চরাচর-হারিয়ে যাচ্ছে দেশি মাছ by সাইফুল ইসলাম খান

'মাছে-ভাতে বাঙালি'। আবহমান কাল ধরে প্রচলিত এ কথা যেন প্রবাদবাক্য। বাঙালির প্রধান খাদ্য ভাত। কিন্তু মাছ! বাঙালির খাদ্যতালিকায় মাছ না থাকলে তা অসম্পূর্ণ বলেই মনে হয়। শত শত নদীনালা, খালবিল, পুকুর-জলাশয় ও হাওর-বাঁওড়ের এই দেশে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়।


'গোলা ভরা ধান আর পুকুর ভরা মাছ'_বাংলা সাহিত্যে এভাবেই উঠে এসেছে আমাদের বিশাল মৎস্যভাণ্ডারের কথা। বস্তুত পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যায় বলেই এ জাতি হয়ে উঠেছে মাছে-ভাতে বাঙালি। আর স্বাদ! পৃথিবীর সব মানুষের কাছেই মাছ সুস্বাদু খাবার হিসেবে সমাদৃত। শত শত বছর ধরে মাছের ওপর নির্ভরশীল এই বাঙালির খাদ্যতালিকা থেকে ধীরে ধীরে উঠে যাচ্ছে মাছ। দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও পানিদূষণ এর প্রধান কারণ। বর্ধিত জনগোষ্ঠীর বসতবাড়ি নির্মাণের জন্য দিন দিন ভরাট হচ্ছে পুকুর, খালবিল, জলাশয়। এমনকি নদীনালাও বাদ যাচ্ছে না। এর সঙ্গে আমাদের অদূরদর্শিতা, বিবেচনা-বোধবুদ্ধিহীন কর্মকাণ্ডে হুমকির মুখে পড়েছে মৎস্যসম্পদ। ইকোসিস্টেমে ভারসাম্য নষ্ট হওয়ায় একদিকে কমে যাচ্ছে মাছের উৎপাদন, অন্যদিকে বিলুপ্ত হতে চলেছে দেশি প্রজাতির অনেক মাছ। তিতপুঁটি, দাড়কিনা, চাঁদা, বইচা, মলা-ঢেলার মতো ছোট জাতের মাছ থেকে শুরু করে শোল, গজার, রিটা, আইড়, পাঙ্গাশ ইত্যাদি বড় জাতের ৫৪ ধরনের মাছের অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে। বাংলাদেশে মোট ৭০৮ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। এর মধ্যে স্বাদু পানিতে ২৬৬ প্রজাতির এবং নোনা পানিতে বাস করে ৪৪২ প্রজাতির মাছ। যেসব প্রজাতির মাছ হুমকির সম্মুখীন, তার বেশির ভাগই স্বাদু পানির। প্রাণিজ আমিষের প্রধান উৎস মাছ। মানবদেহের ক্ষয়পূরণ, বৃদ্ধিসাধন ও রোগ প্রতিরোধে আমিষ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশের সাধারণ জনগোষ্ঠী তাদের খাদ্য আমিষের চাহিদার প্রায় ৬৫ শতাংশ পূরণ করে মাছ দ্বারা। প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও শিক্ষার অভাবে আমাদের রয়েছে সুষম খাদ্য সম্পর্কে অজ্ঞতা ও অনীহা। শুধু অভ্যাসবশে আমরা মাছকে খাদ্য হিসেবে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে থাকি। ফলে দৈনন্দিন আমিষের চাহিদা পূরণ হয়ে যায়। কিন্তু দিন দিন মাছের আবাসস্থল নষ্ট হওয়ায় একদিকে যেমন কমছে প্রাকৃতিকভাবে মাছের উৎপাদন, অন্যদিকে বিলুপ্তির দিকে যাচ্ছে অর্ধশতাধিক প্রজাতির মাছ। চাষের মাধ্যমে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব হলেও প্রাকৃতিকভাবে মাছের উৎপাদন অব্যাহত রাখতে না পারলে প্রাণিজ আমিষের ঘাটতি বেড়ে যাবে। প্রাকৃতিক উৎপাদন অব্যাহত রাখতে এবং বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে যাওয়া মাছগুলো রক্ষার জন্য প্রয়োজন মাছের বেঁচে থাকা ও বংশবিস্তারের উপযোগী পরিবেশ। আর এ জন্য প্রয়োজন দূষণমুক্ত নদীর পানি, রাসায়নিক সার ও কীটনাশকমুক্ত হাওর, বিল ও জলাশয়। চাষাবাদে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার অপরিহার্য, তবে তা যথাযথ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রয়োগ করলে মাছের জন্য সহনশীল হবে। রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমিয়ে জৈব সারের ব্যবহার বৃদ্ধির মাধ্যমেও পানিকে মাছচাষের উপযোগী রাখা যায়। আর যেসব মাছ বিলুপ্তির দিকে যাচ্ছে, সেগুলো রক্ষা করতে হলে অবশ্যই তাদের বাস উপযোগী পরিবেশ দিতে হবে। আর তা না হলে একসময় তারা সত্যি সত্যি হারিয়ে যাবে।
সাইফুল ইসলাম খান

No comments

Powered by Blogger.