নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিন: ড. মুহাম্মদ ইউনূস
ক্ষুদ্রঋণের উদ্যোক্তা এবং এর প্রসারের
জন্যই ড. মুহাম্মদ ইউনূস সমধিক পরিচিত। বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ
বেসামরিক পদক কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল গ্রহণ করে অসামান্য উচ্চতায় নিয়ে
গেছেন বাংলাদেশকে। এর আগে ২০০৬ সালে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অর্জন করেছিলেন
নোবেল পুরস্কার।
গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়ে যে
মানুষটির সাফল্যের শুরু তা আজ বিশ্বস্বীকৃত। সারা বিশ্বে ক্ষুদ্রঋণ
গ্রহীতার সংখ্যা প্রায় ২০ কোটিতে পৌঁছে গেছে। বাংলাদেশে ৮৪ লাখ ক্ষুদ্রঋণ
গ্রহীতার মধ্যে ৯৬ ভাগই নারী। ইউনূস গরিবদের মধ্যে সেবা পৌঁছে দেয়ার জন্য
দেশের সবচেয়ে বড় মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোনসহ আরও বেশ কিছু সেবা ও
পণ্যের উদ্যোগ নিয়েছেন। গত দু’বছর ধরে তিনি এবং তার কর্মকাণ্ড বাংলাদেশ
সরকারের হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। এ বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের নিউ
ইয়র্ক টাইমসসহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছে। সমপ্রতি নিউ ইয়র্ক
টাইমসের ডেভিড বার্নস্টেইনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মুহাম্মদ ইউনূস নিজের
জীবন, সামাজিক ব্যবসার ভূমিকা এবং দারিদ্র্যমুক্ত একটি পৃথিবী গড়ে তোলার
স্বপ্নের ব্যাপারে বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। বলেছেন নিজের সিদ্ধান্ত নিজেরই
নেয়ার কথা। তার সেই সাক্ষাৎকারটি এখানে তুলে ধরা হলো:
নিউ ইয়র্ক টাইমস: ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে আজ অনেক বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। কখন এবং কিভাবে এটি শুরু হয়েছিল? আসলেই কি এটা কার্যকর?
মুহাম্মদ ইউনূস: ২০০৮ সালে সারা বিশ্বের অর্থনৈতিক সঙ্কট শুরু হওয়ার অনেক আগেই আমাদের মধ্যে অনেকে বলেছিলেন যে, অর্থ ব্যবস্থাপনা (ফিন্যান্সিয়াল সিস্টেম)-কে আমাদেরকে নতুন করে বিন্যস্ত করা উচিত। প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থা যা করতে পারে না মানুষের কাছে পৌঁছানোর মাধ্যমে ক্ষুদ্রঋণ সেটাই করে দেখিয়েছে। এর মাধ্যমে দেখানো হয়েছে এটি কোন অসাধ্য কাজ নয়। আমরা যখন ক্ষুদ্রঋণের পরিকল্পনা করছিলাম তখন এর উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে দারিদ্র্য থেকে বেড়িয়ে আসতে সহযোগিতা করা। কিন্তু কিছু লোক এ উদ্দীপনা থেকে সরে গেছেন। গ্রামীণ এখনও সেই আগের মতোই রয়েছে। এটি দরিদ্রতম নারীদের কাছে পৌঁছেছে এবং দেখিয়েছে নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও এটি কার্যকর। পরবর্তী প্রজন্মের শিশুরা গ্রামীণ ব্যাংকে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের সুবিধা পেয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংকে এখন প্রায় ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতাদের একাউন্টে ১০০ কোটি ডলার রয়েছে। আর এ প্রতিষ্ঠানের ৯৭ ভাগের মালিক ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতারা। কেউ যদি ত্রুটিপূর্ণ ভাবে এটি অনুকরণের চেষ্টা করে, সেটার অর্থ এই নয় যে, দরিদ্র জনগণকে ঋণ দেয়ার বিষয়টি ত্রুটিপূর্ণ হয়ে গেল। এটাকে সঠিক ভাবে পরিচালনা করাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
আপনি প্রায়ই নতুন এক ধরনের ব্যবসার কথা বলেন। যেটাকে আপনি সামাজিক ব্যবসা বলে উল্লেখ করেন। এটি সামাজিক দায়বদ্ধতার ব্যবসা বলে যেটা বুঝি সেটা থেকে একেবারেই আলাদা।
আমি যার প্রসার ঘটাতে চাইছি সেটি একেবারেই আলাদা। আমি ব্যক্তিগত লাভের বিষয়টিকে নাকচ করে মানুষ ও কাজের ওপর বিশেষ ভাবে জোর দিচ্ছি। একেই আমি সামাজিক ব্যবসা বলে উল্লেখ করছি। এটি একটি লভ্যাংশবিহীন কোম্পানি। এর লক্ষ্য হচ্ছে মানবিক সমস্যার সমাধান করা। নিজের লাভের কথা চিন্তা না করে এতে একজন ব্যক্তি কেবল সমস্যা সমাধানের দিকেই মনোনিবেশ করবে। কোম্পানি লাভবান হবে। তবে সেই লাভ কোম্পানিতেই থাকবে। মালিক কেবল তার প্রকৃত বিনিয়োগ ফেরত পাবেন। আর কিছু নয়। আমি লাভজনক ব্যবসা থেকে সবাইকে সরে আসতে বলছি না। আমি বলছি সেগুলোকে আলাদা রেখে সমান্তরাল ভাবে সেটা চলমান থাকুক। দারিদ্র্য, বেকারত্ব, পরিবেশ সমস্যার সমাধান করতে একটি টুলবক্স রয়েছে। আমি কেবল সেই বক্সে আরেকটি টুল যোগ করতে চাইছি। এটা হচ্ছে মানুষকে সমস্যা সামাধানে আরেকটি বিকল্প পথের সন্ধান দেয়া।
মানুষের এ ধরনের ব্যবসায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার প্রত্যাশা কি বাস্তবসম্মত?
আমরা যখন ক্ষুদ্রঋণ দেয়া শুরু করেছিলাম, তখন মানুষ আমাদেরকে জিজ্ঞেস করতো জামানত ছাড়া ঋণ দেয়াটা কি বাস্তবসম্মত। আমরা সেটা সম্ভব করে দেখিয়েছি। লাভকেন্দ্রিক বিষয়টি মানুষের একটি দিক মাত্র। যারা কেবল লাভবান হতে আগ্রহী তাদের মধ্যে নিঃস্বার্থের প্রবণতাও রয়েছে। আমি বলছি না পুঁজিবাদ তত্ত্ব ভুল। আমি বলতে চাইছি, এটি ঠিকমতো ব্যাখ্যা করা বা পূর্ণাঙ্গভাবে কার্যকর করা হচ্ছে না। মানুষের ভেতর যে নিঃস্বার্থ অংশটি রয়েছে সেটি এক্ষেত্রে কোন ভূমিকা রাখতে পারছে না। এর ফলে আমরা অর্থকেন্দ্রিক, মানুষের একটি মাত্রাভিত্তিক ব্যবসার ধারণা সৃষ্টি করেছি। কিন্তু মানুষ আসলে বহুমাত্রিক।
যারা বলেন ব্যবসা হওয়া উচিত মুনাফা উদ্দীপক তাদের ব্যাপারে আপনি কি বলবেন?
মানুষ মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় উঠছে। এতে তাদের উদ্দীপক কি? অর্থ বানানো একটি উদ্দীপক বটে। তবে অন্যকে সুখী করার বিষয়টি চরম উদ্দীপক। আমরা এর অংশবিশেষও খতিয়ে দেখিনি। আমি সবাইকে এর স্বাদ নেয়ার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। কারও এটি পছন্দ হলে তখন নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নেবেন। আমি নিজে এর স্বাদ নিয়েছি এবং বিষয়টি আমার কাছে বেশ চমৎকার মনে হয়েছে। এটা অর্থ উপার্জনের চেয়েও অনেক বেশি উত্তেজনাপূর্ণ।
কি কারণে এব্যাপারে আপনি এতটা আত্মবিশ্বাসী?
তরুণ প্রজন্ম এখন সামাজিক ব্যবসার ধারণা নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠছে। মুনাফাভিত্তিক ব্যবসা এখন আর আগের মতো মানুষকে আগ্রহী করে তুলতে পারছে না। এক্ষেত্রে যুদ্ধ-পরবর্তী প্রজন্মের কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। তাদের মূল প্রশ্ন, আমার জীবনে আমি কি করবো? আমার জীবনের উদ্দেশ্য কি?
বিনিয়োগ কোথা থেকে আসবে?
বিভিন্ন ব্যক্তি এবং কোম্পানির নানা ফাউন্ডেশন এবং চ্যারিটি সংস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে। এসব স্থানে শ’ শ’ কোটি ডলার অলস পড়ে রয়েছে। সামাজিক ব্যবসার জন্য দান করা অর্থের কিছু অংশ সংরক্ষিত রাখতে পারি। এর মাধ্যমে চ্যারিটির বিষয়টিকে আবার নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়া যাবে। আর এভাবেই একজন ব্যক্তি স্বয়ংসম্পন্ন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। একবার জনগণ সামাজিক অর্থায়নের বিষয়টি পছন্দ করে ফেললে তারা তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ এনে সামাজিক ব্যবসাতে বিনিয়োগ করবে।
যারা বলেন কোথা থেকে শুরু করবো তাদের ব্যাপারে কি বলবেন?
আপনার চারদিকে কি ধরনের সমস্যা রয়েছে। বসে সেগুলোর একটা তালিকা তৈরি করুন। এরপর সেগুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সাজান। যে কাজটি আপনার সবচেয়ে বেশি পছন্দের সেটি দিয়েই আপনি শুরু করুন। এরপর একটি দিয়ে শুরু করুন। ভেবে দেখুন এমন কোন ব্যবসা আপনি শুরু করতে পারেন কিনা সেটা দিয়ে সেই সমস্যার সমাধান সম্ভব। ধরুন আপনি বেকারত্বকে চিহ্নিত করলেন। বেশ। তাহলে পাঁচ জনের কর্মসংস্থানের জন্য আপনি একটি সামাজিক ব্যবসা শুরু করুন না কেন? এভাবেই সামাজিক ব্যবসা শুরু হবে। ছোট একটি সমস্যা সমাধানের মাধ্যমেই শুরু করতে হবে।
গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান পরিস্থিতি কি?
দুই বছর আগে গ্রামীণ ব্যাংক ক্ষুদ্রঋণ এবং আমার বিরুদ্ধে খুবই আগ্রাসী অভিযান শুরু করা হয়েছিল। অবস্থা দেখে মনে হয়েছিল সরকার যেন গ্রামীণ ব্যাংক দখল করে নিতে চাইছে। একটি কমিশন নিয়োগ করা হয়েছিল। তারা প্রস্তাব করেছিলেন যে, ঋণগ্রহীতাদের শেয়ার তাদেরকে ব্যাংকের কোন মালিকানা নিশ্চিত করে না। এর মালিকানা সরকারের। এর সঙ্গে বাস্তবতার মিল কোথায় সেটা আমি বুঝতে পারি না। তবে তাদের অবস্থান এটাই ছিল। আইনগত ভাবে ব্যাংকের জন্য যে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা ব্যাংক বোর্ডের রয়েছে। সেখানে সরকারের ৩ জন প্রতিনিধি রয়েছে আর ৯ জন প্রতিনিধি রয়েছে ঋণগ্রহীতাদের নির্বাচিত। তবে কমিশন বলছে বোর্ডের নির্বাচনে ত্রুটি রয়েছে। অতএব নির্বাচিত ৯ সদস্যকে বরখাস্ত করতে হবে। আসলে কি হবে সেটা আমাদের জানা নেই।
কি ঘটতে পারে বলে আপনার ধারণা?
গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানা জনগণের। আমি বিশ্বাস করি অবশেষে জনগণেরই জয় হবে। ৮৫ লাখ ঋণ গ্রহীতার সঙ্গে তাদের পরিবারের পাঁচজন করে সদস্য রয়েছেন। সব মিলিয়ে এর সঙ্গে চার কোটি মানুষ জড়িত। চার কোটি মানুষকে পরাজিত করা সম্ভব বলে আমার মনে হয় না। তারা জয়ী হবেই। সরকারি কমিশনের দেয়া সুপারিশ এখনও বাস্তবায়ন করা শুরু হয়নি। তাই গ্রামীণ ব্যাংক এখনও ঠিকই আছে। কিন্তু সরকার যদি আকস্মিক ভাবে ওইসব পরামর্শ বাস্তবায়ন শুরু করে তাহলে তাতে প্রতিষ্ঠানটির মৌলিক ক্ষতিসাধিত হবে।
জীবনের পেছনের দিকে তাকিয়ে কোন সিদ্ধান্তকে আপনার নেয়া সবচেয়ে সঠিক ছিল বলে মনে হয়?
আমার কাছে যেটা ঠিক মনে হতো আমি তাতেই ঝাঁপিয়ে পড়তাম। আমি ছিলাম একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। পাশের গ্রামের দরিদ্র মানুষের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার কোন দরকারই আমার ছিল না। কিন্তু আমি তাদের সমস্যা সমাধান করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। বিষয়টি ঠিক হচ্ছে কিনা সে সম্পর্কে আমার কোন ধারণাই ছিল না। ব্যর্থ হওয়ার ব্যাপারেও আমার কোন উদ্বেগ ছিল না। আমার নিজের পকেট থেকেই মানুষকে অর্থঋণ দিতে শুরু করেছিলাম। আর সারা বিশ্বের মানুষ আমাকে বলেছিল এটি কার্যকর হবে না। এটা একটা আকাশকুসুম কল্পনা। এটি বেশি দিন স্থায়ী হবে না। কিন্তু আমি তাদের কথা শুনিনি। আমি কেবল নিজেকে শুনেছি। আমার কাছে এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। আমি আমার নিজের মতেই অবিচল থাকি।
শিক্ষা ক্ষেত্রে আপনি কি ধরনের পরিবর্তন দেখতে চান?
বিশেষ এমবিএ কোর্স করানোর জন্য বিভাগ খোলা উচিত।
কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেল গ্রহণ করে আপনার অনুভূতি কি?
আমার কাছে বিষয়টি খুবই আবেগের। এটা কেবল একটি স্বীকৃতি নয়। সহকর্মী, বন্ধু, গ্রামীণ ব্যাংকের সব স্টাফ এবং ঋণগ্রহীতা, সামাজিক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত সবার জন্যই এটি একটি স্বীকৃতি। মার্কিন কংগ্রেস ক্ষুদ্রঋণের প্রতি মনোযোগ দিয়েছে সে জন্য আমি কংগ্রেসের কাছে কৃতজ্ঞ। অনেকেই মহৎ কাজ করেন কিন্তু সেটার স্বীকৃতি কখনওই পান না। সে বিবেচনায় আমি খুবই ভাগ্যবান।
আগামী দশকগুলোতে দারিদ্র্যের অবস্থা কি হতে পারে বলে আপনার ধারণা?
মানুষ যখন আকাশে উড়তে শেখেনি তখন থেকেই তারা চাঁদে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছে। তারা এ স্বপ্নকে কল্পবিজ্ঞানে স্থান দিয়েছে। মানুষ সবসময়ই কল্পবিজ্ঞান পছন্দ করে। স্টারট্রেকের মতো টেলিভিশন শো’র কথাই ধরুন না। এটি মানুষকে অন্য গ্যালাক্সিতে নিয়ে যাওয়ার অনুভূতি দেয়। বিজ্ঞান সব সময়ই কল্পকাহিনীকে অনুসরণ করেছে। এটা কাল্পনিক হলেও কোন না কোন ভাবে মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে। তাই আমি মানুষকে সামাজিক কল্পকাহিনী লিখতে উদ্বুদ্ধ করছি। কল্পনা করুন এমন একটি সমাজের যেখানে বর্তমান নানা সমস্যা একেবারেই অজানা। আজ যা অসম্ভব সে সবই সেই সমাজে নিয়মিত বিষয়। ঠিক এখন এ ধরনের সমাজ দৃশ্যত অসম্ভব। মনে হচ্ছে আমাদের পক্ষে কখনওই এ ধরনের সমাজে যাওয়া সম্ভব নয়। তবে আমরা যদি কল্পনা করতে পারি তাহলে আমাদের মনের দুয়ার খুলে যাবে। আমরা যদি কল্পনাই না করতে পারি তবে সেটা কখনও বাস্তবে ঘটতে পারবে না। আমরা এখন যে সামাজিক কল্পনা করতে পারি সেগুলোর মধ্যে দারিদ্র্য দূরীকরণ অন্যতম। মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলের মাধ্যমে বিশ্বাসী ইতিমধ্যেই ২০১৫ সালের মধ্যে দারিদ্র্যকে অর্ধেকে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশ সহ অনেক দেশই এটি অর্জন করবে। ২০১৫ সালের মধ্যে দারিদ্র্যকে অর্ধেকে নামিয়ে আনতে সক্ষম হলে সেটা শূন্যে নামিয়ে আনার সময়সীমা কখন? আমি বলি সেটা হচ্ছে ২০৩০ সাল। আমাদের কাছে সে সৃষ্টিশীল ক্ষমতা রয়েছে সেটা দিয়ে এটা সফল করা সম্ভব। আমরা এমন একটি বিশ্ব সৃষ্টি করতে পারি যেখানে দারিদ্র্যের কোন অস্তিত্বই থাকবে না। পরবর্তী প্রজন্মকে দারিদ্র্য দেখানোর জন্য আমাদেরকে একটি দারিদ্র্য জাদুঘর তৈরি করতে হবে। সেখানেই হবে দারিদ্র্যের অবস্থান, মানব সমাজে নয়।
বিশ্বকে পরিবর্তন করতে চায় এমন তরুণদের উদ্দেশে আপনি কি বলবেন?
প্রথমত সমগ্র বিশ্বকে পরিবর্তন করে দেয়ার মতো সৃষ্টিশীল ক্ষমতা তোমার একার মধ্যেই রয়েছে। এটা বিশ্বাস করতে শুরু করো। যখন তোমার এটা বিশ্বাস হবে তখন তুমি কিভাবে সেটা বাস্তবায়ন করবে সেটা খুঁজে বের করো। সব সময় ছোট দিয়েই শুরু করো। রাতারাতি কোন কিছু পরিবর্তন হয় না। তবে তুমি প্রক্রিয়াটা শুরু করো। বিশ্বের সমস্যা সমাধান করতে হলে তোমাকে প্রথমে মানুষের সমস্যার সমাধান করতে হবে। ব্যক্তির সমস্যা সমাধানে সফল হলে তুমি দেখবে সমস্যা সমাধান কত সহজ হয়ে গেছে। আমরা সব সময় বিশ্বের সমস্যার কথা চিন্তা করে হতাশ হয়ে পড়ি। বিশ্বের অনেক সমস্যা রয়েছে। তাই শুরুটা এভাবেই করা উচিত। প্রথমে একজন ব্যক্তির সমস্যা সমাধান করে পরে পাঁচজন ব্যক্তির সমস্যা সমাধানের জন্য লেগে পড়ো।
আগামী পাঁচ বছরে আপনি কি দেখতে চান?
কমপক্ষে বিশ্ব অর্থনীতির এক শতাংশ যেন সামাজিক ব্যবসা থেকে আসে। আমরা যদি এটা করতে সক্ষম হই, তাহলে আমার মনে হয় বিশ্বের চেহারাটাই আমূল বদলে যাবে। মানুষ এর চমৎকারিত্ব টের পাবে। এরপর খুব তাড়াতাড়িই এটি ১ থেকে ৫ শতাংশে উন্নীত হবে। এভাবেই ৫০ শতাংশ হওয়ার পথ প্রশস্ত হবে।
নিউ ইয়র্ক টাইমস: ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে আজ অনেক বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। কখন এবং কিভাবে এটি শুরু হয়েছিল? আসলেই কি এটা কার্যকর?
মুহাম্মদ ইউনূস: ২০০৮ সালে সারা বিশ্বের অর্থনৈতিক সঙ্কট শুরু হওয়ার অনেক আগেই আমাদের মধ্যে অনেকে বলেছিলেন যে, অর্থ ব্যবস্থাপনা (ফিন্যান্সিয়াল সিস্টেম)-কে আমাদেরকে নতুন করে বিন্যস্ত করা উচিত। প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থা যা করতে পারে না মানুষের কাছে পৌঁছানোর মাধ্যমে ক্ষুদ্রঋণ সেটাই করে দেখিয়েছে। এর মাধ্যমে দেখানো হয়েছে এটি কোন অসাধ্য কাজ নয়। আমরা যখন ক্ষুদ্রঋণের পরিকল্পনা করছিলাম তখন এর উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে দারিদ্র্য থেকে বেড়িয়ে আসতে সহযোগিতা করা। কিন্তু কিছু লোক এ উদ্দীপনা থেকে সরে গেছেন। গ্রামীণ এখনও সেই আগের মতোই রয়েছে। এটি দরিদ্রতম নারীদের কাছে পৌঁছেছে এবং দেখিয়েছে নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও এটি কার্যকর। পরবর্তী প্রজন্মের শিশুরা গ্রামীণ ব্যাংকে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের সুবিধা পেয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংকে এখন প্রায় ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতাদের একাউন্টে ১০০ কোটি ডলার রয়েছে। আর এ প্রতিষ্ঠানের ৯৭ ভাগের মালিক ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতারা। কেউ যদি ত্রুটিপূর্ণ ভাবে এটি অনুকরণের চেষ্টা করে, সেটার অর্থ এই নয় যে, দরিদ্র জনগণকে ঋণ দেয়ার বিষয়টি ত্রুটিপূর্ণ হয়ে গেল। এটাকে সঠিক ভাবে পরিচালনা করাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
আপনি প্রায়ই নতুন এক ধরনের ব্যবসার কথা বলেন। যেটাকে আপনি সামাজিক ব্যবসা বলে উল্লেখ করেন। এটি সামাজিক দায়বদ্ধতার ব্যবসা বলে যেটা বুঝি সেটা থেকে একেবারেই আলাদা।
আমি যার প্রসার ঘটাতে চাইছি সেটি একেবারেই আলাদা। আমি ব্যক্তিগত লাভের বিষয়টিকে নাকচ করে মানুষ ও কাজের ওপর বিশেষ ভাবে জোর দিচ্ছি। একেই আমি সামাজিক ব্যবসা বলে উল্লেখ করছি। এটি একটি লভ্যাংশবিহীন কোম্পানি। এর লক্ষ্য হচ্ছে মানবিক সমস্যার সমাধান করা। নিজের লাভের কথা চিন্তা না করে এতে একজন ব্যক্তি কেবল সমস্যা সমাধানের দিকেই মনোনিবেশ করবে। কোম্পানি লাভবান হবে। তবে সেই লাভ কোম্পানিতেই থাকবে। মালিক কেবল তার প্রকৃত বিনিয়োগ ফেরত পাবেন। আর কিছু নয়। আমি লাভজনক ব্যবসা থেকে সবাইকে সরে আসতে বলছি না। আমি বলছি সেগুলোকে আলাদা রেখে সমান্তরাল ভাবে সেটা চলমান থাকুক। দারিদ্র্য, বেকারত্ব, পরিবেশ সমস্যার সমাধান করতে একটি টুলবক্স রয়েছে। আমি কেবল সেই বক্সে আরেকটি টুল যোগ করতে চাইছি। এটা হচ্ছে মানুষকে সমস্যা সামাধানে আরেকটি বিকল্প পথের সন্ধান দেয়া।
মানুষের এ ধরনের ব্যবসায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার প্রত্যাশা কি বাস্তবসম্মত?
আমরা যখন ক্ষুদ্রঋণ দেয়া শুরু করেছিলাম, তখন মানুষ আমাদেরকে জিজ্ঞেস করতো জামানত ছাড়া ঋণ দেয়াটা কি বাস্তবসম্মত। আমরা সেটা সম্ভব করে দেখিয়েছি। লাভকেন্দ্রিক বিষয়টি মানুষের একটি দিক মাত্র। যারা কেবল লাভবান হতে আগ্রহী তাদের মধ্যে নিঃস্বার্থের প্রবণতাও রয়েছে। আমি বলছি না পুঁজিবাদ তত্ত্ব ভুল। আমি বলতে চাইছি, এটি ঠিকমতো ব্যাখ্যা করা বা পূর্ণাঙ্গভাবে কার্যকর করা হচ্ছে না। মানুষের ভেতর যে নিঃস্বার্থ অংশটি রয়েছে সেটি এক্ষেত্রে কোন ভূমিকা রাখতে পারছে না। এর ফলে আমরা অর্থকেন্দ্রিক, মানুষের একটি মাত্রাভিত্তিক ব্যবসার ধারণা সৃষ্টি করেছি। কিন্তু মানুষ আসলে বহুমাত্রিক।
যারা বলেন ব্যবসা হওয়া উচিত মুনাফা উদ্দীপক তাদের ব্যাপারে আপনি কি বলবেন?
মানুষ মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় উঠছে। এতে তাদের উদ্দীপক কি? অর্থ বানানো একটি উদ্দীপক বটে। তবে অন্যকে সুখী করার বিষয়টি চরম উদ্দীপক। আমরা এর অংশবিশেষও খতিয়ে দেখিনি। আমি সবাইকে এর স্বাদ নেয়ার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। কারও এটি পছন্দ হলে তখন নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নেবেন। আমি নিজে এর স্বাদ নিয়েছি এবং বিষয়টি আমার কাছে বেশ চমৎকার মনে হয়েছে। এটা অর্থ উপার্জনের চেয়েও অনেক বেশি উত্তেজনাপূর্ণ।
কি কারণে এব্যাপারে আপনি এতটা আত্মবিশ্বাসী?
তরুণ প্রজন্ম এখন সামাজিক ব্যবসার ধারণা নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠছে। মুনাফাভিত্তিক ব্যবসা এখন আর আগের মতো মানুষকে আগ্রহী করে তুলতে পারছে না। এক্ষেত্রে যুদ্ধ-পরবর্তী প্রজন্মের কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। তাদের মূল প্রশ্ন, আমার জীবনে আমি কি করবো? আমার জীবনের উদ্দেশ্য কি?
বিনিয়োগ কোথা থেকে আসবে?
বিভিন্ন ব্যক্তি এবং কোম্পানির নানা ফাউন্ডেশন এবং চ্যারিটি সংস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে। এসব স্থানে শ’ শ’ কোটি ডলার অলস পড়ে রয়েছে। সামাজিক ব্যবসার জন্য দান করা অর্থের কিছু অংশ সংরক্ষিত রাখতে পারি। এর মাধ্যমে চ্যারিটির বিষয়টিকে আবার নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়া যাবে। আর এভাবেই একজন ব্যক্তি স্বয়ংসম্পন্ন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। একবার জনগণ সামাজিক অর্থায়নের বিষয়টি পছন্দ করে ফেললে তারা তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ এনে সামাজিক ব্যবসাতে বিনিয়োগ করবে।
যারা বলেন কোথা থেকে শুরু করবো তাদের ব্যাপারে কি বলবেন?
আপনার চারদিকে কি ধরনের সমস্যা রয়েছে। বসে সেগুলোর একটা তালিকা তৈরি করুন। এরপর সেগুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সাজান। যে কাজটি আপনার সবচেয়ে বেশি পছন্দের সেটি দিয়েই আপনি শুরু করুন। এরপর একটি দিয়ে শুরু করুন। ভেবে দেখুন এমন কোন ব্যবসা আপনি শুরু করতে পারেন কিনা সেটা দিয়ে সেই সমস্যার সমাধান সম্ভব। ধরুন আপনি বেকারত্বকে চিহ্নিত করলেন। বেশ। তাহলে পাঁচ জনের কর্মসংস্থানের জন্য আপনি একটি সামাজিক ব্যবসা শুরু করুন না কেন? এভাবেই সামাজিক ব্যবসা শুরু হবে। ছোট একটি সমস্যা সমাধানের মাধ্যমেই শুরু করতে হবে।
গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান পরিস্থিতি কি?
দুই বছর আগে গ্রামীণ ব্যাংক ক্ষুদ্রঋণ এবং আমার বিরুদ্ধে খুবই আগ্রাসী অভিযান শুরু করা হয়েছিল। অবস্থা দেখে মনে হয়েছিল সরকার যেন গ্রামীণ ব্যাংক দখল করে নিতে চাইছে। একটি কমিশন নিয়োগ করা হয়েছিল। তারা প্রস্তাব করেছিলেন যে, ঋণগ্রহীতাদের শেয়ার তাদেরকে ব্যাংকের কোন মালিকানা নিশ্চিত করে না। এর মালিকানা সরকারের। এর সঙ্গে বাস্তবতার মিল কোথায় সেটা আমি বুঝতে পারি না। তবে তাদের অবস্থান এটাই ছিল। আইনগত ভাবে ব্যাংকের জন্য যে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা ব্যাংক বোর্ডের রয়েছে। সেখানে সরকারের ৩ জন প্রতিনিধি রয়েছে আর ৯ জন প্রতিনিধি রয়েছে ঋণগ্রহীতাদের নির্বাচিত। তবে কমিশন বলছে বোর্ডের নির্বাচনে ত্রুটি রয়েছে। অতএব নির্বাচিত ৯ সদস্যকে বরখাস্ত করতে হবে। আসলে কি হবে সেটা আমাদের জানা নেই।
কি ঘটতে পারে বলে আপনার ধারণা?
গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানা জনগণের। আমি বিশ্বাস করি অবশেষে জনগণেরই জয় হবে। ৮৫ লাখ ঋণ গ্রহীতার সঙ্গে তাদের পরিবারের পাঁচজন করে সদস্য রয়েছেন। সব মিলিয়ে এর সঙ্গে চার কোটি মানুষ জড়িত। চার কোটি মানুষকে পরাজিত করা সম্ভব বলে আমার মনে হয় না। তারা জয়ী হবেই। সরকারি কমিশনের দেয়া সুপারিশ এখনও বাস্তবায়ন করা শুরু হয়নি। তাই গ্রামীণ ব্যাংক এখনও ঠিকই আছে। কিন্তু সরকার যদি আকস্মিক ভাবে ওইসব পরামর্শ বাস্তবায়ন শুরু করে তাহলে তাতে প্রতিষ্ঠানটির মৌলিক ক্ষতিসাধিত হবে।
জীবনের পেছনের দিকে তাকিয়ে কোন সিদ্ধান্তকে আপনার নেয়া সবচেয়ে সঠিক ছিল বলে মনে হয়?
আমার কাছে যেটা ঠিক মনে হতো আমি তাতেই ঝাঁপিয়ে পড়তাম। আমি ছিলাম একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। পাশের গ্রামের দরিদ্র মানুষের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার কোন দরকারই আমার ছিল না। কিন্তু আমি তাদের সমস্যা সমাধান করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। বিষয়টি ঠিক হচ্ছে কিনা সে সম্পর্কে আমার কোন ধারণাই ছিল না। ব্যর্থ হওয়ার ব্যাপারেও আমার কোন উদ্বেগ ছিল না। আমার নিজের পকেট থেকেই মানুষকে অর্থঋণ দিতে শুরু করেছিলাম। আর সারা বিশ্বের মানুষ আমাকে বলেছিল এটি কার্যকর হবে না। এটা একটা আকাশকুসুম কল্পনা। এটি বেশি দিন স্থায়ী হবে না। কিন্তু আমি তাদের কথা শুনিনি। আমি কেবল নিজেকে শুনেছি। আমার কাছে এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। আমি আমার নিজের মতেই অবিচল থাকি।
শিক্ষা ক্ষেত্রে আপনি কি ধরনের পরিবর্তন দেখতে চান?
বিশেষ এমবিএ কোর্স করানোর জন্য বিভাগ খোলা উচিত।
কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেল গ্রহণ করে আপনার অনুভূতি কি?
আমার কাছে বিষয়টি খুবই আবেগের। এটা কেবল একটি স্বীকৃতি নয়। সহকর্মী, বন্ধু, গ্রামীণ ব্যাংকের সব স্টাফ এবং ঋণগ্রহীতা, সামাজিক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত সবার জন্যই এটি একটি স্বীকৃতি। মার্কিন কংগ্রেস ক্ষুদ্রঋণের প্রতি মনোযোগ দিয়েছে সে জন্য আমি কংগ্রেসের কাছে কৃতজ্ঞ। অনেকেই মহৎ কাজ করেন কিন্তু সেটার স্বীকৃতি কখনওই পান না। সে বিবেচনায় আমি খুবই ভাগ্যবান।
আগামী দশকগুলোতে দারিদ্র্যের অবস্থা কি হতে পারে বলে আপনার ধারণা?
মানুষ যখন আকাশে উড়তে শেখেনি তখন থেকেই তারা চাঁদে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছে। তারা এ স্বপ্নকে কল্পবিজ্ঞানে স্থান দিয়েছে। মানুষ সবসময়ই কল্পবিজ্ঞান পছন্দ করে। স্টারট্রেকের মতো টেলিভিশন শো’র কথাই ধরুন না। এটি মানুষকে অন্য গ্যালাক্সিতে নিয়ে যাওয়ার অনুভূতি দেয়। বিজ্ঞান সব সময়ই কল্পকাহিনীকে অনুসরণ করেছে। এটা কাল্পনিক হলেও কোন না কোন ভাবে মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে। তাই আমি মানুষকে সামাজিক কল্পকাহিনী লিখতে উদ্বুদ্ধ করছি। কল্পনা করুন এমন একটি সমাজের যেখানে বর্তমান নানা সমস্যা একেবারেই অজানা। আজ যা অসম্ভব সে সবই সেই সমাজে নিয়মিত বিষয়। ঠিক এখন এ ধরনের সমাজ দৃশ্যত অসম্ভব। মনে হচ্ছে আমাদের পক্ষে কখনওই এ ধরনের সমাজে যাওয়া সম্ভব নয়। তবে আমরা যদি কল্পনা করতে পারি তাহলে আমাদের মনের দুয়ার খুলে যাবে। আমরা যদি কল্পনাই না করতে পারি তবে সেটা কখনও বাস্তবে ঘটতে পারবে না। আমরা এখন যে সামাজিক কল্পনা করতে পারি সেগুলোর মধ্যে দারিদ্র্য দূরীকরণ অন্যতম। মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলের মাধ্যমে বিশ্বাসী ইতিমধ্যেই ২০১৫ সালের মধ্যে দারিদ্র্যকে অর্ধেকে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশ সহ অনেক দেশই এটি অর্জন করবে। ২০১৫ সালের মধ্যে দারিদ্র্যকে অর্ধেকে নামিয়ে আনতে সক্ষম হলে সেটা শূন্যে নামিয়ে আনার সময়সীমা কখন? আমি বলি সেটা হচ্ছে ২০৩০ সাল। আমাদের কাছে সে সৃষ্টিশীল ক্ষমতা রয়েছে সেটা দিয়ে এটা সফল করা সম্ভব। আমরা এমন একটি বিশ্ব সৃষ্টি করতে পারি যেখানে দারিদ্র্যের কোন অস্তিত্বই থাকবে না। পরবর্তী প্রজন্মকে দারিদ্র্য দেখানোর জন্য আমাদেরকে একটি দারিদ্র্য জাদুঘর তৈরি করতে হবে। সেখানেই হবে দারিদ্র্যের অবস্থান, মানব সমাজে নয়।
বিশ্বকে পরিবর্তন করতে চায় এমন তরুণদের উদ্দেশে আপনি কি বলবেন?
প্রথমত সমগ্র বিশ্বকে পরিবর্তন করে দেয়ার মতো সৃষ্টিশীল ক্ষমতা তোমার একার মধ্যেই রয়েছে। এটা বিশ্বাস করতে শুরু করো। যখন তোমার এটা বিশ্বাস হবে তখন তুমি কিভাবে সেটা বাস্তবায়ন করবে সেটা খুঁজে বের করো। সব সময় ছোট দিয়েই শুরু করো। রাতারাতি কোন কিছু পরিবর্তন হয় না। তবে তুমি প্রক্রিয়াটা শুরু করো। বিশ্বের সমস্যা সমাধান করতে হলে তোমাকে প্রথমে মানুষের সমস্যার সমাধান করতে হবে। ব্যক্তির সমস্যা সমাধানে সফল হলে তুমি দেখবে সমস্যা সমাধান কত সহজ হয়ে গেছে। আমরা সব সময় বিশ্বের সমস্যার কথা চিন্তা করে হতাশ হয়ে পড়ি। বিশ্বের অনেক সমস্যা রয়েছে। তাই শুরুটা এভাবেই করা উচিত। প্রথমে একজন ব্যক্তির সমস্যা সমাধান করে পরে পাঁচজন ব্যক্তির সমস্যা সমাধানের জন্য লেগে পড়ো।
আগামী পাঁচ বছরে আপনি কি দেখতে চান?
কমপক্ষে বিশ্ব অর্থনীতির এক শতাংশ যেন সামাজিক ব্যবসা থেকে আসে। আমরা যদি এটা করতে সক্ষম হই, তাহলে আমার মনে হয় বিশ্বের চেহারাটাই আমূল বদলে যাবে। মানুষ এর চমৎকারিত্ব টের পাবে। এরপর খুব তাড়াতাড়িই এটি ১ থেকে ৫ শতাংশে উন্নীত হবে। এভাবেই ৫০ শতাংশ হওয়ার পথ প্রশস্ত হবে।
No comments