বাবাকে নিয়ে কিছু কথাবার্তা by শারমিন নাহার
কাল ছিল বাবা দিবস। যান্ত্রিক এই জীবনে বাবার কথা কি মনে পড়ে? বাবা কি সত্যিই কোনো মানে তৈরি করে মনে? সত্যিই কি এই দিনটিতে বাবার প্রতি শ্রদ্ধায় নত হয় মুখ?
কাল দিনটি ছিল যেকোনো সাধারণ দিনের মতোই একটি দিন। কিন্তু যখনই কোনো শিশুর হাত ধরে কোনো বাবাকে যেতে দেখেছি, তখনই মনে হয়েছে দিনটি ভরে গেল অন্য রকম আলোয়।
মা দিবস পালন করা শুরু হয় ১৯০৯ সালে। মায়ের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ দেখে অভিভূত হন অনেকেই। সোনোরা স্মার্ট ডড নামের একটি মেয়ে তখন বাবা দিবসের কথাও ভাবেন। ১৯১০ সালের ১৯ জুন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের স্পোকারে প্রথমবারের মতো পালিত হয় বাবা দিবস। কিন্তু সব শ্রেণীর মানুষ তখন দিনটিকে স্বীকার করে নিতে চায়নি। ১৯২৬ সালে নিউইয়র্কে ‘বাবা দিবস উদ্যাপন কমিটি’ গঠিত হয়। ১৯৫৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বাবা দিবস পালন শুরু হয় রাষ্ট্রীয়ভাবে। ১৯৭২ সালে এই দিনটিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের সিদ্ধান্ত নেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন।
এখন প্রতিবছর জুন মাসের তৃতীয় রোববার পালন করা হয় বাবা দিবস।
এ তো গেল ইতিহাস। ইতিহাস থেকে আমরা বরং একটু বাস্তবের দিকে তাকাই। কথা বলি এমন একটি মেয়ের সঙ্গে, যাঁর বাবা থাকেন ঢাকার বাইরে, গ্রামের বাড়িতে। ওঁর নাম সেঁজুতি। পড়েন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। তিনি বললেন, ‘আয় খুকু আয়’ গানটির মতো আর এমন করে বাবার ডাক শুনতে পাই না। বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি হলে বাড়িতে যাই যখন, তখনই কেবল বাবার সঙ্গে থাকা। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম বইটি তাঁর কাছ থেকেই পাওয়া। বাবার সঙ্গে আসলে পিতা-কন্যার সম্পর্ক নয় আমার। আমরা যেন দুই বন্ধু।’
এ রকম অনেক বাবা আছেন, যাঁরা স্কুল-কোচিং-গৃহশিক্ষক নিয়ে গলদঘর্ম হওয়া সন্তানকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকেন। ভাবেন, আহা! কেন ওদের জীবন এমন হলো? কেন ওরা শৈশবে উপভোগ করতে পারছে না শৈশব? শহরাঞ্চলে শিশুরা দ্রুত হারিয়ে ফেলছে শৈশব। পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করার প্রতিযোগিতায় যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে তাদের জীবন। বাবা-মা কষ্ট পান। কিন্তু সময় ও সাম্প্রতিক প্রবণতার কাছে অনেকেই হন পরাজিত।
আমরা নীপার কথা বলি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্রী নীপা বাবাকে হারিয়েছেন। বাবার স্মৃতিকে আগলে রেখেছেন তিনি। বাবার প্রতি ভালোবাসা অনুভব করেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধে বাবাকে হারানো এক শিশুর কথা বলা যায়। ও কোনো দিন বাবাকে দেখেনি। জন্মের পর থেকে একটি ছবি দেখিয়ে ওকে বলা হয়েছে, ‘ওটাই ওর বাবা।’ ও জানতেও পারেনি, বাবারা রক্তমাংসের মানুষ। ও জানত, বাবা মানে ছবি। একদিন পাড়ার এক পরিচিত পরিবারের সঙ্গে ও গেছে বিমানবন্দরে। শুনেছে, ওর বন্ধুর বাবা আসবে আজ। বিমানবন্দরে যাওয়ার পর ও দেখল, একজন রক্তমাংসের মানুষ এগিয়ে আসছেন। এসে জড়িয়ে ধরলেন পড়শির মেয়েটাকে। স্তব্ধ হয়ে গেল শিশুটি। তারপর বাড়ি এসে ছলছল চোখে ঝাঁপিয়ে পড়ল মায়ের কোলে। বলল, ‘মা, সবার বাবা মানুষের মতো, আমার বাবা কেন ছবির মতো?’
বাবাকে নিয়ে এ রকম অসংখ্য কাহিনি খুঁজে পাওয়া যাবে। সব কাহিনি বেদনা জাগাবে মনে, এমন নয়। আছে অনেক গর্বের কাহিনিও।
আমরা বরং এই ফাঁকে বাবাকে নিয়ে কিঞ্চিৎ সাহিত্যের জগৎ ঘুরে আসি। ‘একজন জ্ঞানী-বাবা তার সন্তানকে অবশ্যই জানে,’ বলেছেন শেকসিপয়ার। ইউরিপিডিস তো আরও এগিয়ে গিয়ে বলেছেন, ‘বিজ্ঞ পিতার সন্তান বিজ্ঞই হয়।’ আর কনফুসিয়াস বলছেন, ‘যে বাবা তাঁর সন্তানকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে সময়মতো অবহিত করেন না, সেই বাবাকে বৃদ্ধ বয়সে যদি তাঁর ছেলে অবহেলা করে, তবে তার দায়িত্ব নিতে হবে সেই বাবাকেই।’
বাবাকে নিয়ে একটা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয় ছেলেদের। শৈশবে বাবাকে মনে হয় সর্ব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। একটু বয়স হলেই মনে হয় বাবা কিছু বিষয়ে জানেন, কিছু বিষয়ে জানেন না। তারপর বয়স যখন আর একটু বাড়ে, তখন মনে হয়, বাবার ভাবনা-চিন্তা সবই সেকেলে। বয়স যখন ত্রিশের কোঠায়, তখন মনে হয়, বাবার সঙ্গে একটু আলাপ করে নিলে হতো, কিছু কিছু বিষয়ে তো বাবার মতামতের গুরুত্ব দেওয়া যেতে পারে। বয়স বাড়তে থাকলেই মনে হয়, বাবা যে কথাগুলো বলেছিলেন, সেগুলোর সত্যিই মূল্য আছে।
এ কথা দিয়ে কি বাবাকে পুরোটা পাওয়া যায়? কিংবা রবীন্দ্রনাথের ‘হৈমন্তী’ গল্পের বাবা ও মা-হারা মেয়ের সম্পর্ক কি তাতে উঠে আসে? বাবার প্রতি মেয়ের ভালোবাসার কি কোনো সীমানা মানে? অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, মেয়েরা বাবাকে পছন্দ করে বেশি। বাবার সুখ-দুঃখের দিকে থাকে তার নজর।
কোনো এক লেখায় একটি উদ্ধৃতি দেখেছিলাম। বলা হচ্ছে, বাবাকে আমি ভালোবাসি, কারণ বাবা মাকে ভালোবাসে।
ভালোবাসার বিষয়টিও বুঝে নিতে চাই। জর্জ হার্বার্ট বলেছেন, একজন বাবা শত শিক্ষকের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। রবার্ট ফ্রস্ট বলেছেন, ছেলের কাছে বাবা সব সময় রক্ষণশীল, আর মা? সব সময় গণতান্ত্রিক! কথাটা যে কত সত্যি, তা তো হরহামেশাই আমরা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু বিপরীত ছবিটিও দুর্লক্ষ্য নয়।
বাবার জন্য গোটা একটি দিনই যখন ঠিক করে রাখা হয়েছে, তখন বলতে ইচ্ছে করে, বাবা, একটিমাত্র দিন দিয়ে তোমাকে বেঁধে রাখা যায় না। তুমি আছ বছরজুড়ে, অস্তিত্বজুড়ে। যাঁরা মুখে কখনো বলেননি, ‘বাবা, তোমাকে ভালোবাসি’, তাঁরা অন্তত বাবার সামনে গিয়ে মনে মনেও বলুন শব্দগুলো। দেখবেন, ভালো লাগছে। মন ভালো হয়ে উঠছে।
কাল দিনটি ছিল যেকোনো সাধারণ দিনের মতোই একটি দিন। কিন্তু যখনই কোনো শিশুর হাত ধরে কোনো বাবাকে যেতে দেখেছি, তখনই মনে হয়েছে দিনটি ভরে গেল অন্য রকম আলোয়।
মা দিবস পালন করা শুরু হয় ১৯০৯ সালে। মায়ের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ দেখে অভিভূত হন অনেকেই। সোনোরা স্মার্ট ডড নামের একটি মেয়ে তখন বাবা দিবসের কথাও ভাবেন। ১৯১০ সালের ১৯ জুন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের স্পোকারে প্রথমবারের মতো পালিত হয় বাবা দিবস। কিন্তু সব শ্রেণীর মানুষ তখন দিনটিকে স্বীকার করে নিতে চায়নি। ১৯২৬ সালে নিউইয়র্কে ‘বাবা দিবস উদ্যাপন কমিটি’ গঠিত হয়। ১৯৫৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বাবা দিবস পালন শুরু হয় রাষ্ট্রীয়ভাবে। ১৯৭২ সালে এই দিনটিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের সিদ্ধান্ত নেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন।
এখন প্রতিবছর জুন মাসের তৃতীয় রোববার পালন করা হয় বাবা দিবস।
এ তো গেল ইতিহাস। ইতিহাস থেকে আমরা বরং একটু বাস্তবের দিকে তাকাই। কথা বলি এমন একটি মেয়ের সঙ্গে, যাঁর বাবা থাকেন ঢাকার বাইরে, গ্রামের বাড়িতে। ওঁর নাম সেঁজুতি। পড়েন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। তিনি বললেন, ‘আয় খুকু আয়’ গানটির মতো আর এমন করে বাবার ডাক শুনতে পাই না। বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি হলে বাড়িতে যাই যখন, তখনই কেবল বাবার সঙ্গে থাকা। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম বইটি তাঁর কাছ থেকেই পাওয়া। বাবার সঙ্গে আসলে পিতা-কন্যার সম্পর্ক নয় আমার। আমরা যেন দুই বন্ধু।’
এ রকম অনেক বাবা আছেন, যাঁরা স্কুল-কোচিং-গৃহশিক্ষক নিয়ে গলদঘর্ম হওয়া সন্তানকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকেন। ভাবেন, আহা! কেন ওদের জীবন এমন হলো? কেন ওরা শৈশবে উপভোগ করতে পারছে না শৈশব? শহরাঞ্চলে শিশুরা দ্রুত হারিয়ে ফেলছে শৈশব। পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করার প্রতিযোগিতায় যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে তাদের জীবন। বাবা-মা কষ্ট পান। কিন্তু সময় ও সাম্প্রতিক প্রবণতার কাছে অনেকেই হন পরাজিত।
আমরা নীপার কথা বলি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্রী নীপা বাবাকে হারিয়েছেন। বাবার স্মৃতিকে আগলে রেখেছেন তিনি। বাবার প্রতি ভালোবাসা অনুভব করেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধে বাবাকে হারানো এক শিশুর কথা বলা যায়। ও কোনো দিন বাবাকে দেখেনি। জন্মের পর থেকে একটি ছবি দেখিয়ে ওকে বলা হয়েছে, ‘ওটাই ওর বাবা।’ ও জানতেও পারেনি, বাবারা রক্তমাংসের মানুষ। ও জানত, বাবা মানে ছবি। একদিন পাড়ার এক পরিচিত পরিবারের সঙ্গে ও গেছে বিমানবন্দরে। শুনেছে, ওর বন্ধুর বাবা আসবে আজ। বিমানবন্দরে যাওয়ার পর ও দেখল, একজন রক্তমাংসের মানুষ এগিয়ে আসছেন। এসে জড়িয়ে ধরলেন পড়শির মেয়েটাকে। স্তব্ধ হয়ে গেল শিশুটি। তারপর বাড়ি এসে ছলছল চোখে ঝাঁপিয়ে পড়ল মায়ের কোলে। বলল, ‘মা, সবার বাবা মানুষের মতো, আমার বাবা কেন ছবির মতো?’
বাবাকে নিয়ে এ রকম অসংখ্য কাহিনি খুঁজে পাওয়া যাবে। সব কাহিনি বেদনা জাগাবে মনে, এমন নয়। আছে অনেক গর্বের কাহিনিও।
আমরা বরং এই ফাঁকে বাবাকে নিয়ে কিঞ্চিৎ সাহিত্যের জগৎ ঘুরে আসি। ‘একজন জ্ঞানী-বাবা তার সন্তানকে অবশ্যই জানে,’ বলেছেন শেকসিপয়ার। ইউরিপিডিস তো আরও এগিয়ে গিয়ে বলেছেন, ‘বিজ্ঞ পিতার সন্তান বিজ্ঞই হয়।’ আর কনফুসিয়াস বলছেন, ‘যে বাবা তাঁর সন্তানকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে সময়মতো অবহিত করেন না, সেই বাবাকে বৃদ্ধ বয়সে যদি তাঁর ছেলে অবহেলা করে, তবে তার দায়িত্ব নিতে হবে সেই বাবাকেই।’
বাবাকে নিয়ে একটা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয় ছেলেদের। শৈশবে বাবাকে মনে হয় সর্ব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। একটু বয়স হলেই মনে হয় বাবা কিছু বিষয়ে জানেন, কিছু বিষয়ে জানেন না। তারপর বয়স যখন আর একটু বাড়ে, তখন মনে হয়, বাবার ভাবনা-চিন্তা সবই সেকেলে। বয়স যখন ত্রিশের কোঠায়, তখন মনে হয়, বাবার সঙ্গে একটু আলাপ করে নিলে হতো, কিছু কিছু বিষয়ে তো বাবার মতামতের গুরুত্ব দেওয়া যেতে পারে। বয়স বাড়তে থাকলেই মনে হয়, বাবা যে কথাগুলো বলেছিলেন, সেগুলোর সত্যিই মূল্য আছে।
এ কথা দিয়ে কি বাবাকে পুরোটা পাওয়া যায়? কিংবা রবীন্দ্রনাথের ‘হৈমন্তী’ গল্পের বাবা ও মা-হারা মেয়ের সম্পর্ক কি তাতে উঠে আসে? বাবার প্রতি মেয়ের ভালোবাসার কি কোনো সীমানা মানে? অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, মেয়েরা বাবাকে পছন্দ করে বেশি। বাবার সুখ-দুঃখের দিকে থাকে তার নজর।
কোনো এক লেখায় একটি উদ্ধৃতি দেখেছিলাম। বলা হচ্ছে, বাবাকে আমি ভালোবাসি, কারণ বাবা মাকে ভালোবাসে।
ভালোবাসার বিষয়টিও বুঝে নিতে চাই। জর্জ হার্বার্ট বলেছেন, একজন বাবা শত শিক্ষকের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। রবার্ট ফ্রস্ট বলেছেন, ছেলের কাছে বাবা সব সময় রক্ষণশীল, আর মা? সব সময় গণতান্ত্রিক! কথাটা যে কত সত্যি, তা তো হরহামেশাই আমরা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু বিপরীত ছবিটিও দুর্লক্ষ্য নয়।
বাবার জন্য গোটা একটি দিনই যখন ঠিক করে রাখা হয়েছে, তখন বলতে ইচ্ছে করে, বাবা, একটিমাত্র দিন দিয়ে তোমাকে বেঁধে রাখা যায় না। তুমি আছ বছরজুড়ে, অস্তিত্বজুড়ে। যাঁরা মুখে কখনো বলেননি, ‘বাবা, তোমাকে ভালোবাসি’, তাঁরা অন্তত বাবার সামনে গিয়ে মনে মনেও বলুন শব্দগুলো। দেখবেন, ভালো লাগছে। মন ভালো হয়ে উঠছে।
No comments