা মূল সিদ্ধান্তকে বিকৃত করে কর্ম সম্পাদন করতে থাকেন, তবে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। আইনকানুনের বেড়াজালে সহজেই তিনি নিজেকে বাঁচিয়ে চলতে পারেন।
ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে গৃহীত সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন নির্ভর করে বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সদিচ্ছা, দক্ষতা ও সততার ওপর। একটি সিদ্ধান্ত যখন বাস্তবায়নের জন্য নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে যায় তখন তাঁর তিন ধরনের প্রতিক্রিয়া হতে পারে। সিদ্ধান্তটি তাঁর পছন্দনীয় হতে পারে, ফলত এটি বাস্তবায়নের জন্য তিনি আগ্রহী হবেন। সিদ্ধান্তটি তাঁর কাছে গতানুগতিক মনে হতে পারে, এর পক্ষে-বিপক্ষে তাঁর কোনো প্রতিক্রিয়া নাও হতে পারে; সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ব্যাপারে তিনি মধ্যমপন্থা অবলম্বন করে উদাসীন থাকতে পারেন। আবার সিদ্ধান্তটি তাঁর অপছন্দনীয় হতে পারে; প্রথম থেকেই তিনি এর বাস্তবায়ন ঠেকাতে, শ্লথ করতে বা একে বিকৃতভাবে বাস্তবায়ন করতে সচেষ্ট হতে পারেন। নির্বাহী কর্মকর্তার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের গতি-প্রকৃতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ ছাড়া রয়েছে বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দক্ষতার পর্যায়। অনেক সময় দেখা যায়, বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী বুঝতে পারছেন না নীতিনির্ধারক পর্যায়ে গৃহীত সিদ্ধান্ত কিভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য যে কৌশল ও পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করতে হবে সে সম্পর্কে হয়তো তাঁদের ধারণা নেই অথবা ধারণা থাকলেও প্রয়োজনীয় কাজগুলো সম্পন্ন করার মতো তাঁদের সাধ্য নেই। নিজেদের অপারগতা তাঁরা সব সময় প্রকাশ করতে চান না; সিদ্ধান্ত দানকারী মহল অনবহিত থাকেন, সিদ্ধান্ত অবাস্তবায়িত থেকে যায়।
কিছু দৃষ্টান্ত এখানে প্রাসঙ্গিক হতে পারে। বেতন কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে মোটামুটি পাঁচ বছর অন্তর সরকারি, আধাসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন উচ্চতর স্কেলে নির্ধারণ করার সরকারি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সব পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এতে উপকৃত হন। বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছে এ সিদ্ধান্ত খুবই পছন্দনীয়। সরকারের চূড়ান্ত পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার অব্যবহিত পরই এ সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং খুব দ্রুত এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়ে যায়। বেতন কমিশনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের গতি-প্রক্রিয়া দেখলে কেউ এমন কথা বলতে পারবে না যে, সরকারি দপ্তরে কাজকর্ম দ্রুত সম্পন্ন হয় না। একই দ্রুততায় সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয় কর্মকর্তাদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে। বাংলাদেশে কয়েক দশক ধরে ব্যাচওয়ারি প্রমোশন হয়ে থাকে। বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তারা, তাঁদের বন্ধুবান্ধব অথবা সহকর্মীরা সাধারণত এ সিদ্ধান্তে উপকৃত হয়ে থাকেন। পদোন্নতির সিদ্ধান্ত চূড়ান্তভাবে গৃহীত হওয়ার পর বিদ্যুৎবেগে তা বাস্তবায়িত হয়ে যায়। এখানে কোনো কিছু পড়ে থাকে না, বিধি-বিধানের ছোটখাটো জটিলতা থাকলে তা ক্ষিপ্রতার সঙ্গে ডিঙিয়ে পদোন্নতির সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়। কোনো ভৌত অবকাঠামোসংক্রান্ত প্রকল্পে বাস্তবায়নকারী নির্বাহী কর্মকর্তার এলাকা যদি সরাসরি উপকৃত হয়, তবে সে প্রকল্প দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন হবে; এতে কোনো সন্দেহ নেই।
যে সিদ্ধান্তের ফলে বাস্তবায়নকারী নির্বাহীরা উপকৃত না হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না, সে কাজ তাঁদের খুব পছন্দনীয় না হলেও অপছন্দনীয়ও নয়। এ ধরনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ব্যাপারে নির্বাহীরা বাড়তি উদ্যোগ গ্রহণ করে না, তবে এর বাস্তবায়নে তেমন কোনো প্রতিবন্ধকতাও সৃষ্টি করেন না। একে রুটিনকাজ মনে করে গতানুগতিক ধারায় কর্ম সম্পাদন করে যান। উদাহরণ- উপজেলা সৃষ্টি এবং ফটোসংবলিত ভোটার তালিকা ও জাতীয় আইডি কার্ড প্রবর্তন। এ ক্ষেত্রে সরকারের সিদ্ধান্ত সুনির্দিষ্ট ছিল এবং সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সরকারের আন্তরিকতা ছিল। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে নির্বাহী কর্মকর্তারা উৎসাহী না হলেও সিদ্ধান্তগুলো তাঁদের অপছন্দনীয় ছিল না। ফলত সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়িত হয়েছে। এতে বড় রকমের কোনো বিলম্ব ঘটেনি। কিন্তু বিভিন্ন সংস্থার সদর দপ্তর ঢাকার বাইরে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নির্বাহী কর্মকর্তাদের চরম অপছন্দনীয় ছিল। তাঁরা ভেতরে ভেতরে এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করতে থাকেন। প্রথমে বিভিন্ন অজুহাতে ঢাকায় লিয়াজোঁ অফিসের নামে বাড়ি ভাড়া করে মাসের বেশির ভাগ সময় এ অফিসে বসে কাজ চালাতে থাকেন। সরকার পরিবর্তনের পর নতুন সরকার পূর্বতন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ততটা আন্তরিক ও উৎসাহী ছিল না। এ সুযোগ নির্বাহী কর্মকর্তারা পূর্বতন সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন থেকে সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকেন এবং মফস্বলের অফিস পরিত্যাগ করে ঢাকায় স্থায়ীভাবে অফিস করা শুরু করেন। ঢাকার বাইরের অফিস স্থানান্তরের সিদ্ধান্তটি ধীরে ধীরে বিস্মৃত হয়ে যায়। সংগঠনের নেতৃত্ব বদলের পর অবিকৃতভাবে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পথে পূর্বতন নেতার সিদ্ধান্তের প্রতি উদাসীনতা, অবজ্ঞা এবং ক্ষেত্রবিশেষে বিরোধিতা বড় রকমের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। সরকারি-আধাসরকারি সংস্থার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এভাবেই বিলম্ব ও বিকৃতি ঘটে।
সিদ্ধান্ত সুনির্দিষ্ট না হওয়া, অস্পষ্ট হওয়া, দ্ব্যর্থবোধক হওয়া ও সিদ্ধান্তে বিভিন্ন প্রকার অভ্যন্তরীণ অসংগতি নির্বাহী পর্যায়ে সিদ্ধান্তকে বিকৃত করার এবং এর বাস্তবায়ন বিলম্বিত করার সুযোগ করে দেয়। সরকারি-আধাসরকারি সংস্থায় একই বিষয়ে বহু আদেশ-নির্দেশ জারি করা হয়। এর মধ্যে অনেক আদেশ-নির্দেশ সাংঘর্ষিক হয়ে থাকে। আগের নির্দেশসহ সর্বশেষ জারীকৃত নির্দেশের পরিপন্থী অন্য সব নির্দেশ যে বাতিল বলে গণ্য হবে এমনটি হয়তো বা স্পষ্ট করে লেখা থাকে না। সর্বশেষ নির্দেশ সব নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে নিশ্চিতভাবে পৌঁছানো হয় না। সে সুযোগে নির্বাহী কর্মকর্তা আগে জারি করা কোনো একটি আদেশের বরাত দিয়ে তাঁর ইচ্ছামতো কাজ করে ফেলেন। যে আদেশটি তাঁর বিপক্ষে যাবে কারসাজি করে তা তাঁর অফিস বা নথি থেকে সরিয়ে ফেলেন। রনির এ কেসে তেমন কিছু ঘটেছে কি না, তা তিনি অনুপুঙ্খ পর্যালোচনা করে দেখতে পারেন। দু-একজন কর্মকর্তার প্রতিবাদলিপিতে সে রকম সম্ভাবনার আভাস পাওয়া যায়।
নীতিনির্ধারকদের নির্দেশ-নির্দেশনা নির্বাহী পর্যায়ে অবিকৃত অবস্থায় যথাসময়ে বাস্তবায়ন করার জন্য নীতিনির্ধারকদেরই মূল উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এ জন্য তাঁদের কর্মপরিকল্পনাগুলোর বাস্তবায়ন পরিধারণের (Monitoring) কৌশল রপ্ত করতে হবে। প্রয়োজনবোধে যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ নিতে হবে। বাস্তবায়নের দায়িত্বে নির্বাহী কর্মকর্তারা প্রকল্প বা কর্মসূচির অগ্রগতি সম্পর্কে নীতিনির্ধারকদের নানাভাবে বিভ্রান্ত করতে পারেন। বিভ্রান্ত হওয়ার বড় কারণ নীতিনির্ধারকদের সপ্রতিভতার (alertness) অভাব এবং কিছু সময় ব্যয় করে বিষয়ের গভীরে যেতে অনীহা। অনেক পর্যালোচনা সভায় উপস্থিত থেকে আমি দেখেছি মিনিট দশেক যাওয়ার পরই সভার মূল ব্যক্তিরা কেমন যেন ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন, নানা হিসাব-নিকাশ এবং পরিসংখ্যানের তোড়ে তাঁরা বিষয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। পর্যালোচনা সভায় আমি খুব কম ব্যক্তিকেই বই-পুস্তক, কাগজপত্র এবং ক্যালকুলেটর সহযোগে আলোচনা করতে দেখেছি। পরিবেশিত তথ্যাদি সত্য বিবেচনা করে সন্তুষ্টচিত্তে সভা ত্যাগ করেছেন। অথচ এ তথ্য ছিল অসত্য, অপ্রাসঙ্গিক ও বিভ্রান্তিকর। সে জন্য প্রকল্প উদ্বোধনের তারিখ বারবার পেছানো হয়, আয়-উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয় না, সামাজিক প্রকল্প কর্মসূচি শেষ হওয়ার পর উপকারভোগীদের খোঁজ পাওয়া যায় না। যে নিয়ম-পদ্ধতিতে কর্মসূচি সম্পন্ন হওয়ার কথা বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে তার কোনো মিল থাকে না।
সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের প্রকৃত অবস্থা শুধু অকুস্থল পরিদর্শনের মাধ্যমেই জানা যায়। নীতিনির্ধারকদেরকে নিজে অথবা বিশ্বস্ত ব্যক্তির মাধ্যমে অকুস্থল পরিদর্শনের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের প্রকৃত তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। সমস্যা চিহ্নিত হলে তা সমাধানের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে, নির্বাহী কর্মকর্তাকে প্রয়োজন মতো সহযোগিতা, সমর্থন জোগাতে হবে। তবেই সিদ্ধান্ত সন্তোষজনকভাবে অবিকৃত অবস্থায় বাস্তবায়িত হবে। অন্যথায় দেখা যাবে জনগণের অর্থে নির্মিত গণশৌচাগারের মধ্যে খাবার হোটেল চলছে (কালের কণ্ঠ, ১০ জুন ২০১৩)।
লেখক : পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান ও
সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব
No comments