গোধরা হত্যাকাণ্ড এখনো এক রহস্য by কুলদীপ নায়ার |
গোধরা ট্রেন জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনার রায় দিয়েছেন বিশেষ আদালত। ৩১ জন দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন এবং বেকসুর খালাস পেয়েছেন ৬৩ জন। এই নিরীহ ৬৩ জনকে নয় বছর ধরে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে মাওলানা উমরজিকে এই হত্যাযজ্ঞের ‘হোতা’ হিসেবে ত্রাণশিবির থেকে আটক করা হয়েছিল। সাক্ষ্যপ্রমাণ না থাকায় তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হন। সম্ভবত একজন নেতা হিসেবে তাঁর বিচার গোড়া থেকেই ভুল ছিল। যখন তাঁর সংশ্লিষ্টতার কোনো প্রমাণই পাওয়া যায়নি, তখন বলা যায় তাঁকে ফাঁসানো হয়েছিল বানোয়াট অভিযোগের ভিত্তিতে।
আমি বরং ষড়যন্ত্রের অভিযোগটি নিয়ে বেশি চিন্তিত। বলা হচ্ছে, ষড়যন্ত্র ‘প্রমাণিত’ হয়েছে। এমনকি সুপ্রিম কোর্টের দ্বারা নিযুক্ত বিশেষ তদন্তকারী দলের (এসআইটি) প্রধানও বলেছেন, ‘আদালতের রায় পেশাদারি জায়গা থেকেও সন্তোষজনক।’ সম্ভবত, তিনি ঠিকই বলেছেন। কিন্তু ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ষড়যন্ত্রের ওপর জোর দেবে, কারণ তাহলে গুজরাটের দাঙ্গা তাদের দিক থেকে জায়েজ হয়।
দাঙ্গাকে প্রতিশোধ হিসেবে চিহ্নিত করে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যে বলেছিলেন ‘সমান ও বিপরীত’ আচরণের কথা, সেটাই এতে জোরদার হলো। ভবিষ্যতে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের বেলায় এ ঘটনা প্রভাব ফেলবে।
গোধরা ঘটনার অল্প সময়ের মধ্যে যাঁরা সেখানে ছুটে গিয়েছিলেন, আমি তাঁদের একজন। আমি সেখানে গিয়েছিলাম, যেখানে তখনো সেই অগ্নিদগ্ধ ট্রেনের কামরাটি দাঁড়িয়ে ছিল। জায়গাটি থেকে কিছুটা দূরে মুসলমানদের বসতি। জায়গাটি আবার এত কাছে নয় যে ট্রেনটি স্টেশন ছাড়ার পর লোকজনের পক্ষে সেখানে দৌড়ে যাওয়া সম্ভব।
ষড়যন্ত্রতত্ত্ব অনুসারে, চলন্ত ট্রেনে লাফিয়ে উঠে তীর্থযাত্রীদের কামরায় ঢুকে আগুন দেওয়ার জন্য মুসলমানরা রেললাইনের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। এই ন্যক্কারজনক কাজের একটা উদ্দেশ্য তো তাদের থাকতে হবে। কিন্তু সেখানকার মুসলমানরা যত ‘খারাপই’ হোক, হিন্দু বা গুজরাটিদের সঙ্গে তাদের কোনো নতুন বা পুরোনো শত্রুতা কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বিতা কিছুই ছিল না।
সে সময় দেশেও এমন কিছু ঘটেনি, যাতে কোথাও না কোথাও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি হয় এবং অন্য কোথাও সেই উত্তেজনার প্রকাশ ঘটবে। গোধরার সেই মুসলমানপল্লির লোকেরা ট্রেনের কামরাভর্তি তীর্থযাত্রীদের পুড়িয়ে মেরেছে এমন কল্পনা কেবল শয়তানি মনেরই ফসল হতে পারে, আইনি যুক্তিতে নয়।
যে মামলার ৬৩ জন আসামিই নিরীহ প্রমাণিত হয়, ধরে নিতে হবে সেই মামলার তদন্তে গুরুতর গলদ ছিল। পুলিশ যে রদ্দিমার্কা কাজকর্ম করেছে, তা প্রমাণিত হয় প্রায় ৯৯ ভাগ অন্ধ এক সরকারি কর্মচারীকে আসামি করায়, যিনি আবার ঘটনাস্থল থেকে অনেক দূরে ছিলেন।
গোধরা হত্যাকাণ্ডের দুই বছরের মাথায় একটি তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় যে ট্রেনের কামরায় আগুন লাগাটা ছিল একটা দুর্ঘটনা। সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারক ইউ সি ব্যানার্জি একটি প্রতিবেদনে লিখেছেন: ‘বাইরের কোনো উপাদান ছাড়াই সেখানে আগুন লেগেছিল।’ কিন্তু মোদি সরকারের নিযুক্ত বিচারপতি নানাবতী কমিশন এই উপসংহারে পৌঁছে যে আগুন দুর্ঘটনাজনিত কারণে লাগেনি। ট্রেনের সেই কামরাটি জ্বালিয়ে দিতে পেট্রল ব্যবহার করা হয়েছিল।
দুটি বিচারিক পর্যবেক্ষণ পরস্পরকে কাটাকাটি করে দেয়। এসব কিছুর পরে মনে হচ্ছে, সঠিক বিবরণ হাত পিছলে বেরিয়ে যাচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে, মোদি নিজেই গোধরা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিলেন, কারণ তিনি চাইছিলেন তাঁর রাজ্যের মুসলমানদের ‘শায়েস্তা’ করতে। হয়তো এর একটা সুরাহা করায় কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরোর (সিবিআই) ওপর নির্ভর করা যেত, কিন্তু সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারের একটি বিভাগ হওয়ায় তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। সাধারণভাবে ভাবা হয় যে সিবিআই সর্বদা ক্ষমতাসীন দলের দ্বারা প্রভাবিত থাকে।
গোধরা ঘটনার তুলনায় গুজরাটের দাঙ্গা বিষয়ে এসআইটির তদন্ত অনেক সফল। তাদের তদন্ত প্রতিবেদন এখনো প্রকাশ না করায় আমি বিস্মিত। গত মে মাস থেকে এটা নিয়ে আদালত গড়িমসি করছেন। এটা প্রকাশের জন্য বর্তমান সময়ই হলো সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। গোধরা বিষয়ে বিশেষ আদালতের রায় যত না প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে, তার থেকে বেশি প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
এসআইটির প্রতিবেদন দেখিয়েছে, গুজরাটের অপরাধ বিচারের ব্যবস্থাকে কীভাবে মোদি সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছেন। প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়, দাঙ্গার চরম মুহূর্তে মোদি মুসলমানদের বিরুদ্ধে ‘আক্রমণাত্মক’ ও ‘দায়িত্বহীন’ মন্তব্য করেছেন। সেখানে আরও বলা হয়, ‘গুজরাট সরকার দাঙ্গার শিকারদের সুবিচার দিতে ব্যর্থ হয়েছে।’
মোদি সরকারের সব থেকে খারাপ কাজ হলো, দাঙ্গার সময় পুলিশের ওয়্যারলেস কথাবার্তার সব রেকর্ড নষ্ট করে ফেলা। তাহলেও একজন সাহসী পুলিশ কর্মকর্তা তদন্ত দলের কাছে হারিয়ে যাওয়া সেসব নথিপত্র সরবরাহ করেন। বিনিময়ে গুজরাট সরকার তাঁর বিরুদ্ধে বিধিভঙ্গের অভিযোগ আনে। দেখে খুবই হতাশ লাগল যে এ ব্যাপারে পুলিশের কেন্দ্রীয় দপ্তর থেকে রা করা হয়নি।
আমি আশা করি, একটি মিথ্যা এনকাউন্টারের বিরুদ্ধে রিট পিটিশনের আবেদনের জবাবে সুপ্রিম কোর্ট নতুন করে তদন্তের যে নির্দেশ দিয়েছিলেন, আমি দ্রুতই তার বাস্তবায়ন চাই। বিচারপতি নানাবতীর নেতৃত্বে কমিটি গঠনের পক্ষপাতী ছিলাম না আমি। তাঁকে নিযুক্ত করা হয়েছে নয় বছর হলো, অথচ এখন পর্যন্ত তিনি প্রাথমিক প্রতিবেদনও দিতে পারেননি। বিজেপি বলেছিল, চার মাসের মধ্যে সব জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে। কিন্তু সেই ঘটনার পর ১১ বছর অতিবাহিত হলেও মোদি বা বিজেপির কোনো বিবেকদংশন নেই। উল্টো গোধরা বিচারের রায় তাদের আরও বাহাদুরি করার ব্যাপারে উৎসাহী করে তুলল।
গালফ নিউজ থেকে অনূদিত
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক।
আমি বরং ষড়যন্ত্রের অভিযোগটি নিয়ে বেশি চিন্তিত। বলা হচ্ছে, ষড়যন্ত্র ‘প্রমাণিত’ হয়েছে। এমনকি সুপ্রিম কোর্টের দ্বারা নিযুক্ত বিশেষ তদন্তকারী দলের (এসআইটি) প্রধানও বলেছেন, ‘আদালতের রায় পেশাদারি জায়গা থেকেও সন্তোষজনক।’ সম্ভবত, তিনি ঠিকই বলেছেন। কিন্তু ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ষড়যন্ত্রের ওপর জোর দেবে, কারণ তাহলে গুজরাটের দাঙ্গা তাদের দিক থেকে জায়েজ হয়।
দাঙ্গাকে প্রতিশোধ হিসেবে চিহ্নিত করে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যে বলেছিলেন ‘সমান ও বিপরীত’ আচরণের কথা, সেটাই এতে জোরদার হলো। ভবিষ্যতে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের বেলায় এ ঘটনা প্রভাব ফেলবে।
গোধরা ঘটনার অল্প সময়ের মধ্যে যাঁরা সেখানে ছুটে গিয়েছিলেন, আমি তাঁদের একজন। আমি সেখানে গিয়েছিলাম, যেখানে তখনো সেই অগ্নিদগ্ধ ট্রেনের কামরাটি দাঁড়িয়ে ছিল। জায়গাটি থেকে কিছুটা দূরে মুসলমানদের বসতি। জায়গাটি আবার এত কাছে নয় যে ট্রেনটি স্টেশন ছাড়ার পর লোকজনের পক্ষে সেখানে দৌড়ে যাওয়া সম্ভব।
ষড়যন্ত্রতত্ত্ব অনুসারে, চলন্ত ট্রেনে লাফিয়ে উঠে তীর্থযাত্রীদের কামরায় ঢুকে আগুন দেওয়ার জন্য মুসলমানরা রেললাইনের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। এই ন্যক্কারজনক কাজের একটা উদ্দেশ্য তো তাদের থাকতে হবে। কিন্তু সেখানকার মুসলমানরা যত ‘খারাপই’ হোক, হিন্দু বা গুজরাটিদের সঙ্গে তাদের কোনো নতুন বা পুরোনো শত্রুতা কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বিতা কিছুই ছিল না।
সে সময় দেশেও এমন কিছু ঘটেনি, যাতে কোথাও না কোথাও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি হয় এবং অন্য কোথাও সেই উত্তেজনার প্রকাশ ঘটবে। গোধরার সেই মুসলমানপল্লির লোকেরা ট্রেনের কামরাভর্তি তীর্থযাত্রীদের পুড়িয়ে মেরেছে এমন কল্পনা কেবল শয়তানি মনেরই ফসল হতে পারে, আইনি যুক্তিতে নয়।
যে মামলার ৬৩ জন আসামিই নিরীহ প্রমাণিত হয়, ধরে নিতে হবে সেই মামলার তদন্তে গুরুতর গলদ ছিল। পুলিশ যে রদ্দিমার্কা কাজকর্ম করেছে, তা প্রমাণিত হয় প্রায় ৯৯ ভাগ অন্ধ এক সরকারি কর্মচারীকে আসামি করায়, যিনি আবার ঘটনাস্থল থেকে অনেক দূরে ছিলেন।
গোধরা হত্যাকাণ্ডের দুই বছরের মাথায় একটি তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় যে ট্রেনের কামরায় আগুন লাগাটা ছিল একটা দুর্ঘটনা। সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারক ইউ সি ব্যানার্জি একটি প্রতিবেদনে লিখেছেন: ‘বাইরের কোনো উপাদান ছাড়াই সেখানে আগুন লেগেছিল।’ কিন্তু মোদি সরকারের নিযুক্ত বিচারপতি নানাবতী কমিশন এই উপসংহারে পৌঁছে যে আগুন দুর্ঘটনাজনিত কারণে লাগেনি। ট্রেনের সেই কামরাটি জ্বালিয়ে দিতে পেট্রল ব্যবহার করা হয়েছিল।
দুটি বিচারিক পর্যবেক্ষণ পরস্পরকে কাটাকাটি করে দেয়। এসব কিছুর পরে মনে হচ্ছে, সঠিক বিবরণ হাত পিছলে বেরিয়ে যাচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে, মোদি নিজেই গোধরা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিলেন, কারণ তিনি চাইছিলেন তাঁর রাজ্যের মুসলমানদের ‘শায়েস্তা’ করতে। হয়তো এর একটা সুরাহা করায় কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরোর (সিবিআই) ওপর নির্ভর করা যেত, কিন্তু সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারের একটি বিভাগ হওয়ায় তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। সাধারণভাবে ভাবা হয় যে সিবিআই সর্বদা ক্ষমতাসীন দলের দ্বারা প্রভাবিত থাকে।
গোধরা ঘটনার তুলনায় গুজরাটের দাঙ্গা বিষয়ে এসআইটির তদন্ত অনেক সফল। তাদের তদন্ত প্রতিবেদন এখনো প্রকাশ না করায় আমি বিস্মিত। গত মে মাস থেকে এটা নিয়ে আদালত গড়িমসি করছেন। এটা প্রকাশের জন্য বর্তমান সময়ই হলো সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। গোধরা বিষয়ে বিশেষ আদালতের রায় যত না প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে, তার থেকে বেশি প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
এসআইটির প্রতিবেদন দেখিয়েছে, গুজরাটের অপরাধ বিচারের ব্যবস্থাকে কীভাবে মোদি সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছেন। প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়, দাঙ্গার চরম মুহূর্তে মোদি মুসলমানদের বিরুদ্ধে ‘আক্রমণাত্মক’ ও ‘দায়িত্বহীন’ মন্তব্য করেছেন। সেখানে আরও বলা হয়, ‘গুজরাট সরকার দাঙ্গার শিকারদের সুবিচার দিতে ব্যর্থ হয়েছে।’
মোদি সরকারের সব থেকে খারাপ কাজ হলো, দাঙ্গার সময় পুলিশের ওয়্যারলেস কথাবার্তার সব রেকর্ড নষ্ট করে ফেলা। তাহলেও একজন সাহসী পুলিশ কর্মকর্তা তদন্ত দলের কাছে হারিয়ে যাওয়া সেসব নথিপত্র সরবরাহ করেন। বিনিময়ে গুজরাট সরকার তাঁর বিরুদ্ধে বিধিভঙ্গের অভিযোগ আনে। দেখে খুবই হতাশ লাগল যে এ ব্যাপারে পুলিশের কেন্দ্রীয় দপ্তর থেকে রা করা হয়নি।
আমি আশা করি, একটি মিথ্যা এনকাউন্টারের বিরুদ্ধে রিট পিটিশনের আবেদনের জবাবে সুপ্রিম কোর্ট নতুন করে তদন্তের যে নির্দেশ দিয়েছিলেন, আমি দ্রুতই তার বাস্তবায়ন চাই। বিচারপতি নানাবতীর নেতৃত্বে কমিটি গঠনের পক্ষপাতী ছিলাম না আমি। তাঁকে নিযুক্ত করা হয়েছে নয় বছর হলো, অথচ এখন পর্যন্ত তিনি প্রাথমিক প্রতিবেদনও দিতে পারেননি। বিজেপি বলেছিল, চার মাসের মধ্যে সব জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে। কিন্তু সেই ঘটনার পর ১১ বছর অতিবাহিত হলেও মোদি বা বিজেপির কোনো বিবেকদংশন নেই। উল্টো গোধরা বিচারের রায় তাদের আরও বাহাদুরি করার ব্যাপারে উৎসাহী করে তুলল।
গালফ নিউজ থেকে অনূদিত
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক।
No comments