শেরাটনীয় বাজেট বিতর্কের আড়ালে by মিজানুর রহমান খান
আপনারা আমাদের অর্থমন্ত্রীদের হাতে কালো একটা ব্রিফকেস দেখেন। ১০ জুনেও দেখেছেন। এই কালো ব্রিফকেসের একটি গল্প আছে। গল্প নয় ইতিহাস।
ব্রিফকেস বহনের ইতিহাস দেড় শ বছরের পুরোনো। এর রং লাল। ১৮৬৮ সালে ব্রিটেনের এক অর্থমন্ত্রী একবার বাজেট ভাষণ দিতে হাউস অব কমন্সে এলেন। হঠাৎ হুঁশ হলো, তিনি তাঁর লাল ব্রিফকেসটি ভুলে বাসায় ফেলে রেখে এসেছেন। এরপর রেওয়াজ হলো, অর্থমন্ত্রীরা যেদিন বাজেট ভাষণ দেবেন, সেদিন তাঁর হাতে দর্শনীয়ভাবে ব্রিফকেস থাকবে। তিনি জনগণকে সেটা দেখাতে দেখাতে আসবেন। তো এই ব্রিফকেস বয়ে আনাটা এখন একটি সংসদীয় সংস্কৃতি।
সংসদীয় গণতন্ত্রের চালিকাশক্তি কী? অর্ধেক সংস্কৃতি বা প্রথা, বাকি অর্ধেক আইন ও সংবিধান। এর মধ্যে আবার সংস্কৃতির জোরটা বেশি। সংস্কৃতি থাকলে গণতন্ত্র চলে। কিন্তু সংস্কৃতি থাকবে না, শুধু সংবিধান থাকবে, তাহলে গণতন্ত্র চলবে না। এর অন্যতম দৃষ্টান্ত বাংলাদেশ। ব্রিটেনের সংবিধান নেই, প্রথা বা সংস্কৃতি আছে। তাই গণতন্ত্র চলছে। আমাদের সংবিধান আছে, সংস্কৃতি নেই। তাই গণতন্ত্র চলে না।
গরিবমারা বাজেট বা গণমুখী বাজেট—এতেই আমরা ঘুরপাক খাই। সেদিক থেকে বেগম খালেদা জিয়া একটা আড়ম্বরপূর্ণ অভিনন্দন পেতে পারেন। তিনি বাজেট দেননি। বাজেট প্রস্তাব দিয়েছেন।
সংসদে প্রাজ্ঞ সাংসদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বক্তব্যকে আমরা দুইভাবে দেখতে পারি। শপথ ভঙ্গ, সংসদ ও সংবিধানের অবমাননার অভিযোগ এনেছেন তিনি। তাঁর কাছে যদি তথ্য থাকে, বিরোধীদলীয় নেতা শুধু সংসদকে খাটো করতেই একটি বিকল্প বাজেট প্রস্তাব করেছেন, তাহলে তাঁর অভিযোগের একটা গ্রাহ্য দিক যাচাইযোগ্য। তবে এর ভিন্ন দিকটিতে এবার দৃষ্টি দিতে চাই। ১৯৯০ সালের পর সব বিরোধী দল সম্পর্কেই এ অভিযোগ আনা যায়। মাত্রাগত তফাত থাকতে পারে। প্রত্যেকটি বিরোধী দল শপথ ভঙ্গ করেছে। সংসদ ও সংবিধানকে অবমাননা করেছে। এই ধারা অব্যাহত আছে এবং ভবিষ্যতে যাতে এটা আটকানো যায়, তেমন কোনো চেষ্টা আমরা দেখি না। আওয়ামী লীগের অনেক সাংসদ চাইছেন খালেদা জিয়ার শেরাটনীয় বাজেটের বিষয়ে স্পিকারের একটি রুলিং। এই প্রস্তাবের প্রতি আমার সমর্থন রয়েছে। কিন্তু আমার সন্দেহ, এটা স্পিকার দেবেন কি না। কারণ, কান টানলে মাথা আসবে। বিরোধী দলের ভূমিকাটা এসে যাবে। সেই ভূমিকাটা কী, কোথাও লেখা আছে কি না। লেখা থাকে না। এটাও ওই সংস্কৃতি।
হাউস অব কমন্সে বাজেট ভাষণ শেষ করেন অর্থমন্ত্রী। ছায়া অর্থমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া দেখানোই সংগত। কিন্তু এদিন তিনি চুপ থাকেন। প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন বিরোধী দলের নেতা। বাজেট পেশের পরদিন মুখ খোলেন ছায়া অর্থমন্ত্রী। এটাই রেওয়াজ। এর মানে হলো, ছায়া প্রধানমন্ত্রী সাধারণভাবে দেশের অর্থনীতি সম্পর্কে একটি মতামত তুলে ধরবেন। আর ছায়া অর্থমন্ত্রী বলবেন ভেবেচিন্তে। তিনি পুরো এক দিন সময় নিয়ে পর্যালোচনা করবেন। আর তার পরই তাঁর সুচিন্তিত অভিমত ব্যাখ্যা করবেন। আমাদের বিরোধী দল কবে কোন বিষয়ে সুচিন্তিত মত দিয়েছে? বাজেট, প্রতিরক্ষা, বিচার বিভাগ কিংবা পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে বিরোধী দলে থেকে এতগুলো পৃষ্ঠা লিখে ভরে ফেলেছে, তার তেমন নজির আগে কোনো বিরোধী দল দেখাতে পারবে বলে মনে হয় না। তাই এ অর্জনকে আমরা খাটো করে দেখতে চাই না। সরকারের উদ্দেশে মুদ্রিত বিরোধী দলের এই পুস্তিকাটি ৩২ পৃষ্ঠার। এটি হতে পারে আমাদের রাজনীতির ইতিহাসের প্রথম প্রামাণ্য সহযোগিতার দলিল। সুতরাং, সংসদে যে যা-ই বলুক, প্রধানমন্ত্রীর ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সুখকর।
বেগম খালেদা জিয়ার বাজেট প্রস্তাবে সন্তুষ্ট হওয়ার অনেক কারণ রয়েছে। আমাদের বিরোধী দল বা রাজনৈতিক দলগুলো মেঠো বক্তৃতায় পারদর্শী। লিখে, গুছিয়ে, রেকর্ড রেখে মনের ভাব প্রকাশে তাদের অতিশয় অনীহা। সেদিক থেকে শেরাটনীয় বাজেট একটা বিরাট বিষয়।
তবে প্রশ্ন হলো, শেরাটন থেকে শেরেবাংলা নগর কত দূর? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, স্টান্টবাজি না হলে ভালো। হলেও ক্ষতি আছে বলে মনে হয় না। বাজেট শব্দ পরিহার করাও যেত। যদি ‘উন্নয়ন’ প্রস্তাবনা বলা হতো, তাহলে হয়তো বিতর্কের কোনো সুযোগ হতো না। শপথ, সংসদ, সংবিধান বেঁচে যেত! আহা একটি শব্দ আমাদের রাজনীতিতে কী করতে পারে?
সংসদীয় গণতন্ত্র অনুশীলনরত ব্রিটেন বা অন্যান্য দেশ অবশ্য ছায়া বাজেট দেয় না। ব্রিটেনের অনুসরণে বেগম খালেদা জিয়ার প্রস্তাবকে নিছক একটি অসংসদীয় উপস্থাপনা হিসেবেও দেখা চলে। প্রতিবছর বাজেট পেশের আগে ব্রিটিশ অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাজ বাড়ে। সমাজের বিভিন্ন স্তর ও সংগঠন বিভিন্ন ধরনের প্রস্তাব দেয়। এর মধ্যে সাংসদেরাও থাকেন। এর সংখ্যা কম নয়। পাঁচ থেকে ১০ হাজার তো হবেই। বিএনপি শেরাটনীয় বাজেটের আয়োজক। বিরোধী দলের নেতা পরিচয়ে খালেদা জিয়া সেটা দেননি। দেখলাম, ওই পুস্তিকায় আছে, শুধু দেশনেত্রীর তকমা।
বাজেট নিয়ে বিএনপি যা করেছে, তা সরকারও তাদের কাছে চাইতে পারত। অবশ্য চাইলে তারা দিত কি না, সন্দেহ। এটাই আমাদের সংস্কৃতি। বাজেট একবার সংসদে তুলে দিলে তাতে কিন্তু বড় পরিবর্তন আনা সহজ নয়। ‘লেজিসলেটিভ ওভারসাইট অ্যান্ড বাজেটিং: এ ওয়ার্ল্ড পারসপেকটিভ’ নামে বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত একটি বই আছে। অনেক গবেষণা ও সমীক্ষা রয়েছে। এতে সারা বিশ্বের সংসদের একটা অভিন্ন প্রবণতা দেখলাম। সরকার যা বাজেটে প্রস্তাব করে, তাই পাস করে। ৪১টি দেশের মধ্যে জরিপ চালানো হয়। এর ৩৪ শতাংশ দেশের সংসদে অর্থমন্ত্রী যেভাবে বাজেট পেশ করেন, তাই পাস হয়। মার্কিন কংগ্রেস অনেক ক্ষমতা রাখে। নতুন করে বাজেট তৈরি করে নিতে পারে। কিন্তু কখনো তারা তা করেনি বা দরকার পড়েনি। ওই ৪১টি দেশের মধ্যে ৬৩ শতাংশ দেশের সংসদ একটু পরিবর্তন নিশ্চিত করে। কিন্তু সে পরিবর্তন অকিঞ্চিৎকর। প্রস্তাবিত ব্যয়ের তিন শতাংশের বেশি হেরফের ঘটে না। সে কারণে গোটা বিশ্বের সংসদ একটি নতুন প্রবণতার দিকে ছুটে যাচ্ছে। সেটা হলো, বাজেটের বেশ আগেই সংসদে একটা ছায়ার মতো প্রতিবেদন দেওয়া। এতে প্রকাশ করা হয়, আসন্ন নতুন বাজেটটি সরকার কীভাবে বানাবে।
এ ধারণাটি আমাদের দেশে ঢোকেনি। তবে বর্তমান সরকার একটি ভালো কাজ করেছে। তারা বাজেট বাস্তবায়ন প্রতিবেদন-ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে। এ পর্যন্ত আমরা দুটি পেলাম। গত ফেব্রুয়ারিতে সংসদে ছয় মাসের প্রথম রিপোর্ট দেন অর্থমন্ত্রী। জুনের গোড়ায় পাওয়া গেল দ্বিতীয়টি। এর বিষয়বস্তু শুধু ২০০৯-২০১০ অর্থবছরের বাজেটের অর্জনের মধ্যে সীমিত থেকেছে। এখন আমরা এর সম্প্রসারণ ঘটাতে পারি।
ব্রিটেনের বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন ১৯৯৭ সালে প্রথম প্রি-বাজেট স্টেটমেন্ট বা পিবিআর চালু করেন। প্রতি হেমন্তে সরকার এই প্রাক-বাজেট রিপোর্ট দিয়ে আসছে। এই যে হেমন্তকে বেছে নেওয়া হলো, এটাই হয়তো ভবিষ্যতে চলতে থাকবে। এটাই সংস্কৃতি, আইন নয়। কিন্তু আইনের চেয়ে বেশি।
এতে বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটের অর্জন ও বাস্তবায়নের বিবরণ থাকে। আর থাকে আগামী অর্থবছরের বাজেটের নীতি কী হবে, সে বিষয়ে নির্দেশনা। হাতে রাখা হয় চার মাস। নতুন বছরের বাজেটে কী থাকবে সে সম্পর্কে সরকারের নীতি ঘোষিত হয়। এর ওপর চিন্তাভাবনা ও সুপারিশের জন্য সময় দরকার। বিরোধী দল ও অন্যান্য আগ্রহী মহল সে জন্য সময় ভালোই পায়। সেখানে সবশেষ প্রাক-বাজেট প্রতিবেদন পেশ করা হলো ৯ ডিসেম্বর ২০০৯। আর বাজেট পেশ করা হয় ১৪ মার্চ ২০১০।
বিশ্বব্যাংক প্রাক-বাজেট প্রতিবেদন নিয়ে বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালসহ ৩৬টি দেশের ওপর সমীক্ষা চালিয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১৮টি দেশের সরকার নতুন বাজেট দেওয়ার চার মাস আগে সংসদে প্রাক-বাজেট প্রতিবেদন দেয়। তবে এখানে দেখার বিষয় হলো, আমাদের মতো নিম্ন আয়ের দেশগুলোর সংসদই এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে। তবুও নিম্ন আয়ের ২১ ভাগ দেশের সংসদ চার মাস আগে প্রাক-বাজেট প্রতিবেদন দিয়ে থাকে। বাংলাদেশের ঠাঁই এই একুশে হলো না। এটা যাতে চালু হয় সে রকম তাড়না কারও মধ্যে দেখি না। বরং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিসংক্রান্ত এ রকম আরও বহু দরকারি ক্ষেত্রে আমরা তাদের মধ্যে সমঝোতা দেখি।
ছায়া সরকারের কোনো ধারণা নিয়ে আমাদের বিরোধী দল চলে না। তারা মনে করে, সংসদ হলো সরকারের। সংসদ যে রাষ্ট্রের সেটা তারা বিশ্বাস করে না। আমাদের দুঃখ এই, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বিচক্ষণ হয়েও শুধু বাজেট প্রশ্নে বিরোধীদলীয় নেতার শপথ ভঙ্গ, সংসদ ও সংবিধানের অবমাননা দেখলেন। খালেদা জিয়া যে এই যে কদিন আগে সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনে গিয়ে বললেন, সরকারকে আর সময় দেওয়া যায় না, সেটা তো শেরাটনীয় বাজেটের চেয়ে মারাত্মক। কেন তিনি সরকার পতনের আন্দোলন করবেন? কেন তিনি সেটা সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে বলবেন? তাঁর ওই সভা ছিল উচ্চ আদালতের রায়ের পরিপন্থী। আওয়ামী লীগ কতটা সংসদ ও সংবিধান-পাগল দল, সেটা বোঝা যাবে। পারলে এ জন্য সংসদে একটি নিন্দা প্রস্তাব আনা হোক।
শেরাটনীয় বাজেট বিতণ্ডাকে আমাদের সামগ্রিকভাবে বিবেচনায় নিতে হবে। সংসদ নিয়ে অসত্য উক্তি করা হয় হরহামেশা। যেমন বলা হয়, সংসদ সার্বভৌম। অথচ সাংবিধানিকভাবে সাংসদেরা অধীনস্থ। তাঁরা ভোটে নির্বাচিত হন। তাঁরা নিজেরা ভোটে স্বাধীন নন। ৭০ অনুচ্ছেদের নিম্নচাপে তাঁদের বাক্স্বাধীনতা অচল হয়ে পড়েছে।
আমাদের বুঝতে হবে, বিরোধী দল কেন সংসদ রেখে শেরাটনে যায়। আর সরকারি দল কেন বলে, এর ফলেই সংবিধান লঙ্ঘিত হয়েছে। আসলে তারা একটি কৃত্রিম, শূন্যগর্ভ তর্কের দিকে জনগণের দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে চায়। বিশ্বব্যাংকের ওই বইটিতে লেখা আছে, বাজেট কেমন ও কতটা স্বচ্ছ হবে, তা প্রধানত নির্ভর করে সংসদের বিশ্লেষণ করার সামর্থ্যের ওপর। আমাদের স্বল্পসংখ্যক সাংসদের সামর্থ্যের সুনাম সুবিদিত।
কখনো মনে হয়, আরেকটি গণতান্ত্রিক রূপান্তরকরণ প্রয়াসের সুযোগ আবারও মাঠে মারা যাবে না তো? কারণ, ভয় পাচ্ছি। জিনিসপত্রের দাম, বিদ্যুৎ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো থাকা গণতান্ত্রিক শাসনের চাওয়া। এটাই সব নয়। কিন্তু হরতাল সফল করতে এর ব্যবহার কার্যকর। সরকারি দল প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে আন্তরিক, এমন কোনো সাড়াশব্দ পাই না। বিরোধী দলের ছায়া বাজেটকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখা যাবে না। নিঃশর্তে একে অভিনন্দন জানানোর দরজা তারাই রুদ্ধ করে রেখেছে। রাজনীতির পরিবেশকে অনবরত তারা দূষিত করছে। দায় উভয়ের আছে। সংসদের পরিবেশ ও বিরোধী দলের প্রতি আচরণ প্রসঙ্গে উদ্বিগ্ন বেগম জিয়া। তবে কবে কখন কোন বিরোধী দলের কাছে সংসদের পরিবেশ ভালো লেগেছিল, তা আমাদের জানা নেই। সংসদ থেকে দলের পৃথক্করণ লাগবে। লাগবে সংসদের স্বাধীনতা। এটা এলে সংসদীয় বাজেট প্রাণ পাবে। শেরাটনীয় বাজেট কিংবা ‘আরেকটা ধাক্কা মেরে সরকার ফেলার’ রাজনীতি থেকে বাঁচার এটাই উল্লেখযোগ্য উপায়।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
ব্রিফকেস বহনের ইতিহাস দেড় শ বছরের পুরোনো। এর রং লাল। ১৮৬৮ সালে ব্রিটেনের এক অর্থমন্ত্রী একবার বাজেট ভাষণ দিতে হাউস অব কমন্সে এলেন। হঠাৎ হুঁশ হলো, তিনি তাঁর লাল ব্রিফকেসটি ভুলে বাসায় ফেলে রেখে এসেছেন। এরপর রেওয়াজ হলো, অর্থমন্ত্রীরা যেদিন বাজেট ভাষণ দেবেন, সেদিন তাঁর হাতে দর্শনীয়ভাবে ব্রিফকেস থাকবে। তিনি জনগণকে সেটা দেখাতে দেখাতে আসবেন। তো এই ব্রিফকেস বয়ে আনাটা এখন একটি সংসদীয় সংস্কৃতি।
সংসদীয় গণতন্ত্রের চালিকাশক্তি কী? অর্ধেক সংস্কৃতি বা প্রথা, বাকি অর্ধেক আইন ও সংবিধান। এর মধ্যে আবার সংস্কৃতির জোরটা বেশি। সংস্কৃতি থাকলে গণতন্ত্র চলে। কিন্তু সংস্কৃতি থাকবে না, শুধু সংবিধান থাকবে, তাহলে গণতন্ত্র চলবে না। এর অন্যতম দৃষ্টান্ত বাংলাদেশ। ব্রিটেনের সংবিধান নেই, প্রথা বা সংস্কৃতি আছে। তাই গণতন্ত্র চলছে। আমাদের সংবিধান আছে, সংস্কৃতি নেই। তাই গণতন্ত্র চলে না।
গরিবমারা বাজেট বা গণমুখী বাজেট—এতেই আমরা ঘুরপাক খাই। সেদিক থেকে বেগম খালেদা জিয়া একটা আড়ম্বরপূর্ণ অভিনন্দন পেতে পারেন। তিনি বাজেট দেননি। বাজেট প্রস্তাব দিয়েছেন।
সংসদে প্রাজ্ঞ সাংসদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বক্তব্যকে আমরা দুইভাবে দেখতে পারি। শপথ ভঙ্গ, সংসদ ও সংবিধানের অবমাননার অভিযোগ এনেছেন তিনি। তাঁর কাছে যদি তথ্য থাকে, বিরোধীদলীয় নেতা শুধু সংসদকে খাটো করতেই একটি বিকল্প বাজেট প্রস্তাব করেছেন, তাহলে তাঁর অভিযোগের একটা গ্রাহ্য দিক যাচাইযোগ্য। তবে এর ভিন্ন দিকটিতে এবার দৃষ্টি দিতে চাই। ১৯৯০ সালের পর সব বিরোধী দল সম্পর্কেই এ অভিযোগ আনা যায়। মাত্রাগত তফাত থাকতে পারে। প্রত্যেকটি বিরোধী দল শপথ ভঙ্গ করেছে। সংসদ ও সংবিধানকে অবমাননা করেছে। এই ধারা অব্যাহত আছে এবং ভবিষ্যতে যাতে এটা আটকানো যায়, তেমন কোনো চেষ্টা আমরা দেখি না। আওয়ামী লীগের অনেক সাংসদ চাইছেন খালেদা জিয়ার শেরাটনীয় বাজেটের বিষয়ে স্পিকারের একটি রুলিং। এই প্রস্তাবের প্রতি আমার সমর্থন রয়েছে। কিন্তু আমার সন্দেহ, এটা স্পিকার দেবেন কি না। কারণ, কান টানলে মাথা আসবে। বিরোধী দলের ভূমিকাটা এসে যাবে। সেই ভূমিকাটা কী, কোথাও লেখা আছে কি না। লেখা থাকে না। এটাও ওই সংস্কৃতি।
হাউস অব কমন্সে বাজেট ভাষণ শেষ করেন অর্থমন্ত্রী। ছায়া অর্থমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া দেখানোই সংগত। কিন্তু এদিন তিনি চুপ থাকেন। প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন বিরোধী দলের নেতা। বাজেট পেশের পরদিন মুখ খোলেন ছায়া অর্থমন্ত্রী। এটাই রেওয়াজ। এর মানে হলো, ছায়া প্রধানমন্ত্রী সাধারণভাবে দেশের অর্থনীতি সম্পর্কে একটি মতামত তুলে ধরবেন। আর ছায়া অর্থমন্ত্রী বলবেন ভেবেচিন্তে। তিনি পুরো এক দিন সময় নিয়ে পর্যালোচনা করবেন। আর তার পরই তাঁর সুচিন্তিত অভিমত ব্যাখ্যা করবেন। আমাদের বিরোধী দল কবে কোন বিষয়ে সুচিন্তিত মত দিয়েছে? বাজেট, প্রতিরক্ষা, বিচার বিভাগ কিংবা পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে বিরোধী দলে থেকে এতগুলো পৃষ্ঠা লিখে ভরে ফেলেছে, তার তেমন নজির আগে কোনো বিরোধী দল দেখাতে পারবে বলে মনে হয় না। তাই এ অর্জনকে আমরা খাটো করে দেখতে চাই না। সরকারের উদ্দেশে মুদ্রিত বিরোধী দলের এই পুস্তিকাটি ৩২ পৃষ্ঠার। এটি হতে পারে আমাদের রাজনীতির ইতিহাসের প্রথম প্রামাণ্য সহযোগিতার দলিল। সুতরাং, সংসদে যে যা-ই বলুক, প্রধানমন্ত্রীর ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সুখকর।
বেগম খালেদা জিয়ার বাজেট প্রস্তাবে সন্তুষ্ট হওয়ার অনেক কারণ রয়েছে। আমাদের বিরোধী দল বা রাজনৈতিক দলগুলো মেঠো বক্তৃতায় পারদর্শী। লিখে, গুছিয়ে, রেকর্ড রেখে মনের ভাব প্রকাশে তাদের অতিশয় অনীহা। সেদিক থেকে শেরাটনীয় বাজেট একটা বিরাট বিষয়।
তবে প্রশ্ন হলো, শেরাটন থেকে শেরেবাংলা নগর কত দূর? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, স্টান্টবাজি না হলে ভালো। হলেও ক্ষতি আছে বলে মনে হয় না। বাজেট শব্দ পরিহার করাও যেত। যদি ‘উন্নয়ন’ প্রস্তাবনা বলা হতো, তাহলে হয়তো বিতর্কের কোনো সুযোগ হতো না। শপথ, সংসদ, সংবিধান বেঁচে যেত! আহা একটি শব্দ আমাদের রাজনীতিতে কী করতে পারে?
সংসদীয় গণতন্ত্র অনুশীলনরত ব্রিটেন বা অন্যান্য দেশ অবশ্য ছায়া বাজেট দেয় না। ব্রিটেনের অনুসরণে বেগম খালেদা জিয়ার প্রস্তাবকে নিছক একটি অসংসদীয় উপস্থাপনা হিসেবেও দেখা চলে। প্রতিবছর বাজেট পেশের আগে ব্রিটিশ অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাজ বাড়ে। সমাজের বিভিন্ন স্তর ও সংগঠন বিভিন্ন ধরনের প্রস্তাব দেয়। এর মধ্যে সাংসদেরাও থাকেন। এর সংখ্যা কম নয়। পাঁচ থেকে ১০ হাজার তো হবেই। বিএনপি শেরাটনীয় বাজেটের আয়োজক। বিরোধী দলের নেতা পরিচয়ে খালেদা জিয়া সেটা দেননি। দেখলাম, ওই পুস্তিকায় আছে, শুধু দেশনেত্রীর তকমা।
বাজেট নিয়ে বিএনপি যা করেছে, তা সরকারও তাদের কাছে চাইতে পারত। অবশ্য চাইলে তারা দিত কি না, সন্দেহ। এটাই আমাদের সংস্কৃতি। বাজেট একবার সংসদে তুলে দিলে তাতে কিন্তু বড় পরিবর্তন আনা সহজ নয়। ‘লেজিসলেটিভ ওভারসাইট অ্যান্ড বাজেটিং: এ ওয়ার্ল্ড পারসপেকটিভ’ নামে বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত একটি বই আছে। অনেক গবেষণা ও সমীক্ষা রয়েছে। এতে সারা বিশ্বের সংসদের একটা অভিন্ন প্রবণতা দেখলাম। সরকার যা বাজেটে প্রস্তাব করে, তাই পাস করে। ৪১টি দেশের মধ্যে জরিপ চালানো হয়। এর ৩৪ শতাংশ দেশের সংসদে অর্থমন্ত্রী যেভাবে বাজেট পেশ করেন, তাই পাস হয়। মার্কিন কংগ্রেস অনেক ক্ষমতা রাখে। নতুন করে বাজেট তৈরি করে নিতে পারে। কিন্তু কখনো তারা তা করেনি বা দরকার পড়েনি। ওই ৪১টি দেশের মধ্যে ৬৩ শতাংশ দেশের সংসদ একটু পরিবর্তন নিশ্চিত করে। কিন্তু সে পরিবর্তন অকিঞ্চিৎকর। প্রস্তাবিত ব্যয়ের তিন শতাংশের বেশি হেরফের ঘটে না। সে কারণে গোটা বিশ্বের সংসদ একটি নতুন প্রবণতার দিকে ছুটে যাচ্ছে। সেটা হলো, বাজেটের বেশ আগেই সংসদে একটা ছায়ার মতো প্রতিবেদন দেওয়া। এতে প্রকাশ করা হয়, আসন্ন নতুন বাজেটটি সরকার কীভাবে বানাবে।
এ ধারণাটি আমাদের দেশে ঢোকেনি। তবে বর্তমান সরকার একটি ভালো কাজ করেছে। তারা বাজেট বাস্তবায়ন প্রতিবেদন-ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে। এ পর্যন্ত আমরা দুটি পেলাম। গত ফেব্রুয়ারিতে সংসদে ছয় মাসের প্রথম রিপোর্ট দেন অর্থমন্ত্রী। জুনের গোড়ায় পাওয়া গেল দ্বিতীয়টি। এর বিষয়বস্তু শুধু ২০০৯-২০১০ অর্থবছরের বাজেটের অর্জনের মধ্যে সীমিত থেকেছে। এখন আমরা এর সম্প্রসারণ ঘটাতে পারি।
ব্রিটেনের বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন ১৯৯৭ সালে প্রথম প্রি-বাজেট স্টেটমেন্ট বা পিবিআর চালু করেন। প্রতি হেমন্তে সরকার এই প্রাক-বাজেট রিপোর্ট দিয়ে আসছে। এই যে হেমন্তকে বেছে নেওয়া হলো, এটাই হয়তো ভবিষ্যতে চলতে থাকবে। এটাই সংস্কৃতি, আইন নয়। কিন্তু আইনের চেয়ে বেশি।
এতে বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটের অর্জন ও বাস্তবায়নের বিবরণ থাকে। আর থাকে আগামী অর্থবছরের বাজেটের নীতি কী হবে, সে বিষয়ে নির্দেশনা। হাতে রাখা হয় চার মাস। নতুন বছরের বাজেটে কী থাকবে সে সম্পর্কে সরকারের নীতি ঘোষিত হয়। এর ওপর চিন্তাভাবনা ও সুপারিশের জন্য সময় দরকার। বিরোধী দল ও অন্যান্য আগ্রহী মহল সে জন্য সময় ভালোই পায়। সেখানে সবশেষ প্রাক-বাজেট প্রতিবেদন পেশ করা হলো ৯ ডিসেম্বর ২০০৯। আর বাজেট পেশ করা হয় ১৪ মার্চ ২০১০।
বিশ্বব্যাংক প্রাক-বাজেট প্রতিবেদন নিয়ে বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালসহ ৩৬টি দেশের ওপর সমীক্ষা চালিয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১৮টি দেশের সরকার নতুন বাজেট দেওয়ার চার মাস আগে সংসদে প্রাক-বাজেট প্রতিবেদন দেয়। তবে এখানে দেখার বিষয় হলো, আমাদের মতো নিম্ন আয়ের দেশগুলোর সংসদই এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে। তবুও নিম্ন আয়ের ২১ ভাগ দেশের সংসদ চার মাস আগে প্রাক-বাজেট প্রতিবেদন দিয়ে থাকে। বাংলাদেশের ঠাঁই এই একুশে হলো না। এটা যাতে চালু হয় সে রকম তাড়না কারও মধ্যে দেখি না। বরং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিসংক্রান্ত এ রকম আরও বহু দরকারি ক্ষেত্রে আমরা তাদের মধ্যে সমঝোতা দেখি।
ছায়া সরকারের কোনো ধারণা নিয়ে আমাদের বিরোধী দল চলে না। তারা মনে করে, সংসদ হলো সরকারের। সংসদ যে রাষ্ট্রের সেটা তারা বিশ্বাস করে না। আমাদের দুঃখ এই, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বিচক্ষণ হয়েও শুধু বাজেট প্রশ্নে বিরোধীদলীয় নেতার শপথ ভঙ্গ, সংসদ ও সংবিধানের অবমাননা দেখলেন। খালেদা জিয়া যে এই যে কদিন আগে সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনে গিয়ে বললেন, সরকারকে আর সময় দেওয়া যায় না, সেটা তো শেরাটনীয় বাজেটের চেয়ে মারাত্মক। কেন তিনি সরকার পতনের আন্দোলন করবেন? কেন তিনি সেটা সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে বলবেন? তাঁর ওই সভা ছিল উচ্চ আদালতের রায়ের পরিপন্থী। আওয়ামী লীগ কতটা সংসদ ও সংবিধান-পাগল দল, সেটা বোঝা যাবে। পারলে এ জন্য সংসদে একটি নিন্দা প্রস্তাব আনা হোক।
শেরাটনীয় বাজেট বিতণ্ডাকে আমাদের সামগ্রিকভাবে বিবেচনায় নিতে হবে। সংসদ নিয়ে অসত্য উক্তি করা হয় হরহামেশা। যেমন বলা হয়, সংসদ সার্বভৌম। অথচ সাংবিধানিকভাবে সাংসদেরা অধীনস্থ। তাঁরা ভোটে নির্বাচিত হন। তাঁরা নিজেরা ভোটে স্বাধীন নন। ৭০ অনুচ্ছেদের নিম্নচাপে তাঁদের বাক্স্বাধীনতা অচল হয়ে পড়েছে।
আমাদের বুঝতে হবে, বিরোধী দল কেন সংসদ রেখে শেরাটনে যায়। আর সরকারি দল কেন বলে, এর ফলেই সংবিধান লঙ্ঘিত হয়েছে। আসলে তারা একটি কৃত্রিম, শূন্যগর্ভ তর্কের দিকে জনগণের দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে চায়। বিশ্বব্যাংকের ওই বইটিতে লেখা আছে, বাজেট কেমন ও কতটা স্বচ্ছ হবে, তা প্রধানত নির্ভর করে সংসদের বিশ্লেষণ করার সামর্থ্যের ওপর। আমাদের স্বল্পসংখ্যক সাংসদের সামর্থ্যের সুনাম সুবিদিত।
কখনো মনে হয়, আরেকটি গণতান্ত্রিক রূপান্তরকরণ প্রয়াসের সুযোগ আবারও মাঠে মারা যাবে না তো? কারণ, ভয় পাচ্ছি। জিনিসপত্রের দাম, বিদ্যুৎ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো থাকা গণতান্ত্রিক শাসনের চাওয়া। এটাই সব নয়। কিন্তু হরতাল সফল করতে এর ব্যবহার কার্যকর। সরকারি দল প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে আন্তরিক, এমন কোনো সাড়াশব্দ পাই না। বিরোধী দলের ছায়া বাজেটকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখা যাবে না। নিঃশর্তে একে অভিনন্দন জানানোর দরজা তারাই রুদ্ধ করে রেখেছে। রাজনীতির পরিবেশকে অনবরত তারা দূষিত করছে। দায় উভয়ের আছে। সংসদের পরিবেশ ও বিরোধী দলের প্রতি আচরণ প্রসঙ্গে উদ্বিগ্ন বেগম জিয়া। তবে কবে কখন কোন বিরোধী দলের কাছে সংসদের পরিবেশ ভালো লেগেছিল, তা আমাদের জানা নেই। সংসদ থেকে দলের পৃথক্করণ লাগবে। লাগবে সংসদের স্বাধীনতা। এটা এলে সংসদীয় বাজেট প্রাণ পাবে। শেরাটনীয় বাজেট কিংবা ‘আরেকটা ধাক্কা মেরে সরকার ফেলার’ রাজনীতি থেকে বাঁচার এটাই উল্লেখযোগ্য উপায়।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
No comments