প্রতিবাদী গণনারী সমাবেশ ‘...সমতা আসে না আজো' by জোবাইদা নাসরীন

প্রতিবাদী গণনারী মহাসমাবেশ হওয়ার কথা ছিল ২৭ এপ্রিল। দুই দফা পেছানোর পর আজ এ দেশের নারীরা প্রতিবাদের ময়দানে হাজির হবে। তারা দেশের প্রতিরোধ ও প্রতিবাদের ভাষাকে আরও উচ্চকিত করবে। সাভারে লাশের স্তূপ ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল জীবনকে।
জীবনহীন দুর্ভাগা মানুষের সঙ্গে তাজা জীবনের সঙ্গ এবং হিসাব-নিকাশ এখনো চলছে। হূদয় মুচড়ে যাওয়া সেই ক্ষতের ঘা থেকেই প্রথম দফায় তারিখ পেছানো। যাদের প্রতিবাদী কণ্ঠ হতে পারত কিংবা হবে এই মহাসমাবেশের মূল শক্তি, তাদের অনেকের জীবন ছিন্নভিন্ন হয়েছে কংক্রিটের আঘাতে, শিল্পমালিকদের অতিমাত্রার অবহেলায়। সাভারের এই বিপর্যয় সমমজুরির এবং নারীর নিরাপত্তার মতো অতি পুরোনো কিন্তু অতি জরুরি প্রশ্নটিকে একেবারেই সামনে নিয়ে এসেছে। আর মানুষ হিসেবে মর্যাদা নিয়ে বাঁচার জায়গাটিকেই বারবার চেনানোর চেষ্টা করছে এ দেশের নারীরা।

দুই.
কেন এই মহাসমাবেশ? কেন নারীর সমন্বিত প্রতিবাদ? মূল চেতনার জায়গাটি হেফাজতের দুটি নারীবিদ্বেষী দফাকে কেন্দ্র করে হলেও এ সমাবেশ অনেকগুলো অমীমাংসিত প্রশ্নের ফয়সালা চায়। ১৯৭১ সালের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নেওয়ার পর ধর্মনিরপেক্ষতাকে একটি মৌলিক স্তম্ভ হিসেবে হাজির করলেও এ দেশে সাম্প্রদায়িক উঁকিঝুঁকি, হামলা এবং বাতাবরণ চলেছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে। আর সাম্প্রদায়িক, জাতিগত এবং সব বৈষম্য ও নিপীড়নের প্রথম শিকার হয় নারী। কারণ, এগুলোর সঙ্গেই হাত ধরাধরি করে পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা তার সব কর্তৃত্ব জারি রাখতে চায়। এসব বাস্তবতা পাশ কাটিয়ে নয় বরং লড়াইয়ের ময়দান হিসেবেই এ সমাবেশ অসাম্প্রদায়িক এবং সমতার বাংলাদেশ গড়ার দেনদরবার করতে আগ্রহী।
এ সমাবেশ আরও বলছে নারীনীতি বাস্তবায়নের কথা। সম্পত্তির উত্তরাধিকারে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা। সিডও সনদ বাস্তবায়নের কথা। বলছে নারীর এগিয়ে যাওয়ার পথের প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে লড়ার কথা। বলছে এ দেশের নারী আন্দোলন এবং নারীর ঈর্ষণীয় সংগ্রামের কথা।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটেই হেফাজতে ইসলাম নামের সংগঠনটি সামনে চলে এসেছে। হেফাজতের ১৩ দফার মধ্যে নারীর জন্য নির্দিষ্ট ছিল কয়েকটি দফা।
সেই ৬ এপ্রিল হেফাজতের সমাবেশ কভার করতে গিয়ে গুরুতর আহত হয়েছে আমাদের সাবেক ছাত্রী এবং ইটিভির প্রতিবেদক নাদিয়া শারমিন। পুরুষের সমাবেশে নারী প্রতিবেদক কেন? মাথায় কাপড় নেই কেন? শুধু কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি তার প্রতি পুরুষতান্ত্রিক আচরণ। তাঁকে ফেলে দিয়ে, দুমড়েমুচড়ে, থেঁতলে ভয়াবহভাবে আক্রান্ত করা হয়েছে।
নারীর প্রতি এ ধরনের অশ্রদ্ধাশীল আচরণ একদিকে সংবিধানবিরোধী, অন্যদিকে মানবতাবিরোধী। যেখানে সংবিধানে ২৮(১) ধারায় স্পষ্টভাবে আছে ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবে না’ এবং ২৮(২) ধারায় আছে, ‘রাষ্ট্রের ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন’, সেখানে একজন নারীর সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার অধিকার সংবিধানের মাধ্যমে স্বীকৃত। সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদেও নাগরিকের ব্যক্তিস্বাধীনতাকে স্বীকার করা হয়েছে এবং এর ৩৯(২) অনুচ্ছেদে নাগরিকের ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে।
নারী-পুরুষের প্রকাশ্য বিচরণ ইসলামসহ কোনো ধর্মেই নিষিদ্ধ নয়। নারীর সঙ্গে ধর্মের বিরোধ ঘটানো কিংবা নারীর বিপরীতে ধর্মীয় পুরুষতান্ত্রিক ব্যাখ্যাকে দাঁড় করানোর চেষ্টার মধ্য দিয়ে পুরুষতন্ত্রকে জোরদার করার মনস্কতা এ দেশে চলমান লৈঙ্গিক রাজনীতির একটি বড়সড় কূটচাল। তাই ধর্মের সঙ্গে নারীর সম্পর্ক কিংবা সম্পর্কহীনতা এত সহজে ফয়সালা হয়ে যাওয়ার বিষয় নয়।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লালসালুতে জমিলারা লড়ছে মজিদের ভণ্ডামির বিরুদ্ধে। সুলতানার স্বপ্নের একজন হয়েই এ দেশের নারীরা লড়াই করে যায়, কারণ সে জানে নারীর হারাবার কিছুই নেই, কারণ সে লড়তে জানে, লড়াকু সন্তান জন্ম দিতে জানে, লাশের স্তূপ থেকে ওঠে প্রতিবাদের নয়া শামিয়ানা বুনতে জানে, আর জানে বলেই নারীকে ভয় পায় হেফাজত, আর তাই নারীকে নিয়ে তুলতে হয় তাকে বন্দী করার নয়া দাবি।

তিন.
পুরুষতন্ত্র, পুঁজিবাদ, ধর্মীয় গোঁড়ামি, বর্ণবাদ, জাতিগত বৈষম্য—সবকিছুর বিরুদ্ধেই লড়তে হচ্ছে নারীকে। মাঝখানে হেফাজতের দুই দফার ইনিংস দেখেছে বাংলাদেশ। ঢাকায় হেফাজতের অবস্থান, তাণ্ডবলীলার সঙ্গে তারা কর্তৃত্ব দেখিয়েছে বিভিন্ন জায়গায় নারীদের মাথায় কাপড় দেওয়ার জন্য নির্দেশ প্রদানের মধ্য দিয়ে। একজন নারী মাথায় কাপড় দেবে কি দেবে না, এটা তার একান্তই নিজস্ব বিষয়।
এ দেশে একজন মুক্তিযোদ্ধা কিংবা শহীদের সন্তান হিসেবে আমরা পরিচয় দিতে অহংকার বোধ করি, তেমন অহংকার বোধ করি বীরাঙ্গনার সন্তান হিসেবে। কারণ, তাঁরাও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। সবাই মুক্তির অপেক্ষায় থাকা একটি বড় এবং কঠিন সময়ের অভিজ্ঞতার গর্বিত মানুষ। তাই এ দেশের ইতিহাসে আমরা যেমন দেখতে চাই না কোনো লৈঙ্গিক ভেদ, চাই না হেফাজতনামার মাধ্যমে নারীকে ঘরে বন্দী রাখার তরিকা।
আর তাই তো কানে বাজে
‘পুষ্টিহীনতা, জুলুমে জখমে দিয়েছি তো কোটি প্রাণ—
তবুও আসে না মমতার দিন, সমতা আসে না আজো।’
 জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
zobaidanasreen@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.