পাকিস্তান-এই অস্থিতিশীলতার শেষ কোথায়? by নাজাম শেঠি

পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী প্রত্যাশা করছিল, ‘মেমোগেট’ নামে পরিচিত সাম্প্রতিক পত্র কেলেঙ্কারির ঘটনাটি এ দেশের ক্ষমতা পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত তত দূর গড়ায়নি। না গড়ানোর আংশিক কারণ, জারদারি সরকার এর বিরুদ্ধে শক্তভাবে দাঁড়িয়েছে, আর এই ঘটনার প্রধান যে সাক্ষী, সেই মনসুর ইজাজ হঠাৎ ভীষণ ভয় পেয়ে পিছু হটে গেছেন।


কিন্তু মনে হচ্ছে, সুপ্রিম কোর্ট এখনো পিছু হটতে রাজি নন। মেমোগেটকে সুপ্রিম কোর্ট আপাতত হিমঘরে রেখে দিয়ে সরকারের পিছু নিয়েছেন ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশন অর্ডিন্যান্সের বিষয়ে। প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানির বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্ট আদালত অবমাননার অভিযোগ তুলেছেন এবং এই হুমকি দিচ্ছেন, তিনি যদি প্রেসিডেন্ট আসিফ জারদারির বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগের মামলা পুনরুজ্জীবিত করার আহ্বান জানিয়ে সুইস কর্তৃপক্ষকে চিঠি না লেখেন, তাহলে আদালত অবমাননার দায়ে তাঁকে দণ্ডিত করা হবে এবং তার ফলে তিনি সাংসদ হিসেবে যোগ্যতা হারাবেন।
আগামী সপ্তাহে, ফেব্রুয়ারির ১৩ তারিখে প্রধানমন্ত্রীর আইনজীবী আইৎজাজ আহসান তাঁর মক্কেলের পক্ষ থেকে আদালত অবমাননার অভিযোগের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ পাবেন; তাতে ব্যর্থ হলে শেষ উপায় হিসেবে প্রেসিডেন্টের বিশেষ দায়মুক্তির যুক্তি তুলে ধরে শুনানি করতে পারেন। সর্বোত্তম যা ঘটতে পারে, তা হলো সুইস কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি পাঠানো ছাড়াই তিনি প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টকে এই সমস্যা থেকে মুক্ত করতে পারেন। আর সবচেয়ে খারাপ যেটা হতে পারে, প্রধানমন্ত্রী আদালত অবমাননার দায়ে দণ্ড পেয়ে যেতে পারেন, প্রেসিডেন্ট তাঁর দায়মুক্তির অধিকার হারাতে পারেন এবং পিপিপির শরিক দলগুলো জোট ভেঙে বেরিয়ে যেতে পারে, যার ফল হবে রাজনৈতিক অরাজকতার মধ্যে নতুন করে নির্বাচন। উভয় রকমের সম্ভাবনাই রয়েছে। ইজ্জত রক্ষার স্বার্থে প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টকে কিছু আপসমূলক পদক্ষেপ নিতে হতে পারে; যেমন, প্রেসিডেন্ট মেনে নেবেন যে ফৌজদারি অভিযোগের ব্যাপারে তাঁর দায়মুক্তির বিশেষ অধিকার আছে, কিন্তু দেওয়ানি অভিযোগের ক্ষেত্রে তা নেই। শেষ পর্যন্ত হয়তো সরকার সুইস কর্তৃপক্ষকে প্রেসিডেন্ট জারদারির মামলাটি আবার চালু করার জন্য চিঠি পাঠাবে। কিন্তু সেটা হবে খুবই বন্ধুর পথ। কারণ, চূড়ান্ত লড়াইটা হবে চিঠিটার ভাষা নিয়ে, শব্দচয়ন নিয়ে।
সরকারের কৌশল যথেষ্ট পরিষ্কার। সরকার বিনয়ের ভান করে সুপ্রিম কোর্টে মামলাটি নিয়ে সময়ক্ষেপণ করতে চায় আগামী মার্চে সিনেটের নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত। তারপর হুমকি দেবে ‘পাঞ্জাবিদের’ হাতে শহীদ হয়ে যাওয়া যোদ্ধার মতো লড়াই চালিয়ে যাওয়ার। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট জারদারি সরকারের এই কৌশল ধরে ফেলেছে। তাই সরকার যাতে পরিকল্পিত পথে এগোতে না পারে, সেই লক্ষ্যে সুপ্রিম কোর্ট ক্ষিপ্রতার সঙ্গে অবিরাম চেষ্টা করে যাবেন, প্রয়োজনে এমনকি পাকিস্তানের ‘নির্বাচিত’ প্রধানমন্ত্রী প্রেসিডেন্টের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ‘যথোপযুক্ত প্রক্রিয়া’ অগ্রাহ্য করে ‘আইনগত তাড়াহুড়ো’রও আশ্রয় নিতে পারেন।
তবে এই অস্থিরতা সৃষ্টিকারী আইনি লড়াই ও রাজনৈতিক ঝগড়া-বিবাদের ফলে একটা ভালো ব্যাপার ঘটেছে। এসবের ফলে এমন এক রাজনৈতিক মতৈক্য সৃষ্টি হয়েছে, এ বছরের শেষের দিকে একটি দ্বিদলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার, স্বাধীন নির্বাচন কমিশন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনারদের দ্বারা একটি স্বচ্ছ ও অবাধ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা প্রয়োজন। সব রাজনৈতিক দল উপলব্ধি করছে, তারা যদি বিষয়টি নিয়ে হইচই আর ঝগড়া-বিবাদ চালিয়ে যেতে থাকে, তাহলে সামরিক বাহিনী ও বিচার বিভাগ এক জোট হয়ে সম্পূর্ণ নতুন এক রাজনৈতিক ব্যবস্থার দিকে যেতে পারে, যেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর তেমন কিছুই করার থাকবে না।
কিন্তু এটা আবার খুব ভালো না-ও হতে পারে। ‘পরিবর্তনের’ লক্ষ্যে আবির্ভূত ‘তৃতীয় শক্তির’ নেতা ইমরান খান হলেন রাজনৈতিক অঙ্গনের সেই সত্যিকারের ভাঁড়, যিনি পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি), পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নেওয়াজ (পিএমএলএন) ও জমিয়াত-উল ইসলামের (জেইউআই) সব হিসাব-নিকাশ গুলিয়ে দিতে পারেন। ২০১০ সালের শেষে নিজের পক্ষে বেশ বড় রকমের একটা সমর্থক গোষ্ঠী গড়ে তোলার আগে সামরিক বাহিনী ও বিচার বিভাগের মধ্যকার একটা বোঝাপড়ার ব্যাপারে ইমরান ছিলেন অত্যন্ত উৎসাহী। সামরিক বাহিনী ও বিচার বিভাগ পরিকল্পনা করেছিল, ‘দূষিত ব্যবস্থাটির অবসান ঘটিয়ে’ অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে টেকনোক্র্যাটদের সমন্বয়ে তিন বছরের জন্য একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে; জবাবদিহি করতে বাধ্য করার মধ্য দিয়ে পিপিপি ও পিএমএলএনকে হটিয়ে দিয়ে একটা ‘শুদ্ধ’ সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে ইমরান খানের ক্ষমতায় যাওয়ার পথ সৃষ্টি করা হবে। কিন্তু এখন ইমরান আর সেই পথে নেই, এখন তিনি জনপ্রিয় ধারায় ফিরেছেন। পিপিপিকে বিদায় করার জন্য ইমরান সুপ্রিম কোর্টের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন (কারণ, পিপিপির নিবেদিতপ্রাণ আদর্শবাদী ভোটারদের ভোট নিজের পক্ষে টানার আশা তিনি করতে পারেন না); অন্যদিকে পাঞ্জাবে পিএমএলএনকে আর খায়বার-পাখতুনখাওয়ায় জমিয়াত-উল ইসলামকে ধরাশায়ী করতে জামার হাতা গোটাচ্ছেন। কারণ, তাঁর পছন্দের রক্ষণশীল ভোটারদের মধ্যে এই দুটি দলের জনপ্রিয়তা আছে। আসলে, পাঞ্জাবের শহরাঞ্চলে ও খায়বার-পাখতুনখাওয়ায় পিএমএলএস ও জেইউআইয়ের চেয়ে ইমরান খানের সমর্থন-ভিত্তি বাড়ছে। সিন্ধুর শহরাঞ্চলেও তাঁর দল ভালো ফল পাবে, সেখানে এমকিউএমের সঙ্গে নির্বাচনী জোট বাঁধলে। সে কারণেই ইমরান পিপিপি, পিএমএলএন ও জমিয়াত-উল ইসলামকে একসঙ্গে বলছেন ‘সত্যিকারের পরিবর্তনের’ পথের অন্তরায় হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকা ‘জনবিরোধী ত্রিশক্তি’।
রাজনীতিকেরা যখন নির্বাচনী সাফল্যের লক্ষ্যে পরস্পরের মধ্যে গুঁতোগুঁতি-ঠেলাঠেলি করছেন, তখন অর্থনীতির দশা বিপর্যস্ত। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সর্বসাম্প্রতিক প্রতিবেদনে যে চিত্র ফুটে উঠেছে, তা অত্যন্ত নৈরাশ্যকর: ‘বর্তমান নীতিতে পাকিস্তানের নিকট ও মধ্য মেয়াদের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ভালো নয়। প্রবৃদ্ধি হবে অত্যন্ত কম, ব্যাপক মাত্রায় নতুন কর্মসংস্থান ঘটবে না, মূল্যস্ফীতি রয়ে যাবে উঁচু হারে এবং বহির্বিশ্বে অবস্থান ভীষণভাবে দুর্বল হয়ে পড়বে। উপরন্তু ক্রম-অস্থিতিশীল বৈশ্বিক পরিবেশের প্রেক্ষাপটে এবং ২০১২ সালের সিনেট নির্বাচন ও ২০১৩ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্রে দুর্বলতার উদ্বেগ থেকে বিদ্যমান অর্থনৈতিক অবস্থা থেকে আরও নিচের দিকে নেমে যাওয়ার যথেষ্ট হুমকি আছে। বিরাট বাজেট-ঘাটতি ও দায়সারা মুদ্রানীতি মিলিয়ে যে অবস্থা চলছে, তা ক্রমেই আরও ভঙ্গুর হয়ে উঠছে।’
ধারণা করা হচ্ছে, পরবর্তী নির্বাচন হবে জারদারির পাকিস্তান পিপলস পার্টি, নেওয়াজ শরিফের পাকিস্তান মুসলিম লিগ ও ইমরান খানের পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের মধ্যে এক ত্রিমুখী লড়াই। এই তিন দলের মধ্যে যেকোনো দুটি দল মিলে জোট সরকার গঠন করবে—এই মুহূর্তে এটা ভাবাই যায় না। কারণ, দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে তাদের দূরত্ব বিরাট। এ কারণে বিপর্যস্ত অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে নতুন করে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার আশঙ্কা সৃষ্টি হচ্ছে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত
 নাজাম শেঠি: পাকিস্তানের সাংবাদিক। সাপ্তাহিক দ্য ফ্রাইডে টাইমস-এর সম্পাদক।

No comments

Powered by Blogger.