মাহমুদুর রহমানের মন্তব্য প্রতিবেদনঃ তিস্তা আমাদের অধিকার করিডোর ওদের আবদার
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর উচ্চ নিনাদে ঢাকঢোল পেটানো সাম্প্রতিক ঢাকা সফরের আগেরদিন ‘দেশপ্রেমিক হলে দেশের স্বার্থ দেখুন’ শিরোনামে যে মন্তব্য প্রতিবেদনটি লিখেছিলাম, সেখানে মূলত ট্রানজিটের মোড়কে করিডোর, পানি আগ্রাসন, বাণিজ্য ঘাটতি এবং সীমান্ত হত্যা, এই চারটি প্রসঙ্গ স্থান পেয়েছিল। সেই লেখায় তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সম্পর্কে যে আগাম মন্তব্যটি করেছিলাম, সেটি উদ্ধৃত করেই ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এবং অমীমাংসিত ইস্যু বিষয়ক তিন কিস্তির মন্তব্য প্রতিবেদন শুরু করছি।
আমি লিখেছিলাম, “এদিকে দু’দিন আগে বলা হলো, তিস্তা নদীর পানিবণ্টনের বিষয়টি নাকি ড. মনমোহনের সফরের সময় দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের এজেন্ডা থেকেই বাদ দেয়া হয়েছে। কূটনৈতিক মহলে শোনা গেল, আলোচনা থেকে তিস্তাচুক্তি বাদ দেয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন একজন অতিমাত্রায় ভারতপন্থী উপদেষ্টা। সর্বশেষ সংবাদ অনুযায়ী অবশ্য তিস্তা পানিচুক্তি এজেন্ডায় ফেরত এসেছে। তবে সেই চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ কী পরিমাণ পানি পেতে যাচ্ছে, তা নিয়ে শুরু হয়েছে আর এক অনিশ্চয়তা। ভারতীয় পত্র-পত্রিকায় লেখা হয়েছে, গজলডোবা পয়েন্টে পানি ৫২:৪৮ হারে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ভাগাভাগি হবে। অপরদিকে বিবিসি রেডিওতে পশ্চিমবঙ্গের ওই এলাকার সাংসদ বলেছেন, বাংলাদেশ নাকি মাত্র ২৫ শতাংশ পানি পাবে। উল্লেখ্য, গজলডোবা পয়েন্টের আগেই অন্তত ডজনখানেক স্থান থেকে ভারত তিস্তার পানি প্রত্যাহার করে চলেছে। অথচ এসব বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার নিশ্চুপ, জনগণ অন্ধকারে। তিস্তা নিয়ে প্রতিদিন যেভাবে নাটকের স্ক্রিপ্টের পরিবর্তন হচ্ছে, তাতে চুক্তি সই না হওয়া পর্যন্ত কোনো রকম ভরসা পাচ্ছি না।”
আমার আশঙ্কা সত্যে পরিণত হয়েছে, তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি শেষ পর্যন্ত হয়নি। তবে চুক্তি না হওয়ার জন্য আমি এদেশের একজন নাগরিক হিসেবে যতটা হতাশ হয়েছি, তার চেয়েও বেশি উদ্বিগ্ন হয়েছি এই চুক্তি না হওয়ার পেছনের কারণটি ভারতীয় সংবাদমাধ্যম মারফত জানতে পেরে। বাংলাদেশ এবং ভারতের ক্ষমতাসীন মহল তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তির নামে প্রকৃতপক্ষে এদেশের জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কল্যাণে সেই প্রতারণার বিষয়টি এখন ফাঁস হয়ে গেছে। বাংলাদেশের জনগণের তিস্তার পানির ন্যায্য অধিকারের প্রতি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করলেও একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে তার স্বচ্ছতার অবশ্যই
প্রশংসা করতে হবে। আমাদের দুই ‘সুপার’ উপদেষ্টা এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিলে বাংলাদেশ ৪৮ শতাংশ পানি পাচ্ছে বলে প্রচারণা চালালেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কল্যাণে জানা গেল আমরা গজলডোবা পয়েন্টে মাত্র ৩৩ শতাংশ পানি পেতে যাচ্ছিলাম।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী দাবি করছেন, তার সম্মতিতে যে খসড়া চুক্তি প্রাথমিকভাবে প্রণীত হয়েছিল সেখানে বাংলাদেশের অংশ আরও অনেক কম অর্থাত্ ২৫ শতাংশ স্থির হয়েছিল। সম্ভবত সে কারণেই পশ্চিমবঙ্গের ওই এলাকার সাংসদ বিবিসি রেডিওতে প্রদত্ত সাক্ষাত্কারে তেত্রিশের পরিবর্তে ২৫ শতাংশের কথাই জানিয়েছিলেন। খসড়া এবং চূড়ান্ত চুক্তির মধ্যকার ফারাকের কারণেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শেষমুহূর্তে বেঁকে বসেছেন। উল্লেখ্য, দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ তিস্তার পানির আধাআধি হিস্যা দাবি করে এসেছে। পানি নিয়ে এ ধরনের প্রতারণা ভারত অবশ্য আমাদের সঙ্গে নতুন করছে না। ১৯৭৫ সালে ভারত ফারাক্কা বাঁধ চালু করেছিল বাংলাদেশের তত্কালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে প্রতারণা করেই।
১৯৭৪ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের ভারত সফর শেষে স্বাক্ষরিত যুক্ত বিবৃতির সূত্র ধরে ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল থেকে ৩১ মে, এই ৪১ দিনের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কা বাঁধ চালুর (Test run) ভারতীয় প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী থেকে রাষ্ট্রপতিতে রূপান্তরিত শেখ মুজিবুর রহমান। দুই দেশের সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল Feeder canal-এর এই অস্থায়ী Test run সম্পন্ন হলে উভয় দেশের মধ্যে গঙ্গার পানি ন্যায্যতার ভিত্তিতে ভাগাভাগি করে আনুষ্ঠানিক চুক্তি হওয়ার পরই কেবল ফারাক্কা বাঁধ স্থায়ীভাবে চালু করা হবে।
বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ফারাক্কা নিয়ে বিতর্ক প্রসঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র একটি বিবৃতি প্রকাশ করেন। সেই বিবৃতির নিচের উদ্ধৃতাংশেও স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হচ্ছে যে, ১৯৭৫ সালে ফারাক্কা Test run একটি সাময়িক কার্যক্রম হওয়ারই কথা ছিল—
"It is to be hoped that this question will now be resolved at the next meeting and a firm and final solution found in a spirit of understanding and friendship safeguarding the legitimate rights and interests of both the countries. A significant step forward had been taken with the conclusion in April 1975 of a short term arrangement providing for the operation of the Feeder canal of the Farakka Barrage during the lean season last year, pending further discussions regarding the allocation of the lean season flows of the Ganga in terms of the Joint Declaration of the Prime Ministers of India and Bangladesh of May 16, 1974."
(আশা করা যাচ্ছে যে, সমঝোতা ও বন্ধুত্বের ভিত্তিতে পরবর্তী আলোচনায় এই সমস্যার এমন একটি স্থায়ী ও চূড়ান্ত সমাধানে উপনীত হওয়া সম্ভব হবে যাতে করে উভয় দেশের ন্যায্য অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষিত হয়। ১৯৭৫ সালের এপ্রিলে ফারাক্কা বাঁধের সংযোগ খাল চালুর একটি স্বল্পকালীন ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে গত বছরের শুষ্ক মৌসুমের সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, তবে ১৯৭৪ সালের ১৬ মে ভারত ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যৌথ বিবৃতির আলোকে শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার পানিবণ্টন সম্পর্কিত আলোচনা এখনও অমীমাংসিত রয়েছে।)
কিন্তু ভারত তার কথা রাখেনি। পরীক্ষামূলকভাবে মাত্র ৪১ দিনের জন্য বাঁধ চালু করার ছদ্মাবরণে তারা সেই যে ফারাক্কা বাঁধ থেকে গঙ্গার পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার শুরু করেছিল, তার অবসান আর কোনোদিন হয়নি। ফলে গত ৩৬ বছরে আমাদের এক সময়ের প্রমত্তা পদ্মা ক্ষীণকায়া স্রোতস্বিনীতে পরিণত হয়েছে এবং সেই সঙ্গে দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এলাকাও আজ মরুকরণ প্রক্রিয়ায় পতিত। ফারাক্কা বাঁধ চালু হওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমান আর মাত্র সামান্য ক’টা দিন জীবিত ছিলেন। কাজেই আমাদের জানার উপায় নেই যে, তিনি ভারতীয় প্রতারণা সম্পর্কে আগাম জানতেন কিনা। দুর্ভাগ্যবশত তার কন্যার ক্ষেত্রে সেই benefit of doubt দেয়া যাচ্ছে না। বরঞ্চ, অবস্থাদৃষ্টে দেশবাসীর কাছে আজ পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, তিস্তা নদীর পানিবণ্টন নিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বাংলাদেশের ষোলো কোটি মানুষের সঙ্গে যে প্রতারণা করছে, আমাদের প্রধানমন্ত্রী এবং দুই সুপার উপদেষ্টাসহ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
তিস্তাচুক্তি নিয়ে এই তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে এখন আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে পানির ন্যায্য হিস্যা প্রাপ্তির দরকষাকষিতে অধিকতর সতর্ক হতে হবে। গজলডোবা পয়েন্টের পানি শতকরা হারে ভাগাভাগির পরিবর্তে গ্যারান্টি ক্লজসহ পানির পরিমাণ (হাজার কিউসেক) নিশ্চিত করা গেলেই কেবল বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষিত হবে। যেনতেন একটি চুক্তি বাংলাদেশের জন্য বরং অমঙ্গলই ডেকে আনবে। ঝানু কূটনীতিকরা বলে থাকেন, "No treaty is better than a bad treaty" (চুক্তি না থাকা খারাপ চুক্তির চাইতে ভালো)। তিস্তা নদীতে মোট পানিপ্রবাহের পরিমাণের অঙ্ক নির্ধারণেও বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক পানি বিশেষজ্ঞদের অবিলম্বে সম্পৃক্ত হওয়া আবশ্যক, যেন সেখানেও বর্তমান সরকার এবং বাংলাদেশের ভারতবন্ধুরা মিলে আমাদের কোনো শুভঙ্করের ফাঁকিতে ফেলতে না পারে।
সেই পাকিস্তান আমল থেকেই ভারত আমাদের বিরুদ্ধে অব্যাহত পানি আগ্রাসন চালালেও প্রতিবেশী রাষ্ট্রটির সব প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আমরা কেবল আশ্বাসবাণীই শুনে এসেছি। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প বাতিলের দাবির প্রেক্ষিতে ড. মনমোহন সিং তার পূর্বসূরিদের চর্বিত চর্বণ পুনরাবৃত্তি করে ঢাকায় বলেছেন, “ভারত এমন কিছু করবে না যাতে বাংলাদেশের জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।” বছরের পর বছর ধরে এই অভিন্ন বাক্য শুনতে শুনতে বাংলাদেশের জনগণ ক্লান্ত হয়ে পড়লেও আশ্চর্যজনকভাবে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীদের একই কথা বলাতে যেন কোনো ক্লান্তি নেই।
শেখ হাসিনা এবারের মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর মিসরের রাজধানী কায়রোতে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে ড. মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে প্রথমবার আনুষ্ঠানিক বৈঠক শেষে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে অবিকল একই মন্তব্য করেছিলেন। অথচ ভারত বরাক নদীতে বাংলাদেশের জন্য আরও একটি মরণ বাঁধ নির্মাণ থেকে সরে আসার কোনো প্রতিশ্রুতি আজ পর্যন্ত দেয়নি। ১৯৫১ সালে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ পরিকল্পনা আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমে ফাঁস হয়ে গেলে পাকিস্তান সরকারের উদ্বেগের জবাবে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুও এই কথাই বলেছিলেন। ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের ফলে বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হয়নি, বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে ষাট বছর পর এমন দাবি ‘র’ (raw)-এর বেতনভুক বাংলাদেশী এজেন্টরাই কেবল করতে পারেন।
যা হোক, শেষ কথা হলো মহাজোট সরকার তিস্তার পানি নিয়ে আমাদের আশার এক প্রকাণ্ড বেলুন ফুলিয়ে তুললেও তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি করতে ভারত চূড়ান্ত মুহূর্তে অসম্মতি জ্ঞাপন করেছে। ড. মনমোহন সিং বাড়ি বয়ে এসে শেখ হাসিনাকে বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন, নতজানু পররাষ্ট্রনীতি দিয়ে দেশের কোনো কল্যাণ সাধন হতে পারে না। এখন বাংলাদেশের জন্য অধিকতর আশঙ্কার বিষয় হলো, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সফরের ২৪ ঘণ্টা না পেরোতেই গণবিরোধী, ভারতপন্থীরা আমাদের স্বাধীনতা হরণের নতুন কৌশল প্রণয়নে কোমর বেঁধে লেগে গেছে।
এই গোষ্ঠী টেলিভিশন ‘টক শো’ এবং পত্র-পত্রিকায় লেখালেখির মাধ্যমে তিস্তার পানির সঙ্গে করিডোর বিনিময়ের একটি পটভূমি তৈরির অপচেষ্টায় জনগণের মগজ ধোলাইয়ের কাজ ইতোমধ্যে শুরু করে দিয়েছেন। সরকারের সর্বোচ্চ মহলের নির্দেশেই যে এরা মাঠে নেমেছেন, তার প্রমাণ বিতর্কিত ‘সুপার উপদেষ্টা’ ড. গওহর রিজভীর আরটিভিতে ৮ তারিখের লাইভ ইন্টারভিউতেই মিলেছে। শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রীত্বের প্রথম মেয়াদের পররাষ্ট্রবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীর তিস্তার পানি এবং করিডোর, এই দুই বিষয়কে এক না করার পরামর্শের জবাব এড়িয়ে ড. গওহর রিজভী দ্বিপাক্ষিক লেনদেনের বায়বীয় গল্প বলে সরকারের অস্বচ্ছ, রাষ্ট্রবিরোধী অবস্থানকেই পুনর্বার স্পষ্ট করেছেন। একটি চিহ্নিত কট্টর ভারত ও সরকারপন্থী পত্রিকায় ৯ সেপ্টেম্বর ‘আধাঘণ্টায় পাল্টে যায় পরিস্থিতি’ শিরোনামের লিড নিউজে লেখা হয়েছে, “আধাঘণ্টায় বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের সব পরিস্থিতি পাল্টে যায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচক্ষণতায় বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় ঘুরে দাঁড়ায়। তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তির সঙ্গে বাদ পড়ে যায় ট্রানজিটের সম্মতিপত্র সইও।”
মার্কিন ও ভারতপন্থী সুশীল (?) পত্রিকা দি ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম ওই ৯ তারিখেই তাদের সহযোগী বাংলা পত্রিকা প্রথম আলোতে লিখেছেন, “দুই দেশের চাওয়া-পাওয়ার বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশের কাছে ভারতের চাওয়ার প্রধান বিষয়—নিরাপত্তার নিশ্চয়তা ও ট্রানজিট সুবিধা। নিরাপত্তার নিশ্চয়তা আগেই দেয়া হয়েছে। ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার ব্যাপারেও বাংলাদেশ নীতিগত সম্মত হয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের প্রধান বিষয়—অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা এবং বাণিজ্য-বৈষম্য কমানো। দ্বিতীয়ত, ভারত কেন ট্রানজিট চাইছে? উত্তর-পূর্বাঞ্চলের উন্নয়নের জন্য। আমরা কেন পানি চাইছি? আমাদের উন্নয়নের জন্য।” কী চমত্কারভাবেই না আমাদের ন্যায্য অধিকারকে ভারতের আধিপত্যবাদী আবদারের সঙ্গে উন্নয়নের নামে তুলনীয় করে দেখানো হয়েছে! মাহফুজ আনাম এবং তার স্বগোত্রীয়রা দীর্ঘদিন ধরে ভারতকে করিডোর দেয়ার পক্ষে ওকালতি করে চলেছেন। সেদিন মাছরাঙা টেলিভিশনে এক সাক্ষাত্কারে ট্রানজিটের মোড়কে করিডোরের পক্ষে তার নীতিগত অবস্থানের কথা নির্দ্বিধায় স্বীকার করে তিনি অবশ্য সততার পরিচয় দিয়েছেন।
আসল কথা হলো, প্রচারণার মাধ্যমে জনগণকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করা হচ্ছে, যাতে ষোলো কোটি মানুষের অধিকারকে সাম্রাজ্যবাদী প্রতিবেশীর আবদারের কাছে বিসর্জন দিলেও দেশে কোনো কার্যকর প্রতিবাদের ঝড় না ওঠে। একথা অনস্বীকার্য যে, বাংলাদেশের গণমাধ্যমে ভারতপন্থীদের লক্ষণীয় প্রভাব রয়েছে। বাংলাদেশের স্বার্থ বিকিয়ে ভারতের সন্তুষ্টি অর্জনই যাদের মোক্ষ, সেই গোষ্ঠী গত দুই দশক ধরে করিডোরের বিনিময়ে ঐশ্বর্য প্রাপ্তির এক অবাস্তব স্বপ্ন ফেরি করে বেড়িয়েছেন। ড. মনমোহনের সফর বাংলাদেশের মোহাবিষ্ট জনগণকে অবশেষে এক জোরদার ঝাঁকুনি দিয়ে কঠিন বাস্তবে নামিয়ে এনেছে। সেই বিবেচনায় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে নিষম্ফল সফর আমার বিবেচনায় একেবারে বৃথা হয়নি। রাস্তাঘাটের আলাপচারিতায় আমার কাছে অন্তত মনে হচ্ছে, একাত্তরের মহান মুক্তিসংগ্রামের সেই স্বাধীনতার স্ফুলিঙ্গ দীর্ঘকাল বাদে গণমানসে আবার যেন দেখতে পাচ্ছি। কবি ফরহাদ মজহারের প্রত্যাশামত এদেশের জনগণের হুঁশ বোধহয় ফিরতে শুর করেছে। ১৯৭১ সালে পিন্ডি যদি আমাদের ‘দাবায়ে’ রাখতে না পেরে থাকে, ইন্শাআল্লাহ্ ২০১১-তে দিল্লিও পারবে না।
বাংলাদেশের জনগণের উপলব্ধি করা কর্তব্য যে, আমাদের মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার স্বার্থে ভারতকে করিডোর দেয়ার প্রস্তাবে আমরা স্বপ্নে প্রাপ্ত কোনো ‘প্রাচুর্যের’ বিনিময়েই সম্মত হতে পারি না। আধিপত্যবাদী প্রতিবেশীকে একবার করিডোর দেয়া হলে এদেশে অশান্তি ও যুদ্ধবিগ্রহ অবশ্যম্ভাবী। ভারতের উত্তর-পূর্বের সাত রাজ্যের প্রতিটিতেই সেই ১৯৪৭ সাল থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদী সহিংস আন্দোলন চলছে। সেসব সশস্ত্র সংগঠনকে দমনের জন্য বিপুলসংখ্যায় ভারতীয় কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য ছয় দশক ধরে কেবল সেখানে অবস্থানই করছে না, আকাশ ও স্থলপথে তাদের বিদ্রোহ দমনের জন্য নিয়মিত প্রয়োজনীয় সামরিক রসদও প্রেরণ করা হচ্ছে। ভারতের মূল ভূখণ্ড এবং সাত রাজ্যের মাঝখানে বাংলাদেশের অবস্থান হওয়ার কারণে স্থলপথে রসদসমূহ জলপাইগুড়ির চিকেন নেক ঘুরে পাঠাতে হচ্ছে। ফলে একদিকে ভারত সরকারের যেমন ব্যয় বৃদ্ধি হচ্ছে, অপরদিকে বিরোধীপক্ষের সামরিক আক্রমণে চিকেন নেক বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার আশঙ্কাও সার্বক্ষণিকভাবে থেকে যাচ্ছে।
সুতরাং মুখে উন্নয়নের কথা প্রচার করা হলেও প্রকৃতপক্ষে সামরিক স্বার্থেই বাংলাদেশের বুক চিরে ভারতের করিডোর আবশ্যক। চীনের সঙ্গে ভারতের সম্ভাব্য সংঘর্ষের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান অতীব গুরুত্বপূর্ণ। আমরা ষোলো কোটি মানবসন্তানের এক দরিদ্র ও শান্তিপ্রিয় জনগোষ্ঠী। এশিয়ার দুই বৃহত্ শক্তির দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জড়িত হওয়ার কোনো ইচ্ছা আমাদের নেই। বাংলাদেশের বর্তমান শাসকশ্রেণী ভারতকে করিডোর দিয়ে সেই দ্বন্দ্বে বাংলাদেশকে সম্পৃক্ত করার অপচেষ্টায় রত হয়েছে। তাছাড়া ভারতে বিভিন্ন দ্বন্দ্ব-সংঘাতের প্রতিক্রিয়ায় জঙ্গিবাদ এক বিপজ্জনক পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। এই উপমহাদেশের তিনটি রাষ্ট্রের মধ্যে বাংলাদেশই সামগ্রিকভাবে জঙ্গিবাদমুক্ত রয়েছে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী যখন বাংলাদেশ সফর করছিলেন, সেই সময় দিল্লি হাইকোর্টে সন্ত্রাসী হামলায় শতাধিক ব্যক্তি হতাহত হয়েছে। করিডোর প্রদান করে আমরা এদেশে জঙ্গিবাদ আমদানির ঝুঁকি নিতে পারি না। বর্তমান সরকারের দেশের স্বার্থবিরোধী এসব কর্মকাণ্ডকে প্রতিহত করতে হলে দেশপ্রেমিক জনতার প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
তাছাড়া অর্থনৈতিক বিবেচনাতেও করিডোর প্রদান দেশের জন্য কোনো সুফল বয়ে আনবে না। এ বিষয়টি বুঝতে পেরেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টারা এখন দেশবাসীকে প্রত্যক্ষ লাভের বদলে পরোক্ষ আয়ের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। বাংলাদেশকে সিঙ্গাপুরে পরিণত করার স্বপ্ন দেখানো ফতোয়াবাজরা ভোল পাল্টে সরকারকে সম্প্রতি ধীরে চলার পরামর্শ দিচ্ছেন। অবশেষে শুভবুদ্ধির উদয় হওয়ার জন্য এসব মরশুমী বুদ্ধিজীবীকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ড. গওহর রিজভী নতুন থিওরি কপচাচ্ছেন, শুল্ক তেমন একটা পাওয়া না গেলেও ভারতীয় ট্রাক ড্রাইভারদের সেবায় বাংলাদেশে হোটেল-রেস্তোরাঁ খুললে সেখান থেকেই আমাদের প্রচুর আয়-রোজগার হবে! এর আগে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ফতোয়া দিয়েছিলেন যে, একটি ‘ট্রানজিট রাষ্ট্র’ হওয়ার জন্যই নাকি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। একই অর্থমন্ত্রী এমন দাবিও করেছেন যে, ২০১০ সালেই তারা ভারতকে ট্রানজিট দিয়ে দিয়েছেন।
অপরদিকে ড. গওহর রিজভী এবং ড. মসিউর রহমান মনে করেন, ১৯৭২ এবং ১৯৭৪ সালে প্রণীত বাণিজ্য চুক্তি ও মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিতেই নাকি মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান ভারতকে ট্রানজিট দিয়ে গেছেন। আমার বিবেচনায় এসব বক্তব্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য কেবল অবমাননাকরই নয়, সেই সঙ্গে রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলকও। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে অপসংস্কৃতির সঙ্গে ভারতীয় মাদক আগ্রাসনেরও শিকারে পরিণত হয়েছে। করিডোর দেয়া হলে তরুণদের মধ্যে ভারতীয় মাদকের ব্যবহার বৃদ্ধির পাশাপাশি অন্যান্য আনুষঙ্গিক অপরাধপ্রবণতাও এদেশে বৃদ্ধি পেতে বাধ্য। মরণব্যাধি ‘এইডসে’র মহামারীতে ভারত বর্তমানে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। এ ধরনের ব্যাধি বিভিন্ন দেশে ভারী যানবাহন চালকদের মাধ্যমেই সচরাচর সংক্রমিত হয়ে থাকে। অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, বর্তমান সরকার বাংলাদেশকে সর্বদিক থেকে একটি বিপজ্জনক রাষ্ট্রে পরিণত করতে উদ্যত হয়েছে। আগামী প্রজন্মকে নিরাপদ করতে হলে এদের প্রতিহত না করে উপায় নেই।
আসুন সমস্বরে বলি, তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা ভারতকে দিতেই হবে, কারণ এটা আমাদের অধিকার। এবং সেই পানির বিনিময়ে করিডোর প্রদানের অপকৌশল আমরা কিছুতেই বাস্তবায়ন হতে দেবো না। ড. মনমোহন সিং তার এই সফরে বাংলাদেশের প্রকৃত স্বাধীনতা হরণের অর্ধেকটা Framework Agreement স্বাক্ষর করতে শেখ হাসিনা সরকারকে বাধ্য করার মাধ্যমে সম্পন্ন করেছেন। এরপর করিডোর নিতে পারলেই বাংলাদেশকে আক্ষরিক অর্থেই একটি vassal state (পোষ্য রাষ্ট্র)-এ রূপান্তর করা যাবে। এ বিষয়ে দ্বিতীয় কিস্তিতে বিশদভাবে লেখার ইচ্ছে রইল। করিডোর প্রদানের সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেই এ সপ্তাহের মন্তব্য প্রতিবেদন সমাপ্ত করছি।
(দ্বিতীয় কিস্তি আগামী ২১ সেপ্টেম্বর ২০১১ বুধবার)
আমার আশঙ্কা সত্যে পরিণত হয়েছে, তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি শেষ পর্যন্ত হয়নি। তবে চুক্তি না হওয়ার জন্য আমি এদেশের একজন নাগরিক হিসেবে যতটা হতাশ হয়েছি, তার চেয়েও বেশি উদ্বিগ্ন হয়েছি এই চুক্তি না হওয়ার পেছনের কারণটি ভারতীয় সংবাদমাধ্যম মারফত জানতে পেরে। বাংলাদেশ এবং ভারতের ক্ষমতাসীন মহল তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তির নামে প্রকৃতপক্ষে এদেশের জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কল্যাণে সেই প্রতারণার বিষয়টি এখন ফাঁস হয়ে গেছে। বাংলাদেশের জনগণের তিস্তার পানির ন্যায্য অধিকারের প্রতি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করলেও একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে তার স্বচ্ছতার অবশ্যই
প্রশংসা করতে হবে। আমাদের দুই ‘সুপার’ উপদেষ্টা এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিলে বাংলাদেশ ৪৮ শতাংশ পানি পাচ্ছে বলে প্রচারণা চালালেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কল্যাণে জানা গেল আমরা গজলডোবা পয়েন্টে মাত্র ৩৩ শতাংশ পানি পেতে যাচ্ছিলাম।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী দাবি করছেন, তার সম্মতিতে যে খসড়া চুক্তি প্রাথমিকভাবে প্রণীত হয়েছিল সেখানে বাংলাদেশের অংশ আরও অনেক কম অর্থাত্ ২৫ শতাংশ স্থির হয়েছিল। সম্ভবত সে কারণেই পশ্চিমবঙ্গের ওই এলাকার সাংসদ বিবিসি রেডিওতে প্রদত্ত সাক্ষাত্কারে তেত্রিশের পরিবর্তে ২৫ শতাংশের কথাই জানিয়েছিলেন। খসড়া এবং চূড়ান্ত চুক্তির মধ্যকার ফারাকের কারণেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শেষমুহূর্তে বেঁকে বসেছেন। উল্লেখ্য, দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ তিস্তার পানির আধাআধি হিস্যা দাবি করে এসেছে। পানি নিয়ে এ ধরনের প্রতারণা ভারত অবশ্য আমাদের সঙ্গে নতুন করছে না। ১৯৭৫ সালে ভারত ফারাক্কা বাঁধ চালু করেছিল বাংলাদেশের তত্কালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে প্রতারণা করেই।
১৯৭৪ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের ভারত সফর শেষে স্বাক্ষরিত যুক্ত বিবৃতির সূত্র ধরে ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল থেকে ৩১ মে, এই ৪১ দিনের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কা বাঁধ চালুর (Test run) ভারতীয় প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী থেকে রাষ্ট্রপতিতে রূপান্তরিত শেখ মুজিবুর রহমান। দুই দেশের সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল Feeder canal-এর এই অস্থায়ী Test run সম্পন্ন হলে উভয় দেশের মধ্যে গঙ্গার পানি ন্যায্যতার ভিত্তিতে ভাগাভাগি করে আনুষ্ঠানিক চুক্তি হওয়ার পরই কেবল ফারাক্কা বাঁধ স্থায়ীভাবে চালু করা হবে।
বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ফারাক্কা নিয়ে বিতর্ক প্রসঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র একটি বিবৃতি প্রকাশ করেন। সেই বিবৃতির নিচের উদ্ধৃতাংশেও স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হচ্ছে যে, ১৯৭৫ সালে ফারাক্কা Test run একটি সাময়িক কার্যক্রম হওয়ারই কথা ছিল—
"It is to be hoped that this question will now be resolved at the next meeting and a firm and final solution found in a spirit of understanding and friendship safeguarding the legitimate rights and interests of both the countries. A significant step forward had been taken with the conclusion in April 1975 of a short term arrangement providing for the operation of the Feeder canal of the Farakka Barrage during the lean season last year, pending further discussions regarding the allocation of the lean season flows of the Ganga in terms of the Joint Declaration of the Prime Ministers of India and Bangladesh of May 16, 1974."
(আশা করা যাচ্ছে যে, সমঝোতা ও বন্ধুত্বের ভিত্তিতে পরবর্তী আলোচনায় এই সমস্যার এমন একটি স্থায়ী ও চূড়ান্ত সমাধানে উপনীত হওয়া সম্ভব হবে যাতে করে উভয় দেশের ন্যায্য অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষিত হয়। ১৯৭৫ সালের এপ্রিলে ফারাক্কা বাঁধের সংযোগ খাল চালুর একটি স্বল্পকালীন ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে গত বছরের শুষ্ক মৌসুমের সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, তবে ১৯৭৪ সালের ১৬ মে ভারত ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যৌথ বিবৃতির আলোকে শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার পানিবণ্টন সম্পর্কিত আলোচনা এখনও অমীমাংসিত রয়েছে।)
কিন্তু ভারত তার কথা রাখেনি। পরীক্ষামূলকভাবে মাত্র ৪১ দিনের জন্য বাঁধ চালু করার ছদ্মাবরণে তারা সেই যে ফারাক্কা বাঁধ থেকে গঙ্গার পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার শুরু করেছিল, তার অবসান আর কোনোদিন হয়নি। ফলে গত ৩৬ বছরে আমাদের এক সময়ের প্রমত্তা পদ্মা ক্ষীণকায়া স্রোতস্বিনীতে পরিণত হয়েছে এবং সেই সঙ্গে দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এলাকাও আজ মরুকরণ প্রক্রিয়ায় পতিত। ফারাক্কা বাঁধ চালু হওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমান আর মাত্র সামান্য ক’টা দিন জীবিত ছিলেন। কাজেই আমাদের জানার উপায় নেই যে, তিনি ভারতীয় প্রতারণা সম্পর্কে আগাম জানতেন কিনা। দুর্ভাগ্যবশত তার কন্যার ক্ষেত্রে সেই benefit of doubt দেয়া যাচ্ছে না। বরঞ্চ, অবস্থাদৃষ্টে দেশবাসীর কাছে আজ পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, তিস্তা নদীর পানিবণ্টন নিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বাংলাদেশের ষোলো কোটি মানুষের সঙ্গে যে প্রতারণা করছে, আমাদের প্রধানমন্ত্রী এবং দুই সুপার উপদেষ্টাসহ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
তিস্তাচুক্তি নিয়ে এই তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে এখন আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে পানির ন্যায্য হিস্যা প্রাপ্তির দরকষাকষিতে অধিকতর সতর্ক হতে হবে। গজলডোবা পয়েন্টের পানি শতকরা হারে ভাগাভাগির পরিবর্তে গ্যারান্টি ক্লজসহ পানির পরিমাণ (হাজার কিউসেক) নিশ্চিত করা গেলেই কেবল বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষিত হবে। যেনতেন একটি চুক্তি বাংলাদেশের জন্য বরং অমঙ্গলই ডেকে আনবে। ঝানু কূটনীতিকরা বলে থাকেন, "No treaty is better than a bad treaty" (চুক্তি না থাকা খারাপ চুক্তির চাইতে ভালো)। তিস্তা নদীতে মোট পানিপ্রবাহের পরিমাণের অঙ্ক নির্ধারণেও বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক পানি বিশেষজ্ঞদের অবিলম্বে সম্পৃক্ত হওয়া আবশ্যক, যেন সেখানেও বর্তমান সরকার এবং বাংলাদেশের ভারতবন্ধুরা মিলে আমাদের কোনো শুভঙ্করের ফাঁকিতে ফেলতে না পারে।
সেই পাকিস্তান আমল থেকেই ভারত আমাদের বিরুদ্ধে অব্যাহত পানি আগ্রাসন চালালেও প্রতিবেশী রাষ্ট্রটির সব প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আমরা কেবল আশ্বাসবাণীই শুনে এসেছি। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প বাতিলের দাবির প্রেক্ষিতে ড. মনমোহন সিং তার পূর্বসূরিদের চর্বিত চর্বণ পুনরাবৃত্তি করে ঢাকায় বলেছেন, “ভারত এমন কিছু করবে না যাতে বাংলাদেশের জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।” বছরের পর বছর ধরে এই অভিন্ন বাক্য শুনতে শুনতে বাংলাদেশের জনগণ ক্লান্ত হয়ে পড়লেও আশ্চর্যজনকভাবে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীদের একই কথা বলাতে যেন কোনো ক্লান্তি নেই।
শেখ হাসিনা এবারের মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর মিসরের রাজধানী কায়রোতে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে ড. মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে প্রথমবার আনুষ্ঠানিক বৈঠক শেষে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে অবিকল একই মন্তব্য করেছিলেন। অথচ ভারত বরাক নদীতে বাংলাদেশের জন্য আরও একটি মরণ বাঁধ নির্মাণ থেকে সরে আসার কোনো প্রতিশ্রুতি আজ পর্যন্ত দেয়নি। ১৯৫১ সালে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ পরিকল্পনা আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমে ফাঁস হয়ে গেলে পাকিস্তান সরকারের উদ্বেগের জবাবে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুও এই কথাই বলেছিলেন। ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের ফলে বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হয়নি, বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে ষাট বছর পর এমন দাবি ‘র’ (raw)-এর বেতনভুক বাংলাদেশী এজেন্টরাই কেবল করতে পারেন।
যা হোক, শেষ কথা হলো মহাজোট সরকার তিস্তার পানি নিয়ে আমাদের আশার এক প্রকাণ্ড বেলুন ফুলিয়ে তুললেও তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি করতে ভারত চূড়ান্ত মুহূর্তে অসম্মতি জ্ঞাপন করেছে। ড. মনমোহন সিং বাড়ি বয়ে এসে শেখ হাসিনাকে বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন, নতজানু পররাষ্ট্রনীতি দিয়ে দেশের কোনো কল্যাণ সাধন হতে পারে না। এখন বাংলাদেশের জন্য অধিকতর আশঙ্কার বিষয় হলো, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সফরের ২৪ ঘণ্টা না পেরোতেই গণবিরোধী, ভারতপন্থীরা আমাদের স্বাধীনতা হরণের নতুন কৌশল প্রণয়নে কোমর বেঁধে লেগে গেছে।
এই গোষ্ঠী টেলিভিশন ‘টক শো’ এবং পত্র-পত্রিকায় লেখালেখির মাধ্যমে তিস্তার পানির সঙ্গে করিডোর বিনিময়ের একটি পটভূমি তৈরির অপচেষ্টায় জনগণের মগজ ধোলাইয়ের কাজ ইতোমধ্যে শুরু করে দিয়েছেন। সরকারের সর্বোচ্চ মহলের নির্দেশেই যে এরা মাঠে নেমেছেন, তার প্রমাণ বিতর্কিত ‘সুপার উপদেষ্টা’ ড. গওহর রিজভীর আরটিভিতে ৮ তারিখের লাইভ ইন্টারভিউতেই মিলেছে। শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রীত্বের প্রথম মেয়াদের পররাষ্ট্রবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীর তিস্তার পানি এবং করিডোর, এই দুই বিষয়কে এক না করার পরামর্শের জবাব এড়িয়ে ড. গওহর রিজভী দ্বিপাক্ষিক লেনদেনের বায়বীয় গল্প বলে সরকারের অস্বচ্ছ, রাষ্ট্রবিরোধী অবস্থানকেই পুনর্বার স্পষ্ট করেছেন। একটি চিহ্নিত কট্টর ভারত ও সরকারপন্থী পত্রিকায় ৯ সেপ্টেম্বর ‘আধাঘণ্টায় পাল্টে যায় পরিস্থিতি’ শিরোনামের লিড নিউজে লেখা হয়েছে, “আধাঘণ্টায় বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের সব পরিস্থিতি পাল্টে যায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচক্ষণতায় বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় ঘুরে দাঁড়ায়। তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তির সঙ্গে বাদ পড়ে যায় ট্রানজিটের সম্মতিপত্র সইও।”
মার্কিন ও ভারতপন্থী সুশীল (?) পত্রিকা দি ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম ওই ৯ তারিখেই তাদের সহযোগী বাংলা পত্রিকা প্রথম আলোতে লিখেছেন, “দুই দেশের চাওয়া-পাওয়ার বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশের কাছে ভারতের চাওয়ার প্রধান বিষয়—নিরাপত্তার নিশ্চয়তা ও ট্রানজিট সুবিধা। নিরাপত্তার নিশ্চয়তা আগেই দেয়া হয়েছে। ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার ব্যাপারেও বাংলাদেশ নীতিগত সম্মত হয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের প্রধান বিষয়—অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা এবং বাণিজ্য-বৈষম্য কমানো। দ্বিতীয়ত, ভারত কেন ট্রানজিট চাইছে? উত্তর-পূর্বাঞ্চলের উন্নয়নের জন্য। আমরা কেন পানি চাইছি? আমাদের উন্নয়নের জন্য।” কী চমত্কারভাবেই না আমাদের ন্যায্য অধিকারকে ভারতের আধিপত্যবাদী আবদারের সঙ্গে উন্নয়নের নামে তুলনীয় করে দেখানো হয়েছে! মাহফুজ আনাম এবং তার স্বগোত্রীয়রা দীর্ঘদিন ধরে ভারতকে করিডোর দেয়ার পক্ষে ওকালতি করে চলেছেন। সেদিন মাছরাঙা টেলিভিশনে এক সাক্ষাত্কারে ট্রানজিটের মোড়কে করিডোরের পক্ষে তার নীতিগত অবস্থানের কথা নির্দ্বিধায় স্বীকার করে তিনি অবশ্য সততার পরিচয় দিয়েছেন।
আসল কথা হলো, প্রচারণার মাধ্যমে জনগণকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করা হচ্ছে, যাতে ষোলো কোটি মানুষের অধিকারকে সাম্রাজ্যবাদী প্রতিবেশীর আবদারের কাছে বিসর্জন দিলেও দেশে কোনো কার্যকর প্রতিবাদের ঝড় না ওঠে। একথা অনস্বীকার্য যে, বাংলাদেশের গণমাধ্যমে ভারতপন্থীদের লক্ষণীয় প্রভাব রয়েছে। বাংলাদেশের স্বার্থ বিকিয়ে ভারতের সন্তুষ্টি অর্জনই যাদের মোক্ষ, সেই গোষ্ঠী গত দুই দশক ধরে করিডোরের বিনিময়ে ঐশ্বর্য প্রাপ্তির এক অবাস্তব স্বপ্ন ফেরি করে বেড়িয়েছেন। ড. মনমোহনের সফর বাংলাদেশের মোহাবিষ্ট জনগণকে অবশেষে এক জোরদার ঝাঁকুনি দিয়ে কঠিন বাস্তবে নামিয়ে এনেছে। সেই বিবেচনায় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে নিষম্ফল সফর আমার বিবেচনায় একেবারে বৃথা হয়নি। রাস্তাঘাটের আলাপচারিতায় আমার কাছে অন্তত মনে হচ্ছে, একাত্তরের মহান মুক্তিসংগ্রামের সেই স্বাধীনতার স্ফুলিঙ্গ দীর্ঘকাল বাদে গণমানসে আবার যেন দেখতে পাচ্ছি। কবি ফরহাদ মজহারের প্রত্যাশামত এদেশের জনগণের হুঁশ বোধহয় ফিরতে শুর করেছে। ১৯৭১ সালে পিন্ডি যদি আমাদের ‘দাবায়ে’ রাখতে না পেরে থাকে, ইন্শাআল্লাহ্ ২০১১-তে দিল্লিও পারবে না।
বাংলাদেশের জনগণের উপলব্ধি করা কর্তব্য যে, আমাদের মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার স্বার্থে ভারতকে করিডোর দেয়ার প্রস্তাবে আমরা স্বপ্নে প্রাপ্ত কোনো ‘প্রাচুর্যের’ বিনিময়েই সম্মত হতে পারি না। আধিপত্যবাদী প্রতিবেশীকে একবার করিডোর দেয়া হলে এদেশে অশান্তি ও যুদ্ধবিগ্রহ অবশ্যম্ভাবী। ভারতের উত্তর-পূর্বের সাত রাজ্যের প্রতিটিতেই সেই ১৯৪৭ সাল থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদী সহিংস আন্দোলন চলছে। সেসব সশস্ত্র সংগঠনকে দমনের জন্য বিপুলসংখ্যায় ভারতীয় কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য ছয় দশক ধরে কেবল সেখানে অবস্থানই করছে না, আকাশ ও স্থলপথে তাদের বিদ্রোহ দমনের জন্য নিয়মিত প্রয়োজনীয় সামরিক রসদও প্রেরণ করা হচ্ছে। ভারতের মূল ভূখণ্ড এবং সাত রাজ্যের মাঝখানে বাংলাদেশের অবস্থান হওয়ার কারণে স্থলপথে রসদসমূহ জলপাইগুড়ির চিকেন নেক ঘুরে পাঠাতে হচ্ছে। ফলে একদিকে ভারত সরকারের যেমন ব্যয় বৃদ্ধি হচ্ছে, অপরদিকে বিরোধীপক্ষের সামরিক আক্রমণে চিকেন নেক বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার আশঙ্কাও সার্বক্ষণিকভাবে থেকে যাচ্ছে।
সুতরাং মুখে উন্নয়নের কথা প্রচার করা হলেও প্রকৃতপক্ষে সামরিক স্বার্থেই বাংলাদেশের বুক চিরে ভারতের করিডোর আবশ্যক। চীনের সঙ্গে ভারতের সম্ভাব্য সংঘর্ষের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান অতীব গুরুত্বপূর্ণ। আমরা ষোলো কোটি মানবসন্তানের এক দরিদ্র ও শান্তিপ্রিয় জনগোষ্ঠী। এশিয়ার দুই বৃহত্ শক্তির দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জড়িত হওয়ার কোনো ইচ্ছা আমাদের নেই। বাংলাদেশের বর্তমান শাসকশ্রেণী ভারতকে করিডোর দিয়ে সেই দ্বন্দ্বে বাংলাদেশকে সম্পৃক্ত করার অপচেষ্টায় রত হয়েছে। তাছাড়া ভারতে বিভিন্ন দ্বন্দ্ব-সংঘাতের প্রতিক্রিয়ায় জঙ্গিবাদ এক বিপজ্জনক পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। এই উপমহাদেশের তিনটি রাষ্ট্রের মধ্যে বাংলাদেশই সামগ্রিকভাবে জঙ্গিবাদমুক্ত রয়েছে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী যখন বাংলাদেশ সফর করছিলেন, সেই সময় দিল্লি হাইকোর্টে সন্ত্রাসী হামলায় শতাধিক ব্যক্তি হতাহত হয়েছে। করিডোর প্রদান করে আমরা এদেশে জঙ্গিবাদ আমদানির ঝুঁকি নিতে পারি না। বর্তমান সরকারের দেশের স্বার্থবিরোধী এসব কর্মকাণ্ডকে প্রতিহত করতে হলে দেশপ্রেমিক জনতার প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
তাছাড়া অর্থনৈতিক বিবেচনাতেও করিডোর প্রদান দেশের জন্য কোনো সুফল বয়ে আনবে না। এ বিষয়টি বুঝতে পেরেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টারা এখন দেশবাসীকে প্রত্যক্ষ লাভের বদলে পরোক্ষ আয়ের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। বাংলাদেশকে সিঙ্গাপুরে পরিণত করার স্বপ্ন দেখানো ফতোয়াবাজরা ভোল পাল্টে সরকারকে সম্প্রতি ধীরে চলার পরামর্শ দিচ্ছেন। অবশেষে শুভবুদ্ধির উদয় হওয়ার জন্য এসব মরশুমী বুদ্ধিজীবীকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ড. গওহর রিজভী নতুন থিওরি কপচাচ্ছেন, শুল্ক তেমন একটা পাওয়া না গেলেও ভারতীয় ট্রাক ড্রাইভারদের সেবায় বাংলাদেশে হোটেল-রেস্তোরাঁ খুললে সেখান থেকেই আমাদের প্রচুর আয়-রোজগার হবে! এর আগে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ফতোয়া দিয়েছিলেন যে, একটি ‘ট্রানজিট রাষ্ট্র’ হওয়ার জন্যই নাকি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। একই অর্থমন্ত্রী এমন দাবিও করেছেন যে, ২০১০ সালেই তারা ভারতকে ট্রানজিট দিয়ে দিয়েছেন।
অপরদিকে ড. গওহর রিজভী এবং ড. মসিউর রহমান মনে করেন, ১৯৭২ এবং ১৯৭৪ সালে প্রণীত বাণিজ্য চুক্তি ও মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিতেই নাকি মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান ভারতকে ট্রানজিট দিয়ে গেছেন। আমার বিবেচনায় এসব বক্তব্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য কেবল অবমাননাকরই নয়, সেই সঙ্গে রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলকও। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে অপসংস্কৃতির সঙ্গে ভারতীয় মাদক আগ্রাসনেরও শিকারে পরিণত হয়েছে। করিডোর দেয়া হলে তরুণদের মধ্যে ভারতীয় মাদকের ব্যবহার বৃদ্ধির পাশাপাশি অন্যান্য আনুষঙ্গিক অপরাধপ্রবণতাও এদেশে বৃদ্ধি পেতে বাধ্য। মরণব্যাধি ‘এইডসে’র মহামারীতে ভারত বর্তমানে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। এ ধরনের ব্যাধি বিভিন্ন দেশে ভারী যানবাহন চালকদের মাধ্যমেই সচরাচর সংক্রমিত হয়ে থাকে। অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, বর্তমান সরকার বাংলাদেশকে সর্বদিক থেকে একটি বিপজ্জনক রাষ্ট্রে পরিণত করতে উদ্যত হয়েছে। আগামী প্রজন্মকে নিরাপদ করতে হলে এদের প্রতিহত না করে উপায় নেই।
আসুন সমস্বরে বলি, তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা ভারতকে দিতেই হবে, কারণ এটা আমাদের অধিকার। এবং সেই পানির বিনিময়ে করিডোর প্রদানের অপকৌশল আমরা কিছুতেই বাস্তবায়ন হতে দেবো না। ড. মনমোহন সিং তার এই সফরে বাংলাদেশের প্রকৃত স্বাধীনতা হরণের অর্ধেকটা Framework Agreement স্বাক্ষর করতে শেখ হাসিনা সরকারকে বাধ্য করার মাধ্যমে সম্পন্ন করেছেন। এরপর করিডোর নিতে পারলেই বাংলাদেশকে আক্ষরিক অর্থেই একটি vassal state (পোষ্য রাষ্ট্র)-এ রূপান্তর করা যাবে। এ বিষয়ে দ্বিতীয় কিস্তিতে বিশদভাবে লেখার ইচ্ছে রইল। করিডোর প্রদানের সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেই এ সপ্তাহের মন্তব্য প্রতিবেদন সমাপ্ত করছি।
(দ্বিতীয় কিস্তি আগামী ২১ সেপ্টেম্বর ২০১১ বুধবার)
No comments