বিল, বিমানবন্দর ও প্রতিবেশ-বিবাদ by পাভেল পার্থ
প্রতিবছর
বাংলাদেশসহ রামসার-ঘোষণা স্বাক্ষরকারী দেশগুলোতে ২ ফেব্রুয়ারি পালিত হয়
বিশ্ব জলাভূমি দিবস। এ বছরের জলাভূমি দিবস হয়তো আড়িয়ল বিলের আহাজারিকে
আড়াল করে রাষ্ট্রের উন্নয়ন-বাহাদুরিকেই স্পষ্ট করে তুলবে। সম্প্রতি
মুন্সিগঞ্জ ও ঢাকা জেলার তিনটি উপজেলায় বিস্তৃত দেশের মধ্য অঞ্চলের আড়িয়ল
বিলে প্রস্তাবিত বিমানবন্দর নির্মাণ নিয়ে রাষ্ট্র বনাম বিলবাসীর
লড়াই-সংঘর্ষকে আমরা জলাভূমি দিবসের প্রধান প্রতিবেশ-রাজনৈতিক প্রশ্ন
হিসেবে পাঠ করতে চাই।
২৬ মাইল দৈর্ঘ্য এবং ১০ মাইল প্রস্থের এই প্রবীণ জলাভূমির আয়তন এক লাখ ৬৬ হাজার ৬০০ একর। আশপাশের ১১টি ইউনিয়নের প্রায় ৭০টি গ্রামের জীবনধারা নিয়েই ঐতিহাসিকভাবে গড়ে উঠেছে আড়িয়ল-সভ্যতা। শত বছর আগে ইতিহাসকার যতীন্দ্রমোহন রায় আড়িয়ল বিলের প্রশস্তি টেনে লিখেছিলেন, চলবিল ও আইরল (আড়িয়ল) বিলেই অতি প্রাচীনকালে ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গম ঘটেছিল। পদ্মা থেকে একটি ছুটন্ত জলপ্রবাহ ‘শ্রীনগরের খাল’ নামে এই বিলের সঙ্গে মিশেছে, যা পরবর্তী সময়ে ধলেশ্বরীর সঙ্গে প্রবাহিত হয়েছে। এই বিলে এখনো প্রতিবছর ৪০ হাজার মেট্রিক টন ধান ফলে, ৭০০ মেট্রিক টন মাছের জোগান আসে। এখনো আড়িয়ল বিলবাসীর কাছাকাছি জন-উন্নয়নের সত্যিকারের ধারণা নিয়ে রাষ্ট্র যেতে পারেনি। আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর নির্মাণকে কেন্দ্র করে সোমবার ঢাকা-মাওয়া সড়কের সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর পুলিশের উপপরিদর্শক মতিউর রহমান। আহত ও নির্যাতিত হয়েছেন অনেকেই। বিমানবন্দর নির্মাণ-প্রশ্নে রাষ্ট্র ও জনগণের ভেতর বিশ্বাস ও প্রতিবেশীয় বন্ধুত্ব তৈরি করা জরুরি।
সারা দুনিয়ায় জল-জমি-জুম-জঙ্গলের ওপর রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও উন্নয়ন-মারদাঙ্গার বিরুদ্ধে স্থানীয় জনপ্রতিরোধ চলমান আছে, আড়িয়ল বিলেও যার ব্যত্যয় ঘটবে না। এটিকে কেবল ‘সরকারপক্ষ’ বা ‘বিরোধী দলের’ রাজনৈতিক বাহাস দিয়ে পাঠ করা যায় না। এটি রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন দর্শন ও রাজনৈতিক মনোজাগতিক অবস্থানের প্রশ্ন। সিলেটের বিমানবন্দর গড়ে তোলা হয়েছে আদিবাসী লালেং (পাত্র) বসত উচ্ছেদ করে (সূত্র: রতনলাল চক্রবর্তী প্রণীত সিলেটের নিঃস্ব আদিবাসী পাত্র)। ষাটের দশকে কর্ণফুলী জলবিদ্যুৎ উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য এক লাখ পাহাড়ি জনগণ উদ্বাস্তু হয়েছিল। সেনানিবাসসহ রাষ্ট্রের বৃহৎ অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পসমূহ বরাবরই স্থানীয় জনগণের ভূমিজীবনের ঐতিহাসিকতা ও প্রতিবেশীয় সম্পর্ককে বিবেচনা করতে অসমর্থ হয়েছে। রেললাইন, মহাসড়ক, সেতু, খনি প্রকল্প, সামাজিক বনায়ন, রাবার বাগান কি চুক্তিবদ্ধ চাষ—এভাবেই স্থানীয় জনদর্শনের ওপর চালানো হয়েছে আঘাত। এটি কেবল পরিবেশ-প্রতিবেশ, অর্থনীতি, রাজনীতি, উন্নয়ন বা সামাজিক সংস্কৃতির প্রশ্ন নয়, এটি জনগণের যাপিত জীবনের সার্বভৌম অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত।
পাশাপাশি আমাদের স্মরণে রাখা জরুরি, আড়িয়ল বিলের প্রশ্নহীন পরিবর্তনশীলতা ও জনসম্পদ থেকে ব্যক্তিগত দখলের স্থানীয় রাজনীতিকেও। আড়িয়ল বিলের প্রাণ হলো ‘ডেঙ্গা’ বা ‘দাংগা’ মানে নিচু জলাধার। উঁচু জমিগুলো স্থানীয়ভাবে ‘ভিটি’ নামে পরিচিত। আউশ ও বোরো ধানের আবাদ হতো এই বিলভূমিতে। আড়িয়ল বিলের খইয়াবোরো ধানের মুড়ি প্রসিদ্ধ ছিল এ অঞ্চলে। ভিটি জমির ক্ষীরাই (ক্ষীরা), উইস্তা (করলা), বড় কুমড় (কুমড়া) ও সবজির চালান জোগান দিত গ্রাম ও শহরের অনেকটাই চাহিদা। আড়িয়ল বিলের সরপুঁটি, কই ও কালকিনি মাছের বেশ নামডাক ছিল এককালে। ষাটের দশকে প্রবর্তিত তথাকথিত সবুজ বিপ্লবের ধাক্কায় আড়িয়ল বিল বদলে যেতে বাধ্য হয়। প্রভাবশালীদের বিল দখল, ভরাট, বাণিজ্যিক মৎস্য খামার, রাসায়নিক কৃষির প্রসারে ভেঙে পড়ে বিল-বাস্তুসংস্থান। হারিয়ে যেতে থাকে বহু প্রজাতির মাছ। কাছিম-কাঠা থেকে শুরু করে বক, ডাহুক, কোড়া, চিল পাখিরাও নিশ্চিহ্ন হতে থাকে। গঙ্গা, মনসা, খোয়াজখিজির, নৌকাবাইচ মিলে আড়িয়ল বিলের সেই বিলসংস্কৃতি প্রায় নিশ্চিহ্ন। যে উন্নয়ন ধারাবাহিকতায় আড়িয়ল বিল তার চরিত্র হারাতে বাধ্য হয়েছে, সেই একই উন্নয়ন-প্রশ্ন নিয়েই আবারও আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর নির্মাণের জন্য জোরদার হচ্ছে রাষ্ট্র।
জলাভূমিকে কোনো দেশের প্রাণ-আধার বলা হয়ে থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পৃথিবীজুড়ে বর্তমান সময়ে জলাভূমির মোট পরিমাণ ৫৪ লাখ বর্গকিলোমিটার থেকে ৫৭ লাখ বর্গকিলোমিটার। ইরানের রামসার শহরে ১৯৭২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি কনভেনশন অন ওয়েটল্যান্ডস অব ইন্টারন্যাশনাল ইম্পরট্যান্স ইস্পেশিয়ালি অ্যাজ ওয়াটারফল হ্যাবিটেট সম্মেলনে পৃথিবীর জলাভূমি বিষয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক মনোযোগ তৈরি হয়। এই সম্মেলন সনদের প্রথম শর্তই হচ্ছে, চুক্তিভুক্ত সদস্য রাষ্ট্রপক্ষ রামসার এলাকার মানুষ ও তার পরিবেশের আন্তসম্পর্ককে বিবেচনা করবে ও গুরুত্ব দেবে। রামসার সম্মেলনের পর জলাভূমি-সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক মনোযোগ কিছুটা বাড়লেও আমরা এখন পর্যন্ত দেশের জলাভূমির পাশে রাষ্ট্রকে নিজস্ব জনদর্শন সঙ্গে নিয়ে দাঁড়াতে দেখিনি। দেশের হাওর-জলাভূমি ও বাঁওড় থেকে শুরু করে চলনবিল কি চান্দারবিল বা আড়িয়ল বিল—সব ক্ষেত্রেই একই উন্নয়ন জবরদস্তি বিরাজ করছে। মূলত ১৯৯৭ সাল থেকেই প্রতিবছরের ২ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব জলাভূমি দিবস পালিত হয়।
আড়িয়ল বিল ও বিমানবন্দর-সম্পর্কিত প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদনসমূহ থেকে জানা যায়, এ প্রকল্প কোনো ধরনের প্রতিবেশগত ও পরিবেশগত সমীক্ষা ও যাচাই ছাড়াই ভূমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু করেছে। কিন্তু যেকোনো ধরনের উন্নয়ন অবকাঠামোর পূর্বশর্ত হলো পরিবেশ-প্রতিবেশ ছাড়পত্র ও স্থানীয় জনগণের সম্মতি। স্থানীয় জনগণের পাশাপাশি উত্তরাঞ্চল ও বৃহত্তর ময়মনসিংহের নদীভাঙা ও কৃষি উদ্বাস্তু শ্রমিকদের এক বিশাল বসতি গড়ে উঠেছে আড়িয়ল বিলকে কেন্দ্র করে। বিমানবন্দরের ফলে এসব উদ্বাস্তু মানুষ আর কতবার উদ্বাস্তু হবে, এটিও বিবেচনা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। নয়া উদারীকরণ অর্থনীতি ও করপোরেট বিশ্বায়িত দুনিয়ার উন্নয়ন-বাণিজ্য থেকে সরে এসে রাষ্ট্রকে জনজীবনের প্রতিবেশীয় ধারায় উন্নয়নকে বিবেচনা করতে হবে। আলোচনার মাধ্যমে আড়িয়ল বিলবাসীর সঙ্গে রাষ্ট্রকে বিমানবন্দর-প্রশ্নের ফয়সালা করতে হবে।
আড়িয়ল বিলের প্রবীণদের ভাষ্য, এ বিলের মাছেরা স্থানীয় মানুষের কথা শোনে। বর্ষাকালে ‘ডেঙ্গা/দাংগা’ অঞ্চল থেকে মাছ ভাসিয়ে দেওয়া হয় নতুন জলধারায়। সারা বর্ষা কাটিয়ে মাছ আবার নিজের বিলঘরে ফিরে আসে। স্থানীয়ভাবে এ মাছকে ‘দুই সনা’ মাছ বলে। আড়িয়ল বিলের মাছ কি পাখি, কৃষি, জলধারা ও স্থানীয় মানুষ বিলজীবনের যে প্রতিবেশীয় ইশতেহার বিরাজমান রেখেছে, সেসব জীবনশর্ত বিবেচনা করার ভেতর দিয়েই রাষ্ট্র জলাভূমি জীবনের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করুক।
>>>পাভেল পার্থ: প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণবিষয়ক গবেষক।
animistbangla@gmail.com
২৬ মাইল দৈর্ঘ্য এবং ১০ মাইল প্রস্থের এই প্রবীণ জলাভূমির আয়তন এক লাখ ৬৬ হাজার ৬০০ একর। আশপাশের ১১টি ইউনিয়নের প্রায় ৭০টি গ্রামের জীবনধারা নিয়েই ঐতিহাসিকভাবে গড়ে উঠেছে আড়িয়ল-সভ্যতা। শত বছর আগে ইতিহাসকার যতীন্দ্রমোহন রায় আড়িয়ল বিলের প্রশস্তি টেনে লিখেছিলেন, চলবিল ও আইরল (আড়িয়ল) বিলেই অতি প্রাচীনকালে ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গম ঘটেছিল। পদ্মা থেকে একটি ছুটন্ত জলপ্রবাহ ‘শ্রীনগরের খাল’ নামে এই বিলের সঙ্গে মিশেছে, যা পরবর্তী সময়ে ধলেশ্বরীর সঙ্গে প্রবাহিত হয়েছে। এই বিলে এখনো প্রতিবছর ৪০ হাজার মেট্রিক টন ধান ফলে, ৭০০ মেট্রিক টন মাছের জোগান আসে। এখনো আড়িয়ল বিলবাসীর কাছাকাছি জন-উন্নয়নের সত্যিকারের ধারণা নিয়ে রাষ্ট্র যেতে পারেনি। আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর নির্মাণকে কেন্দ্র করে সোমবার ঢাকা-মাওয়া সড়কের সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর পুলিশের উপপরিদর্শক মতিউর রহমান। আহত ও নির্যাতিত হয়েছেন অনেকেই। বিমানবন্দর নির্মাণ-প্রশ্নে রাষ্ট্র ও জনগণের ভেতর বিশ্বাস ও প্রতিবেশীয় বন্ধুত্ব তৈরি করা জরুরি।
সারা দুনিয়ায় জল-জমি-জুম-জঙ্গলের ওপর রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও উন্নয়ন-মারদাঙ্গার বিরুদ্ধে স্থানীয় জনপ্রতিরোধ চলমান আছে, আড়িয়ল বিলেও যার ব্যত্যয় ঘটবে না। এটিকে কেবল ‘সরকারপক্ষ’ বা ‘বিরোধী দলের’ রাজনৈতিক বাহাস দিয়ে পাঠ করা যায় না। এটি রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন দর্শন ও রাজনৈতিক মনোজাগতিক অবস্থানের প্রশ্ন। সিলেটের বিমানবন্দর গড়ে তোলা হয়েছে আদিবাসী লালেং (পাত্র) বসত উচ্ছেদ করে (সূত্র: রতনলাল চক্রবর্তী প্রণীত সিলেটের নিঃস্ব আদিবাসী পাত্র)। ষাটের দশকে কর্ণফুলী জলবিদ্যুৎ উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য এক লাখ পাহাড়ি জনগণ উদ্বাস্তু হয়েছিল। সেনানিবাসসহ রাষ্ট্রের বৃহৎ অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পসমূহ বরাবরই স্থানীয় জনগণের ভূমিজীবনের ঐতিহাসিকতা ও প্রতিবেশীয় সম্পর্ককে বিবেচনা করতে অসমর্থ হয়েছে। রেললাইন, মহাসড়ক, সেতু, খনি প্রকল্প, সামাজিক বনায়ন, রাবার বাগান কি চুক্তিবদ্ধ চাষ—এভাবেই স্থানীয় জনদর্শনের ওপর চালানো হয়েছে আঘাত। এটি কেবল পরিবেশ-প্রতিবেশ, অর্থনীতি, রাজনীতি, উন্নয়ন বা সামাজিক সংস্কৃতির প্রশ্ন নয়, এটি জনগণের যাপিত জীবনের সার্বভৌম অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত।
পাশাপাশি আমাদের স্মরণে রাখা জরুরি, আড়িয়ল বিলের প্রশ্নহীন পরিবর্তনশীলতা ও জনসম্পদ থেকে ব্যক্তিগত দখলের স্থানীয় রাজনীতিকেও। আড়িয়ল বিলের প্রাণ হলো ‘ডেঙ্গা’ বা ‘দাংগা’ মানে নিচু জলাধার। উঁচু জমিগুলো স্থানীয়ভাবে ‘ভিটি’ নামে পরিচিত। আউশ ও বোরো ধানের আবাদ হতো এই বিলভূমিতে। আড়িয়ল বিলের খইয়াবোরো ধানের মুড়ি প্রসিদ্ধ ছিল এ অঞ্চলে। ভিটি জমির ক্ষীরাই (ক্ষীরা), উইস্তা (করলা), বড় কুমড় (কুমড়া) ও সবজির চালান জোগান দিত গ্রাম ও শহরের অনেকটাই চাহিদা। আড়িয়ল বিলের সরপুঁটি, কই ও কালকিনি মাছের বেশ নামডাক ছিল এককালে। ষাটের দশকে প্রবর্তিত তথাকথিত সবুজ বিপ্লবের ধাক্কায় আড়িয়ল বিল বদলে যেতে বাধ্য হয়। প্রভাবশালীদের বিল দখল, ভরাট, বাণিজ্যিক মৎস্য খামার, রাসায়নিক কৃষির প্রসারে ভেঙে পড়ে বিল-বাস্তুসংস্থান। হারিয়ে যেতে থাকে বহু প্রজাতির মাছ। কাছিম-কাঠা থেকে শুরু করে বক, ডাহুক, কোড়া, চিল পাখিরাও নিশ্চিহ্ন হতে থাকে। গঙ্গা, মনসা, খোয়াজখিজির, নৌকাবাইচ মিলে আড়িয়ল বিলের সেই বিলসংস্কৃতি প্রায় নিশ্চিহ্ন। যে উন্নয়ন ধারাবাহিকতায় আড়িয়ল বিল তার চরিত্র হারাতে বাধ্য হয়েছে, সেই একই উন্নয়ন-প্রশ্ন নিয়েই আবারও আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর নির্মাণের জন্য জোরদার হচ্ছে রাষ্ট্র।
জলাভূমিকে কোনো দেশের প্রাণ-আধার বলা হয়ে থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পৃথিবীজুড়ে বর্তমান সময়ে জলাভূমির মোট পরিমাণ ৫৪ লাখ বর্গকিলোমিটার থেকে ৫৭ লাখ বর্গকিলোমিটার। ইরানের রামসার শহরে ১৯৭২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি কনভেনশন অন ওয়েটল্যান্ডস অব ইন্টারন্যাশনাল ইম্পরট্যান্স ইস্পেশিয়ালি অ্যাজ ওয়াটারফল হ্যাবিটেট সম্মেলনে পৃথিবীর জলাভূমি বিষয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক মনোযোগ তৈরি হয়। এই সম্মেলন সনদের প্রথম শর্তই হচ্ছে, চুক্তিভুক্ত সদস্য রাষ্ট্রপক্ষ রামসার এলাকার মানুষ ও তার পরিবেশের আন্তসম্পর্ককে বিবেচনা করবে ও গুরুত্ব দেবে। রামসার সম্মেলনের পর জলাভূমি-সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক মনোযোগ কিছুটা বাড়লেও আমরা এখন পর্যন্ত দেশের জলাভূমির পাশে রাষ্ট্রকে নিজস্ব জনদর্শন সঙ্গে নিয়ে দাঁড়াতে দেখিনি। দেশের হাওর-জলাভূমি ও বাঁওড় থেকে শুরু করে চলনবিল কি চান্দারবিল বা আড়িয়ল বিল—সব ক্ষেত্রেই একই উন্নয়ন জবরদস্তি বিরাজ করছে। মূলত ১৯৯৭ সাল থেকেই প্রতিবছরের ২ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব জলাভূমি দিবস পালিত হয়।
আড়িয়ল বিল ও বিমানবন্দর-সম্পর্কিত প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদনসমূহ থেকে জানা যায়, এ প্রকল্প কোনো ধরনের প্রতিবেশগত ও পরিবেশগত সমীক্ষা ও যাচাই ছাড়াই ভূমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু করেছে। কিন্তু যেকোনো ধরনের উন্নয়ন অবকাঠামোর পূর্বশর্ত হলো পরিবেশ-প্রতিবেশ ছাড়পত্র ও স্থানীয় জনগণের সম্মতি। স্থানীয় জনগণের পাশাপাশি উত্তরাঞ্চল ও বৃহত্তর ময়মনসিংহের নদীভাঙা ও কৃষি উদ্বাস্তু শ্রমিকদের এক বিশাল বসতি গড়ে উঠেছে আড়িয়ল বিলকে কেন্দ্র করে। বিমানবন্দরের ফলে এসব উদ্বাস্তু মানুষ আর কতবার উদ্বাস্তু হবে, এটিও বিবেচনা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। নয়া উদারীকরণ অর্থনীতি ও করপোরেট বিশ্বায়িত দুনিয়ার উন্নয়ন-বাণিজ্য থেকে সরে এসে রাষ্ট্রকে জনজীবনের প্রতিবেশীয় ধারায় উন্নয়নকে বিবেচনা করতে হবে। আলোচনার মাধ্যমে আড়িয়ল বিলবাসীর সঙ্গে রাষ্ট্রকে বিমানবন্দর-প্রশ্নের ফয়সালা করতে হবে।
আড়িয়ল বিলের প্রবীণদের ভাষ্য, এ বিলের মাছেরা স্থানীয় মানুষের কথা শোনে। বর্ষাকালে ‘ডেঙ্গা/দাংগা’ অঞ্চল থেকে মাছ ভাসিয়ে দেওয়া হয় নতুন জলধারায়। সারা বর্ষা কাটিয়ে মাছ আবার নিজের বিলঘরে ফিরে আসে। স্থানীয়ভাবে এ মাছকে ‘দুই সনা’ মাছ বলে। আড়িয়ল বিলের মাছ কি পাখি, কৃষি, জলধারা ও স্থানীয় মানুষ বিলজীবনের যে প্রতিবেশীয় ইশতেহার বিরাজমান রেখেছে, সেসব জীবনশর্ত বিবেচনা করার ভেতর দিয়েই রাষ্ট্র জলাভূমি জীবনের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করুক।
>>>পাভেল পার্থ: প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণবিষয়ক গবেষক।
animistbangla@gmail.com
No comments