প্রথম রাউন্ডের সাফল্য সরকারকে যেন অসতর্ক না করে by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
হাসিনা সরকার এক অসমসাহসী যুদ্ধে নেমেছে। এক সঙ্গে একাধিক ফ্রন্টে যুদ্ধ করার রেকর্ড বঙ্গবন্ধু সরকারেরও নেই। এক ফ্রন্টে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, দ্বিতীয় ফ্রন্টে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের অভ্যুত্থানের মোকাবেলা, তৃতীয় ফ্রন্টে বিএনপি-জামায়াতের দেশময় ধ্বংসাত্মক তৎপরতা, চতুর্থ ফ্রন্টে নিরপেক্ষতার মুখোশধারী এলিট শ্রেণীর একটি প্রভাবশালী অংশের দ্বারা সরকারকে ডিসক্রেডিট করার জন্য সেমিনার-গোলটেবিল অনুষ্ঠানের নামে 'সফিসটিকেটেড' প্রচার অভিযান।
অর্থাৎ সরকার মূলত চার ফ্রন্টে যুদ্ধরত। শেখ হাসিনা একা কতদিক সামলাবেন? তার সরকারের একটা প্রশাসনিক সীমাবদ্ধতা আছে। তিনি ইন্দিরা গান্ধী বা মার্গারেট থ্যাচারের মতো লৌহমানবীও হতে চান না। সে সুযোগও তার নেই। তার প্রশাসন ঢিলেঢালা। মন্ত্রীদের অধিকাংশই তার অনুগত, কিন্তু তাদের মধ্যে দক্ষতা ও যোগ্যতার অভাব। সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগের এখন খুবই নাজুক অবস্থা। একেবারে তৃণমূল পর্যন্ত অন্তর্দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত আওয়ামী লীগ। অধিকাংশ আওয়ামী সাংসদের বিরুদ্ধে যে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে, তাতে তারা নিজেদের নির্বাচনী এলাকায় যেতে সাহস পান না, বিএনপি-জামায়াতের চ্যালেঞ্জ তারা মোকাবেলা করবেন কীভাবে?
আওয়ামী লীগ সম্পর্কে আরেকটি বড় আশঙ্কার বিষয়, শর্ষের মধ্যে ভূত ঢোকার মতো এই দলের ভেতরেও জামায়াতিদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। আমার কাছে অন্তত দশটি জেলার আওয়ামী লীগের খবর আছে, সেসব জেলায় আওয়ামী লীগের কর্মকর্তারা জামায়াতিদের সঙ্গে নিয়ে চুটিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন এবং রাজনৈতিক সংকটের সময় তারাই জামায়াতি দুর্বৃত্তদের প্রটেকশন দিচ্ছেন। ছাত্রদল ও শিবিরের ক্যাডাররা যদি মুখোশ পাল্টে ছাত্রলীগ ও যুব লীগে ঢুকে সন্ত্রাস চালায়, তাহলে দোষটা চাপে ছাত্রলীগের ঘাড়েই। আওয়ামী লীগ এই অনুপ্রবেশ রোধেও ব্যর্থ হয়েছে।
কথায় বলে, 'প্রচার যুদ্ধে জয়, যুদ্ধজয়ের অর্ধেকটার বেশি।' আওয়ামী লীগের প্রচারযন্ত্র এতই দুর্বল যে, যুদ্ধে বারবার জিতেও তারা হারে। আওয়ামী লীগ সত্যকে প্রতিষ্ঠাদান করতে পারে না। কিন্তু বিএনপি ও জামায়াত সর্বৈব মিথ্যাকেও সত্য বলে প্রতিষ্ঠাদান করতে পারে। এটা মতিঝিলে হেফাজতিদের সঙ্গে ৫ মের শোডাউনের পরও দেখা গেছে। সত্য হচ্ছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নূ্যনতম শক্তি প্রয়োগে, নূ্যনতম রক্তপাত ঘটিয়ে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের এক ভয়াবহ অভ্যুত্থান থেকে দেশকে রক্ষা করেছে। আওয়ামী লীগ এই সত্যটি প্রতিষ্ঠা করতে পারছে না। কিন্তু পরাজিত বিএনপি-জামায়াত জোট এই মিথ্যাটিকে তুলনামূলকভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারছে যে, হেফাজতি সমাবেশ ভেঙে দেওয়ার জন্য পুলিশের গুলিতে দুই হাজার লোক নিহত হয়েছে।
আমার এক ব্যবসায়ী বন্ধু ঢাকা থেকে লন্ডনে এসেছেন। ৫ মে তিনি ঢাকায় ছিলেন। তিনি বললেন, শহরে ওইদিন হেফাজতিরা যে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করেছিল, তা দমন করতে অন্য কোনো দেশ হলে পুলিশের গুলিতে রক্তের বন্যা বইত। কিন্তু মতিঝিল অভ্যুত্থান দমনে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি যে প্রিসিশন, সংযম এবং রক্তপাত এড়ানোর কাজে দক্ষতা দেখিয়েছে, তৃতীয় বিশ্বের কোনো দেশে তার তুলনা বিরল। এ জন্য তাদের বিপুলভাবে প্রশংসিত হওয়া উচিত। প্রশংসিত হওয়া উচিত সরকারেরও।
কিন্তু মিথ্যা প্রচার দ্বারা এই সত্যটি চেপে রেখে বিএনপি-জামায়াত প্রচার চালাচ্ছে, এই অভিযানে যৌথ বাহিনী দুই থেকে আড়াই হাজার লোক হত্যা করেছে। আমার ব্যবসায়ী বন্ধুর অভিযোগ, এটা শুধু সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচার নয়, দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর প্রশংসনীয় ভূমিকাকে খাটো করে দেশবাসীর কাছে তাদের নিন্দিত করার অপচেষ্টা। শুধু সরকারের নয়, দেশের সচেতন বুদ্ধিজীবীদেরও উচিত, সম্মিলিতভাবে এই মিথ্যা প্রচার খণ্ডন করা। এ ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতার ভান করে নিশ্চুপ থাকার অর্থ হবে দেশে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী অভ্যুত্থানের চক্রান্তকে কার্যত সাহায্য জোগানো। গত শতকের মধ্যভাগে ইউরোপে এ ধরনের কিছু বুদ্ধিজীবীর ভূমিকার জন্যই ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদের অভ্যুত্থান সম্ভব হয়েছিল।
সরকার ইচ্ছা করে ক্র্যাকডাউনে যায়নি। ৬ এপ্রিলেও মতিঝিল শাপলা চত্বরে হেফাজতের বিশাল সমাবেশ হয়েছে এবং নিজেদের দাবি-দাওয়া জানিয়ে তারা নির্দিষ্ট সময়ে শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ শেষ করেছে। কোনো গণ্ডগোল হয়নি। হেফাজতিরা শহরে লুটপাট, অগি্নসংযোগ শুরু করেনি, যৌথ বাহিনীকেও তাদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ করতে হয়নি। তাহলে ৫ মে সেই একই মতিঝিলে এই দুর্বিপাক কেন ঘটল?
বিএনপি ও জামায়াত প্রচুর অর্থের বিনিময়ে কিছু হেফাজতি নেতাকে বশ করেছে এবং তাদের ভেতর ঢুকে গেছে_ এটা জানা থাকা সত্ত্বেও পুলিশ হেফাজতিদের প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করে সমাবেশ করতে অনুমতি দিয়েছে। হেফাজতিরাও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তারা শান্তিপূর্ণভাবে নির্দিষ্ট সময়ে তাদের সমাবেশ শেষ করবে। তারা তা করেনি। বরং সংঘবদ্ধভাবে বায়তুল মোকাররম এলাকায় লুটতরাজ, অগি্নসংযোগ শুরু করে। এমনকি অনির্দিষ্টকাল সমাবেশ চলতে থাকবে_ এমন আভাস দেয়। শুরু হয় একাধিক ব্যাংকের ভল্ট ভেঙে অর্থ লট এবং রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি বেপরোয়াভাবে ধ্বংস করা।
এই ধ্বংসযজ্ঞ, প্রকাশ্য রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতার সামনে যৌথ বাহিনী কি নিষ্ক্রিয় থাকবে, রামধুন গাইবে? তারা যথাকর্তব্য পালন করেছে। দেশ এবং রাষ্ট্রকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছে। মতিঝিলের সমাবেশ থেকে সহিংস পন্থায় ক্ষমতা দখল করে পরদিন ৬ মে নতুন সরকার গঠন করারও স্লোগান দেওয়া হয়েছিল। একটি স্লোগান ছিল_'রাষ্ট্রপতি হবেন কে, শফী ছাড়া আর কে?' এই শফী হেফাজতের প্রধান নেতা আল্লামা শফী।
আগে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা নেতারা সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেছেন। এখন বিএনপি ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতায় যেতে চায়। আর জামায়াতিরা চায় হেফাজতিদের মুখোশ ধারণ করে ধ্বংসাত্মক তৎপরতা দ্বারা '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল এবং গণতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটিয়ে দেশে তালেবানি ধরনের মধ্যযুগীয় শাসন কায়েম করতে। বিএনপি ও জামায়াতের এই দুই ইচ্ছার মিলনে এবং হেফাজতের সহযোগিতায় ৫ মের অভ্যুত্থানের পরিকল্পনাটি তৈরি করা হয়েছিল। গণতান্ত্রিক সরকার এই অভ্যুত্থান ব্যর্থ করে দিয়ে প্রমাণ করল, গণতন্ত্র শুধু মেষশাবক নয়, তারও সিংহের দাঁত রয়েছে। জাতি আপাতত পঁচাত্তরের মতো আরেকটি বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেয়েছে।
এখন বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির একমাত্র মূলধন, যৌথ বাহিনীর ৫ মের অভিযানে দুই হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে এই প্রচার। দেশের কিছু মানুষের কাছে এই প্রচার সাময়িকভাবে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পারা গেলেও সত্য বেশিদিন চাপা থাকবে না। সত্যের ঢাক আপনিই বাজে। কিছুদিনের মধ্যে বিএনপি-জামায়াত সেই ঢাকের বাজনা শুনতে পাবে। ৫ মের পর সাত দিন না যেতেই তাদের মহাঅভ্যুত্থান পরিকল্পনার কথা ফাঁস হতে শুরু করেছে।
মাওলানা বাবুনগরীসহ ধৃত হেফাজত নেতারা পুলিশের কাছে কবুল করেছেন, হেফাজতিদের সামনে শিখণ্ডীর মতো খাড়া করে ৫ মের সমাবেশ ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে জামায়াতিরা। শাপলা চত্বরের মহাসমাবেশ যখন শেষ হওয়ার কথা ছিল, অধিকাংশ হেফাজতি নেতা তখন সভামঞ্চ ত্যাগ করে চলে যান। মঞ্চ দখল করে নেয় জামায়াত-শিবির। তাদের পরিকল্পনা ছিল সমাবেশ অব্যাহত রাখা এবং পরদিন আওয়ামী লীগ সরকারকে দেওয়া বিএনপির ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটামের সময় যখন শেষ হবে, তখন একযোগে সারাদেশে গোলযোগ সৃষ্টি করে প্রশাসন অচল করে দিয়ে সরকারের পতন ঘটানো। বিএনপি-জামায়াতের এই রাষ্ট্রদ্রোহমূলক পরিকল্পনার কথা হেফাজত নেতাদের আগে জাগানো হয়নি, তারা তা জানতেন না। তাদের শুধু ব্যবহার করা হয়েছে।
একই কথা বলেছেন হেফাজতের প্রধান নেতা আল্লাহ শফী ঢাকা থেকে হাটহাজারীতে ফিরে গিয়ে। তিনিও বলেছেন, মতিঝিল সমাবেশের উদ্দেশ্য তিনি জানতেন না। জানতে পেরেই তিনি সমাবেশে যাননি। হেফাজত কোনো রাজনৈতিক দল নয়। সরকারের সঙ্গে বিবাদে যাওয়ার বা রক্তপাত ঘটানোর কোনো ইচ্ছা হেফাজতের নেই। তারা একটি ধর্মীয় দল হিসেবেই তাদের ভূমিকা রাখতে চায়।
আল্লামা শফীর এই উক্তি যে কথার কথা নয়, সম্ভবত সেটা প্রমাণ করার জন্যই হেফাজত রোববার (১২ মে) যে হরতাল ডেকেছিল, তা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। অমনি জামায়াত ওইদিন হরতাল ডেকেছে। অর্থাৎ হেফাজতি মুখোশটি ছিঁড়ে যেতেই জামায়াত সঙ্গে সঙ্গে তার আসল রূপ নিয়ে বেরিয়ে এসেছে। বিএনপির ডাকা ৮ ও ৯ মের ব্যর্থ হরতালের চেহারা দেখেই অনুমান করতে কষ্ট হয় না, রোববারের জামায়াতি হরতালেও কী ঘটবে। জনসমর্থন তাদের কপালে নেই। সন্ত্রাসী শক্তি বেশি। সুতরাং রোববার ঢাকাসহ দেশের কয়েকটি স্থানে জামায়াত-শিবির ধ্বংসাত্মক তৎপরতা চালানোর চেষ্টা করবে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এ ক্ষেত্রে আরও কঠোর ভূমিকা নিতে হবে। জামায়াতিদের জন্য লাঠ্যৌষধির চেয়ে বড় ওষুধ আর কিছু নেই।
গত কয়েক মাস যাবৎ বিএনপি-জামায়াতের ক্রমবর্ধমান সহিংস তৎপরতা এবং সরকারের এপিজমেন্ট পলিসির দরুন দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কে গণতান্ত্রিক শিবিরে একটা হতাশার ও ডিফিটিজমের ভাব দেখা দিয়েছিল। সন্দেহ নেই, মতিঝিলের ৫ মের শোডাউনের একটা পজিটিভ দিক হলো, গণতান্ত্রিক শিবিরে এই ডিফিটিজমের ভাব অনেকটা দূর হয়েছে এবং সরকারেরও মনোবল চাঙ্গা হয়েছে। এর ফলেই বিএনপির ডাকা হরতাল চলাকালেই (৯ মে বৃহস্পতিবার) ট্রাইব্যুনাল '৭১-এর যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ডাদেশ ঘোষণা করতে দ্বিধা করেননি। যুদ্ধাপরাধীদের পালের গোদা গোলাম আযমেরও বিচারের রায় হয়তো দু'চারদিনের মধ্যে ঘোষিত হবে।
বিএনপি নেত্রীর সরকারকে দেওয়া ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম একদম মাঠে মারা গেছে। দলের কয়েকজন প্রধান নেতা গ্রেফতার হওয়ার ভয়ে পলাতক। বিএনপি মুখ রক্ষার জন্য আরেকটি সমাবেশ ডেকেছে। সরকারের তাতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আওয়ামী লীগের এখন সর্বাগ্রে দরকার দল ও সরকারের প্রচার শক্তি বৃদ্ধি করা। বিএনপি-জামায়াতের মিথ্যা প্রচারের উপযুক্ত জবাব দেওয়া। বিএনপি-জামায়াতের যে 'ডার্টি ডজন' তথাকথিত বুদ্ধিজীবী, কলামিস্ট ও টক শোর স্পিকার আছেন, তাদের প্রত্যেকটি মিথ্যা প্রচার খণ্ডনের ব্যবস্থা করা।
সবচেয়ে বড় কথা, গণতন্ত্রের শত্রুদের অভ্যুত্থানের প্রথম রাউন্ড যুদ্ধে (৫ মে) জয়ী হয়ে সরকার যেন কঠোর অবস্থান থেকে না সরে। বরং আরও কঠোরতার সঙ্গে দেশের মাটি থেকে এই গণশত্রুদের নির্মূল করার ব্যবস্থা নেয়। একাত্তরের যুদ্ধজয়-পরবর্তী আত্মসন্তোষ ও শত্রুশিবির সম্পর্কে শৈথিল্য এবং অসতর্কতার ভাব যেন এবারেও দেখা না দেয়।
আওয়ামী লীগ সম্পর্কে আরেকটি বড় আশঙ্কার বিষয়, শর্ষের মধ্যে ভূত ঢোকার মতো এই দলের ভেতরেও জামায়াতিদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। আমার কাছে অন্তত দশটি জেলার আওয়ামী লীগের খবর আছে, সেসব জেলায় আওয়ামী লীগের কর্মকর্তারা জামায়াতিদের সঙ্গে নিয়ে চুটিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন এবং রাজনৈতিক সংকটের সময় তারাই জামায়াতি দুর্বৃত্তদের প্রটেকশন দিচ্ছেন। ছাত্রদল ও শিবিরের ক্যাডাররা যদি মুখোশ পাল্টে ছাত্রলীগ ও যুব লীগে ঢুকে সন্ত্রাস চালায়, তাহলে দোষটা চাপে ছাত্রলীগের ঘাড়েই। আওয়ামী লীগ এই অনুপ্রবেশ রোধেও ব্যর্থ হয়েছে।
কথায় বলে, 'প্রচার যুদ্ধে জয়, যুদ্ধজয়ের অর্ধেকটার বেশি।' আওয়ামী লীগের প্রচারযন্ত্র এতই দুর্বল যে, যুদ্ধে বারবার জিতেও তারা হারে। আওয়ামী লীগ সত্যকে প্রতিষ্ঠাদান করতে পারে না। কিন্তু বিএনপি ও জামায়াত সর্বৈব মিথ্যাকেও সত্য বলে প্রতিষ্ঠাদান করতে পারে। এটা মতিঝিলে হেফাজতিদের সঙ্গে ৫ মের শোডাউনের পরও দেখা গেছে। সত্য হচ্ছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নূ্যনতম শক্তি প্রয়োগে, নূ্যনতম রক্তপাত ঘটিয়ে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের এক ভয়াবহ অভ্যুত্থান থেকে দেশকে রক্ষা করেছে। আওয়ামী লীগ এই সত্যটি প্রতিষ্ঠা করতে পারছে না। কিন্তু পরাজিত বিএনপি-জামায়াত জোট এই মিথ্যাটিকে তুলনামূলকভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারছে যে, হেফাজতি সমাবেশ ভেঙে দেওয়ার জন্য পুলিশের গুলিতে দুই হাজার লোক নিহত হয়েছে।
আমার এক ব্যবসায়ী বন্ধু ঢাকা থেকে লন্ডনে এসেছেন। ৫ মে তিনি ঢাকায় ছিলেন। তিনি বললেন, শহরে ওইদিন হেফাজতিরা যে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করেছিল, তা দমন করতে অন্য কোনো দেশ হলে পুলিশের গুলিতে রক্তের বন্যা বইত। কিন্তু মতিঝিল অভ্যুত্থান দমনে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি যে প্রিসিশন, সংযম এবং রক্তপাত এড়ানোর কাজে দক্ষতা দেখিয়েছে, তৃতীয় বিশ্বের কোনো দেশে তার তুলনা বিরল। এ জন্য তাদের বিপুলভাবে প্রশংসিত হওয়া উচিত। প্রশংসিত হওয়া উচিত সরকারেরও।
কিন্তু মিথ্যা প্রচার দ্বারা এই সত্যটি চেপে রেখে বিএনপি-জামায়াত প্রচার চালাচ্ছে, এই অভিযানে যৌথ বাহিনী দুই থেকে আড়াই হাজার লোক হত্যা করেছে। আমার ব্যবসায়ী বন্ধুর অভিযোগ, এটা শুধু সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচার নয়, দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর প্রশংসনীয় ভূমিকাকে খাটো করে দেশবাসীর কাছে তাদের নিন্দিত করার অপচেষ্টা। শুধু সরকারের নয়, দেশের সচেতন বুদ্ধিজীবীদেরও উচিত, সম্মিলিতভাবে এই মিথ্যা প্রচার খণ্ডন করা। এ ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতার ভান করে নিশ্চুপ থাকার অর্থ হবে দেশে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী অভ্যুত্থানের চক্রান্তকে কার্যত সাহায্য জোগানো। গত শতকের মধ্যভাগে ইউরোপে এ ধরনের কিছু বুদ্ধিজীবীর ভূমিকার জন্যই ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদের অভ্যুত্থান সম্ভব হয়েছিল।
সরকার ইচ্ছা করে ক্র্যাকডাউনে যায়নি। ৬ এপ্রিলেও মতিঝিল শাপলা চত্বরে হেফাজতের বিশাল সমাবেশ হয়েছে এবং নিজেদের দাবি-দাওয়া জানিয়ে তারা নির্দিষ্ট সময়ে শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ শেষ করেছে। কোনো গণ্ডগোল হয়নি। হেফাজতিরা শহরে লুটপাট, অগি্নসংযোগ শুরু করেনি, যৌথ বাহিনীকেও তাদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ করতে হয়নি। তাহলে ৫ মে সেই একই মতিঝিলে এই দুর্বিপাক কেন ঘটল?
বিএনপি ও জামায়াত প্রচুর অর্থের বিনিময়ে কিছু হেফাজতি নেতাকে বশ করেছে এবং তাদের ভেতর ঢুকে গেছে_ এটা জানা থাকা সত্ত্বেও পুলিশ হেফাজতিদের প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করে সমাবেশ করতে অনুমতি দিয়েছে। হেফাজতিরাও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তারা শান্তিপূর্ণভাবে নির্দিষ্ট সময়ে তাদের সমাবেশ শেষ করবে। তারা তা করেনি। বরং সংঘবদ্ধভাবে বায়তুল মোকাররম এলাকায় লুটতরাজ, অগি্নসংযোগ শুরু করে। এমনকি অনির্দিষ্টকাল সমাবেশ চলতে থাকবে_ এমন আভাস দেয়। শুরু হয় একাধিক ব্যাংকের ভল্ট ভেঙে অর্থ লট এবং রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি বেপরোয়াভাবে ধ্বংস করা।
এই ধ্বংসযজ্ঞ, প্রকাশ্য রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতার সামনে যৌথ বাহিনী কি নিষ্ক্রিয় থাকবে, রামধুন গাইবে? তারা যথাকর্তব্য পালন করেছে। দেশ এবং রাষ্ট্রকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছে। মতিঝিলের সমাবেশ থেকে সহিংস পন্থায় ক্ষমতা দখল করে পরদিন ৬ মে নতুন সরকার গঠন করারও স্লোগান দেওয়া হয়েছিল। একটি স্লোগান ছিল_'রাষ্ট্রপতি হবেন কে, শফী ছাড়া আর কে?' এই শফী হেফাজতের প্রধান নেতা আল্লামা শফী।
আগে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা নেতারা সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেছেন। এখন বিএনপি ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতায় যেতে চায়। আর জামায়াতিরা চায় হেফাজতিদের মুখোশ ধারণ করে ধ্বংসাত্মক তৎপরতা দ্বারা '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল এবং গণতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটিয়ে দেশে তালেবানি ধরনের মধ্যযুগীয় শাসন কায়েম করতে। বিএনপি ও জামায়াতের এই দুই ইচ্ছার মিলনে এবং হেফাজতের সহযোগিতায় ৫ মের অভ্যুত্থানের পরিকল্পনাটি তৈরি করা হয়েছিল। গণতান্ত্রিক সরকার এই অভ্যুত্থান ব্যর্থ করে দিয়ে প্রমাণ করল, গণতন্ত্র শুধু মেষশাবক নয়, তারও সিংহের দাঁত রয়েছে। জাতি আপাতত পঁচাত্তরের মতো আরেকটি বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেয়েছে।
এখন বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির একমাত্র মূলধন, যৌথ বাহিনীর ৫ মের অভিযানে দুই হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে এই প্রচার। দেশের কিছু মানুষের কাছে এই প্রচার সাময়িকভাবে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পারা গেলেও সত্য বেশিদিন চাপা থাকবে না। সত্যের ঢাক আপনিই বাজে। কিছুদিনের মধ্যে বিএনপি-জামায়াত সেই ঢাকের বাজনা শুনতে পাবে। ৫ মের পর সাত দিন না যেতেই তাদের মহাঅভ্যুত্থান পরিকল্পনার কথা ফাঁস হতে শুরু করেছে।
মাওলানা বাবুনগরীসহ ধৃত হেফাজত নেতারা পুলিশের কাছে কবুল করেছেন, হেফাজতিদের সামনে শিখণ্ডীর মতো খাড়া করে ৫ মের সমাবেশ ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে জামায়াতিরা। শাপলা চত্বরের মহাসমাবেশ যখন শেষ হওয়ার কথা ছিল, অধিকাংশ হেফাজতি নেতা তখন সভামঞ্চ ত্যাগ করে চলে যান। মঞ্চ দখল করে নেয় জামায়াত-শিবির। তাদের পরিকল্পনা ছিল সমাবেশ অব্যাহত রাখা এবং পরদিন আওয়ামী লীগ সরকারকে দেওয়া বিএনপির ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটামের সময় যখন শেষ হবে, তখন একযোগে সারাদেশে গোলযোগ সৃষ্টি করে প্রশাসন অচল করে দিয়ে সরকারের পতন ঘটানো। বিএনপি-জামায়াতের এই রাষ্ট্রদ্রোহমূলক পরিকল্পনার কথা হেফাজত নেতাদের আগে জাগানো হয়নি, তারা তা জানতেন না। তাদের শুধু ব্যবহার করা হয়েছে।
একই কথা বলেছেন হেফাজতের প্রধান নেতা আল্লাহ শফী ঢাকা থেকে হাটহাজারীতে ফিরে গিয়ে। তিনিও বলেছেন, মতিঝিল সমাবেশের উদ্দেশ্য তিনি জানতেন না। জানতে পেরেই তিনি সমাবেশে যাননি। হেফাজত কোনো রাজনৈতিক দল নয়। সরকারের সঙ্গে বিবাদে যাওয়ার বা রক্তপাত ঘটানোর কোনো ইচ্ছা হেফাজতের নেই। তারা একটি ধর্মীয় দল হিসেবেই তাদের ভূমিকা রাখতে চায়।
আল্লামা শফীর এই উক্তি যে কথার কথা নয়, সম্ভবত সেটা প্রমাণ করার জন্যই হেফাজত রোববার (১২ মে) যে হরতাল ডেকেছিল, তা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। অমনি জামায়াত ওইদিন হরতাল ডেকেছে। অর্থাৎ হেফাজতি মুখোশটি ছিঁড়ে যেতেই জামায়াত সঙ্গে সঙ্গে তার আসল রূপ নিয়ে বেরিয়ে এসেছে। বিএনপির ডাকা ৮ ও ৯ মের ব্যর্থ হরতালের চেহারা দেখেই অনুমান করতে কষ্ট হয় না, রোববারের জামায়াতি হরতালেও কী ঘটবে। জনসমর্থন তাদের কপালে নেই। সন্ত্রাসী শক্তি বেশি। সুতরাং রোববার ঢাকাসহ দেশের কয়েকটি স্থানে জামায়াত-শিবির ধ্বংসাত্মক তৎপরতা চালানোর চেষ্টা করবে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এ ক্ষেত্রে আরও কঠোর ভূমিকা নিতে হবে। জামায়াতিদের জন্য লাঠ্যৌষধির চেয়ে বড় ওষুধ আর কিছু নেই।
গত কয়েক মাস যাবৎ বিএনপি-জামায়াতের ক্রমবর্ধমান সহিংস তৎপরতা এবং সরকারের এপিজমেন্ট পলিসির দরুন দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কে গণতান্ত্রিক শিবিরে একটা হতাশার ও ডিফিটিজমের ভাব দেখা দিয়েছিল। সন্দেহ নেই, মতিঝিলের ৫ মের শোডাউনের একটা পজিটিভ দিক হলো, গণতান্ত্রিক শিবিরে এই ডিফিটিজমের ভাব অনেকটা দূর হয়েছে এবং সরকারেরও মনোবল চাঙ্গা হয়েছে। এর ফলেই বিএনপির ডাকা হরতাল চলাকালেই (৯ মে বৃহস্পতিবার) ট্রাইব্যুনাল '৭১-এর যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ডাদেশ ঘোষণা করতে দ্বিধা করেননি। যুদ্ধাপরাধীদের পালের গোদা গোলাম আযমেরও বিচারের রায় হয়তো দু'চারদিনের মধ্যে ঘোষিত হবে।
বিএনপি নেত্রীর সরকারকে দেওয়া ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম একদম মাঠে মারা গেছে। দলের কয়েকজন প্রধান নেতা গ্রেফতার হওয়ার ভয়ে পলাতক। বিএনপি মুখ রক্ষার জন্য আরেকটি সমাবেশ ডেকেছে। সরকারের তাতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আওয়ামী লীগের এখন সর্বাগ্রে দরকার দল ও সরকারের প্রচার শক্তি বৃদ্ধি করা। বিএনপি-জামায়াতের মিথ্যা প্রচারের উপযুক্ত জবাব দেওয়া। বিএনপি-জামায়াতের যে 'ডার্টি ডজন' তথাকথিত বুদ্ধিজীবী, কলামিস্ট ও টক শোর স্পিকার আছেন, তাদের প্রত্যেকটি মিথ্যা প্রচার খণ্ডনের ব্যবস্থা করা।
সবচেয়ে বড় কথা, গণতন্ত্রের শত্রুদের অভ্যুত্থানের প্রথম রাউন্ড যুদ্ধে (৫ মে) জয়ী হয়ে সরকার যেন কঠোর অবস্থান থেকে না সরে। বরং আরও কঠোরতার সঙ্গে দেশের মাটি থেকে এই গণশত্রুদের নির্মূল করার ব্যবস্থা নেয়। একাত্তরের যুদ্ধজয়-পরবর্তী আত্মসন্তোষ ও শত্রুশিবির সম্পর্কে শৈথিল্য এবং অসতর্কতার ভাব যেন এবারেও দেখা না দেয়।
No comments