সংগীতগুরুর প্রয়াণে by দিঠি হাসনাত
যখন আমরা একজন গুণী শিল্পীর কাছে যাই, তখন শুধু সেই ব্যক্তির একটা নির্দিষ্ট পারফরম্যান্সই দেখি না; নির্দিষ্ট পারফরম্যান্সের সঙ্গে লুকিয়ে থাকে একজন ব্যক্তির বহু বছরের সাধনা, অভিজ্ঞতা।
আর এই উপলব্ধিটা অনেক বেশি সত্য উচ্চাঙ্গসংগীতের দিকপাল গুরু পণ্ডিত ভীমসেন যোশির মতো ব্যক্তিত্বের ক্ষেত্রে। একটা এক ঘণ্টার রাগের খেয়াল গাওয়ার পেছনে তাঁর প্রতিদিনের ১৬-১৮ ঘণ্টার অদম্য সাধনা, অথবা সংগীতকে ভালোবেসে গুরুর খোঁজে ঘর ছেড়ে অনেক কষ্ট মেনে নেওয়া গুরুকে সন্তুষ্ট করার আপ্রাণ চেষ্টা লুকিয়ে থাকে।
আর তাঁর মৃত্যু তাই ভারতীয় উপমহাদেশের সংগীতজগতের জন্য অপূরণীয়। ২৪ জানুয়ারি সকালে তিনি পুনে শহরের শাহাদ্রি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর। ১৯২২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি তিনি কর্ণাটকে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ছিলেন স্কুলশিক্ষক। ছোটবেলা থেকেই সংগীত তাঁকে এমনভাবে আকর্ষণ করে যে মাত্র ১১ বছর বয়সে গুরুর খোঁজে বাড়ি ছাড়েন। অনেক দোর ঘুরে তিনি রামপুরে পৌঁছান। সেখানে ওস্তাদ মুশতাক হুসেন খানের কাছে বছর খানেক কাটিয়ে লক্ষৌতে ঠুমরির আন্দাজ নিতে তালিম নেন। তখন ডিসি দত্ত বলে আমিনাবাদের এক চায়ের দোকানের মালিকের গীত-গজল গাইয়ে হিসেবে খুব নামডাক ছিল। তাঁরই চেষ্টায় ভীমসেন রেডিওর স্টাফ আর্টিস্ট হন এবং ২৫ টাকা ফি-তে খেয়াল ও প্রধানত ভজন গাইতেন। তাঁকে পাওয়া যায় কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং পাহাড়ি সান্যালের কথোপকথনে... কুমারপ্রসাদ বলছেন তাঁর কুদরতি রঙ্গীবিরঙ্গী বইয়ে। এক অনুষ্ঠান শেষে ভীমসেনজি এসে পাহাড়ি সান্যালকে বলছেন, ‘আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না? আমি ওই ভীমসেন, যে আপনার বসন্ত রায় রোডের বাসায় থাকতাম।’ চলে গেলে পাহাড়ি সান্যাল কপাল চাপড়ে কুমারপ্রসাদকে বলছেন, ‘হা ভগবান, এই সেই ভীমসেন! জানিস, এই ব্যাটার তখন চাল নেই চুলা নেই, কলকাতা শহর বিদেশবিভূঁই, গান শেখার অসম্ভব শখ। বেশ কিছুদিন আমার বাড়িতে ছিল, ফাইফরমাশ খাটত। গানের গলা মোষের বাচ্চার মতো। আমি শুনেটুনে বললাম, তোমার বাছা হবে না। ভগবান তোমায় গলা দেননি, তুমি থাকো, খাও আমার বাড়িতে, চেষ্টাচরিত্র করে স্টুডিওতে একটা ছোটখাটো কাজের চেষ্টা করে দেখব। তা এই সেই ভীমসেন!’
এই গল্পটা থেকে বোঝা যাবে ভীমসেন যোশি কত পরিশ্রম করে আজকের অবস্থানে এসেছেন, অসাধারণ কণ্ঠ তৈরি করেছেন। একনিষ্ঠ সাধনার রেওয়াজের ফসল তাঁর এই গলা। দৈনিক ১০ ঘণ্টারও বেশি রেওয়াজ করেছেন তিনি। তাঁর রেওয়াজের নিয়মটা ছিল—সকালে মোষের দুধ খেয়ে খরজে পুরো একটি রাগ গেয়ে সেই রাগ বিকেলে মধ্য ও তার সপ্তকে তানের সঙ্গে নিয়মিত অভ্যাস করতেন।
যোশি কিরানা ঘরানার জন্য গর্ব ছিলেন। কিরানা ঘরানার দিকপাল শিল্পী ওস্তাদ আবদুল করিম খানের শিষ্য সওয়াই গন্ধর্বের কাছে তালিম নেন। ওস্তাদ আবদুল করিম খান হিন্দুস্তানি উচ্চাঙ্গসংগীত নান্দনিকতার ওপর প্রয়োগ করে উত্তর ভারতীয় সংগীতে নতুন মাত্রা সংযোজন করেছেন। গোয়ালিয়র ঘরানার সংগীতগুরু ওস্তাদ হাফিজ আলী খান ভীষণ ভালোবাসতেন ভীমসেন যোশিকে। সওয়াই গন্ধর্বের কণ্ঠও একটু অন্য রকম ছিল। বংশগতভাবে তাঁর গলার নেতিবাচক দিকটিকেই তিনি ইতিবাচক শক্তিতে পরিণত করেছেন। ভীমসেন যোশিরও আওয়াজ লাগানোর পদ্ধতি একটু আলাদা ছিল। তাঁর আওয়াজ অনেক বলিষ্ঠ ছিল, তিনি চমৎকার ভলিউম কন্ট্রোল করতে পারতেন। ২০০৮ সালে ভারতের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘ভারতরত্ন’ পান তিনি। তাঁর প্লাটিনাম ডিস্ক বের হয় ১৯৮৬ সালে। ১৯৭২ সালে তিনি ‘পদ্মশ্রী’ পান, ‘সংগীত নাটক একাডেমি’ পান ১৯৭৬ সালে। ১৯৮৫ সালে তিনি ‘পদ্মভূষণ’ পান। তিনি শুধু খেয়ালই গাননি, ভজনও গেয়েছেন। তানসেন আখে, বসন্ত বাহার, ব্রাইডাল মাই ব্রাদার প্রভৃতি চলচ্চিত্রে কণ্ঠ দিয়েছেন। দূরদর্শনের জন্য তাঁর সংগীত আয়োজন মিলে সুর তুমহারা মেরা,
যেখানে পণ্ডিত রবিশংকর, হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া, ওস্তাদ আমজাদ আলী খান প্রমুখ সংগীতের মহারথীরা অংশগ্রহণ করেছিলেন। এই আয়োজনটা বেশ জনপ্রিয় হয়।
ভীমসেনের জনপ্রিয় রাগ শুদ্ধ কল্যাণ, শংকরা ইমন, মূলতানি, পুরীয়, পুরিয়া ধানেশ্রী, মালকোষ, দরবারি। তিনি নিজেই ছিলেন একটা প্রতিষ্ঠানের মতো; নিজস্ব একটা স্টাইলের প্রবর্তন করেছিলেন। পণ্ডিত ভীমসেন যোশির মৃত্যু তাই পাঁচ দশকের তাঁর সংগীত সাধনার, পরম্পরার অবসান।
আর এই উপলব্ধিটা অনেক বেশি সত্য উচ্চাঙ্গসংগীতের দিকপাল গুরু পণ্ডিত ভীমসেন যোশির মতো ব্যক্তিত্বের ক্ষেত্রে। একটা এক ঘণ্টার রাগের খেয়াল গাওয়ার পেছনে তাঁর প্রতিদিনের ১৬-১৮ ঘণ্টার অদম্য সাধনা, অথবা সংগীতকে ভালোবেসে গুরুর খোঁজে ঘর ছেড়ে অনেক কষ্ট মেনে নেওয়া গুরুকে সন্তুষ্ট করার আপ্রাণ চেষ্টা লুকিয়ে থাকে।
আর তাঁর মৃত্যু তাই ভারতীয় উপমহাদেশের সংগীতজগতের জন্য অপূরণীয়। ২৪ জানুয়ারি সকালে তিনি পুনে শহরের শাহাদ্রি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর। ১৯২২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি তিনি কর্ণাটকে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ছিলেন স্কুলশিক্ষক। ছোটবেলা থেকেই সংগীত তাঁকে এমনভাবে আকর্ষণ করে যে মাত্র ১১ বছর বয়সে গুরুর খোঁজে বাড়ি ছাড়েন। অনেক দোর ঘুরে তিনি রামপুরে পৌঁছান। সেখানে ওস্তাদ মুশতাক হুসেন খানের কাছে বছর খানেক কাটিয়ে লক্ষৌতে ঠুমরির আন্দাজ নিতে তালিম নেন। তখন ডিসি দত্ত বলে আমিনাবাদের এক চায়ের দোকানের মালিকের গীত-গজল গাইয়ে হিসেবে খুব নামডাক ছিল। তাঁরই চেষ্টায় ভীমসেন রেডিওর স্টাফ আর্টিস্ট হন এবং ২৫ টাকা ফি-তে খেয়াল ও প্রধানত ভজন গাইতেন। তাঁকে পাওয়া যায় কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং পাহাড়ি সান্যালের কথোপকথনে... কুমারপ্রসাদ বলছেন তাঁর কুদরতি রঙ্গীবিরঙ্গী বইয়ে। এক অনুষ্ঠান শেষে ভীমসেনজি এসে পাহাড়ি সান্যালকে বলছেন, ‘আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না? আমি ওই ভীমসেন, যে আপনার বসন্ত রায় রোডের বাসায় থাকতাম।’ চলে গেলে পাহাড়ি সান্যাল কপাল চাপড়ে কুমারপ্রসাদকে বলছেন, ‘হা ভগবান, এই সেই ভীমসেন! জানিস, এই ব্যাটার তখন চাল নেই চুলা নেই, কলকাতা শহর বিদেশবিভূঁই, গান শেখার অসম্ভব শখ। বেশ কিছুদিন আমার বাড়িতে ছিল, ফাইফরমাশ খাটত। গানের গলা মোষের বাচ্চার মতো। আমি শুনেটুনে বললাম, তোমার বাছা হবে না। ভগবান তোমায় গলা দেননি, তুমি থাকো, খাও আমার বাড়িতে, চেষ্টাচরিত্র করে স্টুডিওতে একটা ছোটখাটো কাজের চেষ্টা করে দেখব। তা এই সেই ভীমসেন!’
এই গল্পটা থেকে বোঝা যাবে ভীমসেন যোশি কত পরিশ্রম করে আজকের অবস্থানে এসেছেন, অসাধারণ কণ্ঠ তৈরি করেছেন। একনিষ্ঠ সাধনার রেওয়াজের ফসল তাঁর এই গলা। দৈনিক ১০ ঘণ্টারও বেশি রেওয়াজ করেছেন তিনি। তাঁর রেওয়াজের নিয়মটা ছিল—সকালে মোষের দুধ খেয়ে খরজে পুরো একটি রাগ গেয়ে সেই রাগ বিকেলে মধ্য ও তার সপ্তকে তানের সঙ্গে নিয়মিত অভ্যাস করতেন।
যোশি কিরানা ঘরানার জন্য গর্ব ছিলেন। কিরানা ঘরানার দিকপাল শিল্পী ওস্তাদ আবদুল করিম খানের শিষ্য সওয়াই গন্ধর্বের কাছে তালিম নেন। ওস্তাদ আবদুল করিম খান হিন্দুস্তানি উচ্চাঙ্গসংগীত নান্দনিকতার ওপর প্রয়োগ করে উত্তর ভারতীয় সংগীতে নতুন মাত্রা সংযোজন করেছেন। গোয়ালিয়র ঘরানার সংগীতগুরু ওস্তাদ হাফিজ আলী খান ভীষণ ভালোবাসতেন ভীমসেন যোশিকে। সওয়াই গন্ধর্বের কণ্ঠও একটু অন্য রকম ছিল। বংশগতভাবে তাঁর গলার নেতিবাচক দিকটিকেই তিনি ইতিবাচক শক্তিতে পরিণত করেছেন। ভীমসেন যোশিরও আওয়াজ লাগানোর পদ্ধতি একটু আলাদা ছিল। তাঁর আওয়াজ অনেক বলিষ্ঠ ছিল, তিনি চমৎকার ভলিউম কন্ট্রোল করতে পারতেন। ২০০৮ সালে ভারতের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘ভারতরত্ন’ পান তিনি। তাঁর প্লাটিনাম ডিস্ক বের হয় ১৯৮৬ সালে। ১৯৭২ সালে তিনি ‘পদ্মশ্রী’ পান, ‘সংগীত নাটক একাডেমি’ পান ১৯৭৬ সালে। ১৯৮৫ সালে তিনি ‘পদ্মভূষণ’ পান। তিনি শুধু খেয়ালই গাননি, ভজনও গেয়েছেন। তানসেন আখে, বসন্ত বাহার, ব্রাইডাল মাই ব্রাদার প্রভৃতি চলচ্চিত্রে কণ্ঠ দিয়েছেন। দূরদর্শনের জন্য তাঁর সংগীত আয়োজন মিলে সুর তুমহারা মেরা,
যেখানে পণ্ডিত রবিশংকর, হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া, ওস্তাদ আমজাদ আলী খান প্রমুখ সংগীতের মহারথীরা অংশগ্রহণ করেছিলেন। এই আয়োজনটা বেশ জনপ্রিয় হয়।
ভীমসেনের জনপ্রিয় রাগ শুদ্ধ কল্যাণ, শংকরা ইমন, মূলতানি, পুরীয়, পুরিয়া ধানেশ্রী, মালকোষ, দরবারি। তিনি নিজেই ছিলেন একটা প্রতিষ্ঠানের মতো; নিজস্ব একটা স্টাইলের প্রবর্তন করেছিলেন। পণ্ডিত ভীমসেন যোশির মৃত্যু তাই পাঁচ দশকের তাঁর সংগীত সাধনার, পরম্পরার অবসান।
No comments