চোখ বন্ধ রাখলে প্রলয় বন্ধ হবেনা by তোফায়েল আহমেদ
বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নিয়ে আমরা অনেকেই ভীষণ ভাবিত। বিদেশে আমাদের এ নিম্নস্তরের ভাবমূর্তি কখনোই অভাবিতপূর্ব ছিল, তা নয়। সাম্প্রতিক কালের ‘সাভার ট্র্যাজেডি’ পূর্ব থেকে বিরাজিত নেতিবাচকতায় তীব্রতার নতুনমাত্রা যুক্ত করেছে মাত্র। তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের নিম্ন বেতন, মানবেতর জীবনযাপন, অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যু, হত্যা-গুম, অনিরাপদ কর্মপরিবেশ, অনিশ্চিত জীবিকা, যৌন হয়রানি—এসব চিত্র দেশ-বিদেশে কারও অজানা নয়।
অপরদিকে তৈরি পোশাকশিল্পের অর্থে রাজনৈতিক পদ-পদবির প্রতিযোগিতা, দেশে-বিদেশে বিলাসী জীবন, অর্থসম্পদ স্থানান্তর, বিদেশি নাগরিকত্ব গ্রহণ, ব্যাংকের দায়দেনা—এসব অজানা নয়। তাই বিদেশে বড় বড় ক্রয় কোম্পানি, শ্রমিক সংঘ, মানবাধিকারকর্মী এসব বিষয়ে বহু পূর্ব থেকেই সোচ্চার। এসবে আমরা যতটুকু কান দেওয়ার, তা দেইনি। কোনো দুর্ঘটনা হলেই কয়দিন সোচ্চার হয়ে পুনরায় নির্লিপ্ত থাকছি। এমতাবস্থায় এ দেশ, সমাজ ও রাষ্ট্রের ভাবমূর্তির প্রশ্নটি অবান্তর। তবু চেষ্টার বিরাম নেই। কিন্তু আমরা ভুলে যাই গলাবাজি, ডিনার আর লাঞ্চ পার্টি বা ভাড়া করা সাংবাদিক, লবিস্ট, বুদ্ধিজীবী দিয়ে ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়া যায় না।
আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ভাবমূর্তি গড়ার চেষ্টায় প্রাণান্ত। শোনা যায়, আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নাকি নিজের দেশের চেয়ে পরের দেশেই বেশি সময় কাটান। কিন্তু তার এ বহুল বিদেশ ভ্রমণ দেশের ভাবমূর্তিতে কয়টি সোনালী-রূপালী পালক যুক্ত করল বা প্রজাপতির রং ছড়াল, তার মূল্যায়ন কে করবে?
ইংরেজি ‘ইমেজ’-এর বাংলা প্রতিশব্দ বা অনুবাদ হিসেবে ভাবমূর্তি খুব জুতসই মনে হয় না। এখানে ‘মূর্তি’র মধ্যে একদিকে পৌত্তলিকতার গন্ধ, অপরদিকে সেই ভাবের মূর্তি ধ্বংস হলে মৌলবাদী জঙ্গিপনার সম্পর্ক পাওয়া যায়।
ইংরেজি ইমেজ শব্দটি যে অর্থ বহন করে তা হচ্ছে, একজন ব্যক্তি মানুষ, একটি পরিবার, সমাজ-সভ্যতা ও রাষ্ট্রের দর্শন, মনোভঙ্গি, দৃষ্টিভঙ্গি; যা সত্যিকার কর্মে ও প্রয়োগে প্রতিফলিত, তারই একটি সামগ্রিক যোগফল—অন্যের মানসভূমিতে যার ছায়াপাত ঘটে বা রেখাপাত করে, তাতেই তার একটি ইমেজ গড়ে ওঠে। আমাদের সঙ্গে যাদের দীর্ঘদিনের মিথস্ক্রিয়া তাদের কাছে আমাদের একটি ইমেজ ইতিমধ্যে পাকাপোক্তভাবে গড়ে উঠেছে। রাতারাতি তার পরিবর্তন সম্ভব নয়। তবে সাভারের মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ও তার পূর্বের ধারাবাহিক অন্যান্য দুর্ঘটনার জন্য আন্তরিক অনুশোচনা ও সংশোধনের ততধিক আন্তরিকতাই পারে ইমেজের ওপর ফেলতে কিছু ইতিবাচক প্রভাব।
সাভারের এত বিপুল প্রাণহানি, আহত, পঙ্গু হওয়া এবং আনুষঙ্গিক ক্ষয়ক্ষতির বিচারে বিশ্বে এটি একটি রেকর্ড। কিন্তু দুর্ভাগ্য-দুর্গতির এটিই কি শেষ ঘটনা? একই দুর্ঘটনার ১৫তম দিনে আবারও পোশাক কারখানায় আগুন ও নিহতের ঘটনা ঘটে গেল। এ-ই যখন আমাদের ‘ভাব’, তাহলে মূর্তি আর কীই-বা হতে পারে? যার যা ভাব তার সে রকমই মূর্তি। আমাদের ভাবমূর্তি পাষাণ-হূদয় অতি মুনাফালোভী এবং শ্রমিকের জীবন, ঘাম, শ্রম, মান-সম্মান সম্পর্কে সাংঘাতিক নির্লিপ্ততার জ্বলন্ত উদাহরণ।
তৈরি পোশাকশিল্প একটি আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন সম্পর্কজালে জড়িত। এটি একটি রপ্তানিনির্ভর শিল্প। তাই বিশ্বমান, বিশ্বব্যাপী চর্চিত শ্রম অধিকার ও নৈতিকতা মেনেই এ শিল্পের বিকাশ হবে। এর ব্যতিক্রম নেই। কিন্তু জাতীয়ভাবে একটি মারাত্মক স্বার্থপরতা বা স্বার্থান্ধ শ্রেণী মানসিকতাকে আমরা উতরাতে পারিনি। সেটি হচ্ছে আমরা পোশাক খাতকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের খাত এবং এ শিল্পের বিপর্যয় রক্ষার নামে ধারাবাহিকভাবে মালিকের মুনাফাকে যত গুরুত্ব দিয়ে দেখেছি, শ্রমিকের শোষণ-বঞ্চনাকে ততধিক বা তার ন্যায্য গুরুত্ব দিইনি। এমনকি বিপর্যয়ের পর শিল্পচিন্তার সঙ্গে শ্রমিকের প্রতি ন্যায়বিচারের প্রশ্নটি এখনো দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরেই রয়ে গেল।
এ শিল্পের টিকে থাকা এবং উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি অবশ্যই কাম্য। কিন্তু শুধু মালিকের মুনাফা, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি, নির্বাহীগণের মোটা বেতনের জন্য নয়, ৪০ লাখ নারী-পুরুষ শ্রমিকের বিষয়টিও সমান গুরুত্বের দাবিদার। এটি নৈতিকতার প্রশ্ন তো বটেই, শিল্পের সুরক্ষার জন্যও প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক রীতিনীতি ও পণ্যের গুণ-মানের সঙ্গে শ্রমিক সন্তুষ্টির তুলনামূলক পরিমাপ করেই ভবিষ্যতে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের বিকাশের চিন্তা করতে হবে। শ্রমিক সন্তুষ্টির প্রশ্নটি আর দ্বিতীয় স্থানে রাখার অবকাশ নেই। কারণ, এটি শ্রমঘন ও শ্রমিকপ্রধান শিল্প। পুঁজি ও প্রযুক্তিনির্ভর শিল্প হলে এ চিন্তা কম করলেও চলত। এখন এ বিপর্যয়ের পর আর অন্য বিকল্প নেই।
ভ্যাটিকান থেকে পোপের আহ্বান এখনো বোধ হয় আমাদের পাষাণ-হূদয় নিরেট মুনাফালোভীদের কর্ণকুহরে পৌঁছালেও মর্ম স্পর্শ করেনি। কিন্তু ইউরোপ-আমেরিকার খ্রিষ্টধর্ম বিশ্বাসীদের মর্মে তা দারুণভাবে আঘাত করেছে। তাদের অনেকেই এখন দোকানে গিয়ে পোশাক ক্রয়ের সময় এ পোশাক কোথাকার তৈরি, সেটি দেখেই কিনছে। হয়তো পোশাক ক্রেতাদের বড় বড় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের অনেকেই তাদের অর্ডার সাময়িকভাবে বাতিল করবে না। কিন্তু পশ্চিমের সাধারণ ক্রেতারা ভোক্তাদের মধ্যে একটা বড় অংশ এ দেশি পণ্যের ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে।
এ রকম একটি সময়ে আন্তর্জাতিকভাবে স্বনাম ও সুনামধন্যদের সৎ কর্মের ইমেজ কাজে লাগিয়ে আমাদের আন্তরিকতার সব ধরনের প্রমাণ দিতে হবে। অবশ্যই তা করতে হবে উদারভাবে এবং ক্ষিপ্রতার সঙ্গে। নতুন ‘আম-ছালা’র গল্প নতুনভাবে এ ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। এ শিল্প ধ্বংস না হলেও সংকুচিত হবে।
গত ২০ বছরের পোশাক খাতের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, উদীয়মান অনেক দেশ পিছিয়ে পড়েছে। আবার নতুন অনেক দেশ এ মানচিত্রে যুক্ত হচ্ছে। বাংলাদেশের বিকল্প হিসেবে এখন নিশ্চিতভাবে মিয়ানমারকে ব্যবহার করার প্রস্তুতি চলছে। হয়তো আমাদের অনেক পোশাকশিল্পের মালিক সেখানে বিনিয়োগ করবেন।
এখনো অনেকে হংকং, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশে অফিস এবং যৌথভাবে শিল্পেও বিনিয়োগ করছেন। তাঁরা এখন সে সক্ষমতা অর্জন করেছেন। আমাদের পরিচিত পরিমণ্ডলে এমন অনেকে আছেন, যাঁরা আমেরিকা, কানাডাসহ পশ্চিমের কোনো দেশে নিজের কেনা বাড়িতে বসে স্কাইপে বাংলাদেশে কারখানা চালান। এখানে অনেকের ভৌত বিনিয়োগ খুবই সীমিত। কিন্তু মুনাফার বহুমুখীকরণ হয়েছে। ভবন ব্যবহার করেন ভাড়ায়, মেশিনারি ব্যাংকের কাছে বন্ধক, কাঁচামালও অনুরূপভাবে ব্যাংকঋণে, শ্রমিক অস্থায়ী ও সস্তায়। অর্ডার পাওয়া, অর্ডার সাপ্লাই হয়ে ওঠে মুখ্য। ব্রোকারের মতো উদ্বৃত্তটা বিদেশে সঞ্চয় করছেন। দেশে সত্যিকারের বিনিয়োগ তাঁরা করছেন না।
কজন মালিক ২০ বছরে নিজস্ব প্রাঙ্গণে শিল্প চালাচ্ছেন? বেশি দূর খোঁড়াখুঁড়ি এ দুঃসময়ে করতে চাই না। শুধু এ মুহূর্তে সরকারকে অনুরোধ করব, শ্রমিকবান্ধব অন্যান্য কর্মসূচির সঙ্গে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের দ্বিতীয় প্রস্তাবটি ভেবে দেখুন।
অতি মুনাফালোভী ও প্রবঞ্চক-প্রতারক মানসিকতা আমাদের যে পর্যায়ে নিম্নগামী করেছে, তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য এককভাবে সরকার-বিজিএমইএ-বিকেএমইএর প্রচেষ্টা যথেষ্ট নয়। স্বাধীন, বিশ্বাসযোগ্য, দক্ষ ও অভিজ্ঞ নাগরিক উদ্যোগ এ ক্ষেত্রে সম্পূরক ভূমিকা পালন করতে পারে।
বিশেষত অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং স্যার ফজলে হাসান আবেদ ছাড়াও ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, এনাম মেডিকেলের প্রধান ডা. এনামুর রহমান, প্রবীণ ও ত্যাগী পোশাক সেক্টরের শ্রমিক নেতাগণ উদ্যোগী ভূমিকা নিতে পারেন। পোশাক ক্রেতার অর্থে ‘শ্রমিক কল্যাণ ট্রাস্ট’ গঠন এবং এর ব্যবস্থাপনায় আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্বাস অর্জনকারী ব্যক্তিদের ভূমিকা রাখার সুযোগ সৃষ্টির এ প্রস্তাবটি বাস্তবায়নের জন্য অতি দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে আসা উচিত।
আদর্শ ও বাস্তবতার দ্বন্দ্ব চিরন্তন। বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি ও মনোজগৎ এখন বহুধা বিভক্ত। বিভক্তির এ সময়ে মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে সরকারের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকতে পারে। পোশাকশ্রমিক, পোশাকশিল্প এবং বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির ইতিবাচকতার স্বার্থে তিনি যে হাত প্রসারিত করেছেন বা বাড়িয়ে দিয়েছেন, সেটির মর্যাদা দিলে জাতি সামগ্রিকভাবে লাভবান শুধু নয়, জাতি হিসেবে আমাদের নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে।
চোখ বন্ধ রাখলে প্রলয় বন্ধ থাকবে না। তাই চোখ খুলে বিশ্ব পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করুন। যেখানে যাঁরাই এগিয়ে আসছেন, তাঁদের সবার সাহায্য-সহানুুভূতি, বুদ্ধি পরামর্শ গ্রহণ করে এ সংকটের উত্তরণে আন্তরিক হোন।
জাতির এ ক্রান্তিলগ্নে এগিয়ে আসার জন্য অধ্যাপক ইউনূসের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা।
অপরদিকে তৈরি পোশাকশিল্পের অর্থে রাজনৈতিক পদ-পদবির প্রতিযোগিতা, দেশে-বিদেশে বিলাসী জীবন, অর্থসম্পদ স্থানান্তর, বিদেশি নাগরিকত্ব গ্রহণ, ব্যাংকের দায়দেনা—এসব অজানা নয়। তাই বিদেশে বড় বড় ক্রয় কোম্পানি, শ্রমিক সংঘ, মানবাধিকারকর্মী এসব বিষয়ে বহু পূর্ব থেকেই সোচ্চার। এসবে আমরা যতটুকু কান দেওয়ার, তা দেইনি। কোনো দুর্ঘটনা হলেই কয়দিন সোচ্চার হয়ে পুনরায় নির্লিপ্ত থাকছি। এমতাবস্থায় এ দেশ, সমাজ ও রাষ্ট্রের ভাবমূর্তির প্রশ্নটি অবান্তর। তবু চেষ্টার বিরাম নেই। কিন্তু আমরা ভুলে যাই গলাবাজি, ডিনার আর লাঞ্চ পার্টি বা ভাড়া করা সাংবাদিক, লবিস্ট, বুদ্ধিজীবী দিয়ে ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়া যায় না।
আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ভাবমূর্তি গড়ার চেষ্টায় প্রাণান্ত। শোনা যায়, আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নাকি নিজের দেশের চেয়ে পরের দেশেই বেশি সময় কাটান। কিন্তু তার এ বহুল বিদেশ ভ্রমণ দেশের ভাবমূর্তিতে কয়টি সোনালী-রূপালী পালক যুক্ত করল বা প্রজাপতির রং ছড়াল, তার মূল্যায়ন কে করবে?
ইংরেজি ‘ইমেজ’-এর বাংলা প্রতিশব্দ বা অনুবাদ হিসেবে ভাবমূর্তি খুব জুতসই মনে হয় না। এখানে ‘মূর্তি’র মধ্যে একদিকে পৌত্তলিকতার গন্ধ, অপরদিকে সেই ভাবের মূর্তি ধ্বংস হলে মৌলবাদী জঙ্গিপনার সম্পর্ক পাওয়া যায়।
ইংরেজি ইমেজ শব্দটি যে অর্থ বহন করে তা হচ্ছে, একজন ব্যক্তি মানুষ, একটি পরিবার, সমাজ-সভ্যতা ও রাষ্ট্রের দর্শন, মনোভঙ্গি, দৃষ্টিভঙ্গি; যা সত্যিকার কর্মে ও প্রয়োগে প্রতিফলিত, তারই একটি সামগ্রিক যোগফল—অন্যের মানসভূমিতে যার ছায়াপাত ঘটে বা রেখাপাত করে, তাতেই তার একটি ইমেজ গড়ে ওঠে। আমাদের সঙ্গে যাদের দীর্ঘদিনের মিথস্ক্রিয়া তাদের কাছে আমাদের একটি ইমেজ ইতিমধ্যে পাকাপোক্তভাবে গড়ে উঠেছে। রাতারাতি তার পরিবর্তন সম্ভব নয়। তবে সাভারের মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ও তার পূর্বের ধারাবাহিক অন্যান্য দুর্ঘটনার জন্য আন্তরিক অনুশোচনা ও সংশোধনের ততধিক আন্তরিকতাই পারে ইমেজের ওপর ফেলতে কিছু ইতিবাচক প্রভাব।
সাভারের এত বিপুল প্রাণহানি, আহত, পঙ্গু হওয়া এবং আনুষঙ্গিক ক্ষয়ক্ষতির বিচারে বিশ্বে এটি একটি রেকর্ড। কিন্তু দুর্ভাগ্য-দুর্গতির এটিই কি শেষ ঘটনা? একই দুর্ঘটনার ১৫তম দিনে আবারও পোশাক কারখানায় আগুন ও নিহতের ঘটনা ঘটে গেল। এ-ই যখন আমাদের ‘ভাব’, তাহলে মূর্তি আর কীই-বা হতে পারে? যার যা ভাব তার সে রকমই মূর্তি। আমাদের ভাবমূর্তি পাষাণ-হূদয় অতি মুনাফালোভী এবং শ্রমিকের জীবন, ঘাম, শ্রম, মান-সম্মান সম্পর্কে সাংঘাতিক নির্লিপ্ততার জ্বলন্ত উদাহরণ।
তৈরি পোশাকশিল্প একটি আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন সম্পর্কজালে জড়িত। এটি একটি রপ্তানিনির্ভর শিল্প। তাই বিশ্বমান, বিশ্বব্যাপী চর্চিত শ্রম অধিকার ও নৈতিকতা মেনেই এ শিল্পের বিকাশ হবে। এর ব্যতিক্রম নেই। কিন্তু জাতীয়ভাবে একটি মারাত্মক স্বার্থপরতা বা স্বার্থান্ধ শ্রেণী মানসিকতাকে আমরা উতরাতে পারিনি। সেটি হচ্ছে আমরা পোশাক খাতকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের খাত এবং এ শিল্পের বিপর্যয় রক্ষার নামে ধারাবাহিকভাবে মালিকের মুনাফাকে যত গুরুত্ব দিয়ে দেখেছি, শ্রমিকের শোষণ-বঞ্চনাকে ততধিক বা তার ন্যায্য গুরুত্ব দিইনি। এমনকি বিপর্যয়ের পর শিল্পচিন্তার সঙ্গে শ্রমিকের প্রতি ন্যায়বিচারের প্রশ্নটি এখনো দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরেই রয়ে গেল।
এ শিল্পের টিকে থাকা এবং উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি অবশ্যই কাম্য। কিন্তু শুধু মালিকের মুনাফা, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি, নির্বাহীগণের মোটা বেতনের জন্য নয়, ৪০ লাখ নারী-পুরুষ শ্রমিকের বিষয়টিও সমান গুরুত্বের দাবিদার। এটি নৈতিকতার প্রশ্ন তো বটেই, শিল্পের সুরক্ষার জন্যও প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক রীতিনীতি ও পণ্যের গুণ-মানের সঙ্গে শ্রমিক সন্তুষ্টির তুলনামূলক পরিমাপ করেই ভবিষ্যতে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের বিকাশের চিন্তা করতে হবে। শ্রমিক সন্তুষ্টির প্রশ্নটি আর দ্বিতীয় স্থানে রাখার অবকাশ নেই। কারণ, এটি শ্রমঘন ও শ্রমিকপ্রধান শিল্প। পুঁজি ও প্রযুক্তিনির্ভর শিল্প হলে এ চিন্তা কম করলেও চলত। এখন এ বিপর্যয়ের পর আর অন্য বিকল্প নেই।
ভ্যাটিকান থেকে পোপের আহ্বান এখনো বোধ হয় আমাদের পাষাণ-হূদয় নিরেট মুনাফালোভীদের কর্ণকুহরে পৌঁছালেও মর্ম স্পর্শ করেনি। কিন্তু ইউরোপ-আমেরিকার খ্রিষ্টধর্ম বিশ্বাসীদের মর্মে তা দারুণভাবে আঘাত করেছে। তাদের অনেকেই এখন দোকানে গিয়ে পোশাক ক্রয়ের সময় এ পোশাক কোথাকার তৈরি, সেটি দেখেই কিনছে। হয়তো পোশাক ক্রেতাদের বড় বড় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের অনেকেই তাদের অর্ডার সাময়িকভাবে বাতিল করবে না। কিন্তু পশ্চিমের সাধারণ ক্রেতারা ভোক্তাদের মধ্যে একটা বড় অংশ এ দেশি পণ্যের ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে।
এ রকম একটি সময়ে আন্তর্জাতিকভাবে স্বনাম ও সুনামধন্যদের সৎ কর্মের ইমেজ কাজে লাগিয়ে আমাদের আন্তরিকতার সব ধরনের প্রমাণ দিতে হবে। অবশ্যই তা করতে হবে উদারভাবে এবং ক্ষিপ্রতার সঙ্গে। নতুন ‘আম-ছালা’র গল্প নতুনভাবে এ ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। এ শিল্প ধ্বংস না হলেও সংকুচিত হবে।
গত ২০ বছরের পোশাক খাতের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, উদীয়মান অনেক দেশ পিছিয়ে পড়েছে। আবার নতুন অনেক দেশ এ মানচিত্রে যুক্ত হচ্ছে। বাংলাদেশের বিকল্প হিসেবে এখন নিশ্চিতভাবে মিয়ানমারকে ব্যবহার করার প্রস্তুতি চলছে। হয়তো আমাদের অনেক পোশাকশিল্পের মালিক সেখানে বিনিয়োগ করবেন।
এখনো অনেকে হংকং, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশে অফিস এবং যৌথভাবে শিল্পেও বিনিয়োগ করছেন। তাঁরা এখন সে সক্ষমতা অর্জন করেছেন। আমাদের পরিচিত পরিমণ্ডলে এমন অনেকে আছেন, যাঁরা আমেরিকা, কানাডাসহ পশ্চিমের কোনো দেশে নিজের কেনা বাড়িতে বসে স্কাইপে বাংলাদেশে কারখানা চালান। এখানে অনেকের ভৌত বিনিয়োগ খুবই সীমিত। কিন্তু মুনাফার বহুমুখীকরণ হয়েছে। ভবন ব্যবহার করেন ভাড়ায়, মেশিনারি ব্যাংকের কাছে বন্ধক, কাঁচামালও অনুরূপভাবে ব্যাংকঋণে, শ্রমিক অস্থায়ী ও সস্তায়। অর্ডার পাওয়া, অর্ডার সাপ্লাই হয়ে ওঠে মুখ্য। ব্রোকারের মতো উদ্বৃত্তটা বিদেশে সঞ্চয় করছেন। দেশে সত্যিকারের বিনিয়োগ তাঁরা করছেন না।
কজন মালিক ২০ বছরে নিজস্ব প্রাঙ্গণে শিল্প চালাচ্ছেন? বেশি দূর খোঁড়াখুঁড়ি এ দুঃসময়ে করতে চাই না। শুধু এ মুহূর্তে সরকারকে অনুরোধ করব, শ্রমিকবান্ধব অন্যান্য কর্মসূচির সঙ্গে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের দ্বিতীয় প্রস্তাবটি ভেবে দেখুন।
অতি মুনাফালোভী ও প্রবঞ্চক-প্রতারক মানসিকতা আমাদের যে পর্যায়ে নিম্নগামী করেছে, তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য এককভাবে সরকার-বিজিএমইএ-বিকেএমইএর প্রচেষ্টা যথেষ্ট নয়। স্বাধীন, বিশ্বাসযোগ্য, দক্ষ ও অভিজ্ঞ নাগরিক উদ্যোগ এ ক্ষেত্রে সম্পূরক ভূমিকা পালন করতে পারে।
বিশেষত অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং স্যার ফজলে হাসান আবেদ ছাড়াও ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, এনাম মেডিকেলের প্রধান ডা. এনামুর রহমান, প্রবীণ ও ত্যাগী পোশাক সেক্টরের শ্রমিক নেতাগণ উদ্যোগী ভূমিকা নিতে পারেন। পোশাক ক্রেতার অর্থে ‘শ্রমিক কল্যাণ ট্রাস্ট’ গঠন এবং এর ব্যবস্থাপনায় আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্বাস অর্জনকারী ব্যক্তিদের ভূমিকা রাখার সুযোগ সৃষ্টির এ প্রস্তাবটি বাস্তবায়নের জন্য অতি দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে আসা উচিত।
আদর্শ ও বাস্তবতার দ্বন্দ্ব চিরন্তন। বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি ও মনোজগৎ এখন বহুধা বিভক্ত। বিভক্তির এ সময়ে মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে সরকারের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকতে পারে। পোশাকশ্রমিক, পোশাকশিল্প এবং বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির ইতিবাচকতার স্বার্থে তিনি যে হাত প্রসারিত করেছেন বা বাড়িয়ে দিয়েছেন, সেটির মর্যাদা দিলে জাতি সামগ্রিকভাবে লাভবান শুধু নয়, জাতি হিসেবে আমাদের নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে।
চোখ বন্ধ রাখলে প্রলয় বন্ধ থাকবে না। তাই চোখ খুলে বিশ্ব পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করুন। যেখানে যাঁরাই এগিয়ে আসছেন, তাঁদের সবার সাহায্য-সহানুুভূতি, বুদ্ধি পরামর্শ গ্রহণ করে এ সংকটের উত্তরণে আন্তরিক হোন।
জাতির এ ক্রান্তিলগ্নে এগিয়ে আসার জন্য অধ্যাপক ইউনূসের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা।
ড. তোফায়েল আহমেদ: স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সদস্য, স্থানীয় সরকারকমিশন।
No comments