সবার আগে এনবিআরকে ডিজিটাল করুন by জাকারিয়া স্বপন

দেড় বছরের বেশি সময় এই সরকার ক্ষমতায়। এই পুরো সময়টাজুড়ে তারা ডিজিটাল বাংলাদেশ ব্যানারের অধীনে যা করেছে, সবই বিক্ষিপ্ত। একটি লক্ষ্য নিয়ে সুন্দর পরিকল্পনা করে কাজগুলো এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তা মোটেই মনে হয় না। তারা স্কুলে কম্পিউটার দিচ্ছে, ওয়েবসাইট বানাচ্ছে, টেন্ডার অটোমেট করছে, ভিডিও কনফারেন্স করছে, আবার অন্যদিকে ফেসবুক বা ইউটিউব বন্ধ করে দিচ্ছে, দেশীয় টেলিফোন কোম্পানি বন্ধ করে দিচ্ছে, ডিজিটাল বাজেটের মতো হাস্যকর জিনিসও জাতিকে উপহার দিচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রেই কৌতুকে পরিণত হয়েছে। সরকারে যাঁরা ডিজিটাল বাংলাদেশ বলে রাজনৈতিক স্লোগান দিচ্ছেন, তাঁরা আসলেই জানেন না, ঠিক কী করতে হবে। তাঁরা কোনোভাবে শব্দটা প্রচলন করে দিয়েছেন। কিন্তু তারপর ঠিক কী করতে হবে, সেই জায়গাটির পুরোটাই অস্পষ্টতায় ভরা। সেটা তাঁদের কার্যক্রম দেখলেই বোঝা যাচ্ছে। আমার এই লেখার উদ্দেশ্য সরকারের সমালোচনা করা নয়। তাদের উদ্দেশ্য যে ভালো, সেটা নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। তবে আগামী দিনগুলোতে ঠিক কোন জিনিসগুলো করলে সেই উদ্দেশ্য সফল হতে পারে, তা বুঝে দেখাই উদ্দেশ্য।
বিভিন্ন জায়গায় কম্পিউটার বিতরণ রুটিন কাজের আওতায়ই পড়ে। সেটা নিয়ে ঘটা করে বলার কিছু নেই। সরকার যেহেতু এই রুটিন কাজের বাইরে আরও কিছু করতে চাইছে, তাহলে তাকে আরেকটু ঠান্ডা মাথায় কিছু জিনিস ঠিক করে নিয়ে সামনে এগোতে হবে। সবকিছুতে হাত দিয়ে কোনোটাই ঠিকভাবে করতে না পারলে অর্ধেক সেতু বানিয়ে কোনো লাভ নেই। ওটা দিয়ে গাড়ি বা মানুষ কোনোটাই যাতায়াত করতে পারে না। আগামী তিন বছরের জন্য তিনটি প্রধান কাজ করে যাওয়া দরকার। এগুলো হবে ডিজিটাল বাংলাদেশের ভিত্তি। এর মধ্যে প্রথম কাজ হলো এনবিআরসহ দেশের করব্যবস্থাকে পুরোপুরি কম্পিউটারাইজ করা।
এক লাইনে কথাটি খুব ছোট কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
১. বাংলাদেশের কতজন লোক ঠিকঠাক কর দেন তা এক বিরাট রহস্য। ১০ লাখের মতো লোকের টিন (ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর) আছে। আবার একই লোকের একাধিক টিন আছে। ঘুষ দিয়ে একটা টিন বের করা যে কত সহজ, সেটা বোধ করি এনবিআরের চেয়ারম্যান সাহেব এবং স্বয়ং অর্থমন্ত্রীও জানেন। এটা কোনো পদ্ধতি হতে পারে না। যদি ১৬ কোটি দেশের মানুষের ভেতর ১০ লাখ লোক ট্যাক্স দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন, তাহলে সেটাই আমরা মেনে নেব। কিন্তু সংখ্যাটি যা-ই হোক, সেটা নির্ভুল করব। এখানে সমঝোতা করলে চলবে না।
২. সরকার কর দেওয়ার যে নিয়ম বেঁধে দিয়েছে, তার আওতায় পড়ার পরও যাঁরা টিন নম্বর নেননি, তাঁদের একটি দিন-তারিখ বেঁধে দিন। এরপর যদি আবিষ্কার হয় যে তাঁরা তা দেননি, তাহলে সেটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ইন্টারনেটে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে তাঁদের আবেদন করতে বলুন। ঘরে বসেই তাঁরা তাঁদের আবেদন করতে পারবেন। এনবিআরের কর্মকর্তারা সেটা পরীক্ষা করে তাঁকে টিন নম্বরের চিঠি পাঠিয়ে দেবেন। এটা নিশ্চিত করতে পারলে একটা সঠিক সংখ্যায় উপনীত হওয়া যাবে। তবে প্রথম বছরেই সব হবে না। পদ্ধতিটি এ বছরই শুরু করতে হবে।
৩. প্রত্যেক ব্যক্তির পাশাপাশি প্রতিটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকেও এর আওতায় আসতে হবে।
৪. যেকোনো ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলা এবং পরিচালনা করতে হলে তার একটি আইডি লাগবে। সেটা হতে পারে এই টিন নম্বর। আর যদি হয় সেটা ‘জাতীয় পরিচয়পত্র’, তাহলে টিন নম্বর খোলার সময় এই জাতীয় পরিচয় নম্বরটিও রাখতে হবে। সোজা কথা হলো, টিন নম্বর, জাতীয় পরিচয়পত্র এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সঙ্গে একটি প্রত্যক্ষ যোগাযোগ থাকতে হবে। জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়া কারও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকলে সেটাকে ফ্রিজ করা যেতে পারে। আর ব্যাংকগুলোকেও সেটা মেনে চলতে হবে।
৫. পাঁচ লাখ টাকার ওপর কোনো লেনদেন হলেই ব্যাংক সেটা এনবিআরকে জানাতে বাধ্য থাকবে। ব্যাংকগুলোর কম্পিউটার সিস্টেম থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেটা এনবিআরে চলে যাবে। এনবিআরের কম্পিউটার সিস্টেম সেভাবেই উন্নত করতে হবে।
৬. ইন্টারনেটের মাধ্যমে ঘরে বসেই ট্যাক্স ফাইল করা যাবে। যাঁরা কাগজের মাধ্যমে ট্যাক্স ফাইল করবেন, সেগুলো এনবিআর অফিসে ডেটা এন্ট্রির মাধ্যমে কম্পিউটারে ঢুকিয়ে ফেলতে হবে। মোট কথা, পুরো সিস্টেমটাই হবে আগাগোড়া কম্পিউটার দ্বারা পরিচালিত।
৭. রাষ্ট্রের যতগুলো জায়গায় কাস্টমস অফিস আছে সেগুলো এবং ভ্যাটের কাঠামো এই নেটওয়ার্কের আওতায় থাকবে। আমদানি-রপ্তানির প্রতিটি তথ্য এখানে লিপিবদ্ধ থাকবে।
৮. দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ এখন টেলিফোন সেবার আওতায় রয়েছে। দেশের সবচেয়ে সুন্দর ডিজিটাল সিস্টেম হলো এই টেলিকম কোম্পানিগুলো। তারা প্রতিটি পদে কম্পিউটার ব্যবহার করে থাকে। তারা সবকিছুই ভালো করে, কিন্তু একটি কাজ ঠিকমতো করে না। প্রত্যেক গ্রাহককে তাঁদের জাতীয় পরিচয় নম্বরটি এন্ট্রি করতে বলা হলেও তাঁরা সেটা করেন না। আবার কিছু ক্ষেত্রে করলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভুয়া এন্ট্রি দিয়ে থাকেন। ছবির কথা আর না-ই বা বললাম। এনবিআরের এই ডেটাবেইসের সঙ্গে টেলিফোন কোম্পানির গ্রাহকদের একটা যোগ থাকতে হবে। টেলিফোন কোম্পানিগুলো তাদের গ্রাহকদের সবকিছু ডেটাবেইসে রাখে। ওটার সঙ্গে এনবিআরের সিস্টেমের যোগাযোগ তৈরি করা খুব কঠিন কিছু নয়।
৯. এই পুরো সিস্টেম মনিটর করার জন্য সরকারের বিভিন্ন শাখাকে সুযোগ দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর, অর্থ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন বিভাগ সেই তথ্যভান্ডার থেকে প্রয়োজনমতো নিজের মতোই রিপোর্ট বের করে নিতে পারবে। এর জন্য কারও ওপর নির্ভর করতে হবে না। তবে সবার সব তথ্য জেনে ফেলার অধিকার দেওয়া ঠিক হবে না। আবার একজনের কাছে সব তথ্য থাকবে, সেটাও সঠিক নয়। এটা হলো চেক অ্যান্ড ব্যালান্স।
আগামী এক বছরে এই একটি কাজের অধীনে অনেক ছোট ছোট কাজ রয়েছে। এবং এই কাজগুলো মোটেও সহজ নয়। অন্তত স্কুলে কম্পিউটার বিতরণ কিংবা সভা-সমিতিতে গলা ফাটানোর চেয়ে অনেক কঠিন কাজ। এর জন্য সরকারের মেরুদণ্ড অনেক শক্ত হতে হবে। হাজারো বাধা বিভিন্ন দিক থেকে আসতে শুরু করবে। কিন্তু আমাদের কাউকে না কাউকে এই কঠিন কাজ করতে হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ যখন এই জিনিস করতে গেছে, তারাও বিভিন্ন বাধার মুখোমুখি পড়েছে; তবে কাজটি করেছে।
তবে সরকার যখনই এ ধরনের প্রকল্পের কথা ভাববে, তখনই তারা বিদেশি সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে বসে থাকে। বিদেশি উপদেষ্টারা এসে সেই টাকা লুটেপুটে খেয়ে চলে যান। নিজের দেশের সম্পদ দিয়েই যে এ কাজগুলো করা যায়, সেটা সরকার ভেবে দেখে না কিংবা সাহস করে না। এ কাজটি দেশীয় সম্পদ দিয়েই করা সম্ভব। সরকারের নিজের লোকবলে না কুলালে প্রাইভেট পার্টনারশিপের আওতায় খুব সহজেই এটা করা সম্ভব। এই সিস্টেমের ফলে সরকারের যে বাড়তি টাকা উপার্জন হবে, সেটার খুবই ক্ষুদ্র একটি অংশ প্রাইভেট সেক্টরের সঙ্গে শেয়ার করলেই এটা হয়ে যেতে পারে। প্রয়োজনে একাধিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এই পার্টনারশিপ হতে পারে। একেকটি প্রতিষ্ঠানকে একেকটি বিভাগীয় এলাকা কিংবা জোনে ভাগ করে দেওয়া যেতে পারে। ইচ্ছে থাকলে বাস্তবসম্মত কত উপায়ই না বের করা যায়।
ডিজিটাল বাংলাদেশের নামে নানা স্লোগানমুখী সস্তা কার্যক্রম বাদ দিয়ে পুরো বছরটিতে দেখুন এই একটি কাজ করতে পারেন কি না।
জাকারিয়া স্বপন: তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ।
zakariaswapan@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.