সমালোচকেরা কি আওয়ামী লীগের শত্রু? by বিশ্বজি ৎ চৌধুরী
আওয়ামী লীগ নেতা ওবায়দুল কাদেরের নির্ভয় উচ্চারণ শুনে বিস্মিত হয়েছি। নিজের নির্বাচনী এলাকায় সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি বলেছেন, ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং যদি লস্কর-ই-তাইয়েবার সঙ্গে আলোচনায় বসতে পারেন, তাহলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার একসঙ্গে বসতে অসুবিধা কোথায়?’ প্রশ্নটা খুবই সাধারণ এবং যুক্তিটাও অকাট্য। কিন্তু বিস্মিত হওয়ার কারণ, এসব সাধারণ ও যুক্তিসংগত কথা বলার পরিণাম সম্পর্কে অতীতের অভিজ্ঞতা ও উদাহরণ থেকে যে শিক্ষা সরকার ও বিরোধী দলের রাজনীতিকেরা পেয়েছেন, তাতে সাহস হারানোটা স্বাভাবিক—ওই পথ পুনর্বার না মাড়ানোরই কথা। মনে পড়ে, দুই নেত্রীর একসঙ্গে বসা ও আলোচনার গুরুত্বের কথা বলে দলে কী রকম বেকায়দায় পড়েছিলেন বিএনপি নেতা নাজমুল হুদা। সরকারি দলের শীর্ষ ব্যক্তিরাও এ ধরনের কথা পছন্দ করবেন বলে মনে হয় না।
আমাদের বড় দুটি দলের শীর্ষ ব্যক্তিরা এই একটি কাজ (একসঙ্গে বসা ও আলোচনা করা) সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করেন। এ কথা ঠিক, পরস্পরকে অপছন্দ করার এক শ একটা কারণ হয়তো আছে। পরস্পরের বিরুদ্ধে সন্দেহ-অবিশ্বাসের শিকড়টাও অনেক গভীরে। সম্প্রতি ২১ আগস্টের ঘটনার সঙ্গে পূর্ববর্তী সরকারের সংশ্লিষ্টতার নানা তথ্য যেভাবে বেরিয়ে আসছে, তাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তো মনে হতেই পারে, তাঁদের সঙ্গে সমঝোতা করা মানে দলের নেতা-কর্মী হত্যাকারী, এমনকি তাঁর নিজের হত্যা-চক্রান্তকারীর সঙ্গেই হাত মেলানো। তবু ওবায়দুল কাদের বা নাজমুল হুদারা ঝুঁকি নিয়ে কদাচি ৎ দুই নেত্রীর বৈঠকের গুরুত্বের কথা বলে ফেলেন; আমরাও ঐক্যের কথা বলি। বলি, কেননা ঘটনাচক্রে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া শুধু ব্যক্তিবিশেষ নন, তাঁরা এমন দুটি দলের প্রধান, যে দল দুটির হাতে দীর্ঘকাল পালাক্রমে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে আসছে এ দেশের মানুষ। তবে বিভিন্ন জেলায় একই সঙ্গে সিরিজ বোমা হামলা, যশোরের সিনেমা হলে বা ঢাকায় রমনার বটমূলে হামলা, সিলেটে ব্রিটিশ হাইকমিশনারের ওপর বা গোপালগঞ্জে শেখ হাসিনার ওপর হামলাসহ অন্য যেসব চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র, ঘটনা-দুর্ঘটনা এ দেশে ঘটেছে, তার প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটন ও আইনি প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হোক, তা আমরা চাই না। কিন্তু জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোয় সরকার ও বিরোধী দলের ন্যূনতম সমঝোতা কি হতে পারে না? যেমন—তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ইস্যু বা ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর, ট্রানজিট ও অন্যান্য চুক্তির বিষয়েও তো এ আলোচনার সূত্রপাত ঘটতে পারত। এ ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে সরকারেরই উচিত এক পা বাড়িয়ে রাখা।
উদারতা দিয়ে জয় করা বা জয় করে উদারতার ইতিহাস কি বিশ্ব রাজনীতিতে বিরল? জীবনের সেরা ২৭টি বছর কারাভোগ করে, অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করে নেলসন ম্যান্ডেলা কি এ মহত্ত্বের জোরেই বিরোধীদের জয় করেননি, জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেননি? জানি, এ উপমহাদেশে এ রকম উদাহরণ খুব একটা নেই। কিছুদিন আগে বাংলাদেশ সফরের সময় শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা সরকার ও বিরোধী দলের এ বৈরিতার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তাঁর দেশের উদাহরণ তুলে ধরেছেন এবং দেশের অগ্রগতির পথে একে বড় বাধা বলে উল্লেখ করেছেন। এ বাধা অতিক্রম করা কি একেবারেই অসম্ভব? শুরুতেই শীর্ষ নেতৃত্বের বৈঠক না হোক, অন্তত বরফ গলানোর কিছু ছোটখাটো প্রক্রিয়া তো শুরু হতে পারে। আমাদের ধারণা, পরস্পরকে সহ্য করার, পরস্পরের বক্তব্য আমলে নেওয়ার উদ্যোগের মধ্য দিয়েই ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের রাজনীতির পথ রুদ্ধ হতে পারে।
২.
সমালোচনা ও জনদাবিকে আমলে নেওয়ার মানেই নিজেদের ব্যর্থতা স্বীকার করে নেওয়া—এ রকমই কি ভাবছে সরকার? না হলে বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে খোদ দলীয় সাংসদ ও মহাজোটের অন্তর্ভুক্ত দলের সাংসদেরা যখন কয়েকজন মন্ত্রীর সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠলেন, প্রধানমন্ত্রী তা সহজভাবে নিলেন না কেন? কেন উল্টো উপদেশ দিলেন যে, শত্রুর হাতে অস্ত্র তুলে দেবেন না। কারা শত্রু? বিরোধী দল? নাগরিক সমাজ বা গণমাধ্যম? একজন বা দুজন মন্ত্রীর ব্যর্থতাকে গায়ে পড়ে পুরো সরকারের ব্যর্থতা হিসেবে কেন নিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। মন্ত্রিসভায় রদবদল বা পুনর্বিন্যাস তো খুব স্বাভাবিক ঘটনা। প্রয়োজনে এ সাধারণ নিয়মের চর্চা করলে সরকারের ভাবমূর্তি বাড়ত বলেই তো মনে হয়। এতে বিরোধী দল বা নাগরিক সমাজের ক্ষোভ প্রশমিত হতো, জনগণও সরকারের সদিচ্ছার বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারত। এর উদাহরণ তো সম্প্রতি আমরা প্রতিবেশী ভারতেই দেখেছি।
লোকপাল বিল নিয়ে সমাজকর্মী (অনেকে বলেন, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল আরএসএসের গোপন সমর্থক) আন্না হাজারের অনশন নিয়ে ভারত সরকার শুরুতে ছিল কঠোর অবস্থানে। তাঁকে আটক করা ও অনশন করতে না দেওয়ার ঘটনায় যখন জনগণের ক্ষোভ তৈরি হলো এবং বিরাট জনসমর্থন পেলেন আন্না, তখন সরকার পিছিয়ে এল তার অবস্থান থেকে। আন্নার সঙ্গে সমঝোতা করে আপাতত পরিস্থিতির আরও অবনতিকে ঠেকানো হলো। এরই নাম সম্ভবত দূরদর্শিতা। শুধু এ ঘটনা কেন, যেখানেই প্রতিবাদ, যেখানেই জনরোষ, সেখানেই সরকার সক্রিয় হয়েছে, জনমতকে সম্মান জানিয়েছে। যেসব মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তাঁদেরই সরিয়ে দিয়েছেন মনমোহন সিং। দুর্নীতির অভিযোগে জেলে আছেন অন্তত চারজন মন্ত্রী। এর ফলে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সততা ও সদিচ্ছা নিয়ে কোনো দ্বিধা নেই জনমনে, এর সুফল তাঁর দল ও সরকারের ঘরেও গেল অনেকটা।
আমাদের দেশে এ রকম উদাহরণ সৃষ্টি করা কি অসম্ভব? কোনো ক্ষেত্রেই সরকারের সাফল্য নেই, এ কথা তো বলছেন না কেউ। মতিয়া চৌধুরী, নুরুল ইসলাম নাহিদ বা ইয়াফেস ওসমানের মতো মন্ত্রিসভার অধিকাংশ সদস্যকে নিয়ে তো কথা উঠছে না। তাহলে সৈয়দ আবুল হোসেন, ফারুক খান বা শাজাহান খানদের ব্যর্থতার দায় কেন বহন করতে হবে সরকারকে?
৩.
একজন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাবিদ একবার সখেদে বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ শুধু সমর্থন চায়, কারও পরামর্শ চায় না। এটা কত নির্মম উপলব্ধি, তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। আজ যাঁরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে কথা বলছেন, কোনো মন্ত্রীর অযোগ্যতার সমালোচনা করছেন, তাঁদের অনেকের গায়েই ‘আওয়ামী বুদ্ধিজীবী’র তকমা লেগে আছে। অনেকে, এমনকি নিজেই আওয়ামী লীগের সমর্থক স্বীকার করে নিয়ে ‘আওয়ামী লীগ ডুবলে আমরাও ডুবব’ কিংবা ‘আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে কি ভুল করেছি?’ শিরোনামে কলামও লিখেছেন। কিন্তু শুভানুধ্যায়ীদের এসব কথা কর্ণগোচর হচ্ছে না সরকারের নীতিনির্ধারকদের। সমালোচনা মানেই শত্রুতা, এ ধারণায় অটল তাঁরা।
সম্প্রতি যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের পদত্যাগের দাবিতে ‘ছাত্র-শিক্ষক-পেশাজীবী-জনতা’র ব্যানারে যাঁরা একত্র হয়েছেন, দাবি পূরণ না হওয়ায় ঈদের দিন শহীদ মিনারে সমাবেশ করেছেন, তাঁদের অনেকেই বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে নানাভাবে নিগৃহীত হয়েছিলেন। কারণ, জোট সরকারের দুঃশাসন, যুদ্ধাপরাধীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দান, জঙ্গি ত ৎ পরতায় তাঁদের সংশ্লিষ্টতাসহ নানা অভিযোগ তুলে সোচ্চার ছিলেন তাঁরা। আজ আবার বিবেকের তাড়নায় প্রতিবাদী ভূমিকা নিয়েছেন বলে তাঁরা আওয়ামী লীগের শত্রু?
নিজেদের মিত্র বাড়াতে নামসর্বস্ব দলগুলোর সঙ্গেও আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। অথচ প্রকৃত মিত্রদের দূরে ঠেলছে শুধু তাঁরা সরকারের ভুলত্রুটিগুলোর দিকে আঙুল তুলছেন বলে। ‘লেস দ্যান অনেস্ট’ এক বা একাধিক মন্ত্রীকে রক্ষার জন্য ক্রমে যে গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে সরকার, এ উপলব্ধি তাদের কবে হবে বা আদৌ হবে কি না জানি না।
বিশ্বজি ৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwa_chy@yahoo.com
আমাদের বড় দুটি দলের শীর্ষ ব্যক্তিরা এই একটি কাজ (একসঙ্গে বসা ও আলোচনা করা) সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করেন। এ কথা ঠিক, পরস্পরকে অপছন্দ করার এক শ একটা কারণ হয়তো আছে। পরস্পরের বিরুদ্ধে সন্দেহ-অবিশ্বাসের শিকড়টাও অনেক গভীরে। সম্প্রতি ২১ আগস্টের ঘটনার সঙ্গে পূর্ববর্তী সরকারের সংশ্লিষ্টতার নানা তথ্য যেভাবে বেরিয়ে আসছে, তাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তো মনে হতেই পারে, তাঁদের সঙ্গে সমঝোতা করা মানে দলের নেতা-কর্মী হত্যাকারী, এমনকি তাঁর নিজের হত্যা-চক্রান্তকারীর সঙ্গেই হাত মেলানো। তবু ওবায়দুল কাদের বা নাজমুল হুদারা ঝুঁকি নিয়ে কদাচি ৎ দুই নেত্রীর বৈঠকের গুরুত্বের কথা বলে ফেলেন; আমরাও ঐক্যের কথা বলি। বলি, কেননা ঘটনাচক্রে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া শুধু ব্যক্তিবিশেষ নন, তাঁরা এমন দুটি দলের প্রধান, যে দল দুটির হাতে দীর্ঘকাল পালাক্রমে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে আসছে এ দেশের মানুষ। তবে বিভিন্ন জেলায় একই সঙ্গে সিরিজ বোমা হামলা, যশোরের সিনেমা হলে বা ঢাকায় রমনার বটমূলে হামলা, সিলেটে ব্রিটিশ হাইকমিশনারের ওপর বা গোপালগঞ্জে শেখ হাসিনার ওপর হামলাসহ অন্য যেসব চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র, ঘটনা-দুর্ঘটনা এ দেশে ঘটেছে, তার প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটন ও আইনি প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হোক, তা আমরা চাই না। কিন্তু জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোয় সরকার ও বিরোধী দলের ন্যূনতম সমঝোতা কি হতে পারে না? যেমন—তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ইস্যু বা ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর, ট্রানজিট ও অন্যান্য চুক্তির বিষয়েও তো এ আলোচনার সূত্রপাত ঘটতে পারত। এ ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে সরকারেরই উচিত এক পা বাড়িয়ে রাখা।
উদারতা দিয়ে জয় করা বা জয় করে উদারতার ইতিহাস কি বিশ্ব রাজনীতিতে বিরল? জীবনের সেরা ২৭টি বছর কারাভোগ করে, অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করে নেলসন ম্যান্ডেলা কি এ মহত্ত্বের জোরেই বিরোধীদের জয় করেননি, জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেননি? জানি, এ উপমহাদেশে এ রকম উদাহরণ খুব একটা নেই। কিছুদিন আগে বাংলাদেশ সফরের সময় শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা সরকার ও বিরোধী দলের এ বৈরিতার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তাঁর দেশের উদাহরণ তুলে ধরেছেন এবং দেশের অগ্রগতির পথে একে বড় বাধা বলে উল্লেখ করেছেন। এ বাধা অতিক্রম করা কি একেবারেই অসম্ভব? শুরুতেই শীর্ষ নেতৃত্বের বৈঠক না হোক, অন্তত বরফ গলানোর কিছু ছোটখাটো প্রক্রিয়া তো শুরু হতে পারে। আমাদের ধারণা, পরস্পরকে সহ্য করার, পরস্পরের বক্তব্য আমলে নেওয়ার উদ্যোগের মধ্য দিয়েই ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের রাজনীতির পথ রুদ্ধ হতে পারে।
২.
সমালোচনা ও জনদাবিকে আমলে নেওয়ার মানেই নিজেদের ব্যর্থতা স্বীকার করে নেওয়া—এ রকমই কি ভাবছে সরকার? না হলে বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে খোদ দলীয় সাংসদ ও মহাজোটের অন্তর্ভুক্ত দলের সাংসদেরা যখন কয়েকজন মন্ত্রীর সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠলেন, প্রধানমন্ত্রী তা সহজভাবে নিলেন না কেন? কেন উল্টো উপদেশ দিলেন যে, শত্রুর হাতে অস্ত্র তুলে দেবেন না। কারা শত্রু? বিরোধী দল? নাগরিক সমাজ বা গণমাধ্যম? একজন বা দুজন মন্ত্রীর ব্যর্থতাকে গায়ে পড়ে পুরো সরকারের ব্যর্থতা হিসেবে কেন নিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। মন্ত্রিসভায় রদবদল বা পুনর্বিন্যাস তো খুব স্বাভাবিক ঘটনা। প্রয়োজনে এ সাধারণ নিয়মের চর্চা করলে সরকারের ভাবমূর্তি বাড়ত বলেই তো মনে হয়। এতে বিরোধী দল বা নাগরিক সমাজের ক্ষোভ প্রশমিত হতো, জনগণও সরকারের সদিচ্ছার বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারত। এর উদাহরণ তো সম্প্রতি আমরা প্রতিবেশী ভারতেই দেখেছি।
লোকপাল বিল নিয়ে সমাজকর্মী (অনেকে বলেন, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল আরএসএসের গোপন সমর্থক) আন্না হাজারের অনশন নিয়ে ভারত সরকার শুরুতে ছিল কঠোর অবস্থানে। তাঁকে আটক করা ও অনশন করতে না দেওয়ার ঘটনায় যখন জনগণের ক্ষোভ তৈরি হলো এবং বিরাট জনসমর্থন পেলেন আন্না, তখন সরকার পিছিয়ে এল তার অবস্থান থেকে। আন্নার সঙ্গে সমঝোতা করে আপাতত পরিস্থিতির আরও অবনতিকে ঠেকানো হলো। এরই নাম সম্ভবত দূরদর্শিতা। শুধু এ ঘটনা কেন, যেখানেই প্রতিবাদ, যেখানেই জনরোষ, সেখানেই সরকার সক্রিয় হয়েছে, জনমতকে সম্মান জানিয়েছে। যেসব মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তাঁদেরই সরিয়ে দিয়েছেন মনমোহন সিং। দুর্নীতির অভিযোগে জেলে আছেন অন্তত চারজন মন্ত্রী। এর ফলে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সততা ও সদিচ্ছা নিয়ে কোনো দ্বিধা নেই জনমনে, এর সুফল তাঁর দল ও সরকারের ঘরেও গেল অনেকটা।
আমাদের দেশে এ রকম উদাহরণ সৃষ্টি করা কি অসম্ভব? কোনো ক্ষেত্রেই সরকারের সাফল্য নেই, এ কথা তো বলছেন না কেউ। মতিয়া চৌধুরী, নুরুল ইসলাম নাহিদ বা ইয়াফেস ওসমানের মতো মন্ত্রিসভার অধিকাংশ সদস্যকে নিয়ে তো কথা উঠছে না। তাহলে সৈয়দ আবুল হোসেন, ফারুক খান বা শাজাহান খানদের ব্যর্থতার দায় কেন বহন করতে হবে সরকারকে?
৩.
একজন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাবিদ একবার সখেদে বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ শুধু সমর্থন চায়, কারও পরামর্শ চায় না। এটা কত নির্মম উপলব্ধি, তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। আজ যাঁরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে কথা বলছেন, কোনো মন্ত্রীর অযোগ্যতার সমালোচনা করছেন, তাঁদের অনেকের গায়েই ‘আওয়ামী বুদ্ধিজীবী’র তকমা লেগে আছে। অনেকে, এমনকি নিজেই আওয়ামী লীগের সমর্থক স্বীকার করে নিয়ে ‘আওয়ামী লীগ ডুবলে আমরাও ডুবব’ কিংবা ‘আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে কি ভুল করেছি?’ শিরোনামে কলামও লিখেছেন। কিন্তু শুভানুধ্যায়ীদের এসব কথা কর্ণগোচর হচ্ছে না সরকারের নীতিনির্ধারকদের। সমালোচনা মানেই শত্রুতা, এ ধারণায় অটল তাঁরা।
সম্প্রতি যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের পদত্যাগের দাবিতে ‘ছাত্র-শিক্ষক-পেশাজীবী-জনতা’র ব্যানারে যাঁরা একত্র হয়েছেন, দাবি পূরণ না হওয়ায় ঈদের দিন শহীদ মিনারে সমাবেশ করেছেন, তাঁদের অনেকেই বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে নানাভাবে নিগৃহীত হয়েছিলেন। কারণ, জোট সরকারের দুঃশাসন, যুদ্ধাপরাধীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দান, জঙ্গি ত ৎ পরতায় তাঁদের সংশ্লিষ্টতাসহ নানা অভিযোগ তুলে সোচ্চার ছিলেন তাঁরা। আজ আবার বিবেকের তাড়নায় প্রতিবাদী ভূমিকা নিয়েছেন বলে তাঁরা আওয়ামী লীগের শত্রু?
নিজেদের মিত্র বাড়াতে নামসর্বস্ব দলগুলোর সঙ্গেও আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। অথচ প্রকৃত মিত্রদের দূরে ঠেলছে শুধু তাঁরা সরকারের ভুলত্রুটিগুলোর দিকে আঙুল তুলছেন বলে। ‘লেস দ্যান অনেস্ট’ এক বা একাধিক মন্ত্রীকে রক্ষার জন্য ক্রমে যে গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে সরকার, এ উপলব্ধি তাদের কবে হবে বা আদৌ হবে কি না জানি না।
বিশ্বজি ৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwa_chy@yahoo.com
No comments