মৃত্যুঞ্জয়ী রেশমা by নূরুজ্জামান ও হাফিজউদ্দিন
মৃত্যুকে জয় করে ফিরে এলেন রেশমা।
মৃত্যুঞ্জয়ী রেশমা শুধু দেশ নয়, গোটা বিশ্বে এখন সংবাদ শিরোনাম। সাভারের
ভয়াবহ রানা প্লাজা ধসের ঘটনার ১৭ দিন পর উদ্ধার হয়েছে গার্মেন্ট কর্মী
রেশমা। অলৌকিক! অবিশ্বাস্য ঘটনা। ক্ষণিকের জন্য হাজারো লাশের শোক ভুলিয়ে
দিয়েছেন তিনি।
সবার চোখে আনন্দাশ্রু ঝরেছে। উদ্ধার-মুহূর্ত
ছিল সেখানে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। উপস্থিত হাজার হাজার মানুষ মহান
সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়ে হাত তুলে মোনাজাত করেন। কেউ কেউ
দাঁড়িয়ে যান নামাজে। এমনই অবস্থায় যখন তাকে সুড়ঙ্গ কেটে বাইরে বের করে আনা
হয় তখন আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে এলাকা। মিরাকল এক ঘটনা।
কিভাবে এ ১৭ দিন রানা প্লাজার কংক্রিটের স্তূপে চাপা পড়েছিলেন তিনি।
মৃত্যুঞ্জয়ী রেশমা বিজ্ঞানকেও ভুল প্রমাণ করেছেন। তাকে উদ্ধার করে
সেনাবাহিনীর অ্যাম্বুলেন্সযোগে সাভারের সিএমএইচের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে
ভর্তি করা হয়েছে। রেশমা উদ্ধারের পরপরই প্রধানমন্ত্রী মোবাইল ফোনে তার
সঙ্গে কথা বলেছেন। পরে হেলিকপ্টারযোগে তিনি রেশমাকে দেখতে সিএমএইচ
হাসপাতালে যান। যে রেশমাকে নিয়ে এত কিছু। দেশ-বিদেশে হইচই। সেই রেশমা
কিভাবে উদ্ধার হলেন? তখন বিকাল ৩টা ১৫ মিনিট। মেজর মোয়াজ্জেম হোসেন রানা
প্লাজার সামনে উদ্ধার অভিযান কাজের তদারকি করছিলেন। সে সময় এ প্রতিবেদকসহ
সমকালের সিনিয়র রিপোর্টার শাহাদাত হোসেন পরশ, সাভারের স্টাফ রিপোর্টার
গোবিন্দ আচার্য ও একুশে টেলিভিশনের দু’জন সংবাদ কর্মী তার কাছে উদ্ধার
অভিযান বিষয়ে জানতে চান। তখন তিনি বলেন, চলেন আপনাদের স্বচক্ষে দেখিয়ে নিয়ে
আসি। ভবনের বেইজমেন্টে পানি ঢুকেছে। উপচে দ্বিতীয় তলা পর্যন্ত ছুঁই ছুঁই
করছে। এ অবস্থায় কিভাবে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করবো তা আপনারাই বিচার
করুন। তিনি যখন সাংবাদিকদের নিয়ে গেলেন, তখন দু’টি ভারী যন্ত্র ভেকু ও
হ্যামার ড্রিল ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজে ব্যস্ত ছিল।
রেশমা যেখানে আটকে ছিলেন তার ওপরই হ্যামার ড্রিল ধ্বংসস্তূপ প্রকম্পিত করে ছিদ্র করছিল। মেজর মোয়াজ্জেম সাংবাদিকদের পর্যবেক্ষণ নির্বিঘ্ন করতে মেশিন চালানো বন্ধ করতে বলেন। মেশিনের শব্দ থেমে গেলে হঠাৎ বেইজমেন্টের নিচ থেকে মানুষের ক্লান্ত ধ্বনি শোনা যায়। একইসঙ্গে একটি কাঠি নড়তে থাকে চাপা পড়া দেয়ালের ভেতর থেকে। তখনই রাজ্জাক নামের এক উদ্ধার কর্মী মানুষের উপস্থিতি শনাক্ত করে সবাইকে সতর্ক করেন। এরপরই সেনাকর্মকর্তা ও সাংবাদিকরা তার কাছাকাছি যান। ছোট্ট ছিদ্র দিয়ে তার দু’টি চোখ দেখা যাচ্ছিল। মুখ কালচে মনে হচ্ছিল। বাঁচার জন্য হাত নাড়ছিলেন। ভেতর থেকে বলে ওঠেন, আমি সুস্থ আছি, আমারে বাঁচান স্যার। এরপরই শুরু হয় শ্বাসরুদ্ধকর অভিযান। দ্রুত অক্সিজেন, পানি ও বিস্কিট সরবরাহ করা হয়। রেশমা নিজের হাত দিয়ে বিস্কিট ও পানি নেন।
অবিশ্বাস্য এ উদ্ধার অভিযানের সাক্ষী হতে হাজার হাজার লোক উদ্ধারস্থলে ভিড় জমান। ছুটে আসেন নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল হাসান সোহরাওয়ার্দী ও প্রতিমন্ত্রী এডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক। তাদের উপস্থিতিতেই রেশমাকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। রেশমাকে যখন উদ্ধার করা হচ্ছিলো বাইরে তখন হাজার হাজার মানুষ সৃষ্টিকর্তার কাছে রেশমার প্রাণভিক্ষা চেয়ে মোনাজাত করছিলেন। অনেকেই আল্লাহর কাছে জীবিত উদ্ধারের প্রার্থনায় কান্নায় ভেঙে পড়েন। অবশেষে ৪টা ২৫ মিনিটে রেশমাকে যখন সুড়ঙ্গ কেটে বের করা হয় তখন ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। প্রাণের সঞ্চারে স্বস্তি ফিরে আসে উদ্ধারকর্মীদের মনে। রেশমা উদ্ধারের পর সেনাবাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশনের অধিনায়ক মেজর জেনারেল চৌধুরী হাসান সোহরাওয়ার্দী সংক্ষিপ্ত সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সাভারের ভবন ধসের সময় রেশমা রানা প্লাজার তৃতীয় তলার পোশাক কারখানায় কর্মরত ছিলেন। ধসের সময় তার সঙ্গে আরও তিন পোশাক শ্রমিক ছিলেন, যাদের আগেই মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে।
তিনি আবেগতাড়িত কণ্ঠে বলেন, সকাল পর্যন্ত মৃতদেহের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছিল। এতে বেদনাহত হয়ে পড়েছিলাম। ইতিমধ্যে ৪১৬ ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। এমন একটি মুহূর্তে আমাদের কাছে আনন্দের সংবাদ এলো যা কল্পনাকেও হার মানিয়েছে। বিশ্বের সকল উদ্ধার অভিযান পেছনে ফেলে সেনাবাহিনীর নতুন রেকর্ড অর্জিত হয়েছে। আর সেটা হচ্ছে রেশমার ইতিহাস। আজকের গল্পের নায়িকা কেবলই রেশমা। যিনি মৃত্যুকূপে গার্মেন্টের কাটার মেশিন দিয়ে নিজেই নিজের চুল কেটেছেন। সামনে যা পেয়েছেন তাই খেয়ে ১৭ তিন জীবন ধারণ করেছেন।
তিনি শুধু বলেছেন, আমি ভাল আছি, আমাকে উদ্ধার করুন।
তিনি আরও বলেন, এ উদ্ধার অভিযানে মেজর এম মোয়াজ্জেম হোসেন, দেলোয়ার হোসেন ও লে. কর্নেল মঈন তাকে উদ্ধার করেন। রেশমা উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়া সেনাবাহিনীর মেজর মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, তার সন্ধান পাওয়ার পর আমরা প্রথমে তাকে অল্প পরিমাণ পানি ও বিস্কুট দিই। তিনি টানা কয়েক দিন না খেয়েছিলেন। তার সঙ্গে কিছু শুকনা খাবার ছিল। সেগুলোই অল্প অল্প করে খেয়ে এতদিন বেঁচে ছিলেন। সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারী দলের আপ্রাণ চেষ্টায় ভবন ধসের ১৭ দিনের মাথায় আল্লাহর রহমতে তাকে জীবিত উদ্ধার করতে পেরেছি। মেজর মোয়াজ্জেম বলেন, ‘উদ্ধারের আগে একটি পাইপ নড়ে ওঠে। আমি পাইপটির কাছে যাই, এরপর গোঙানির আওয়াজ শুনি। একটি ফুটো দিয়ে কান পাতলে ভেতর থেকে এক নারী কণ্ঠ বলে ওঠে, আমাকে বাঁচান, আমাকে বাঁচান। তিনি তার নাম বলেন রেশমা। উদ্ধারকাজে নিয়োজিত অনেকেই তার সঙ্গে কথা বলেছেন।’ ধ্বংসস্তূপের ভেতরে রেশমা অক্ষত অবস্থায় বসে আছেন।
রেশমা জীবিত উদ্ধার হওয়ায় উদ্ধারকারীর দল ভারী যন্ত্রপাতির ব্যবহার বন্ধ রেখেছে। আরও জীবিত প্রাণ আছে কি না তা সন্ধান করে দেখছে উদ্ধারকর্মীরা। উদ্ধার কার্যক্রম শুরুর প্রায় ১১০ ঘণ্টা পর গত ২৮শে এপ্রিল জীবিত কাউকে উদ্ধারের আশা ছেড়ে দিয়ে ভারী যন্ত্রপাতি দিয়ে ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজ শুরুর ঘোষণা দেন অভিযানের নেতৃত্বে থাকা সেনাবাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশনের অধিনায়ক মেজর জেনারেল চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী। সেদিন পর্যন্ত ৩৩৭ জনের লাশ উদ্ধার করা হলেও ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে অভিযান শুরু হয়। গতকাল এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ১০৪৫ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
রানা প্লাজার পেছন দিকে সিঁড়ির অংশে উদ্ধার কাজ শুরু হওয়ার পর লাশের সংখ্যা দ্রুতগতিতে বেড়ে চলেছে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে গতকাল রাত পর্যন্ত উদ্ধার করা হয়েছে দেড় শতাধিক লাশ।
সাভার অধরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ে জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে জানানো হয়, গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ৭৩১টি মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
এদিকে ধ্বংসস্তূপ থেকে লাশ উদ্ধারের পর সেগুলো নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সাভার অধরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে। সেখানে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ৪৩টি মরদেহ ছিল। আর ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে ছিল আরও ৮৪টি লাশ।
পরিচয় শনাক্ত করতে না পারায় মোট ১৫৬ জনকে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে জুরাইন কবরস্থানে।
গত ২৪শে এপ্রিল সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন রানা প্লাজা ধসে পড়ে। ওই ভবনে পাঁচটি তৈরী পোশাক কারখানায় তখনও কাজ চলছিল। উদ্ধারকর্মীরা এ পর্যন্ত ৯তলা ভবনের সামনের দিকের ধ্বংসস্তূপ সরাতে পেরেছেন। তবে ভবনের বেইজমেন্টে এখনও ঢুকতে পারেননি তারা।
ভবনের পেছনের অংশে উদ্ধার তৎপরতা শুরু হওয়ার পর থেকে কয়েকটি ফ্লোরের কংক্রিটের স্তূপ সরানো হলেও পেছনেই আরেকটি ভবন থাকায় উদ্ধার কাজ বিলম্বিত হচ্ছে বলে ফায়ার ব্রিগেডের উদ্ধারকর্মীরা জানান।
তারা বলেন, উদ্ধার কাজ শেষ হতে আরও কয়েক দিন লাগতে পারে, যদিও নিয়ন্ত্রণ কক্ষের নোটিস বোর্ডে বুধবার জানানো হয়েছিল দু-একদিনের মধ্যে উদ্ধার কাজ শেষ হতে পারে। ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে এখন যেসব মৃতদেহ পাওয়া যাচ্ছে তার বেশিরভাগই বিকৃত হয়ে গেছে। উদ্ধারকর্মীরা জানান, এখন পর্যন্ত ৯তলা ভবনের সামনের দিকের ধ্বংসস্তুপ সরাতে পেরেছেন। তবে ভবনের বেজমেন্টে এখনও ঢুকতে পারেননি তারা। ভবনের পিছনের অংশে উদ্ধার তৎপরতা শুরু হওয়ার পর সেখান থেকেই একের পর এক মৃতদেহ উদ্ধার হচ্ছে। এছাড়া সেখানের ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজ চলছে। উদ্ধার কাজ শেষ হতে আরও কয়েক দিন লাগতে পারে বলে ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকর্মীরা জানিয়েছেন।
নিখোঁজের স্বজনদের অপেক্ষা: গতকালও সাভার অধরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ও ধংসস্তূপের সামনে নিখোঁজের অনেকের স্বজন ‘সন্ধান চাই’ লেখা ছবি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। লাশের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে স্বজনরা। তারা প্রিয় মানুষটির লাশ খুঁজে ফিরছেন ক্লান্তিহীনভাবে। কিছুক্ষণ পর পর আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের গাড়িতে করে আনা মৃতদেহগুলো বিদ্যালয় মাঠে নিয়ে আসা হলেই সেখানে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন নিখোঁজদের স্বজনরা। লাশে পচন ধরায় স্বজনরা চিনতে পারছে না প্রিয়জনকে। পকেটে থাকা মোবাইল ফোন কিংবা পরিচয়পত্রের মাধ্যমে শনাক্তের চেষ্টা করছে তারা। তবে এখনও কতজন নিখোঁজ রয়েছে তা প্রশাসন কিংবা উদ্ধার কাজে নিয়োজিত কেউ জানেনা। গত ২৪শে এপ্রিল সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডে রানা প্লাজা বহুতল ভবন ধসে পড়ে। এখন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ১০৪৫ জনে পৌঁছেছে। ধসে পড়ার আগের দিন ভবনটিতে ফাটল দেখা দিয়েছিল এবং সামান্য প্লাস্টার খসে পড়েছিল। ওই ভবনে ৫টি পোশাক কারখানা ছিল। আহত-নিহতরা সকলেই ওই পোশাক কারখানার শ্রমিক। ওদিকে রেশমা উদ্ধারের পরই আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন রেশমার মা জোবেদা খাতুন। অতিরিক্ত টেনশনে অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি বলেন, তার মেয়ে জনতা ব্যাংকের কাছে স্বামী মো. সবুজ মিয়ার সঙ্গে আনসার আলীকে নিয়ে ভাড়া থাকতেন। আড়াই বছর আগে মনসুর আহমেদ নুরুর বাসায় ভাড়া থাকতেন। তার বাড়ি দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট থানার কাশিগাড়ি গ্রামে। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, প্রায় এক বছর আগে রেশমাকে তালাক দিয়ে চলে যায় তার স্বামী সবুজ মিয়া। বিক্রি করে দেয় ঘরের আসবাবপত্র। এছাড়া রেশমাকে মাঝে-মধ্যেই মারধর করতো সবুজ। দিনের পর দিন না খাইয়ে রাখতেন। স্বামী পরিত্যক্ত হওয়ার পর রেশমা দাদা গার্মেন্টে চাকরি নেয়। সেখান থেকে গত এপ্রিল মাসে রানা প্লাজার তৃতীয় তলায় চাকরি নেয়। রেশমার মা আরও জানান, তার দুই ছেলে তিন মেয়ে। সবার ছোট রেশমা। ভবন ধসের পর থেকেই তিনি তার বড় মেয়ে আসমা, ছোট মেয়ের জামাই শহিদুল রেশমার খোঁজে অধর চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ে অবস্থান করছিলেন। লাশের সন্ধানে হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরেছেন। মাইকে রেশমা জীবিত উদ্ধারের চেষ্টার খবর শুনেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে বিকাল ৫টা ১০ মিনিটে তাকে সাভার থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।
পানিই জীবন বাঁচিয়েছে: ধংসস্তুপের নীচে ৪১৬ ঘন্টা আটকে ছিলেন রেশমা। যৎসামান্য শুকনা খাবার ফুরিয়ে যায় অনেক আগেই। এরপর কেবল পানি পানেই বেঁচে ছিলেন রেশমা। উদ্ধারকর্মীরা ওপর থেকে নানা সময়ে বোতলজাত পানি বিভিন্ন সময় ফুটো দিয়ে ভিতরে পাঠাতো সেখান থেকে কয়েক বোতল পানি সংরক্ষণ করে রেখেছিল। পরে সেই পানি অল্প অল্প করে খেয়ে বেঁচেছিল রেশমা।
রেশমা আক্তার দিনাজপুর জেলার ঘোরাঘাট থানার কাশিগাড়ী এলাকার মৃত আনসার আলীর মেয়ে। সে ধসেপড়া ভবনের তৃতীয় তলার নিউ ওয়েভ বটমস কারখানার শ্রমিক ছিল। গতকাল সাভার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ছোট বোন রেশমার সঙ্গে দেখা করে বাইরে বেরিয়ে সাংবাদিকদের আসমা আক্তার জানায়, আমার বোন রেশমা কথা বলতে পরেছে। তাকে আমি পানি খাইয়েছি। তবে তার শরীরে প্রচুর ব্যাথা করছে বলে জানিয়েছে সে। বর্তমানে তাকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিউতে) রাখা হয়েছে। সে ১৭দিন সংসস্তুপের নীচে পানি খেয়ে বেঁচে ছিল।
চিকিৎসাধীন অবস্থায় রেশমা বলেন, পানি খেয়ে বেঁচেছিলাম। ভবন ধসের পরপরই ভবনের নিচে আটকা পড়ি। উদ্ধারকর্মীরা ওপর থেকে নানা সময়ে পানির বোতল পাঠাতো সেখান থেকে কয়েক বোতল পানি সংরক্ষণ করে রাখি। সেই বোতলের পানি আমি প্রতিদিন অল্প অল্প করে খেয়ে কোনরকম বেঁচে ছিলাম। একসময় ওই পানিও শেষ হয়ে যায় পরে মাঝে মাঝে বিভিন্ন ফুটো থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি পড়তো। এসব খেয়েই বেঁচেছিলাম। নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম। শেষের দুই দিন পানিও শেষ হয়ে যাওয়ায় কিছুই খাওয়া হয়নি।
সাভারে বহুতল ভবন রানা প্লাজা ধসে পরার ৪১৬ ঘন্টা পর শুক্রবার বিকেলে রেশমা আক্তারকে (১৯) জীবিত উদ্ধার করেছে উদ্ধারকর্মীরা।
এদিকে উদ্ধারকর্মী মো. ফেরদৌস জানান, আমরা যখন উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করছিলা তখন হঠাৎ করে ভিতর থেকে একটি পাইপ নড়াচরা করতে দেখে ভিতরে উঁকি মারি এবং লাইট মেরে রেশমাকে দেখতে পাই। এসময় রেশমা এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে বলেন, আমাকে বাঁচান। পরে আমি তাকে পানি খেতে দিলে সে পানি পান করে। পরবর্তীতে আমি উদ্ধাকারী দলের অন্যান্য সদস্যদের বিষয়টি অবহিত করার পর সকলেই প্রথমে বিষ্মিত হয়। অনেকেই বিশ্বাস করতে পারছিলনা আমার কথা। পরে সবাই আমার কথা শুনে কৌতুহল বসত দেখতে এসে রেশমাকে দেখে অবাক হয়ে যায়। এর পরই শুরু উদ্ধার কার্যক্রম সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সদস্যদের সম্মিলিত চেষ্টার পর প্রায় ৭০ মিনিটের মধ্যে তাকে উদ্ধার করে সাভারের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এর আগে উদ্ধার কাজ চলাকালীন সময়ে তাকে পানি, বিস্কুট ও অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়।
তার আসে পাশে অনেক মেশিন ছিল, এবং তার আশপাশে অনেক পানি ছিল বলে জানিয়েছে। তার সঙ্গী আরও অনেক শ্রমিক মারা গেছে, যাদের পচা গন্ধ অনুভব করেছেন।
আগেও অনাহারে থেকেছেন: স্বামীর অত্যাচারে মাঝে-মধ্যেই টানা কয়েকদিন অনাহারে থেকেছেন অলৌকিক কন্যা রেশমা আক্তার। ১৭ দিন পর ধ্বংসস্তূপ থেকে তিনি জীবিত উদ্ধার হয়েছেন। কিভাবে এত দিন জীবিত ছিলেন মৃত্যুকূপে সেই কাহিনীর বর্ণনা করতে গিয়ে সেনা কর্মকর্তারা বলেন, কিছু পানি ও শুকনা খাবার ছিল তার সঙ্গে। ধসের সময় তিনি গুরুতর কোন আঘাতও পাননি। গার্মেন্টের কিছু কার্টন ও কাপড়ের স্তূপে চাপা পড়েছিলেন। তার সঙ্গে থাকা খাবার অনেক আগেই ফুরিয়েছিল। তখন নিজের চুল নিজেই কেটে ফেলেন। সামনে যা পান তাই খাওয়ার চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে ক্ষুধার জ্বালায় দুর্বল হয়ে পড়েন। তারপরও মোটামুটি সুস্থ অবস্থায় তাকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন উদ্ধারকর্মীরা। তবে রেশমার ব্যক্তিগত অজানা গল্পের কথা শোনালেন বাড়ির মালিক মসছুর আহমেদ নূরু। তিনি বলেন, সাভার বাজার রোডের বি-১৩৮ নম্বরে আমার বাড়ি। এ বাড়িতেই রেশমা গত আড়াই বছর ধরে ভাড়া থাকেন। প্রায় এক বছর আগে তার স্বামী সবুজ মিয়া তাকে ছেড়ে চলে যান। যাওয়ার আগে সব আসবাবপত্র বিক্রি করে যায়। এছাড়া মাঝে-মধ্যেই মারধর করতেন। দিনের পর দিন না খাইয়ে রাখতেন রেশমাকে। আবার মারধরের ঘটনা মোবাইল ফোনে ভিডিও করে রাখতেন। তা প্রকাশের ভয়ভীতি দেখিয়ে মারধরের কথা গোপন রাখতেন। বাড়ির মালিক নুুরু আরও বলেন, তার স্ত্রী হাজেরা বেগম মেয়েটিকে নিজের কন্যার মতো আগলে রাখতেন। সবুজের নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করতেন। এরই একপর্যায়ে নিপীড়নকারী স্বামী সবুজ তাকে ছেড়ে দিয়ে চলে যায়। এরপর থেকে আর কোন খোঁজ-খবর রাখেনি। এদিকে রেশমা উদ্ধারের পরপরই স্ত্রী দাবি করেন রাজ্জাক নামে এক ব্যক্তি। পরে সেনা কর্মকর্তারা তাকে চিকিৎসাধীন রেশমার সামনে নিয়ে গেলে রেশমা বলেন, উনি আমার স্বামী নন। এরপর তাকে সেনা হেফাজতে রাখা হয়েছে।
রেশমাকে দেখতে হাসপাতালে বিএনপির প্রতিনিধি দল: রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে ১৭তম দিনে উদ্ধার হওয়া রেশমাকে দেখতে সাভারের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) যান বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল। গতকাল রাতে ঢাকা জেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল মান্নান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) রুহুল আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল হাসপাতালে যায়। তারা এ সময় রেশমার চিকিৎসার খোঁজখবর নেন এবং দ্রুত সুস্থ হওয়ার কামনা করেন। ঢাকা জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল মান্নান মানবজমিনকে জানান, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নির্দেশে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল রেশমাকে দেখতে সাবার সিএমএইচে গিয়েছিলাম। ডাক্তারদের কাছে তার চিকিৎসার খোঁজখবর নিয়েছি। তার দ্রুত সুস্থ হতে দোয়া কামনা করেছি।
ধ্বংসস্তূপের নিচে ২৭ দিন বেঁচে ছিলেন ইভানস: রানা প্লাজা ধ্বংসস্তূপের নিচে ১৭ দিন আটকে থাকার পর রেশমাকে জীবিত উদ্ধার করে উদ্ধারকর্মীরা। ডেইলি মেইল প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, ২০১০-এ হাইতি ভূমিকম্পে ধ্বংসস্তূপের নিচে ২৭ দিন পরও বেঁচে ছিলেন ইভানস মনসিগনাক। কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে অবরুদ্ধ অবস্থায় দীর্ঘ সময় ধরে জীবিত থাকার রেকর্ডের অধিকারী দুই সন্তানের বাবা এই ইভানস। হাইতির রাজধানী পোর্ট অফ প্রিন্সের এক ধংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করা হয় তাকে। আটকে পড়া স্থানের নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া নর্দমার পানি আর ইট পাথরের টুকরো খেয়ে বেঁচে ছিলেন তিনি। টেলিগ্রাফকে দেয়া বর্ণনায় ইভানস, ‘আমি ভেবেছিলাম মারা গেছি। দুই অথবা তিন দিনের মাথায় বুঝতে পারলাম যে না এখনও বেঁচে আছি। তখন ওই নদর্মার পানি চোখে পড়ে। অনেক ক্ষুধার্ত আর তৃষ্ণার্ত ছিলাম। নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া পানির ধারা থেকে পানি খেতে চেষ্টা করলাম। সঙ্গে সঙ্গেই পেট ঘুলিয়ে উঠলো। পরে শুধু এক আঙুল চুবিয়ে ঠোট ভেজাতাম আর জিহ্বার ওপর দিয়ে অনেক কষ্টে গলধঃকরণ করতাম। দিন দিন আরও অসুস্থ হয়ে পড়ছিলাম।’
রেশমা যেখানে আটকে ছিলেন তার ওপরই হ্যামার ড্রিল ধ্বংসস্তূপ প্রকম্পিত করে ছিদ্র করছিল। মেজর মোয়াজ্জেম সাংবাদিকদের পর্যবেক্ষণ নির্বিঘ্ন করতে মেশিন চালানো বন্ধ করতে বলেন। মেশিনের শব্দ থেমে গেলে হঠাৎ বেইজমেন্টের নিচ থেকে মানুষের ক্লান্ত ধ্বনি শোনা যায়। একইসঙ্গে একটি কাঠি নড়তে থাকে চাপা পড়া দেয়ালের ভেতর থেকে। তখনই রাজ্জাক নামের এক উদ্ধার কর্মী মানুষের উপস্থিতি শনাক্ত করে সবাইকে সতর্ক করেন। এরপরই সেনাকর্মকর্তা ও সাংবাদিকরা তার কাছাকাছি যান। ছোট্ট ছিদ্র দিয়ে তার দু’টি চোখ দেখা যাচ্ছিল। মুখ কালচে মনে হচ্ছিল। বাঁচার জন্য হাত নাড়ছিলেন। ভেতর থেকে বলে ওঠেন, আমি সুস্থ আছি, আমারে বাঁচান স্যার। এরপরই শুরু হয় শ্বাসরুদ্ধকর অভিযান। দ্রুত অক্সিজেন, পানি ও বিস্কিট সরবরাহ করা হয়। রেশমা নিজের হাত দিয়ে বিস্কিট ও পানি নেন।
অবিশ্বাস্য এ উদ্ধার অভিযানের সাক্ষী হতে হাজার হাজার লোক উদ্ধারস্থলে ভিড় জমান। ছুটে আসেন নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল হাসান সোহরাওয়ার্দী ও প্রতিমন্ত্রী এডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক। তাদের উপস্থিতিতেই রেশমাকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। রেশমাকে যখন উদ্ধার করা হচ্ছিলো বাইরে তখন হাজার হাজার মানুষ সৃষ্টিকর্তার কাছে রেশমার প্রাণভিক্ষা চেয়ে মোনাজাত করছিলেন। অনেকেই আল্লাহর কাছে জীবিত উদ্ধারের প্রার্থনায় কান্নায় ভেঙে পড়েন। অবশেষে ৪টা ২৫ মিনিটে রেশমাকে যখন সুড়ঙ্গ কেটে বের করা হয় তখন ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। প্রাণের সঞ্চারে স্বস্তি ফিরে আসে উদ্ধারকর্মীদের মনে। রেশমা উদ্ধারের পর সেনাবাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশনের অধিনায়ক মেজর জেনারেল চৌধুরী হাসান সোহরাওয়ার্দী সংক্ষিপ্ত সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সাভারের ভবন ধসের সময় রেশমা রানা প্লাজার তৃতীয় তলার পোশাক কারখানায় কর্মরত ছিলেন। ধসের সময় তার সঙ্গে আরও তিন পোশাক শ্রমিক ছিলেন, যাদের আগেই মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে।
তিনি আবেগতাড়িত কণ্ঠে বলেন, সকাল পর্যন্ত মৃতদেহের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছিল। এতে বেদনাহত হয়ে পড়েছিলাম। ইতিমধ্যে ৪১৬ ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। এমন একটি মুহূর্তে আমাদের কাছে আনন্দের সংবাদ এলো যা কল্পনাকেও হার মানিয়েছে। বিশ্বের সকল উদ্ধার অভিযান পেছনে ফেলে সেনাবাহিনীর নতুন রেকর্ড অর্জিত হয়েছে। আর সেটা হচ্ছে রেশমার ইতিহাস। আজকের গল্পের নায়িকা কেবলই রেশমা। যিনি মৃত্যুকূপে গার্মেন্টের কাটার মেশিন দিয়ে নিজেই নিজের চুল কেটেছেন। সামনে যা পেয়েছেন তাই খেয়ে ১৭ তিন জীবন ধারণ করেছেন।
তিনি শুধু বলেছেন, আমি ভাল আছি, আমাকে উদ্ধার করুন।
তিনি আরও বলেন, এ উদ্ধার অভিযানে মেজর এম মোয়াজ্জেম হোসেন, দেলোয়ার হোসেন ও লে. কর্নেল মঈন তাকে উদ্ধার করেন। রেশমা উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়া সেনাবাহিনীর মেজর মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, তার সন্ধান পাওয়ার পর আমরা প্রথমে তাকে অল্প পরিমাণ পানি ও বিস্কুট দিই। তিনি টানা কয়েক দিন না খেয়েছিলেন। তার সঙ্গে কিছু শুকনা খাবার ছিল। সেগুলোই অল্প অল্প করে খেয়ে এতদিন বেঁচে ছিলেন। সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারী দলের আপ্রাণ চেষ্টায় ভবন ধসের ১৭ দিনের মাথায় আল্লাহর রহমতে তাকে জীবিত উদ্ধার করতে পেরেছি। মেজর মোয়াজ্জেম বলেন, ‘উদ্ধারের আগে একটি পাইপ নড়ে ওঠে। আমি পাইপটির কাছে যাই, এরপর গোঙানির আওয়াজ শুনি। একটি ফুটো দিয়ে কান পাতলে ভেতর থেকে এক নারী কণ্ঠ বলে ওঠে, আমাকে বাঁচান, আমাকে বাঁচান। তিনি তার নাম বলেন রেশমা। উদ্ধারকাজে নিয়োজিত অনেকেই তার সঙ্গে কথা বলেছেন।’ ধ্বংসস্তূপের ভেতরে রেশমা অক্ষত অবস্থায় বসে আছেন।
রেশমা জীবিত উদ্ধার হওয়ায় উদ্ধারকারীর দল ভারী যন্ত্রপাতির ব্যবহার বন্ধ রেখেছে। আরও জীবিত প্রাণ আছে কি না তা সন্ধান করে দেখছে উদ্ধারকর্মীরা। উদ্ধার কার্যক্রম শুরুর প্রায় ১১০ ঘণ্টা পর গত ২৮শে এপ্রিল জীবিত কাউকে উদ্ধারের আশা ছেড়ে দিয়ে ভারী যন্ত্রপাতি দিয়ে ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজ শুরুর ঘোষণা দেন অভিযানের নেতৃত্বে থাকা সেনাবাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশনের অধিনায়ক মেজর জেনারেল চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী। সেদিন পর্যন্ত ৩৩৭ জনের লাশ উদ্ধার করা হলেও ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে অভিযান শুরু হয়। গতকাল এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ১০৪৫ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
রানা প্লাজার পেছন দিকে সিঁড়ির অংশে উদ্ধার কাজ শুরু হওয়ার পর লাশের সংখ্যা দ্রুতগতিতে বেড়ে চলেছে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে গতকাল রাত পর্যন্ত উদ্ধার করা হয়েছে দেড় শতাধিক লাশ।
সাভার অধরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ে জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে জানানো হয়, গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ৭৩১টি মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
এদিকে ধ্বংসস্তূপ থেকে লাশ উদ্ধারের পর সেগুলো নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সাভার অধরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে। সেখানে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ৪৩টি মরদেহ ছিল। আর ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে ছিল আরও ৮৪টি লাশ।
পরিচয় শনাক্ত করতে না পারায় মোট ১৫৬ জনকে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে জুরাইন কবরস্থানে।
গত ২৪শে এপ্রিল সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন রানা প্লাজা ধসে পড়ে। ওই ভবনে পাঁচটি তৈরী পোশাক কারখানায় তখনও কাজ চলছিল। উদ্ধারকর্মীরা এ পর্যন্ত ৯তলা ভবনের সামনের দিকের ধ্বংসস্তূপ সরাতে পেরেছেন। তবে ভবনের বেইজমেন্টে এখনও ঢুকতে পারেননি তারা।
ভবনের পেছনের অংশে উদ্ধার তৎপরতা শুরু হওয়ার পর থেকে কয়েকটি ফ্লোরের কংক্রিটের স্তূপ সরানো হলেও পেছনেই আরেকটি ভবন থাকায় উদ্ধার কাজ বিলম্বিত হচ্ছে বলে ফায়ার ব্রিগেডের উদ্ধারকর্মীরা জানান।
তারা বলেন, উদ্ধার কাজ শেষ হতে আরও কয়েক দিন লাগতে পারে, যদিও নিয়ন্ত্রণ কক্ষের নোটিস বোর্ডে বুধবার জানানো হয়েছিল দু-একদিনের মধ্যে উদ্ধার কাজ শেষ হতে পারে। ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে এখন যেসব মৃতদেহ পাওয়া যাচ্ছে তার বেশিরভাগই বিকৃত হয়ে গেছে। উদ্ধারকর্মীরা জানান, এখন পর্যন্ত ৯তলা ভবনের সামনের দিকের ধ্বংসস্তুপ সরাতে পেরেছেন। তবে ভবনের বেজমেন্টে এখনও ঢুকতে পারেননি তারা। ভবনের পিছনের অংশে উদ্ধার তৎপরতা শুরু হওয়ার পর সেখান থেকেই একের পর এক মৃতদেহ উদ্ধার হচ্ছে। এছাড়া সেখানের ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজ চলছে। উদ্ধার কাজ শেষ হতে আরও কয়েক দিন লাগতে পারে বলে ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকর্মীরা জানিয়েছেন।
নিখোঁজের স্বজনদের অপেক্ষা: গতকালও সাভার অধরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ও ধংসস্তূপের সামনে নিখোঁজের অনেকের স্বজন ‘সন্ধান চাই’ লেখা ছবি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। লাশের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে স্বজনরা। তারা প্রিয় মানুষটির লাশ খুঁজে ফিরছেন ক্লান্তিহীনভাবে। কিছুক্ষণ পর পর আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের গাড়িতে করে আনা মৃতদেহগুলো বিদ্যালয় মাঠে নিয়ে আসা হলেই সেখানে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন নিখোঁজদের স্বজনরা। লাশে পচন ধরায় স্বজনরা চিনতে পারছে না প্রিয়জনকে। পকেটে থাকা মোবাইল ফোন কিংবা পরিচয়পত্রের মাধ্যমে শনাক্তের চেষ্টা করছে তারা। তবে এখনও কতজন নিখোঁজ রয়েছে তা প্রশাসন কিংবা উদ্ধার কাজে নিয়োজিত কেউ জানেনা। গত ২৪শে এপ্রিল সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডে রানা প্লাজা বহুতল ভবন ধসে পড়ে। এখন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ১০৪৫ জনে পৌঁছেছে। ধসে পড়ার আগের দিন ভবনটিতে ফাটল দেখা দিয়েছিল এবং সামান্য প্লাস্টার খসে পড়েছিল। ওই ভবনে ৫টি পোশাক কারখানা ছিল। আহত-নিহতরা সকলেই ওই পোশাক কারখানার শ্রমিক। ওদিকে রেশমা উদ্ধারের পরই আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন রেশমার মা জোবেদা খাতুন। অতিরিক্ত টেনশনে অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি বলেন, তার মেয়ে জনতা ব্যাংকের কাছে স্বামী মো. সবুজ মিয়ার সঙ্গে আনসার আলীকে নিয়ে ভাড়া থাকতেন। আড়াই বছর আগে মনসুর আহমেদ নুরুর বাসায় ভাড়া থাকতেন। তার বাড়ি দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট থানার কাশিগাড়ি গ্রামে। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, প্রায় এক বছর আগে রেশমাকে তালাক দিয়ে চলে যায় তার স্বামী সবুজ মিয়া। বিক্রি করে দেয় ঘরের আসবাবপত্র। এছাড়া রেশমাকে মাঝে-মধ্যেই মারধর করতো সবুজ। দিনের পর দিন না খাইয়ে রাখতেন। স্বামী পরিত্যক্ত হওয়ার পর রেশমা দাদা গার্মেন্টে চাকরি নেয়। সেখান থেকে গত এপ্রিল মাসে রানা প্লাজার তৃতীয় তলায় চাকরি নেয়। রেশমার মা আরও জানান, তার দুই ছেলে তিন মেয়ে। সবার ছোট রেশমা। ভবন ধসের পর থেকেই তিনি তার বড় মেয়ে আসমা, ছোট মেয়ের জামাই শহিদুল রেশমার খোঁজে অধর চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ে অবস্থান করছিলেন। লাশের সন্ধানে হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরেছেন। মাইকে রেশমা জীবিত উদ্ধারের চেষ্টার খবর শুনেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে বিকাল ৫টা ১০ মিনিটে তাকে সাভার থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।
পানিই জীবন বাঁচিয়েছে: ধংসস্তুপের নীচে ৪১৬ ঘন্টা আটকে ছিলেন রেশমা। যৎসামান্য শুকনা খাবার ফুরিয়ে যায় অনেক আগেই। এরপর কেবল পানি পানেই বেঁচে ছিলেন রেশমা। উদ্ধারকর্মীরা ওপর থেকে নানা সময়ে বোতলজাত পানি বিভিন্ন সময় ফুটো দিয়ে ভিতরে পাঠাতো সেখান থেকে কয়েক বোতল পানি সংরক্ষণ করে রেখেছিল। পরে সেই পানি অল্প অল্প করে খেয়ে বেঁচেছিল রেশমা।
রেশমা আক্তার দিনাজপুর জেলার ঘোরাঘাট থানার কাশিগাড়ী এলাকার মৃত আনসার আলীর মেয়ে। সে ধসেপড়া ভবনের তৃতীয় তলার নিউ ওয়েভ বটমস কারখানার শ্রমিক ছিল। গতকাল সাভার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ছোট বোন রেশমার সঙ্গে দেখা করে বাইরে বেরিয়ে সাংবাদিকদের আসমা আক্তার জানায়, আমার বোন রেশমা কথা বলতে পরেছে। তাকে আমি পানি খাইয়েছি। তবে তার শরীরে প্রচুর ব্যাথা করছে বলে জানিয়েছে সে। বর্তমানে তাকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিউতে) রাখা হয়েছে। সে ১৭দিন সংসস্তুপের নীচে পানি খেয়ে বেঁচে ছিল।
চিকিৎসাধীন অবস্থায় রেশমা বলেন, পানি খেয়ে বেঁচেছিলাম। ভবন ধসের পরপরই ভবনের নিচে আটকা পড়ি। উদ্ধারকর্মীরা ওপর থেকে নানা সময়ে পানির বোতল পাঠাতো সেখান থেকে কয়েক বোতল পানি সংরক্ষণ করে রাখি। সেই বোতলের পানি আমি প্রতিদিন অল্প অল্প করে খেয়ে কোনরকম বেঁচে ছিলাম। একসময় ওই পানিও শেষ হয়ে যায় পরে মাঝে মাঝে বিভিন্ন ফুটো থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি পড়তো। এসব খেয়েই বেঁচেছিলাম। নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম। শেষের দুই দিন পানিও শেষ হয়ে যাওয়ায় কিছুই খাওয়া হয়নি।
সাভারে বহুতল ভবন রানা প্লাজা ধসে পরার ৪১৬ ঘন্টা পর শুক্রবার বিকেলে রেশমা আক্তারকে (১৯) জীবিত উদ্ধার করেছে উদ্ধারকর্মীরা।
এদিকে উদ্ধারকর্মী মো. ফেরদৌস জানান, আমরা যখন উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করছিলা তখন হঠাৎ করে ভিতর থেকে একটি পাইপ নড়াচরা করতে দেখে ভিতরে উঁকি মারি এবং লাইট মেরে রেশমাকে দেখতে পাই। এসময় রেশমা এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে বলেন, আমাকে বাঁচান। পরে আমি তাকে পানি খেতে দিলে সে পানি পান করে। পরবর্তীতে আমি উদ্ধাকারী দলের অন্যান্য সদস্যদের বিষয়টি অবহিত করার পর সকলেই প্রথমে বিষ্মিত হয়। অনেকেই বিশ্বাস করতে পারছিলনা আমার কথা। পরে সবাই আমার কথা শুনে কৌতুহল বসত দেখতে এসে রেশমাকে দেখে অবাক হয়ে যায়। এর পরই শুরু উদ্ধার কার্যক্রম সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সদস্যদের সম্মিলিত চেষ্টার পর প্রায় ৭০ মিনিটের মধ্যে তাকে উদ্ধার করে সাভারের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এর আগে উদ্ধার কাজ চলাকালীন সময়ে তাকে পানি, বিস্কুট ও অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়।
তার আসে পাশে অনেক মেশিন ছিল, এবং তার আশপাশে অনেক পানি ছিল বলে জানিয়েছে। তার সঙ্গী আরও অনেক শ্রমিক মারা গেছে, যাদের পচা গন্ধ অনুভব করেছেন।
আগেও অনাহারে থেকেছেন: স্বামীর অত্যাচারে মাঝে-মধ্যেই টানা কয়েকদিন অনাহারে থেকেছেন অলৌকিক কন্যা রেশমা আক্তার। ১৭ দিন পর ধ্বংসস্তূপ থেকে তিনি জীবিত উদ্ধার হয়েছেন। কিভাবে এত দিন জীবিত ছিলেন মৃত্যুকূপে সেই কাহিনীর বর্ণনা করতে গিয়ে সেনা কর্মকর্তারা বলেন, কিছু পানি ও শুকনা খাবার ছিল তার সঙ্গে। ধসের সময় তিনি গুরুতর কোন আঘাতও পাননি। গার্মেন্টের কিছু কার্টন ও কাপড়ের স্তূপে চাপা পড়েছিলেন। তার সঙ্গে থাকা খাবার অনেক আগেই ফুরিয়েছিল। তখন নিজের চুল নিজেই কেটে ফেলেন। সামনে যা পান তাই খাওয়ার চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে ক্ষুধার জ্বালায় দুর্বল হয়ে পড়েন। তারপরও মোটামুটি সুস্থ অবস্থায় তাকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন উদ্ধারকর্মীরা। তবে রেশমার ব্যক্তিগত অজানা গল্পের কথা শোনালেন বাড়ির মালিক মসছুর আহমেদ নূরু। তিনি বলেন, সাভার বাজার রোডের বি-১৩৮ নম্বরে আমার বাড়ি। এ বাড়িতেই রেশমা গত আড়াই বছর ধরে ভাড়া থাকেন। প্রায় এক বছর আগে তার স্বামী সবুজ মিয়া তাকে ছেড়ে চলে যান। যাওয়ার আগে সব আসবাবপত্র বিক্রি করে যায়। এছাড়া মাঝে-মধ্যেই মারধর করতেন। দিনের পর দিন না খাইয়ে রাখতেন রেশমাকে। আবার মারধরের ঘটনা মোবাইল ফোনে ভিডিও করে রাখতেন। তা প্রকাশের ভয়ভীতি দেখিয়ে মারধরের কথা গোপন রাখতেন। বাড়ির মালিক নুুরু আরও বলেন, তার স্ত্রী হাজেরা বেগম মেয়েটিকে নিজের কন্যার মতো আগলে রাখতেন। সবুজের নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করতেন। এরই একপর্যায়ে নিপীড়নকারী স্বামী সবুজ তাকে ছেড়ে দিয়ে চলে যায়। এরপর থেকে আর কোন খোঁজ-খবর রাখেনি। এদিকে রেশমা উদ্ধারের পরপরই স্ত্রী দাবি করেন রাজ্জাক নামে এক ব্যক্তি। পরে সেনা কর্মকর্তারা তাকে চিকিৎসাধীন রেশমার সামনে নিয়ে গেলে রেশমা বলেন, উনি আমার স্বামী নন। এরপর তাকে সেনা হেফাজতে রাখা হয়েছে।
রেশমাকে দেখতে হাসপাতালে বিএনপির প্রতিনিধি দল: রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে ১৭তম দিনে উদ্ধার হওয়া রেশমাকে দেখতে সাভারের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) যান বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল। গতকাল রাতে ঢাকা জেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল মান্নান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) রুহুল আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল হাসপাতালে যায়। তারা এ সময় রেশমার চিকিৎসার খোঁজখবর নেন এবং দ্রুত সুস্থ হওয়ার কামনা করেন। ঢাকা জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল মান্নান মানবজমিনকে জানান, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নির্দেশে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল রেশমাকে দেখতে সাবার সিএমএইচে গিয়েছিলাম। ডাক্তারদের কাছে তার চিকিৎসার খোঁজখবর নিয়েছি। তার দ্রুত সুস্থ হতে দোয়া কামনা করেছি।
ধ্বংসস্তূপের নিচে ২৭ দিন বেঁচে ছিলেন ইভানস: রানা প্লাজা ধ্বংসস্তূপের নিচে ১৭ দিন আটকে থাকার পর রেশমাকে জীবিত উদ্ধার করে উদ্ধারকর্মীরা। ডেইলি মেইল প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, ২০১০-এ হাইতি ভূমিকম্পে ধ্বংসস্তূপের নিচে ২৭ দিন পরও বেঁচে ছিলেন ইভানস মনসিগনাক। কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে অবরুদ্ধ অবস্থায় দীর্ঘ সময় ধরে জীবিত থাকার রেকর্ডের অধিকারী দুই সন্তানের বাবা এই ইভানস। হাইতির রাজধানী পোর্ট অফ প্রিন্সের এক ধংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করা হয় তাকে। আটকে পড়া স্থানের নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া নর্দমার পানি আর ইট পাথরের টুকরো খেয়ে বেঁচে ছিলেন তিনি। টেলিগ্রাফকে দেয়া বর্ণনায় ইভানস, ‘আমি ভেবেছিলাম মারা গেছি। দুই অথবা তিন দিনের মাথায় বুঝতে পারলাম যে না এখনও বেঁচে আছি। তখন ওই নদর্মার পানি চোখে পড়ে। অনেক ক্ষুধার্ত আর তৃষ্ণার্ত ছিলাম। নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া পানির ধারা থেকে পানি খেতে চেষ্টা করলাম। সঙ্গে সঙ্গেই পেট ঘুলিয়ে উঠলো। পরে শুধু এক আঙুল চুবিয়ে ঠোট ভেজাতাম আর জিহ্বার ওপর দিয়ে অনেক কষ্টে গলধঃকরণ করতাম। দিন দিন আরও অসুস্থ হয়ে পড়ছিলাম।’
No comments