ঝড় উঠেছে বৈরী বাতাস by এম আবদুল হাফিজ
আমাদের অতীত কখনও সংকটমুক্ত বা সমস্যা-বিবর্জিত ছিল না। একটি রক্তস্নাত স্বাধীনতা যুদ্ধ আমাদের অস্তিত্বে এনেছিল বিশ্বের অন্যতম হতদরিদ্র দেশ হিসেবে। যেদিকেই তাকাই আমাদের জন্য প্রীত হওয়ার মতো ইতিবাচক কিছুই নেই। আছে শুধু রোগ-শোক, ক্ষুধা, জরা, মন্বন্তর এবং একটি মারাত্মক বৈরী জলবায়ুর অশনিসংকেত।
খরা, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস ও ঝড়ঝঞ্ঝা আমাদের নিত্যসঙ্গী। এরই মধ্যে এসবের ভেতর দিয়েই একটি স্বাধীন সত্তা হিসেবে আমরা বিয়ালি্লশটি বছর অতিক্রম করেছি। জাতি হিসেবে অর্জনের ক্ষেত্রে কিছু এগোলেও, পিছিয়েছি অনেক বেশি।দেশ, রাজনীতি, জাতি গঠন নিয়ে আশাবাদ অনেক পোষণ করলেও হাজারো বিপত্তি যেন কিছুতেই আমাদের পিছু ছাড়ছে না। একটি দুর্বিপাকের ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আরেক অদৃশ্য ঝড়ের ঝাপটায় মুখ থুবড়ে পড়ছি। আমাদের একমাত্র অর্থকরী শিল্প তৈরি পোশাক, যা আমাদের কোষাগারকে দেয় বছরে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা এবং যাতে আমাদের প্রায় চলি্লশ লাখ নারীশ্রমিক নিয়োজিত; সেখানে ঘটেছে এক ভয়াবহ বিপর্যয়, যেখানে হতাহতের সংখ্যা কোনো বিবেচনায় গ্রহণযোগ্য নয়। সেখানকার রক্তক্ষরণ অব্যাহত থাকতেই রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে ঘটল একই প্রকার ভয়াবহ রাজনৈতিক বিস্ফোরণ এবং তার পরিণতিতে আরও প্রাণ ও সম্পদহানি। বলা বাহুল্য, এই বিস্ফোরণের জের এত সত্বর এবং সহজে শেষ হবে না।
বিগত তিন-চার দিনে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে যে হার্ডলাইনের রাজনীতি আমরা দেখলাম, তাতে যে একটি রাজনৈতিক নিষ্পত্তির বাতাবরণ, যা সম্প্রতি অনুভূত হচ্ছিল তা আবার অনির্দিষ্টকালের জন্য ভণ্ডুল হয়ে গেল। জানি না কী প্রকার দুর্যোগদৃষ্টে আইরিশ কবি ইয়েটসের বহুল উদৃব্দত পঙ্ক্তিমালা রচিত হয়েছিল Things are falling apart’. কিন্তু অবস্থা অনেকটাই ছাড়িয়ে গেছে আমাদের বেলায় উদ্ভূত অনমনীয়তা, তিক্ততা এবং অবিশ্বাসে। এখানেও চারদিকেই Things are falling apart. এ দেশের সংকটের প্রেক্ষিতগুলো এমনই যে, কেউ তাৎক্ষণিকভাবে সংকট নিরসনের কোনো ফর্মুলা বলতে পারবে না। অন্তত এতদিন কারও পক্ষে তা বাচনিকতার ঊধর্ে্ব উঠতে পারেনি। তবে লেগে থাকলে তা কোনো দিন ক্লিক করলেও করতে পারে। ইংরেজিতে একটি আপ্তবাক্য আছে :United we stand, Divided we fall. কথাটার তাৎপর্য কি আমরা কোনো দিন গভীরভাবে বুঝতে চেষ্টা করেছি? অবস্থাদৃষ্টে রাজনৈতিক পরিসরে এখনও যে কাদা ছোড়াছুড়ি অব্যাহত আছে_ সেই তাৎপর্য বোঝার আন্তরিক প্রচেষ্টা থাকলে কবেই তা থেমে যেত!
আমাদের সমস্যার পরিধি এতই বিস্মৃত এবং তা এতটাই পৌনঃপুনিক যে, তা আয়ত্তে আনতে যে কোনো সরকার, কর্তৃপক্ষ বা গোষ্ঠী হিমশিম খাবে। নানা ছুতোয় নামমাত্র কারণে কর্মবিরতি বা হরতাল, বিক্ষোভ বা অবরোধ কোনো দেশে এত বেশি ঘটতে দেখা যায় না। উপরন্তু প্রায় সর্বক্ষেত্রেই তা সহিংস এবং বিধ্বংসী। জন্মলগ্নেই যে দেশটিকে অনেক মূল্য দিয়ে অস্তিত্বে আসতে হয়েছে, তার আর কতই-বা অন্তর্নিহিত শক্তি থাকতে পারে প্রতিকূল অবস্থার ভেতর দিয়ে টিকে থাকতে?
যদিও সম্ভাবনার কিছু কিছু ঝিলিক কখনও কখনও পরিদৃষ্ট হয়, অদৃশ্য ও অজ্ঞাত কোনো উৎস থেকে আগত দুর্বিপাক, বিপত্তি ও রাজনৈতিক কলহ নিমেষেই তা মিথ্যা প্রমাণিত করে। তা ছাড়া প্রশাসনের রল্প্রেব্দ রল্প্রেব্দ দুর্নীতি, অনিয়ম এবং একাধিক অসঙ্গতি তো আছেই। এ সবকিছুকেই আমি বিভিন্ন আঙ্গিকের সংকট বলতে চাই। আরও দুঃখজনক যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা সংকটের নীরব দর্শক। মনেই হয় না এর প্রশমনে আমাদের কোনো ভূমিকা থাকতে পারে।
আগের কথায় ফিরে যাই। সংকট যখন ঘনীভূত হয় এবং Things are fall apart আমরা তো তা ঠেকাতে যূথবদ্ধ হতে পারি, জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে পারি এবং তার ভিত্তিতে জাতীয় ইস্যুগুলোর সমাধানে জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তুলতে পারি। নতুবা রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় মতবিভেদ, বিদ্বেষ ও কলহে আমরাই এক পর্যায়ে নিঃশেষ হয়ে যাব।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় যেন আমাদের সমস্যা-সংকটের কেবল মাত্র শুরু; অনেক পথ সামনে বাকি। আমরা হয়তো একদিন থাকব না, কিন্তু আমাদের উত্তরপুরুষ থাকবে। তারা হয়তো আমাদের মতো কূটতর্কে সময়ক্ষেপণ না করে সংকটকালে যূথবদ্ধ থেকে সামনে এগোবে। নতুবা পরস্পরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কলহে লিপ্ত হলেই পতনের সমূহ আশঙ্কা।
ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ
সাবেক মহাপরিচালক বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক
No comments