যে তাহেরকে আমি জানতাম ব্য লরেন্স লিফশুলজ
তাহেরের সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৭৪ সালে। আমি তখন বাংলাদেশেই বাস করছি। ওই বছরে প্রচণ্ড বন্যায় দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয় শস্য। রংপুর এলাকায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল বেশি। পাঁচ দিনের বেশি সময় ধরে জমির ফসল ছিল পানির নিচে। এর ফলে ভূমিহীন ও দরিদ্র কৃষক কাজের অভাবে খুব বিপাকে পড়েন। নিজেদের ক্ষুধা নিবারণেও তাঁরা চাল কিনতে পারেননি।
ওই শরতেই হাজার হাজার ক্ষুধার্ত চাষি খাদ্য, কাজ ও ত্রাণের আশায় শহরে ভিড় জমাতে শুরু করেন। আমি যখন অক্টোবরে রংপুরে পৌঁছাই, দুর্ভিক্ষ তখন শহর ও তার আশপাশের এলাকা গ্রাস করেছে। দৃশ্যটি দান্তের ইনফারনোর সঙ্গে তুলনীয়, যেখানে হাজার হাজার নারী ও শিশু খাদ্যের জন্য ভিক্ষা করছে। তাদের পরিবারের পুরুষ সদস্যরা কাজ কিংবা ত্রাণ ও বাড়িতে টাকা পাঠানোর আশায় বহু আগেই দূরবর্তী শহরে চলে গেছেন। অনেকেই তাঁদের কোনো খোঁজখবর পাচ্ছিলেন না।
এমনই একটি পরিবেশে আমি ঢাকায় আমার সহকর্মীদের কাছে জানতে চাইলাম, তাঁরা এমন কারও কথা জানেন কি না, বন্যা নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে যাঁর উন্নত ধারণা রয়েছে। এমন কেউ কি আছেন, যিনি বুঝতে পারেন, কেন বছরের পর বছর ধরে বারবার বন্যা হচ্ছে।
একজন সম্পাদক সহকর্মী আমাকে বললেন, তিনি এমন একজন সেনা কর্মকর্তাকে জানেন, যিনি সদ্য সাপ্তাহিক বিচিত্রায় এ বিষয়ে একটি নিবন্ধ লিখেছেন। তাঁর লেখায় যে বিষয়টি ফুটে উঠেছে, তা হলো তাঁর উদ্ভাবনীমূলক ধারণা, যাতে মনে হচ্ছে তিনি সমস্যা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখেন এবং কেন পৌনঃপুনিক বন্যা হচ্ছে তার সঠিক কারণও তাঁর জানা। এই কর্মকর্তার নাম আবু তাহের।
আমি তাহেরের সঙ্গে তাঁর অফিসে সাক্ষাৎ করি। তিনি সম্প্রতি সেনাবাহিনী ত্যাগ করেছেন এবং বর্তমানে সি-ট্রাক ইউনিট নামে এক অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন সংস্থার কর্তাব্যক্তি হিসেবে কাজ করছেন। আমি তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলে চমৎকৃত হলাম। তিনি জানতেন, দেশের পৌনঃপুনিক বন্যা সমস্যার স্থায়ী ও টেকসই সমাধান না করে ভবিষ্যতের উপর্যুপরি দুর্ভিক্ষ প্রতিহত করা যাবে না। মোগল আমল থেকে বন্যা নিয়ন্ত্রণের যেসব কলাকৌশল ব্যবহার করা হয়েছে, তাহের সে সম্পর্কে ব্যাপক গবেষণা করেন। এমনকি ঔপনিবেশিক যুগের বন্যা-পরিস্থিতির বিষয়েও তাঁর ছিল ব্যাপক অধ্যয়ন। স্পষ্টতই ইতিহাসের এসব পর্ব থেকে এমন অনেক কিছু শিক্ষা নেওয়ার ছিল, যে সম্পর্কে আধুনিক বিশেষজ্ঞরা একেবারেই ওয়াকিবহাল ছিলেন না।
শুধু এই চিন্তাভাবনা দিয়ে তাহেরকে চেনার সুযোগ নেই। কিন্তু আমি একটি বিষয় পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলাম, আমি এমন একজন ব্যক্তির সাক্ষাৎ পেয়েছি, যিনি ছিলেন একজন ‘বিজ্ঞ সৈনিক’। যিনি ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে আজকের সমস্যার বাস্তব সমাধান খোঁজার চেষ্টা করছেন। আমি ঢাকায় অনেককেই জানতাম। একজন রিপোর্টার হিসেবে সেটাই ছিল আমার কাজ। কিন্তু এবারে আমি এমন একজন তাহেরকে জানলাম, যিনি অবিস্মরণীয়, বুদ্ধিদীপ্ত, বাস্তববাদী এবং বাংলাদেশের দারিদ্র্য ও অনুন্নয়ন দূরীকরণের চিন্তায় সমৃদ্ধ। আমি এরপর তাঁর সঙ্গে বহু সন্ধ্যা কাটিয়েছি এবং কথা বলেছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
আমি তাঁর কাছ থেকে জেনেছি গেরিলা যুদ্ধের কলাকৌশল, যা তিনি ১১ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাস্তবায়ন শুরু করেছিলেন। আমি তাঁর কাছ থেকে আরও জানলাম, কুমিল্লা ব্রিগেডের দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর তিনি কীভাবে সেনাবাহিনীর জন্য একটি ‘নতুন দৃষ্টান্তের’ বাস্তবায়ন শুরু করেছিলেন। তাহের মনে করেছিলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী একটি সংযোগস্থলে দাঁড়ানো। এই সেনাবাহিনী হয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাঠামো ও সাংগঠনিক প্রকৃতিতে গঠিত হবে অথবা তার নিজস্ব উদ্ভাবনী শক্তি খাটিয়ে এমন একটি সেনাবাহিনী গড়ে তুলবে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় আগে কখনো দেখা যায়নি। যদি এই সেনাবাহিনী আদর্শগত ও কাঠামোগতভাবে পাকিস্তানি মডেল গ্রহণ করে, যেখানে প্রায় সব সেনাসদস্য প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন, সে ক্ষেত্রে কোনো সন্দেহ নেই যে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীও ভবিষ্যতে কোনো একপর্যায়ে একটি সামরিক কিংবা একটি সামরিক-বেসামরিক স্বৈরতন্ত্রের এজেন্সিতে পরিণত হবে।
তাহের মনে করতেন, যদি বাংলাদেশের স্বাধীনতা হয়ে থাকে হতদরিদ্র ও নিরন্ন মানুষের জীবনের মৌলিক পরিবর্তনের জন্য, সে ক্ষেত্রে এমন একটি সেনাবাহিনীর প্রবর্তন দরকার হবে, যারা দরিদ্র মানুষের স্বপ্ন পূরণে সচেষ্ট থাকবে। তাঁর ভাবনা ছিল, এটা সম্ভব হতে পারে, সেনাবাহিনী যদি গ্রামবাসী ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাদের দৈনন্দিন আলাপ-আলোচনায় নিজেদের সম্পৃক্ত করে। এটা হবে এমন একটি সেনাবাহিনী, যারা অস্ত্র বহনকারী শক্তির চেয়ে অধিকতর কিছু। সে কারণেই তাহের সেনাবাহিনীর এই পর্যায়ের নামকরণ করেছিলেন, ‘উৎপাদনশীল সেনাবাহিনী’।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী অন্যান্য প্রথাগত সেনাবাহিনীর মতোই দেশের মূল্যবান সম্পদ অপচয়ের কান্ডারি ছিল। বিপুল অর্থ ব্যয় হতো প্রতিরক্ষা খাতে। এর ফলে স্কুল, হাসপাতাল ও উৎপাদনশীল বিনিয়োগে সম্পদের ব্যবহার সংকুচিত হতো। দশকের পর দশক ধরে বিরাজমান সামরিক একনায়কতন্ত্র ও আধিপত্য বজায় রাখার কারণে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কার্যত দেশের অর্থনীতির জন্য গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাহের মনে করতেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী ছিল এক দানবীয় পরগাছা, যা সবকিছু শুষে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে গরিব ও পশ্চাৎপদ রেখেছিল।
তিনি নিজেকেই জিজ্ঞেস করতেন, একটি স্বাধীন বাংলাদেশে এ রকম একটি দানব গড়ে তোলার জন্যই কি লাখ লাখ মানুষ স্বাধীনতার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করেছিল? তার জবাব ছিল, না এবং একজন সেনা কর্মকর্তা হিসেবে তিনি তা ঘটতে দিতে পারেন না। কীভাবে একটি নতুন দৃষ্টান্তে উত্তরণ ঘটানো যায়, তার পথ দেখাতে তিনি সচেষ্ট হন।
কুমিল্লা ব্রিগেডে তাহের তাঁর সেনাসদস্যদের ‘উৎপাদনশীল সৈন্য’ হিসেবে সংগঠিত করেন। তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্রিগেড তার খাদ্যের জোগান নিজেই নিশ্চিত করতে উদ্যোগী হয় এবং এ ক্ষেত্রে অনেকটা স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে ওঠে। এ প্রয়াসের লক্ষ্য ছিল সমাজের ওপর তারা যাতে কোনো অর্থনৈতিক বোঝার কারণ না হয়ে দাঁড়ায়। এই ব্রিগেডের সদস্যরা আশপাশের গ্রামগুলোতে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। তাঁরা স্থানীয় কৃষকদের চাষাবাদ, ফসল কাটা এবং সেচব্যবস্থার কাজে সহায়তা করতেন। তাঁরা সেনাবাহিনীর অবশিষ্ট অংশের কাছে ‘লাঙল সেনা’ হিসেবে পরিচিতি পান। অনেকে ভাবতেন, এটা মজার বিষয়। কিন্তু অন্যরা দেখেছেন, এর পেছনে নিশ্চয় গুরুতর উদ্দেশ্য রয়েছে।
তাহের দেখেছিলেন, এভাবে সেনা ও সাধারণ লোকদের দৈনন্দিন আলোচনা সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরের সংস্কৃতি পরিবর্তন ঘটাতে পারে। সেনাদের ‘কর্তৃত্বের মানসিকতাই’ প্রকারান্তরে একটি সামরিক স্বৈরাচারের জন্মদানের মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি তৈরি করে দেয়। তাহেরের এই নীতিই আসলে পরবর্তী সময়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জন্য গণবাহিনী গঠনের দর্শন হয়ে ওঠে। তাহের আমার কাছে ব্যাখ্যা করেছিলেন, তিনি সেনাবাহিনী ত্যাগ করেছিলেন এই কারণে যে তাঁর মতো যাঁরা সমমনা কর্মকর্তা, যাঁরা দুর্নীতির ভ্রূণের বিরুদ্ধে এবং একটি নতুন কাঠামোর প্রতি একটি আন্দোলন সৃষ্টির জন্য উদ্গ্রীব, তাঁরা কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন। প্রথাগত ধ্যান-ধারণাই তাঁদের পুনরায় আচ্ছন্ন করতে বসেছে। পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত কর্মকর্তা, বাংলাদেশের যুদ্ধের আদর্শগত প্রভাব যাঁদের স্পর্শ করেনি, ক্রমবর্ধমানভাবে তাঁরাই বৃহত্তর ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন।
তাহেরের সঙ্গে বৈঠকে মুজিব বিষয়টিতে সায় দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি আসলে বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেননি। কর্তৃত্বপরায়ণতা ও সামরিক স্বৈরতন্ত্রের বীজ বপন হচ্ছিল। কিন্তু মুজিব তা দেখতে পাননি। পাকিস্তানি ঐতিহ্য অনুযায়ী একটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটবে। তাহের সেই দিনটি আসার আগেই একটি বিকল্প তৈরির প্রস্তুতি নিতে সেনাবাহিনীর বাইরে এলেন। সর্বশেষ বৈঠকে তাহের তাঁকে যা বোঝাতে চেয়েছিলেন, তা না বুঝতে পেরে মুজিব চড়া মূল্য দিলেন।
১৯৭৪ সালের শেষের দিকে আমি বাংলাদেশ ত্যাগ করি। আমাকে ফার স্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ পত্রিকার দিল্লিভিত্তিক সংবাদদাতা নিয়োগ করা হয়। সুতরাং আমাকে গোটা দক্ষিণ এশিয়া কভারে মনোযোগী হতে হয়। আমি যখন তাহেরের কাছে বিদায় জানাতে গেলাম, তখন আসলে আমার কোনো ধারণাই ছিল না যে তিনি জাসদের একজন গোপন সদস্য। কিংবা তিনি সেনাবাহিনীর ভেতরে ও বাইরে একটি মোর্চা গঠনে সক্রিয়, যারা সেই মুহূর্তের জন্য নিজেদের তৈরি করছিল, যখন বাংলাদেশি সমাজের সবচেয়ে রক্ষণশীল অংশ একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করবেন এবং যা একই সঙ্গে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অধিকারের কবর দিতে হুমকি সৃষ্টি করবে।
তাহেরের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা থেকে আমি যা বুঝতে পেরেছি তা হলো, তিনি বহু বছর ধরে ধীরে ধীরে নিজেকে একজন বিপ্লবী সমাজতন্ত্রীতে পরিণত করেছিলেন। তিনি মাঝেমধ্যে আমাকে এ বিষয়ে বিদেশ থেকে কোনো একটি নির্দিষ্ট বই বা সাময়িকী এনে দিতে বলতেন। স্পষ্টতই সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির বিতর্ক এবং উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা সম্পর্কে তাঁর দারুণ আগ্রহ ছিল। আমাদের আলোচনায় তাহেরের অন্তর্দৃষ্টি ও যুক্তিবাদী মননের প্রতিফলন ঘটত।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের বিদ্রোহের পর তাহেরের সঙ্গে আমার আবার দেখা হয়। আমি বিস্ময়ের সঙ্গে জানতে পারি, তিনিই ছিলেন সেই বিদ্রোহের সামরিক অধিনায়ক। এটা আমাকে বিস্মিত করলেও একই সঙ্গে আমার কাছে তা ছিল যৌক্তিক। তাহের আসলে তাঁর ধারণাকে বাস্তবে রূপ দিতে চেয়েছিলেন।
তাহেরের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল সম্পূর্ণরূপে পেশাগত। নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ। তিনি আত্মগোপন করেছিলেন। এ অবস্থায় আমরা পুনরায় আলোচনা করি। ৭ নভেম্বরে যদিও তাহের জিয়ার জীবন রক্ষা করেন (জিয়া প্রকাশ্যেই এ কথা উল্লেখ করেছিলেন)। জিয়ার অবস্থান সম্পর্কে তাহের এবং জাসদের ইতিবাচক মূল্যায়ন ছিল ভুল। যদিও ঘরোয়াভাবে জিয়া দাবি করেছিলেন, একমাত্র সমাজতান্ত্রিক নীতি বাংলাদেশের চরম দারিদ্র্য ঘোচাতে পারে।
অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তাহেরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে সক্ষম হই। তাহেরের বড় ভাই আবু ইউসুফ খান এ ব্যাপারে সাহায্য করেন। আমরা প্রায় ৯০ মিনিট আলোচনা করেছিলাম। সেখানে আমি ৭ নভেম্বর সম্পর্কে তাহেরের বক্তব্য জানতে পারি। আমি তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিতে চাইলে তিনি বললেন, আবার তাঁকে স্বাগত জানাতে পারলে তিনি খুশি হবেন। তাহের ছিলেন আশাবাদী। তাঁর ভাবনা ছিল, তাঁদের দিন আসছে।
আমি তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিলাম, যদি তাঁরা ক্ষমতায় আসেন, তাহলে তাঁকে ও তাঁর সহকর্মীদের ভিড় থেকে অনেক দূরে দাঁড়িয়ে অবলোকন করবেন। আমি বললাম, তাঁরা বিষয়টিকে কীভাবে নেন, তার ওপর নির্ভর করবে আমাকে তখন ‘স্বাগত’ জানানো হবে কি না। আমি তাঁকে বললাম, যদি গ্রেপ্তার কিংবা তার চেয়ে খারাপ কিছু ঘটে, তা রিপোর্ট করার ক্ষেত্রে আমিই হব প্রথম। তেমন পরিস্থিতিতে আমাকে স্বাগত নাও জানানো হতে পারে। তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিই, আমি আসলে সব ক্ষমতা সম্পর্কেই সন্দিগ্ধ। তিনি মাথা ঝাঁকালেন, হাসলেন এবং বললেন, তিনি আমার ইঙ্গিত বুঝতে পেরেছেন। আমি বললাম, আপনি যদি আপনার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেন, তাহলে সে সম্পর্কে রিপোর্ট করার ক্ষেত্রেও আমি হাজির থাকব। নতুন সেনাবাহিনী গঠন করুন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ সমস্যা সমাধান করুন, দরিদ্রকে সাহায্য করুন, তাদের দারিদ্র্যের অবসান ঘটান—আমি সবকিছুরই বৃত্তান্ত লিখব।
আমরা বিদায় নিলাম। সেটাই ছিল তাহেরের সঙ্গে আমার শেষ দেখা। আমি এরপর তাঁকে আর দেখিনি। এরপর আমি অবশ্য তাঁর নিকট দূরত্বে উপস্থিত হয়েছিলাম। সেই দিনটিতে, যেদিন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তাঁর গোপন বিচার শুরু হয়েছিল। আমি দাঁড়িয়েছিলাম কারাগারের সামনে।
২০০৬ সালের ২১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত আলোচনায় মূল বক্তৃতার শুরুতে প্রদত্ত স্মৃতিচারণা, ইংরেজি থেকে অনূদিত।
লরেন্স লিফশুলজ: প্রখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক।
ওই শরতেই হাজার হাজার ক্ষুধার্ত চাষি খাদ্য, কাজ ও ত্রাণের আশায় শহরে ভিড় জমাতে শুরু করেন। আমি যখন অক্টোবরে রংপুরে পৌঁছাই, দুর্ভিক্ষ তখন শহর ও তার আশপাশের এলাকা গ্রাস করেছে। দৃশ্যটি দান্তের ইনফারনোর সঙ্গে তুলনীয়, যেখানে হাজার হাজার নারী ও শিশু খাদ্যের জন্য ভিক্ষা করছে। তাদের পরিবারের পুরুষ সদস্যরা কাজ কিংবা ত্রাণ ও বাড়িতে টাকা পাঠানোর আশায় বহু আগেই দূরবর্তী শহরে চলে গেছেন। অনেকেই তাঁদের কোনো খোঁজখবর পাচ্ছিলেন না।
এমনই একটি পরিবেশে আমি ঢাকায় আমার সহকর্মীদের কাছে জানতে চাইলাম, তাঁরা এমন কারও কথা জানেন কি না, বন্যা নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে যাঁর উন্নত ধারণা রয়েছে। এমন কেউ কি আছেন, যিনি বুঝতে পারেন, কেন বছরের পর বছর ধরে বারবার বন্যা হচ্ছে।
একজন সম্পাদক সহকর্মী আমাকে বললেন, তিনি এমন একজন সেনা কর্মকর্তাকে জানেন, যিনি সদ্য সাপ্তাহিক বিচিত্রায় এ বিষয়ে একটি নিবন্ধ লিখেছেন। তাঁর লেখায় যে বিষয়টি ফুটে উঠেছে, তা হলো তাঁর উদ্ভাবনীমূলক ধারণা, যাতে মনে হচ্ছে তিনি সমস্যা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখেন এবং কেন পৌনঃপুনিক বন্যা হচ্ছে তার সঠিক কারণও তাঁর জানা। এই কর্মকর্তার নাম আবু তাহের।
আমি তাহেরের সঙ্গে তাঁর অফিসে সাক্ষাৎ করি। তিনি সম্প্রতি সেনাবাহিনী ত্যাগ করেছেন এবং বর্তমানে সি-ট্রাক ইউনিট নামে এক অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন সংস্থার কর্তাব্যক্তি হিসেবে কাজ করছেন। আমি তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলে চমৎকৃত হলাম। তিনি জানতেন, দেশের পৌনঃপুনিক বন্যা সমস্যার স্থায়ী ও টেকসই সমাধান না করে ভবিষ্যতের উপর্যুপরি দুর্ভিক্ষ প্রতিহত করা যাবে না। মোগল আমল থেকে বন্যা নিয়ন্ত্রণের যেসব কলাকৌশল ব্যবহার করা হয়েছে, তাহের সে সম্পর্কে ব্যাপক গবেষণা করেন। এমনকি ঔপনিবেশিক যুগের বন্যা-পরিস্থিতির বিষয়েও তাঁর ছিল ব্যাপক অধ্যয়ন। স্পষ্টতই ইতিহাসের এসব পর্ব থেকে এমন অনেক কিছু শিক্ষা নেওয়ার ছিল, যে সম্পর্কে আধুনিক বিশেষজ্ঞরা একেবারেই ওয়াকিবহাল ছিলেন না।
শুধু এই চিন্তাভাবনা দিয়ে তাহেরকে চেনার সুযোগ নেই। কিন্তু আমি একটি বিষয় পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলাম, আমি এমন একজন ব্যক্তির সাক্ষাৎ পেয়েছি, যিনি ছিলেন একজন ‘বিজ্ঞ সৈনিক’। যিনি ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে আজকের সমস্যার বাস্তব সমাধান খোঁজার চেষ্টা করছেন। আমি ঢাকায় অনেককেই জানতাম। একজন রিপোর্টার হিসেবে সেটাই ছিল আমার কাজ। কিন্তু এবারে আমি এমন একজন তাহেরকে জানলাম, যিনি অবিস্মরণীয়, বুদ্ধিদীপ্ত, বাস্তববাদী এবং বাংলাদেশের দারিদ্র্য ও অনুন্নয়ন দূরীকরণের চিন্তায় সমৃদ্ধ। আমি এরপর তাঁর সঙ্গে বহু সন্ধ্যা কাটিয়েছি এবং কথা বলেছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
আমি তাঁর কাছ থেকে জেনেছি গেরিলা যুদ্ধের কলাকৌশল, যা তিনি ১১ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাস্তবায়ন শুরু করেছিলেন। আমি তাঁর কাছ থেকে আরও জানলাম, কুমিল্লা ব্রিগেডের দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর তিনি কীভাবে সেনাবাহিনীর জন্য একটি ‘নতুন দৃষ্টান্তের’ বাস্তবায়ন শুরু করেছিলেন। তাহের মনে করেছিলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী একটি সংযোগস্থলে দাঁড়ানো। এই সেনাবাহিনী হয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাঠামো ও সাংগঠনিক প্রকৃতিতে গঠিত হবে অথবা তার নিজস্ব উদ্ভাবনী শক্তি খাটিয়ে এমন একটি সেনাবাহিনী গড়ে তুলবে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় আগে কখনো দেখা যায়নি। যদি এই সেনাবাহিনী আদর্শগত ও কাঠামোগতভাবে পাকিস্তানি মডেল গ্রহণ করে, যেখানে প্রায় সব সেনাসদস্য প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন, সে ক্ষেত্রে কোনো সন্দেহ নেই যে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীও ভবিষ্যতে কোনো একপর্যায়ে একটি সামরিক কিংবা একটি সামরিক-বেসামরিক স্বৈরতন্ত্রের এজেন্সিতে পরিণত হবে।
তাহের মনে করতেন, যদি বাংলাদেশের স্বাধীনতা হয়ে থাকে হতদরিদ্র ও নিরন্ন মানুষের জীবনের মৌলিক পরিবর্তনের জন্য, সে ক্ষেত্রে এমন একটি সেনাবাহিনীর প্রবর্তন দরকার হবে, যারা দরিদ্র মানুষের স্বপ্ন পূরণে সচেষ্ট থাকবে। তাঁর ভাবনা ছিল, এটা সম্ভব হতে পারে, সেনাবাহিনী যদি গ্রামবাসী ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাদের দৈনন্দিন আলাপ-আলোচনায় নিজেদের সম্পৃক্ত করে। এটা হবে এমন একটি সেনাবাহিনী, যারা অস্ত্র বহনকারী শক্তির চেয়ে অধিকতর কিছু। সে কারণেই তাহের সেনাবাহিনীর এই পর্যায়ের নামকরণ করেছিলেন, ‘উৎপাদনশীল সেনাবাহিনী’।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী অন্যান্য প্রথাগত সেনাবাহিনীর মতোই দেশের মূল্যবান সম্পদ অপচয়ের কান্ডারি ছিল। বিপুল অর্থ ব্যয় হতো প্রতিরক্ষা খাতে। এর ফলে স্কুল, হাসপাতাল ও উৎপাদনশীল বিনিয়োগে সম্পদের ব্যবহার সংকুচিত হতো। দশকের পর দশক ধরে বিরাজমান সামরিক একনায়কতন্ত্র ও আধিপত্য বজায় রাখার কারণে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কার্যত দেশের অর্থনীতির জন্য গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাহের মনে করতেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী ছিল এক দানবীয় পরগাছা, যা সবকিছু শুষে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে গরিব ও পশ্চাৎপদ রেখেছিল।
তিনি নিজেকেই জিজ্ঞেস করতেন, একটি স্বাধীন বাংলাদেশে এ রকম একটি দানব গড়ে তোলার জন্যই কি লাখ লাখ মানুষ স্বাধীনতার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করেছিল? তার জবাব ছিল, না এবং একজন সেনা কর্মকর্তা হিসেবে তিনি তা ঘটতে দিতে পারেন না। কীভাবে একটি নতুন দৃষ্টান্তে উত্তরণ ঘটানো যায়, তার পথ দেখাতে তিনি সচেষ্ট হন।
কুমিল্লা ব্রিগেডে তাহের তাঁর সেনাসদস্যদের ‘উৎপাদনশীল সৈন্য’ হিসেবে সংগঠিত করেন। তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্রিগেড তার খাদ্যের জোগান নিজেই নিশ্চিত করতে উদ্যোগী হয় এবং এ ক্ষেত্রে অনেকটা স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে ওঠে। এ প্রয়াসের লক্ষ্য ছিল সমাজের ওপর তারা যাতে কোনো অর্থনৈতিক বোঝার কারণ না হয়ে দাঁড়ায়। এই ব্রিগেডের সদস্যরা আশপাশের গ্রামগুলোতে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। তাঁরা স্থানীয় কৃষকদের চাষাবাদ, ফসল কাটা এবং সেচব্যবস্থার কাজে সহায়তা করতেন। তাঁরা সেনাবাহিনীর অবশিষ্ট অংশের কাছে ‘লাঙল সেনা’ হিসেবে পরিচিতি পান। অনেকে ভাবতেন, এটা মজার বিষয়। কিন্তু অন্যরা দেখেছেন, এর পেছনে নিশ্চয় গুরুতর উদ্দেশ্য রয়েছে।
তাহের দেখেছিলেন, এভাবে সেনা ও সাধারণ লোকদের দৈনন্দিন আলোচনা সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরের সংস্কৃতি পরিবর্তন ঘটাতে পারে। সেনাদের ‘কর্তৃত্বের মানসিকতাই’ প্রকারান্তরে একটি সামরিক স্বৈরাচারের জন্মদানের মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি তৈরি করে দেয়। তাহেরের এই নীতিই আসলে পরবর্তী সময়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জন্য গণবাহিনী গঠনের দর্শন হয়ে ওঠে। তাহের আমার কাছে ব্যাখ্যা করেছিলেন, তিনি সেনাবাহিনী ত্যাগ করেছিলেন এই কারণে যে তাঁর মতো যাঁরা সমমনা কর্মকর্তা, যাঁরা দুর্নীতির ভ্রূণের বিরুদ্ধে এবং একটি নতুন কাঠামোর প্রতি একটি আন্দোলন সৃষ্টির জন্য উদ্গ্রীব, তাঁরা কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন। প্রথাগত ধ্যান-ধারণাই তাঁদের পুনরায় আচ্ছন্ন করতে বসেছে। পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত কর্মকর্তা, বাংলাদেশের যুদ্ধের আদর্শগত প্রভাব যাঁদের স্পর্শ করেনি, ক্রমবর্ধমানভাবে তাঁরাই বৃহত্তর ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন।
তাহেরের সঙ্গে বৈঠকে মুজিব বিষয়টিতে সায় দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি আসলে বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেননি। কর্তৃত্বপরায়ণতা ও সামরিক স্বৈরতন্ত্রের বীজ বপন হচ্ছিল। কিন্তু মুজিব তা দেখতে পাননি। পাকিস্তানি ঐতিহ্য অনুযায়ী একটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটবে। তাহের সেই দিনটি আসার আগেই একটি বিকল্প তৈরির প্রস্তুতি নিতে সেনাবাহিনীর বাইরে এলেন। সর্বশেষ বৈঠকে তাহের তাঁকে যা বোঝাতে চেয়েছিলেন, তা না বুঝতে পেরে মুজিব চড়া মূল্য দিলেন।
১৯৭৪ সালের শেষের দিকে আমি বাংলাদেশ ত্যাগ করি। আমাকে ফার স্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ পত্রিকার দিল্লিভিত্তিক সংবাদদাতা নিয়োগ করা হয়। সুতরাং আমাকে গোটা দক্ষিণ এশিয়া কভারে মনোযোগী হতে হয়। আমি যখন তাহেরের কাছে বিদায় জানাতে গেলাম, তখন আসলে আমার কোনো ধারণাই ছিল না যে তিনি জাসদের একজন গোপন সদস্য। কিংবা তিনি সেনাবাহিনীর ভেতরে ও বাইরে একটি মোর্চা গঠনে সক্রিয়, যারা সেই মুহূর্তের জন্য নিজেদের তৈরি করছিল, যখন বাংলাদেশি সমাজের সবচেয়ে রক্ষণশীল অংশ একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করবেন এবং যা একই সঙ্গে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অধিকারের কবর দিতে হুমকি সৃষ্টি করবে।
তাহেরের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা থেকে আমি যা বুঝতে পেরেছি তা হলো, তিনি বহু বছর ধরে ধীরে ধীরে নিজেকে একজন বিপ্লবী সমাজতন্ত্রীতে পরিণত করেছিলেন। তিনি মাঝেমধ্যে আমাকে এ বিষয়ে বিদেশ থেকে কোনো একটি নির্দিষ্ট বই বা সাময়িকী এনে দিতে বলতেন। স্পষ্টতই সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির বিতর্ক এবং উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা সম্পর্কে তাঁর দারুণ আগ্রহ ছিল। আমাদের আলোচনায় তাহেরের অন্তর্দৃষ্টি ও যুক্তিবাদী মননের প্রতিফলন ঘটত।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের বিদ্রোহের পর তাহেরের সঙ্গে আমার আবার দেখা হয়। আমি বিস্ময়ের সঙ্গে জানতে পারি, তিনিই ছিলেন সেই বিদ্রোহের সামরিক অধিনায়ক। এটা আমাকে বিস্মিত করলেও একই সঙ্গে আমার কাছে তা ছিল যৌক্তিক। তাহের আসলে তাঁর ধারণাকে বাস্তবে রূপ দিতে চেয়েছিলেন।
তাহেরের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল সম্পূর্ণরূপে পেশাগত। নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ। তিনি আত্মগোপন করেছিলেন। এ অবস্থায় আমরা পুনরায় আলোচনা করি। ৭ নভেম্বরে যদিও তাহের জিয়ার জীবন রক্ষা করেন (জিয়া প্রকাশ্যেই এ কথা উল্লেখ করেছিলেন)। জিয়ার অবস্থান সম্পর্কে তাহের এবং জাসদের ইতিবাচক মূল্যায়ন ছিল ভুল। যদিও ঘরোয়াভাবে জিয়া দাবি করেছিলেন, একমাত্র সমাজতান্ত্রিক নীতি বাংলাদেশের চরম দারিদ্র্য ঘোচাতে পারে।
অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তাহেরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে সক্ষম হই। তাহেরের বড় ভাই আবু ইউসুফ খান এ ব্যাপারে সাহায্য করেন। আমরা প্রায় ৯০ মিনিট আলোচনা করেছিলাম। সেখানে আমি ৭ নভেম্বর সম্পর্কে তাহেরের বক্তব্য জানতে পারি। আমি তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিতে চাইলে তিনি বললেন, আবার তাঁকে স্বাগত জানাতে পারলে তিনি খুশি হবেন। তাহের ছিলেন আশাবাদী। তাঁর ভাবনা ছিল, তাঁদের দিন আসছে।
আমি তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিলাম, যদি তাঁরা ক্ষমতায় আসেন, তাহলে তাঁকে ও তাঁর সহকর্মীদের ভিড় থেকে অনেক দূরে দাঁড়িয়ে অবলোকন করবেন। আমি বললাম, তাঁরা বিষয়টিকে কীভাবে নেন, তার ওপর নির্ভর করবে আমাকে তখন ‘স্বাগত’ জানানো হবে কি না। আমি তাঁকে বললাম, যদি গ্রেপ্তার কিংবা তার চেয়ে খারাপ কিছু ঘটে, তা রিপোর্ট করার ক্ষেত্রে আমিই হব প্রথম। তেমন পরিস্থিতিতে আমাকে স্বাগত নাও জানানো হতে পারে। তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিই, আমি আসলে সব ক্ষমতা সম্পর্কেই সন্দিগ্ধ। তিনি মাথা ঝাঁকালেন, হাসলেন এবং বললেন, তিনি আমার ইঙ্গিত বুঝতে পেরেছেন। আমি বললাম, আপনি যদি আপনার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেন, তাহলে সে সম্পর্কে রিপোর্ট করার ক্ষেত্রেও আমি হাজির থাকব। নতুন সেনাবাহিনী গঠন করুন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ সমস্যা সমাধান করুন, দরিদ্রকে সাহায্য করুন, তাদের দারিদ্র্যের অবসান ঘটান—আমি সবকিছুরই বৃত্তান্ত লিখব।
আমরা বিদায় নিলাম। সেটাই ছিল তাহেরের সঙ্গে আমার শেষ দেখা। আমি এরপর তাঁকে আর দেখিনি। এরপর আমি অবশ্য তাঁর নিকট দূরত্বে উপস্থিত হয়েছিলাম। সেই দিনটিতে, যেদিন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তাঁর গোপন বিচার শুরু হয়েছিল। আমি দাঁড়িয়েছিলাম কারাগারের সামনে।
২০০৬ সালের ২১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত আলোচনায় মূল বক্তৃতার শুরুতে প্রদত্ত স্মৃতিচারণা, ইংরেজি থেকে অনূদিত।
লরেন্স লিফশুলজ: প্রখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক।
No comments