মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় মাহে রমজান -সিয়াম সাধনার মাস ধর্ম by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান
ইসলামের নীতি-আদর্শ দ্বারা পরিচালিত জীবনব্যবস্থা নৈতিক মূল্যবোধ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এটি মানুষের ইচ্ছার একটি প্রধান মানদণ্ড। এ মানদণ্ডে সমাজে মানুষের কর্মকাণ্ডের ভালোমন্দ বিচার করা হয়। তাই সামাজিক মূল্যবোধ হচ্ছে সত্যবাদিতা, ন্যায়নীতি, শিষ্টাচার, সহনশীলতা, সহমর্মিতা, সময়ানুবর্তিতা, শৃঙ্খলাবোধ, কর্তব্যপরায়ণতা, সদাচরণ প্রভৃতি সুকুমার বৃত্তি বা মানবীয় গুণাবলির সমষ্টি। ইসলাম মানবজাতিকে এসব মহৎ গুণ অর্জনের জন্য আজীবন প্রয়াস চালাতে বিশেষভাবে দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে।
সামাজিক মূল্যবোধ হলো সমাজের ভিত্তি। সমাজ জীবনে মানুষের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত আচরণ এবং কর্মকাণ্ড যেসব ইসলামি নীতিমালার আলোকে প্রতিষ্ঠিত হয়, তাদের সমষ্টিই সামাজিক মূল্যবোধ। জীবনে কোনো প্রকার অন্যায়-অত্যাচার, জুলুম-নির্যাতন থাকবে না, মানুষ স্বার্থপরতা-সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত থাকবে—এটি ইসলামের শিক্ষা। যেকোনো সমাজের রীতিনীতি, মনোভাব এবং সমাজের অন্যান্য অনুমোদিত ব্যবহারের সমন্বয়ে মানুষের মধ্যে স্নেহ, মায়া-মমতা, সততা, সম্প্রীতি প্রভৃতি সৃষ্টি হয়। এমন হলে সেখানে নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ বিদ্যমান আছে বলে মনে হয়। নৈতিক আদর্শসংবলিত সমাজে কোনো অনাচার থাকবে না। ঘুষ, দুর্নীতি, বঞ্চনা, শোষণ, স্বার্থপরতা এসব কুপ্রবৃত্তি থেকে সমাজ মুক্ত থাকলেই তাতে নৈতিকতার আদর্শ প্রতিফলিত হয়। সব ধরনের দুর্নীতি থেকে মুক্ত জীবনই আদর্শ জীবন। নীতি থেকে বিচ্যুত জীবন কখনোই আদর্শরূপে গণ্য হতে পারে না। নবী করিম (সা.) মানবজাতিকে অন্যায় প্রতিরোধের শিক্ষা দিয়ে বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ যদি কাউকে অন্যায় কাজ করতে দেখে তাহলে সে যেন তার শক্তি দ্বারা তা প্রতিহত করে, যদি সে তাতে অক্ষম হয়, তবে মুখ দ্বারা নিষেধ করবে, যদি সে তাতেও অপারগ হয় তবে সে অন্তর দ্বারা ঘৃণা পোষণ করবে।’ (মুসলিম)
বর্তমান সমাজে নানা রকম দুর্নীতির অনুপ্রবেশ ঘটায় নৈতিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ঘটছে। জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে দুর্নীতির ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। কোনো প্রকার অন্যায়ই যেন অপরাধ বলে বিবেচিত হয় না। নীতিভ্রষ্ট মানুষ নিজেকে অপরাধী বা হীন বলে গণ্য করে না। দুর্নীতির মাধ্যমে বিত্তশালী হয়েও সংকোচবোধ করে না বরং অর্থের অহংবোধে গৌরবান্বিত হয়। সমাজে ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জন ও আত্মসাতের প্রতিযোগিতা চলছে। সীমাহীন দুর্নীতি সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে সমাজ জীবনকে কলুষিত করে ফেলছে। অথচ পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা অন্যায়ভাবে একে অপরের ধন-সম্পদ গ্রাস করো না।’ (সূরা আন-নিসা, আয়াত-২৯)
বর্তমান সমাজে মানুষ দারুণভাবে নৈতিকতার অভাব অনুভব করছে। নৈতিক মূল্যবোধ আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে। চুরি, ডাকাতি, সন্ত্রাস, বোমাবাজি খুন-খারাবি, অপরাধ, দুর্নীতি, সমাজ ও রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড, সুদ, ঘুষ, কালোবাজারি, মুনাফাখোরি, লোভ, লালসা, নারী নির্যাতন, অধিকার আদায়ের নামে নারী জাতিকে ভোগ্যপণ্যের মতো ব্যবহার প্রভৃতি অনৈতিক কার্যাবলি আজকের সমাজকে সম্পূর্ণরূপে কলুষিত করে ফেলেছে। এমতাবস্থায় ইসলামে যে আদর্শ নৈতিকতা রয়েছে তা গ্রহণ করলে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবন সুন্দর ও মধুময় হয়ে উঠবে নিঃসন্দেহে। সামাজিক ঐক্য ও নিরাপত্তা বিধানে এবং একটি সংঘাতমুক্ত গঠনমূলক আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে মাহে রমজান গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। রমজান মাসে কঠোর সিয়াম সাধনার মাধ্যমে রোজাদার ব্যক্তিরা অপরের বদনাম ও কুটনামি থেকে বিরত থাকেন। তারা সকল প্রকার ঝগড়া-বিবাদ, ফিতনা-ফ্যাসাদ, অযথা বাগিবতণ্ডা ও যাবতীয় খারাপ কাজ থেকে দূরে থাকেন। তাদের মুখ থেকে কোনো প্রকার অশ্লীল কথা বের হয় না। যদি কোনো রোজাদার লোককে কেউ গালিগালাজ ও ঝগড়া-বিবাদে প্ররোচিত করতে চায়, তখন সেই রোজাদার যদি উত্তেজিত না হয়ে ঝগড়া-বিবাদ ও গালিগালাজ থেকে দূরে সরে যান, তাহলে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয় না এবং একটি আদর্শ নৈতিকতাপূর্ণ সহনশীল সমাজ গড়ে ওঠে। নবী করিম (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘যখন তোমাদের কেউ কোনো দিন রোজা রাখে তখন তার মুখ থেকে যেন কোনো রকম খারাপ কথা ও শোরগোল বের না হয়। যদি কেউ তাকে গালিগালাজ করে বা ঝগড়া-বিবাদে প্ররোচিত করতে চায় তখন সে যেন বলে, ‘আমি রোজাদার ব্যক্তি।’ (বুখারি)
সামাজিক মূল্যবোধ মানুষের প্রতি সাহায্য ও সহযোগিতার মনোভাব সৃষ্টি করে। ফলে সমাজের মধ্যে মানববন্ধন গভীর হয়, মানুষের মধ্যে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব স্থাপিত হয়। দেশের জন্য ভালোবাসা জন্মে। সামাজিক মূল্যবোধ মানুষের প্রতি সদাচরণ করতে শেখায়, জীবনে শৃঙ্খলা আনে এবং মানুষকে পরিপূর্ণ হতে সাহায্য করে। মানুষের প্রতি মানুষের সহানুভূতির অভাব, কর্তব্যে আন্তরিকতার বদলে দায়সারাভাব, স্বীয় স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যাপক তত্পরতা, জনকল্যাণের প্রতি অনীহা—এসব মূল্যবোধহীনতা মানুষের জীবনকে অশান্তিময় করে তোলে। সুশৃঙ্খল পরিবেশ সামাজিক মূল্যবোধ বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের অভাবে সমাজে বিশৃঙ্খলা বা অসংগতি বৃদ্ধি পায়। পরমতসহিষ্ণুতা ও সহনশীলতার অভাবে পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি, দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ প্রভৃতি অনাচারের ফলে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় হয়। বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর চরিত্রের অন্যতম ভূষণ ছিল ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘সহনশীলতা অপেক্ষা অধিক উত্তম ও অত্যধিক কল্যাণকর বস্তু আর কিছুই কাউকে দান করা হয়নি।’ (বুখারি)
রমজান মাসে আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের কঠোর ত্যাগ, উদারতা, সততা, ধৈর্য ও সহনশীলতা প্রদর্শনের নির্দেশ দিয়েছেন। এ মাসটি ধৈর্য অবলম্বনের মাস। ধৈর্যধারণের বিনিময়ে নির্ধারিত রয়েছে অতুলনীয় শান্তির আবাস বেহেশত। তাই এ মাসটির পরিচয় তুলে ধরে ধৈর্য ও সবরের গুরুত্ব প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘এটা ধৈর্যের মাস, আর সবরের বিনিময় হচ্ছে জান্নাত।’ (মিশকাত) মাহে রমজানে কঠোরভাবে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে ধৈর্য ও সহনশীলতার যে মানবিক গুণটি অর্জিত হয়, তা শুধু ব্যক্তি পর্যায়ের গুণই নয় বরং এ মহৎ গুণটি কারও মধ্যে সৃষ্টি হলে ঈমানদারের সমষ্টিগত জীবনে অপরের জন্য তা উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে, মানুষকে কঠিন ও দুর্গম পথ পরিক্রমায় চলতে শক্তি জোগায়। রোজা পালনের মাধ্যমে অর্জিত ধৈর্য ও সহনশীলতা ঈমান ও তার ন্যায্য দাবি প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম সাধনায় প্রচুর নিয়ামক শক্তি সঞ্চার করে। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে অর্জিত সহনশীলতা তাই শুধু ব্যক্তিগত কল্যাণই বয়ে আনে না বরং মুসলমান সমাজের জন্য একটি দলগত কল্যাণ বয়ে আনে। এ মর্মে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘অবশ্যই ধৈর্যশীলদের তাদের (ধৈর্যের) প্রতিদান পরিপূর্ণভাবে প্রদান করা হবে।’ (সূরা আল-জুুমার, আয়াত-১০)
নবী করিম (সা.) নিজেকে ইসলামি নীতিবোধ অনুযায়ী পরিচালনা করেছেন এবং সাহাবীগণ সে অনুযায়ী নিজেদের চরিত্রকে গঠন করতে উপদেশ দিয়েছেন। ইসলামি রীতিনীতি ও নৈতিকতাবোধ জীবনে বাস্তবায়ন করলে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল খুশি হন এবং ইহকাল ও পরকালে চরম সুখ ও পরম শান্তি লাভ করা যায়। দেশ ও জাতির সার্বিক কল্যাণের জন্য জাতীয় জীবন থেকে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় দূর করার উদ্যোগ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। সমাজের সর্বস্তর থেকে সর্বপ্রকার দুর্নীতির অবসান ঘটাতে হবে। দুর্নীতিবাজদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। মানুষকে জান-মাল ও জীবিকার পূর্ণ নিরাপত্তা দিতে হবে। সামাজিক মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতাসম্পন্ন সুদক্ষ প্রশাসন গড়ে তুলতে গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে এবং জনগণের মধ্যে দেশপ্রেম-দেশাত্মবোধ জাগ্রত করতে হবে। সুতরাং আজকের সমাজও যদি ইসলামের সর্বজনীনতাকে মেনে নিয়ে ইসলামি বিধি-বিধান ও অনুশাসনকে রোজাদারদের জীবন ও সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে, তবেই সমাজ থেকে যাবতীয় অনৈতিকতা দূর হবে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমি, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়। পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব হজরত মুহাম্মদ (সা.)।
সামাজিক মূল্যবোধ হলো সমাজের ভিত্তি। সমাজ জীবনে মানুষের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত আচরণ এবং কর্মকাণ্ড যেসব ইসলামি নীতিমালার আলোকে প্রতিষ্ঠিত হয়, তাদের সমষ্টিই সামাজিক মূল্যবোধ। জীবনে কোনো প্রকার অন্যায়-অত্যাচার, জুলুম-নির্যাতন থাকবে না, মানুষ স্বার্থপরতা-সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত থাকবে—এটি ইসলামের শিক্ষা। যেকোনো সমাজের রীতিনীতি, মনোভাব এবং সমাজের অন্যান্য অনুমোদিত ব্যবহারের সমন্বয়ে মানুষের মধ্যে স্নেহ, মায়া-মমতা, সততা, সম্প্রীতি প্রভৃতি সৃষ্টি হয়। এমন হলে সেখানে নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ বিদ্যমান আছে বলে মনে হয়। নৈতিক আদর্শসংবলিত সমাজে কোনো অনাচার থাকবে না। ঘুষ, দুর্নীতি, বঞ্চনা, শোষণ, স্বার্থপরতা এসব কুপ্রবৃত্তি থেকে সমাজ মুক্ত থাকলেই তাতে নৈতিকতার আদর্শ প্রতিফলিত হয়। সব ধরনের দুর্নীতি থেকে মুক্ত জীবনই আদর্শ জীবন। নীতি থেকে বিচ্যুত জীবন কখনোই আদর্শরূপে গণ্য হতে পারে না। নবী করিম (সা.) মানবজাতিকে অন্যায় প্রতিরোধের শিক্ষা দিয়ে বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ যদি কাউকে অন্যায় কাজ করতে দেখে তাহলে সে যেন তার শক্তি দ্বারা তা প্রতিহত করে, যদি সে তাতে অক্ষম হয়, তবে মুখ দ্বারা নিষেধ করবে, যদি সে তাতেও অপারগ হয় তবে সে অন্তর দ্বারা ঘৃণা পোষণ করবে।’ (মুসলিম)
বর্তমান সমাজে নানা রকম দুর্নীতির অনুপ্রবেশ ঘটায় নৈতিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ঘটছে। জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে দুর্নীতির ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। কোনো প্রকার অন্যায়ই যেন অপরাধ বলে বিবেচিত হয় না। নীতিভ্রষ্ট মানুষ নিজেকে অপরাধী বা হীন বলে গণ্য করে না। দুর্নীতির মাধ্যমে বিত্তশালী হয়েও সংকোচবোধ করে না বরং অর্থের অহংবোধে গৌরবান্বিত হয়। সমাজে ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জন ও আত্মসাতের প্রতিযোগিতা চলছে। সীমাহীন দুর্নীতি সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে সমাজ জীবনকে কলুষিত করে ফেলছে। অথচ পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা অন্যায়ভাবে একে অপরের ধন-সম্পদ গ্রাস করো না।’ (সূরা আন-নিসা, আয়াত-২৯)
বর্তমান সমাজে মানুষ দারুণভাবে নৈতিকতার অভাব অনুভব করছে। নৈতিক মূল্যবোধ আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে। চুরি, ডাকাতি, সন্ত্রাস, বোমাবাজি খুন-খারাবি, অপরাধ, দুর্নীতি, সমাজ ও রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড, সুদ, ঘুষ, কালোবাজারি, মুনাফাখোরি, লোভ, লালসা, নারী নির্যাতন, অধিকার আদায়ের নামে নারী জাতিকে ভোগ্যপণ্যের মতো ব্যবহার প্রভৃতি অনৈতিক কার্যাবলি আজকের সমাজকে সম্পূর্ণরূপে কলুষিত করে ফেলেছে। এমতাবস্থায় ইসলামে যে আদর্শ নৈতিকতা রয়েছে তা গ্রহণ করলে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবন সুন্দর ও মধুময় হয়ে উঠবে নিঃসন্দেহে। সামাজিক ঐক্য ও নিরাপত্তা বিধানে এবং একটি সংঘাতমুক্ত গঠনমূলক আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে মাহে রমজান গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। রমজান মাসে কঠোর সিয়াম সাধনার মাধ্যমে রোজাদার ব্যক্তিরা অপরের বদনাম ও কুটনামি থেকে বিরত থাকেন। তারা সকল প্রকার ঝগড়া-বিবাদ, ফিতনা-ফ্যাসাদ, অযথা বাগিবতণ্ডা ও যাবতীয় খারাপ কাজ থেকে দূরে থাকেন। তাদের মুখ থেকে কোনো প্রকার অশ্লীল কথা বের হয় না। যদি কোনো রোজাদার লোককে কেউ গালিগালাজ ও ঝগড়া-বিবাদে প্ররোচিত করতে চায়, তখন সেই রোজাদার যদি উত্তেজিত না হয়ে ঝগড়া-বিবাদ ও গালিগালাজ থেকে দূরে সরে যান, তাহলে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয় না এবং একটি আদর্শ নৈতিকতাপূর্ণ সহনশীল সমাজ গড়ে ওঠে। নবী করিম (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘যখন তোমাদের কেউ কোনো দিন রোজা রাখে তখন তার মুখ থেকে যেন কোনো রকম খারাপ কথা ও শোরগোল বের না হয়। যদি কেউ তাকে গালিগালাজ করে বা ঝগড়া-বিবাদে প্ররোচিত করতে চায় তখন সে যেন বলে, ‘আমি রোজাদার ব্যক্তি।’ (বুখারি)
সামাজিক মূল্যবোধ মানুষের প্রতি সাহায্য ও সহযোগিতার মনোভাব সৃষ্টি করে। ফলে সমাজের মধ্যে মানববন্ধন গভীর হয়, মানুষের মধ্যে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব স্থাপিত হয়। দেশের জন্য ভালোবাসা জন্মে। সামাজিক মূল্যবোধ মানুষের প্রতি সদাচরণ করতে শেখায়, জীবনে শৃঙ্খলা আনে এবং মানুষকে পরিপূর্ণ হতে সাহায্য করে। মানুষের প্রতি মানুষের সহানুভূতির অভাব, কর্তব্যে আন্তরিকতার বদলে দায়সারাভাব, স্বীয় স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যাপক তত্পরতা, জনকল্যাণের প্রতি অনীহা—এসব মূল্যবোধহীনতা মানুষের জীবনকে অশান্তিময় করে তোলে। সুশৃঙ্খল পরিবেশ সামাজিক মূল্যবোধ বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের অভাবে সমাজে বিশৃঙ্খলা বা অসংগতি বৃদ্ধি পায়। পরমতসহিষ্ণুতা ও সহনশীলতার অভাবে পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি, দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ প্রভৃতি অনাচারের ফলে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় হয়। বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর চরিত্রের অন্যতম ভূষণ ছিল ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘সহনশীলতা অপেক্ষা অধিক উত্তম ও অত্যধিক কল্যাণকর বস্তু আর কিছুই কাউকে দান করা হয়নি।’ (বুখারি)
রমজান মাসে আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের কঠোর ত্যাগ, উদারতা, সততা, ধৈর্য ও সহনশীলতা প্রদর্শনের নির্দেশ দিয়েছেন। এ মাসটি ধৈর্য অবলম্বনের মাস। ধৈর্যধারণের বিনিময়ে নির্ধারিত রয়েছে অতুলনীয় শান্তির আবাস বেহেশত। তাই এ মাসটির পরিচয় তুলে ধরে ধৈর্য ও সবরের গুরুত্ব প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘এটা ধৈর্যের মাস, আর সবরের বিনিময় হচ্ছে জান্নাত।’ (মিশকাত) মাহে রমজানে কঠোরভাবে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে ধৈর্য ও সহনশীলতার যে মানবিক গুণটি অর্জিত হয়, তা শুধু ব্যক্তি পর্যায়ের গুণই নয় বরং এ মহৎ গুণটি কারও মধ্যে সৃষ্টি হলে ঈমানদারের সমষ্টিগত জীবনে অপরের জন্য তা উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে, মানুষকে কঠিন ও দুর্গম পথ পরিক্রমায় চলতে শক্তি জোগায়। রোজা পালনের মাধ্যমে অর্জিত ধৈর্য ও সহনশীলতা ঈমান ও তার ন্যায্য দাবি প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম সাধনায় প্রচুর নিয়ামক শক্তি সঞ্চার করে। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে অর্জিত সহনশীলতা তাই শুধু ব্যক্তিগত কল্যাণই বয়ে আনে না বরং মুসলমান সমাজের জন্য একটি দলগত কল্যাণ বয়ে আনে। এ মর্মে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘অবশ্যই ধৈর্যশীলদের তাদের (ধৈর্যের) প্রতিদান পরিপূর্ণভাবে প্রদান করা হবে।’ (সূরা আল-জুুমার, আয়াত-১০)
নবী করিম (সা.) নিজেকে ইসলামি নীতিবোধ অনুযায়ী পরিচালনা করেছেন এবং সাহাবীগণ সে অনুযায়ী নিজেদের চরিত্রকে গঠন করতে উপদেশ দিয়েছেন। ইসলামি রীতিনীতি ও নৈতিকতাবোধ জীবনে বাস্তবায়ন করলে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল খুশি হন এবং ইহকাল ও পরকালে চরম সুখ ও পরম শান্তি লাভ করা যায়। দেশ ও জাতির সার্বিক কল্যাণের জন্য জাতীয় জীবন থেকে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় দূর করার উদ্যোগ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। সমাজের সর্বস্তর থেকে সর্বপ্রকার দুর্নীতির অবসান ঘটাতে হবে। দুর্নীতিবাজদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। মানুষকে জান-মাল ও জীবিকার পূর্ণ নিরাপত্তা দিতে হবে। সামাজিক মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতাসম্পন্ন সুদক্ষ প্রশাসন গড়ে তুলতে গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে এবং জনগণের মধ্যে দেশপ্রেম-দেশাত্মবোধ জাগ্রত করতে হবে। সুতরাং আজকের সমাজও যদি ইসলামের সর্বজনীনতাকে মেনে নিয়ে ইসলামি বিধি-বিধান ও অনুশাসনকে রোজাদারদের জীবন ও সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে, তবেই সমাজ থেকে যাবতীয় অনৈতিকতা দূর হবে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমি, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়। পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব হজরত মুহাম্মদ (সা.)।
No comments