নরওয়ে ট্র্যাজেডির শিক্ষা by ইনাম আহমদ চৌধুরী
শান্তির দেশ মধ্যরাতের সূর্যের দেশ নরওয়ে। শান্তির নগর তিলোত্তমা অসলো। তারই বুক ঘেঁষে স্বপ্নদ্বীপ ইউটোয়া হচ্ছে স্বর্গপুরী। গত শুক্রবার সেখানেই নেমে এল দোজখের বিভীষিকা। উত্তর সাগর নরওয়েজিয়ান সির কোলে বঙ্কিম ভঙ্গিমায় শায়িত অসংখ্য ফিয়র্ড অলংকৃত বিরল বৃক্ষরাজিশোভিত ও বরফাচ্ছাদিত বিরাট প্রান্তরের মতো, ৪৯ লাখ শান্তিপ্রিয় জন-অধ্যুষিত প্রাচুর্যের দেশ নরওয়ে। এখান থেকেই যথাযথভাবে দরিদ্রবান্ধব অধ্যাপক ইউনূস নিয়ে এসেছিলেন বিশ্বশান্তির নোবেল বরমাল্যের বিরল সম্মাননা—বাঙালির গর্বের ধন। এ শান্তির নীড়ে যে এ ধরনের কোনো বীভৎ স তাণ্ডব হতে পারে, তা কোনো অবস্থাতেই কেউ ভাবেনি।
তাই তো যখন নগরের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কর্মকেন্দ্রে—যেখানে অবিস্থিত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, তেল মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং অন্যান্য সরকারি অফিস, জনপ্রিয় দৈনিক বিজ-এর কার্যালয়—বোমা বিস্ফোরিত হলো, সবাই বিস্ময়াহত। পুলিশও কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সৌভাগ্যবশত সরকারি ছুটি থাকায় প্রধানমন্ত্রী জেনস স্টলটেনবার্গ নিজের অফিসে ছিলেন না, তবে তাঁর ১৭ তলা ভবন ভেঙে চুরমার। প্রাণহানি হলো অবশ্য সাতজনের, আহত বহু। বিধ্বংসী এ বিস্ফোরণ ঘটাল অ্যানডার্স বেরিং ব্রেইভিক নামের ৩২ বছর বয়সী একজন জাতিগত নরওয়েজিয়ান-ককেশীয় উগ্রপন্থী খ্রিষ্টান—একটি চরমপন্থী রক্ষণশীল দলের সমর্থক ও সাবেক সদস্য। অসলোর নিকটবর্তী নৈসর্গিক অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত উতোইয়া দ্বীপে পুলিশের ছদ্মবেশে ব্রেইভিক গেলেন—সেখানে ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত যুব সমাবেশে অংশগ্রহণকারীদের আহ্বান করে তিনি চালালেন নির্বাচারে গুলি। আত্মরক্ষার জন্য কারও কাছে কোনো অস্ত্র নেই। স্বয়ংক্রিয় রাইফেলের গুলি খেয়ে নিকটস্থ লেকের পানিতে ঝাঁপ দেন অনেক তরুণ-তরুণী। ব্রেইভিক তাড়া করে সেখানেও তাঁদের গুলি করেন। সঙ্গে তাঁর ছিল একটি শটগান ও পিস্তল। আড্রিয়ান প্র্যাক্টন নামের আহত একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, হত্যাকারী অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা মোতাবেক নির্বিচারে সর্বাধিক জনহত্যার জন্য হত্যা করে যাচ্ছিলেন। তাঁকে দেখাচ্ছিল সিনেমার একজন নাৎ সি যুদ্ধকর্মীর মতো।
পুলিশপ্রধান ওয়েস্টিন মায়েল্যান্ডের মতে, বিস্ফোরণ ও গুলিতে প্রায় ৯৬ জন নিহত হয়েছেন, আহত আরও অনেকে। নিহত মানুষের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। ঘাতক একটি কৃষি ফার্ম গঠন করেছিলেন ধোঁকা দেওয়ার জন্য। একজন কৃষি ব্যবসায়ীর কাছ থেকে গত মে মাসে তিনি ছয় টন সার কিনেছিলেন বিস্ফোরক তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করার জন্য। অর্থাৎ এই হত্যাযজ্ঞের প্রস্তুতি ব্রেইভিক নিচ্ছিলেন বহুদিন ধরেই, আকস্মিক উন্মাদনা ছিল না এটি।
তদন্তে প্রকাশ, ব্রেইভিক নিজেকে ফেসবুকে পরিচয় দিয়েছিলেন রক্ষণশীল খ্রিষ্টান হিসেবে। তিনি যুদ্ধসংক্রান্ত কম্পিউটার খেলা পছন্দ করতেন। তিনি কল্পনা করতেন, তিনি মধ্যযুগীয় ক্রুসেডের একজন নাইটস টেম্পলার। ব্রিটিশ দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিলের একটি বাণী তিনি টুইটার অ্যাকাউন্টে প্রকাশ করেছিলেন, ‘একজন বিশ্বাসী লাখো স্বার্থান্বেষী মানুষের মতো শক্তিশালী।’ তাঁর ধারণা ও আশা, একাই তিনি বিরাট পরিবর্তনের সূচনা করতে পারেন একটি বিরাট ধাক্কা দিয়ে। কেননা, তাঁর একটি বিশ্বাস আছে। তিনি ছিলেন বামপন্থী উদারতা, মার্ক্সিস্ট সংস্কৃতি ও ইসলামবিদ্বেষী।
বিশ্বের সর্বত্রই এই জঘন্যতম নৃশংস ঘটনার জোরালো নিন্দাবাদ হয়েছে এবং হচ্ছে। রাষ্ট্রনায়ক, রাজনীতিবিদ, সমাজনেতারা কথা বলেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ওবামা বলেছেন, এটা স্মরণ করিয়ে দেয় যে সমগ্র আন্তর্জাতিক সমাজের এ ধরনের সন্ত্রাস দমনে স্বার্থ রয়েছে। জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল বলেছেন, গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও শান্তিতে বিশ্বাসী সবাইকে একযোগে এজাতীয় ঘৃণার বিরুদ্ধে কাজ করে যেতে হবে।
এ ভাষণগুলোর মর্মার্থ সত্যি। কিন্তু আমরা বিশ্লেষণ করলে দেখতে পারি, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিশ্বনেতা ও রাষ্ট্রনায়কেরা তাঁদের ঘোষিত বাণী অনুসরণ করছেন না। রাষ্ট্রযন্ত্র ও সমাজচালকেরা যেন কখনো কখনো ইচ্ছাকৃতভাবেই প্রকৃত সত্য বা ঘটনার মূল উদ্ঘাটন না করেই পূর্বনির্ধারিত একটি ধারণা প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী এবং তা মূলত ইসলামবিদ্বেষী।
নরওয়ের এই বীভৎ স ঘটনাই দেখা যাক। প্রথমেই মিডিয়া জোর সন্দেহ করল, এটা হতে পারে লিবিয়া ও আফগানিস্তানে নরওয়ের সেনাদল কর্তৃক পশ্চিমা আগ্রাসনের এবং বেসামরিক জনহত্যায় অংশগ্রহণের প্রতিশোধ। কেউ বললেন, নরওয়ে-নিবাসী কোনো উগ্রবাদী মুসলিম বা দল আছে এর পেছনে। এই অমূলক সন্দেহ নিয়ে অতি স্বল্প সময়েই বিশ্বে বহু গুজবের রটনা হলো—হলো ঘৃণার বিস্তার। ব্রেইভিক পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে দাম্ভিক স্বীকারোক্তি না করলে হয়তো এজাতীয় ধারণা আরও বিস্তার লাভ করত। দুর্ভাগ্যবশত পৃথিবীর রাষ্ট্র ও মিডিয়াযন্ত্রের নিয়ন্ত্রক ও চালক বিরাট শক্তিমান এবং বর্তমানে একটি বিশেষ স্বার্থসমন্বিত চিন্তাধারার বাহক। যুক্তরাষ্ট্রে ৯/১১ হয়েছিল, কিন্তু সেখানে ১৯৯৫ সালে ওকলাহোমা শহরে আমেরিকান টিমোথি ম্যাকভির মতো উগ্রবাদী খ্রিষ্টানরা ট্রাকবোমা দিয়ে ১৬৮ জন নিরপরাধ লোককে নির্বিচারে হত্যা করেছিল। টিমোথিও ছিলেন ব্রেইভিকের মতো গণতন্ত্র ও ইসলামবিরোধী। এ ধরনের সদেশ-উদ্ভূত বহু অঘটন ঘটেছে খোদ যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিতে। হয়েছে ব্রিটেন, স্পেন, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, রাশিয়া এমনকি বাংলাদেশেও। প্রতিটি ঘটনাই বর্বরোচিত, বীভৎ স। প্রতিটি ঘটনাই চরমপন্থী উগ্রমতবাদীদের কুকাণ্ড। দুর্ভাগ্যবশত এর মধ্যে কখনো-বা রাষ্ট্রযন্ত্র এবং দেশি-বিদেশি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বা শক্তিশালী রাজনৈতিক সংস্থাও সংশ্লিষ্ট থাকছে। যেমন—ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, ইরাক ও আফগানিস্তানে।
আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, বিভিন্ন স্থানে সুনিয়ন্ত্রিত দাঙ্গা, দেখেছি গুজরাট, আহমদাবাদে নির্বিচারে মুসলিম নিধন, দিল্লিতে শিখ হত্যা। আমরা দেখেছি বিভিন্ন দেশে সাম্প্রদায়িকতা, গোত্রগত-বর্ণগত-অঞ্চলগত ভেদাভেদের জন্য সবল দুর্বলের ওপর নৃশংস হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। হচ্ছে পরাশক্তি কর্তৃক নিজস্বার্থে কাপুরুষোচিত আক্রমণ। কাশ্মীরে তো ভারতীয় সেনাবাহিনী ধর্ষণকে তাদের একটি রণকৌশল হিসেবে ব্যবহার করছে। রাষ্ট্রযন্ত্র মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোনো তোয়াক্কাই করছে না। ২২ জুলাই বিলেতের গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত একটি তথ্যবহুল নিবন্ধে সীমা দাশগুপ্তা বর্ণনা দিয়েছেন, ভারতে রাষ্ট্রযন্ত্র কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘন গণতন্ত্রকে একটি উপহাসে পরিণত করেছে। একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশপ্রধান প্রকাশ সিংকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেছেন, ‘এটা ঠিক যে উগ্রপন্থী কার্যকলাপ আইনের কাঠামোয় এনে কঠোরভাবে দমন করতে হবে। তবে ভারতে সে রাষ্ট্রযন্ত্র এখন “লুণ্ঠনকারী লোলুপ” হয়ে উঠেছে।’ পাকিস্তানে এখন চলছে অব্যাহত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। আফগানিস্তানে দেশি-বিদেশি সেনাবাহিনী কর্তৃক শিশু-মহিলাসহ সংখ্যাতীত নিরপরাধের প্রাণহানি ঘটছে।
এ সম্পর্কে দ্বিমতের কোনো অবকাশ নেই, সব ধরনের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম ও অভিযান চালিয়ে যেতে হবে। সন্ত্রাস হতে পারে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, দলগত বা ব্যক্তিগত। তবে এর সাফল্যের জন্য প্রয়োজন আন্তরিকতা ও নিরপেক্ষভাবে সন্ত্রাসের কারণ নির্ণয় করে তার প্রতিষেধক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। আগে স্বার্থপ্রণোদিত ধারণার বশবর্তী হয়ে পদক্ষেপ নিলে তা কুফলপ্রসবা হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তা হরহামেশাই হচ্ছে। সুইডেনের ‘এগজিস্ট ফাউন্ডেশন’-এর রবার্ট ওরেল বলেছেন, ইসলামিক র্যাডিকেলদের ওপর অতিরিক্ত নজর চরম ডানপন্থী উগ্রবাদ প্রসারে অনুকূল হয়েছে। ইউরোপ ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় যে উগ্রপন্থী খ্রিষ্টান ও চরম ডানপন্থীদের প্রসার বাড়ছে, সন্দেহ নেই। এবং নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ম্যাথু গুডউইনও মনে করেন, ইসলামিক চরমপন্থীদের ওপর অহেতুক অতিরিক্ত ‘ফোকাস’ অন্যান্য উগ্রপন্থী মতাদর্শের এবং কর্মকাণ্ড প্রসারের সহায়তা করছে। নিও-নাজি কার্যকলাপও বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা হয়েছে।
যেকোনো উগ্র মতবাদ ও চরমপন্থী মতাদর্শ বা অসহনশীলতাই সন্ত্রাসের জন্ম দিতে পারে। অন্যায় আচরণ, অধিকার হরণ, অত্যাচার-অবিচার যে ক্ষোভ ও বঞ্চনার সৃষ্টি করে, তা দেয় প্রতিশোধের স্পৃহার জন্ম এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা হয়ে ওঠে সন্ত্রাসের সূতিকাগার। ইতিহাস ও সাম্প্রতিক ঘটনাবলি তা-ই প্রমাণ করে। বিভিন্ন ঘটনা ঘৃণা বা আশঙ্কার জন্ম দেয় এবং তার প্রতিফলন কখনো ঘটে যায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে। যেমন—ব্রেইভিকের জবানিতেই তিনি মার্ক্সিস্ট সংস্কৃতির ও ইসলামবিদ্বেষী। মধ্য বামপন্থী নরওয়েজিয়ান লেবার সরকারকেও তাঁর অপছন্দ। তিনি স্বীকার করেছেন, তাঁর কৃতকর্ম বর্বরোচিত, কিন্তু এর প্রয়োজন ছিল। কেননা, তিনি ইউরোপীয় বা খ্রিষ্টানদের বিরাট এক আঘাত করে মার্ক্সীয় সংস্কৃতি, ইসলাম এবং অহেতুক সহনশীলতার প্রসার সম্পর্কে সাবধান করতে চেয়েছিলেন। এরই জন্য বহু হত্যা বা ধ্বংসের প্রয়োজন ছিল, যাতে তাদের টনক নড়ে। এবং এ জঘন্য ক্রাইমের জন্য তাঁর সর্বোচ্চ শাস্তি দেশের বর্তমান আইনে হবে মাত্র ২১ বছরের জেল, ফাঁসি বা ইলেকট্রিক চেয়ার নয়।
নরওয়ে বা স্ক্যান্ডিনেভিয়ার সাম্প্রতিক ইতিহাস কিন্তু এ ধরনের চরমপন্থী বা নিও-নাজিদের উত্থানের শুধু আভাস-ইঙ্গিত নয়, জীবন্ত প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। তাদের উদার রাষ্ট্রীয় নীতির জন্য অনেক অভিবাসী ওখানে বসতি গেড়েছেন এবং দ্বিতীয় প্রজন্মের অনেকেই যথেষ্ট বর্ধিষ্ণু হয়েছেন। তাই স্থানীয় অধিবাসীদের কেউ কেউ অসহনশীল হয়ে ঈর্ষা করে ভাবেন, তাঁরা উড়ে এসে জুড়ে বসতে চাইছেন। ২০০৭ সালে ৬১ হাজার ২০০ বিদেশি স্থায়ী নিবাসের জন্য এখানে আশ্রয় নিয়েছেন। এর মধ্যে ভারতীয়, শ্রীলঙ্কান, তামিল ও এশীয় এবং উত্তর আফ্রিকার সোমালি-সুদানিসহ প্রচুর অভিবাসী মুসলমান। বাংলাদেশি অবশ্য হাজার খানেক। নরওয়ের ৪৯ লাখ লোকের মধ্যে এক-দশমাংশই এখন অভিবাসী। ষাটের দশকে তেল আবিষ্কার এবং শিল্পোন্নয়নের জন্য নরওয়ে বর্তমানে বিশ্বের একটি অন্যতম ধনী দেশ, যেখানে সামাজিক নিরাপত্তা রয়েছে সর্বাধিক। শুধু তেল থেকেই নরওয়ের বার্ষিক আয় ৪০ বিলিয়ন ডলার। উগ্র চরমপন্থীদের বিশেষ আবেদন তাই নতুন প্রজন্মের কাছে—যারা প্রাচুর্যের কোলে লালিত। তাদের তো দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন বা তেল-পূর্ব নরওয়েবাসের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। দেখা যাচ্ছে, প্রাচীনেরা সম্ভবত তাঁদের অভিজ্ঞতাজনিত কারণে যথেষ্ট সহনশীল, যদিও খ্রিষ্টান লুথেরান চার্ট এখনো রাষ্ট্রীয় সহায়তা পায়। ব্রেইভিক তো বলেছেন, তিনি পোপকেও সমর্থন করেন। সাধারণভাবে তাদের ধারণা, অভিবাসীরা অন্যায়ভাবে নরওয়ের সম্পদের ভাগীদার হচ্ছে, চালু করছে ভিন্ন সংস্কৃতি-মূল্যবোধ। এটা ওদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
এই বিরাট ট্র্যাজেডি থেকে নিশ্চয়ই শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। প্রথমত বুঝতে হবে, যেকোনো উগ্র মতবাদ, রাষ্ট্রীয় বা গোষ্ঠীগত স্বার্থ বা ধর্মীয় গোঁড়ামি এ ধরনের সহিংস সন্ত্রাসের জন্ম দিতে পারে। এবং তা নিরপেক্ষভাবে নির্ণয় করে সম্মিলিতভাবেই সবাইকে প্রচেষ্টা নিতে হবে সব রাষ্ট্রের, সব জাতির, সব মানুষের। নইলে কোনো দেশ বা সমাজই সন্ত্রাসের মরণছোবল থেকে রেহাই পাবে না। তবে আশ্বাস ও স্বস্তির কথা, নরওয়েজিয়ান সরকার অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে এ ট্র্যাজেডির মোকাবিলা করেছে। আন্তর্জাতিক মানবতাবাদী ফ্রিড নেন সেনের ঐতিহ্যের দেশ নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী জিনেস স্টলটেনবার্গ পরম বিশ্বাসে বলেছেন, ‘আমরা পৃথিবীকে দেখিয়ে দেব, নরওয়েজিয়ান গণতন্ত্রের উত্তরোত্তর বিকাশ হচ্ছে। কেউ বোমাবাজি করে আমাদের থামাতে পারবে না। আমরা আমাদের মূল্যবোধ আঁকড়ে থাকব। আমরা দেখিয়ে দেব, পরীক্ষার এই ক্রান্তিকালে নরওয়েজিয়ান সমাজ রুখে দাঁড়াতে পারে—We must show that Norwegian society can stand up to these testing time. We must show humanity, but not naivety?’
নরওয়েজিয়ান জনগণকে সমবেদনা জানানোর সঙ্গে নরওয়ের নেতৃত্বকে প্রশস্তি জানাই। জানাই সাধুবাদ। জয় হোক তাদের আশাবাদী মতাদর্শের।
ইনাম আহমদ চৌধুরী: বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা।
তাই তো যখন নগরের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কর্মকেন্দ্রে—যেখানে অবিস্থিত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, তেল মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং অন্যান্য সরকারি অফিস, জনপ্রিয় দৈনিক বিজ-এর কার্যালয়—বোমা বিস্ফোরিত হলো, সবাই বিস্ময়াহত। পুলিশও কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সৌভাগ্যবশত সরকারি ছুটি থাকায় প্রধানমন্ত্রী জেনস স্টলটেনবার্গ নিজের অফিসে ছিলেন না, তবে তাঁর ১৭ তলা ভবন ভেঙে চুরমার। প্রাণহানি হলো অবশ্য সাতজনের, আহত বহু। বিধ্বংসী এ বিস্ফোরণ ঘটাল অ্যানডার্স বেরিং ব্রেইভিক নামের ৩২ বছর বয়সী একজন জাতিগত নরওয়েজিয়ান-ককেশীয় উগ্রপন্থী খ্রিষ্টান—একটি চরমপন্থী রক্ষণশীল দলের সমর্থক ও সাবেক সদস্য। অসলোর নিকটবর্তী নৈসর্গিক অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত উতোইয়া দ্বীপে পুলিশের ছদ্মবেশে ব্রেইভিক গেলেন—সেখানে ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত যুব সমাবেশে অংশগ্রহণকারীদের আহ্বান করে তিনি চালালেন নির্বাচারে গুলি। আত্মরক্ষার জন্য কারও কাছে কোনো অস্ত্র নেই। স্বয়ংক্রিয় রাইফেলের গুলি খেয়ে নিকটস্থ লেকের পানিতে ঝাঁপ দেন অনেক তরুণ-তরুণী। ব্রেইভিক তাড়া করে সেখানেও তাঁদের গুলি করেন। সঙ্গে তাঁর ছিল একটি শটগান ও পিস্তল। আড্রিয়ান প্র্যাক্টন নামের আহত একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, হত্যাকারী অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা মোতাবেক নির্বিচারে সর্বাধিক জনহত্যার জন্য হত্যা করে যাচ্ছিলেন। তাঁকে দেখাচ্ছিল সিনেমার একজন নাৎ সি যুদ্ধকর্মীর মতো।
পুলিশপ্রধান ওয়েস্টিন মায়েল্যান্ডের মতে, বিস্ফোরণ ও গুলিতে প্রায় ৯৬ জন নিহত হয়েছেন, আহত আরও অনেকে। নিহত মানুষের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। ঘাতক একটি কৃষি ফার্ম গঠন করেছিলেন ধোঁকা দেওয়ার জন্য। একজন কৃষি ব্যবসায়ীর কাছ থেকে গত মে মাসে তিনি ছয় টন সার কিনেছিলেন বিস্ফোরক তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করার জন্য। অর্থাৎ এই হত্যাযজ্ঞের প্রস্তুতি ব্রেইভিক নিচ্ছিলেন বহুদিন ধরেই, আকস্মিক উন্মাদনা ছিল না এটি।
তদন্তে প্রকাশ, ব্রেইভিক নিজেকে ফেসবুকে পরিচয় দিয়েছিলেন রক্ষণশীল খ্রিষ্টান হিসেবে। তিনি যুদ্ধসংক্রান্ত কম্পিউটার খেলা পছন্দ করতেন। তিনি কল্পনা করতেন, তিনি মধ্যযুগীয় ক্রুসেডের একজন নাইটস টেম্পলার। ব্রিটিশ দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিলের একটি বাণী তিনি টুইটার অ্যাকাউন্টে প্রকাশ করেছিলেন, ‘একজন বিশ্বাসী লাখো স্বার্থান্বেষী মানুষের মতো শক্তিশালী।’ তাঁর ধারণা ও আশা, একাই তিনি বিরাট পরিবর্তনের সূচনা করতে পারেন একটি বিরাট ধাক্কা দিয়ে। কেননা, তাঁর একটি বিশ্বাস আছে। তিনি ছিলেন বামপন্থী উদারতা, মার্ক্সিস্ট সংস্কৃতি ও ইসলামবিদ্বেষী।
বিশ্বের সর্বত্রই এই জঘন্যতম নৃশংস ঘটনার জোরালো নিন্দাবাদ হয়েছে এবং হচ্ছে। রাষ্ট্রনায়ক, রাজনীতিবিদ, সমাজনেতারা কথা বলেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ওবামা বলেছেন, এটা স্মরণ করিয়ে দেয় যে সমগ্র আন্তর্জাতিক সমাজের এ ধরনের সন্ত্রাস দমনে স্বার্থ রয়েছে। জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল বলেছেন, গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও শান্তিতে বিশ্বাসী সবাইকে একযোগে এজাতীয় ঘৃণার বিরুদ্ধে কাজ করে যেতে হবে।
এ ভাষণগুলোর মর্মার্থ সত্যি। কিন্তু আমরা বিশ্লেষণ করলে দেখতে পারি, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিশ্বনেতা ও রাষ্ট্রনায়কেরা তাঁদের ঘোষিত বাণী অনুসরণ করছেন না। রাষ্ট্রযন্ত্র ও সমাজচালকেরা যেন কখনো কখনো ইচ্ছাকৃতভাবেই প্রকৃত সত্য বা ঘটনার মূল উদ্ঘাটন না করেই পূর্বনির্ধারিত একটি ধারণা প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী এবং তা মূলত ইসলামবিদ্বেষী।
নরওয়ের এই বীভৎ স ঘটনাই দেখা যাক। প্রথমেই মিডিয়া জোর সন্দেহ করল, এটা হতে পারে লিবিয়া ও আফগানিস্তানে নরওয়ের সেনাদল কর্তৃক পশ্চিমা আগ্রাসনের এবং বেসামরিক জনহত্যায় অংশগ্রহণের প্রতিশোধ। কেউ বললেন, নরওয়ে-নিবাসী কোনো উগ্রবাদী মুসলিম বা দল আছে এর পেছনে। এই অমূলক সন্দেহ নিয়ে অতি স্বল্প সময়েই বিশ্বে বহু গুজবের রটনা হলো—হলো ঘৃণার বিস্তার। ব্রেইভিক পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে দাম্ভিক স্বীকারোক্তি না করলে হয়তো এজাতীয় ধারণা আরও বিস্তার লাভ করত। দুর্ভাগ্যবশত পৃথিবীর রাষ্ট্র ও মিডিয়াযন্ত্রের নিয়ন্ত্রক ও চালক বিরাট শক্তিমান এবং বর্তমানে একটি বিশেষ স্বার্থসমন্বিত চিন্তাধারার বাহক। যুক্তরাষ্ট্রে ৯/১১ হয়েছিল, কিন্তু সেখানে ১৯৯৫ সালে ওকলাহোমা শহরে আমেরিকান টিমোথি ম্যাকভির মতো উগ্রবাদী খ্রিষ্টানরা ট্রাকবোমা দিয়ে ১৬৮ জন নিরপরাধ লোককে নির্বিচারে হত্যা করেছিল। টিমোথিও ছিলেন ব্রেইভিকের মতো গণতন্ত্র ও ইসলামবিরোধী। এ ধরনের সদেশ-উদ্ভূত বহু অঘটন ঘটেছে খোদ যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিতে। হয়েছে ব্রিটেন, স্পেন, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, রাশিয়া এমনকি বাংলাদেশেও। প্রতিটি ঘটনাই বর্বরোচিত, বীভৎ স। প্রতিটি ঘটনাই চরমপন্থী উগ্রমতবাদীদের কুকাণ্ড। দুর্ভাগ্যবশত এর মধ্যে কখনো-বা রাষ্ট্রযন্ত্র এবং দেশি-বিদেশি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বা শক্তিশালী রাজনৈতিক সংস্থাও সংশ্লিষ্ট থাকছে। যেমন—ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, ইরাক ও আফগানিস্তানে।
আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, বিভিন্ন স্থানে সুনিয়ন্ত্রিত দাঙ্গা, দেখেছি গুজরাট, আহমদাবাদে নির্বিচারে মুসলিম নিধন, দিল্লিতে শিখ হত্যা। আমরা দেখেছি বিভিন্ন দেশে সাম্প্রদায়িকতা, গোত্রগত-বর্ণগত-অঞ্চলগত ভেদাভেদের জন্য সবল দুর্বলের ওপর নৃশংস হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। হচ্ছে পরাশক্তি কর্তৃক নিজস্বার্থে কাপুরুষোচিত আক্রমণ। কাশ্মীরে তো ভারতীয় সেনাবাহিনী ধর্ষণকে তাদের একটি রণকৌশল হিসেবে ব্যবহার করছে। রাষ্ট্রযন্ত্র মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোনো তোয়াক্কাই করছে না। ২২ জুলাই বিলেতের গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত একটি তথ্যবহুল নিবন্ধে সীমা দাশগুপ্তা বর্ণনা দিয়েছেন, ভারতে রাষ্ট্রযন্ত্র কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘন গণতন্ত্রকে একটি উপহাসে পরিণত করেছে। একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশপ্রধান প্রকাশ সিংকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেছেন, ‘এটা ঠিক যে উগ্রপন্থী কার্যকলাপ আইনের কাঠামোয় এনে কঠোরভাবে দমন করতে হবে। তবে ভারতে সে রাষ্ট্রযন্ত্র এখন “লুণ্ঠনকারী লোলুপ” হয়ে উঠেছে।’ পাকিস্তানে এখন চলছে অব্যাহত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। আফগানিস্তানে দেশি-বিদেশি সেনাবাহিনী কর্তৃক শিশু-মহিলাসহ সংখ্যাতীত নিরপরাধের প্রাণহানি ঘটছে।
এ সম্পর্কে দ্বিমতের কোনো অবকাশ নেই, সব ধরনের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম ও অভিযান চালিয়ে যেতে হবে। সন্ত্রাস হতে পারে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, দলগত বা ব্যক্তিগত। তবে এর সাফল্যের জন্য প্রয়োজন আন্তরিকতা ও নিরপেক্ষভাবে সন্ত্রাসের কারণ নির্ণয় করে তার প্রতিষেধক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। আগে স্বার্থপ্রণোদিত ধারণার বশবর্তী হয়ে পদক্ষেপ নিলে তা কুফলপ্রসবা হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তা হরহামেশাই হচ্ছে। সুইডেনের ‘এগজিস্ট ফাউন্ডেশন’-এর রবার্ট ওরেল বলেছেন, ইসলামিক র্যাডিকেলদের ওপর অতিরিক্ত নজর চরম ডানপন্থী উগ্রবাদ প্রসারে অনুকূল হয়েছে। ইউরোপ ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় যে উগ্রপন্থী খ্রিষ্টান ও চরম ডানপন্থীদের প্রসার বাড়ছে, সন্দেহ নেই। এবং নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ম্যাথু গুডউইনও মনে করেন, ইসলামিক চরমপন্থীদের ওপর অহেতুক অতিরিক্ত ‘ফোকাস’ অন্যান্য উগ্রপন্থী মতাদর্শের এবং কর্মকাণ্ড প্রসারের সহায়তা করছে। নিও-নাজি কার্যকলাপও বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা হয়েছে।
যেকোনো উগ্র মতবাদ ও চরমপন্থী মতাদর্শ বা অসহনশীলতাই সন্ত্রাসের জন্ম দিতে পারে। অন্যায় আচরণ, অধিকার হরণ, অত্যাচার-অবিচার যে ক্ষোভ ও বঞ্চনার সৃষ্টি করে, তা দেয় প্রতিশোধের স্পৃহার জন্ম এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা হয়ে ওঠে সন্ত্রাসের সূতিকাগার। ইতিহাস ও সাম্প্রতিক ঘটনাবলি তা-ই প্রমাণ করে। বিভিন্ন ঘটনা ঘৃণা বা আশঙ্কার জন্ম দেয় এবং তার প্রতিফলন কখনো ঘটে যায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে। যেমন—ব্রেইভিকের জবানিতেই তিনি মার্ক্সিস্ট সংস্কৃতির ও ইসলামবিদ্বেষী। মধ্য বামপন্থী নরওয়েজিয়ান লেবার সরকারকেও তাঁর অপছন্দ। তিনি স্বীকার করেছেন, তাঁর কৃতকর্ম বর্বরোচিত, কিন্তু এর প্রয়োজন ছিল। কেননা, তিনি ইউরোপীয় বা খ্রিষ্টানদের বিরাট এক আঘাত করে মার্ক্সীয় সংস্কৃতি, ইসলাম এবং অহেতুক সহনশীলতার প্রসার সম্পর্কে সাবধান করতে চেয়েছিলেন। এরই জন্য বহু হত্যা বা ধ্বংসের প্রয়োজন ছিল, যাতে তাদের টনক নড়ে। এবং এ জঘন্য ক্রাইমের জন্য তাঁর সর্বোচ্চ শাস্তি দেশের বর্তমান আইনে হবে মাত্র ২১ বছরের জেল, ফাঁসি বা ইলেকট্রিক চেয়ার নয়।
নরওয়ে বা স্ক্যান্ডিনেভিয়ার সাম্প্রতিক ইতিহাস কিন্তু এ ধরনের চরমপন্থী বা নিও-নাজিদের উত্থানের শুধু আভাস-ইঙ্গিত নয়, জীবন্ত প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। তাদের উদার রাষ্ট্রীয় নীতির জন্য অনেক অভিবাসী ওখানে বসতি গেড়েছেন এবং দ্বিতীয় প্রজন্মের অনেকেই যথেষ্ট বর্ধিষ্ণু হয়েছেন। তাই স্থানীয় অধিবাসীদের কেউ কেউ অসহনশীল হয়ে ঈর্ষা করে ভাবেন, তাঁরা উড়ে এসে জুড়ে বসতে চাইছেন। ২০০৭ সালে ৬১ হাজার ২০০ বিদেশি স্থায়ী নিবাসের জন্য এখানে আশ্রয় নিয়েছেন। এর মধ্যে ভারতীয়, শ্রীলঙ্কান, তামিল ও এশীয় এবং উত্তর আফ্রিকার সোমালি-সুদানিসহ প্রচুর অভিবাসী মুসলমান। বাংলাদেশি অবশ্য হাজার খানেক। নরওয়ের ৪৯ লাখ লোকের মধ্যে এক-দশমাংশই এখন অভিবাসী। ষাটের দশকে তেল আবিষ্কার এবং শিল্পোন্নয়নের জন্য নরওয়ে বর্তমানে বিশ্বের একটি অন্যতম ধনী দেশ, যেখানে সামাজিক নিরাপত্তা রয়েছে সর্বাধিক। শুধু তেল থেকেই নরওয়ের বার্ষিক আয় ৪০ বিলিয়ন ডলার। উগ্র চরমপন্থীদের বিশেষ আবেদন তাই নতুন প্রজন্মের কাছে—যারা প্রাচুর্যের কোলে লালিত। তাদের তো দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন বা তেল-পূর্ব নরওয়েবাসের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। দেখা যাচ্ছে, প্রাচীনেরা সম্ভবত তাঁদের অভিজ্ঞতাজনিত কারণে যথেষ্ট সহনশীল, যদিও খ্রিষ্টান লুথেরান চার্ট এখনো রাষ্ট্রীয় সহায়তা পায়। ব্রেইভিক তো বলেছেন, তিনি পোপকেও সমর্থন করেন। সাধারণভাবে তাদের ধারণা, অভিবাসীরা অন্যায়ভাবে নরওয়ের সম্পদের ভাগীদার হচ্ছে, চালু করছে ভিন্ন সংস্কৃতি-মূল্যবোধ। এটা ওদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
এই বিরাট ট্র্যাজেডি থেকে নিশ্চয়ই শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। প্রথমত বুঝতে হবে, যেকোনো উগ্র মতবাদ, রাষ্ট্রীয় বা গোষ্ঠীগত স্বার্থ বা ধর্মীয় গোঁড়ামি এ ধরনের সহিংস সন্ত্রাসের জন্ম দিতে পারে। এবং তা নিরপেক্ষভাবে নির্ণয় করে সম্মিলিতভাবেই সবাইকে প্রচেষ্টা নিতে হবে সব রাষ্ট্রের, সব জাতির, সব মানুষের। নইলে কোনো দেশ বা সমাজই সন্ত্রাসের মরণছোবল থেকে রেহাই পাবে না। তবে আশ্বাস ও স্বস্তির কথা, নরওয়েজিয়ান সরকার অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে এ ট্র্যাজেডির মোকাবিলা করেছে। আন্তর্জাতিক মানবতাবাদী ফ্রিড নেন সেনের ঐতিহ্যের দেশ নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী জিনেস স্টলটেনবার্গ পরম বিশ্বাসে বলেছেন, ‘আমরা পৃথিবীকে দেখিয়ে দেব, নরওয়েজিয়ান গণতন্ত্রের উত্তরোত্তর বিকাশ হচ্ছে। কেউ বোমাবাজি করে আমাদের থামাতে পারবে না। আমরা আমাদের মূল্যবোধ আঁকড়ে থাকব। আমরা দেখিয়ে দেব, পরীক্ষার এই ক্রান্তিকালে নরওয়েজিয়ান সমাজ রুখে দাঁড়াতে পারে—We must show that Norwegian society can stand up to these testing time. We must show humanity, but not naivety?’
নরওয়েজিয়ান জনগণকে সমবেদনা জানানোর সঙ্গে নরওয়ের নেতৃত্বকে প্রশস্তি জানাই। জানাই সাধুবাদ। জয় হোক তাদের আশাবাদী মতাদর্শের।
ইনাম আহমদ চৌধুরী: বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা।
No comments