ফুতেনমার গোলকধাঁধা by মনজুরুল হক
গত বছর আগস্ট মাসে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলে পাঁচ দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে জাপানে প্রথমবারের মতো প্রকৃত অর্থে সরকার বদলের সূত্রপাত হওয়ার পর থেকে জাপান-মার্কিন সম্পর্ক যে খুব একটা ভালো যাচ্ছে না, তা এখন আর অজানা কোনো বিষয় নয়। ইয়ুকিও হাতোইয়ামার নেতৃত্বে ডেমোক্রেটিক পার্টির কোয়ালিশন সরকার দায়িত্ব পালন শুরু করেছে গত সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে। সেই হিসেবে সরকারের মেয়াদ আট মাসের কাছাকাছি। প্রধানমন্ত্রী হাতোইয়ামা অবশ্য এই সময়ের মধ্যে ওয়াশিংটনে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এসেছেন এবং প্রেসিডেন্ট ওবামাও নভেম্বরে সরকারি সফরে জাপান ঘুরে গেছেন। তবে তার পরও হঠাৎ করে শীতল হয়ে আসা একসময়ের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ দুই মিত্রের সম্পর্ক যে চাঙা করে তোলা যাচ্ছে না, তার পেছনের একাধিক কারণের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণটি জাপানের মার্কিন সামরিক উপস্থিতির সঙ্গে সম্পর্কিত।
জাপানে মার্কিন সামরিক উপস্থিতির সূচনা ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরাজিত শক্তি হিসেবে জাপানের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে। সেই হিসেবে জাপানে মার্কিন সামরিক উপস্থিতির স্থায়িত্বের মেয়াদ ৬৫ বছর পূর্ণ হতে চলেছে। ৬৫ বছর ধরে সার্বভৌম রাষ্ট্রের দাবিদার কোনো ভূখণ্ডে বিদেশি সামরিক বাহিনীর যত্রতত্র উপস্থিতির নজির বিশ্বে আর দ্বিতীয়টি নেই। পশ্চিম ইউরোপের কয়েকটি দেশে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি দীর্ঘসময় ধরে চলে এলেও সৈন্য ও ঘাঁটির সংখ্যার দিক থেকে তা হচ্ছে খুবই নগণ্য। ফলে জাপানে সে রকম লোকজনের সংখ্যার বেলাতেও খুব একটা কমতি চোখে পড়ে না, যাঁরা বলে আসছেন জাপান এখনো কার্যত পরাধীন এক দেশ রয়ে গেছে। ফলে সে রকম পরোক্ষ পরাধীনতার বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারার আহ্বান যাঁরা জানাচ্ছেন, তাঁদের প্রতি সমর্থনের পাল্লাও দেশজুড়ে কোনো অংশে কম নয়।
আগস্ট মাসের নির্বাচনে ইয়ুকিও হাতোইয়ামার গণতান্ত্রিক দল নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। দলের নির্বাচনী ঘোষণায় দেওয়া প্রতিশ্রুতির মধ্যে জাপানে, বিশেষ করে দেশের দক্ষিণের দ্বীপ জেলা ওকিনাওয়ার ওপর চেপে বসা বিদেশি সৈন্যের বোঝা লাঘবে পদক্ষেপ গ্রহণের অঙ্গীকার দলটি করেছিল। ফলে গণতান্ত্রিক দলকে যাঁরা ভোট দিয়েছেন, তাঁদের একাংশ অবশ্যই সে রকম প্রতিশ্রুতিতে আকৃষ্ট হয়ে থাকবে। দলীয় নেতৃত্ব তাই এখন মনে করছে অন্তত ওকিনাওয়ার ভার লাঘবে কিছু একটা তাদের অবশ্যই করা উচিত। আর এ কারণেই ক্ষমতা গ্রহণের সূচনালগ্ন থেকেই হাতোইয়ামা প্রশাসনের অনেকেই ওকিনাওয়ার বিশেষ যে সমস্যার দিকে নজর দিতে শুরু করেন, সেটা হচ্ছে ঘন জনবসতিপূর্ণ এলাকা গিনোওয়ান শহরের একেবারে কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত মার্কিন মেরিন বাহিনীর ফুতেনমা বিমান স্টেশন দ্বীপেরই অন্য আরেক মার্কিন সামরিক ঘাঁটি ক্যাম্প শোয়াবের অদূরের সমুদ্রে সরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন করে আলোচনা শুরু করা।
শহরের ঠিক মাঝখানটায় সামরিক বিমান ওঠানামার ব্যবস্থা থেকে দেখা দেওয়া সমস্যার কথা গিনোওয়ানবাসী অনেক দিন থেকেই বলে আসছে। শব্দ দূষণ ছাড়াও দুর্ঘটনার আশঙ্কার মুখে নাগরিক জীবনে হুমকি দেখা দেওয়া নিয়ে শহরবাসী উদ্বিগ্ন। মনে পড়ে ঠিক এক দশক আগে শিল্পোন্নত দেশগুলোর বার্ষিক শীর্ষ সম্মেলনের সংবাদ সংগ্রহে ওকিনাওয়ায় অবস্থান করার সময় সমস্যার গভীরতা সম্পর্কে সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করাতে গিনোওয়ানের তৎকালীন মেয়র এক দিন তাঁর কার্যালয়ে আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। নগরভবনের ছাদে উঠতেই আমাদের চোখে ধরা দেয় ঠিক এর পাশ বরাবর গড়ে ওঠা সেই বিমান স্টেশনটি, যেখান থেকে ভেসে আসা যুদ্ধবিমান ওঠানামার বিকট শব্দে অন্য কোনো কিছুই আর শোনা যাচ্ছিল না।
গিনোওয়ান শহরের সেই বিতর্কিত বিমান স্টেশনটি নগরকেন্দ্র থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য ২০০৬ সালে মতৈক্যে উপনীত হয়েছিল। উদার গণতান্ত্রিক দল এলডিপির নেতৃত্বাধীন জাপানের সেই সময়ের সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাক্ষরিত চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ওকিনাওয়া জেলাতেই ফুতেনমার বদলে নতুন একটি বিমান স্টেশন জাপানের তৈরি করে দেওয়ার কথা, যে স্থাপনার নির্মাণকাজ শেষ হলে যুক্তরাষ্ট্র ফুতেনমার পালা চুকিয়ে মেরিন বাহিনীর বিমান স্টেশন সেখানে সরিয়ে নেবে। নতুন সেই বিমান স্টেশনের জন্য একটি জায়গাও পরবর্তীকালে ঠিক করে নেওয়া হয়, যার অবস্থান হচ্ছে দ্বীপের নাগো শহরে অবস্থিত মার্কিন বিমান ঘাঁটি ক্যাম্প শোয়াবের সমুদ্রের অদূরে।
সমুদ্র ভরাট করে নেওয়ার প্রক্রিয়ায় পাওয়া ভূখণ্ডে রানওয়ে ও বিমান চলাচলের অন্যান্য ব্যবস্থা মার্কিন মেরিন বাহিনীর জন্য তৈরি করে দিতে জাপান সেই চুক্তিতে সম্মতি ব্যক্ত করেছিল। তবে চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার পর থেকেই বিষয়টিকে ঘিরে নতুন করে নাগরিক অসন্তোষ দেখা দেয়। ওকিনাওয়াবাসীর সংখ্যাগরিষ্ঠ তখন থেকেই বলে আসছে যে, সমুদ্র ভরাট করে নেওয়া হলে দ্বীপের সেই এলাকার অদূরের সাগরে বিরল যেসব সমুদ্র প্রজাতির বসবাস, তার সবটাই চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাওয়ার হুমকির মুখোমুখি দাঁড়াবে। ফলে দুই দেশের মধ্যে ২০০৬ সালে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হলেও নির্ধারিত জায়গায় নির্মাণকাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি এবং ফুতেনমা বিমান স্টেশন এখনো পর্যন্ত গিনোওয়ান শহরের নগরকেন্দ্রেই রয়ে গেছে, যা নিয়ে অন্যদিকে আবার গিনোওয়ানবাসীর ক্ষোভের বোঝাও দিন দিন ভারী হয়ে আসছে।
গত গ্রীষ্মের সাধারণ নির্বাচনে ওকিনাওয়ার সব কয়টি আসনে বর্তমানে ক্ষমতাসীন গণতান্ত্রিক পার্টির সমর্থক প্রার্থীরা জয়লাভ করেন। ফলে প্রধানমন্ত্রী হাতোইয়ামার নতুন সরকারকে ওকিনাওয়ার সমস্যা সমাধানের দিকে শুরু থেকেই নজর দিতে হয়। তবে সরকারের আন্তরিকতা সত্ত্বেও সমস্যার সহজ সমাধান খুঁজে পাওয়া যে সহজ কাজ মোটেও নয়, তা অনুধাবন করতেও খুব একটা কালক্ষেপণ সরকারকে করতে হয়নি। হাতোইয়ামা প্রশাসন নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণে আগ্রহ ব্যক্ত করার মুখে ওয়াশিংটন সরাসরি টোকিওকে জানিয়ে দেয় যে দুই দেশের সরকারের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির রদবদল যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। অন্যদিকে নির্বাচনের পর নতুনভাবে সংঘবদ্ধ হতে থাকা ওকিনাওয়ার জনগণের যে দাবি সরকারের সামনে তুলে ধরে, তা হলো ফুতেনমাকে কেবল গিনোওয়ান শহরের বাইরেই নয় বরং ওকিনাওয়া দ্বীপের বাইরে সরিয়ে নেওয়া তারা দেখতে চায়। দ্বীপবাসীর সেই দাবির সঙ্গে কোয়ালিশন সরকারের ছোট অংশীদার সমাজ গণতান্ত্রিক দল কণ্ঠ মেলালে সরকারকে তা আসলেই কঠিন এক অবস্থার মধ্যে ফেলে দেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে পরবর্তী সময় আরও ঘোষণা করা হয়, জাপান সরকার ফুতেনমা প্রশ্নে অনড় থাকলে ওকিনাওয়া থেকে ১০ হাজার মেরিন সৈন্য গুয়ামে সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত মতৈক্য মেনে চলতে যুক্তরাষ্ট্র বাধ্য থাকবে না। ফলে নতুন অনেক জটিলতা ফুতেনমার প্রশ্নকে ঘিরে তৈরি হতে শুরু করে, যা কিনা সমস্যাটিকে শেষ পর্যন্ত করে তুলেছে অনেক বেশি জটিল।
জাপানের প্রধানমন্ত্রী এখন বলছেন, মে মাসের মধ্যেই বিষয়টির নিষ্পত্তি তিনি করে নেবেন। সেই লক্ষ্যে ওকিনাওয়ার উত্তরে কিউশু দ্বীপের কাগোশিমা জেলার অন্তর্ভুক্ত ক্ষুদ্র দ্বীপ তোকুনোশিমাতে ফুতেনমার সব রকম সুযোগ-সুবিধা স্থানান্তরের প্রস্তাব সরকারের পক্ষ থেকে কিছুদিন আগে রাখা হয়। তবে তার পরও সরকার বিপদমুক্ত হতে পারেনি। সরকারের সেই পরিকল্পনা সম্পর্কে অবগত হওয়ার পর তোকুনোশিমাবাসী কালক্ষেপণ না করে ঘাঁটিবিরোধী বিশাল জনসভার আয়োজন করে সরকারকে জানিয়ে দেয় যে, মার্কিন সৈন্যের উপস্থিতি তাদের দ্বীপে গ্রহণযোগ্য হবে না। ফলে বিকল্প নতুন পথের সন্ধান জাপান সরকারকে আবারও এখন করতে হচ্ছে। ভিন্ন যে নতুন বিকল্পের কথা এখন বলা হচ্ছে তা হলো, আগের সেই নির্ধারিত স্থান, ক্যাম্প শোয়াবের অদূরের সমুদ্রেই সাগরের নিচে পোক্ত পিলার বসিয়ে নিয়ে তার ওপর ভাসমান রানওয়ে তৈরি করে নেওয়া। এর ফলে সমুদ্র ভরাট করে নেওয়ার সমস্যা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হবে, তবে খরচ এতে কী রকম পড়বে তা অবশ্য এখনো হিসাব করে দেখা হয়নি।
ফুতেনমার স্থানান্তরের গোলকধাঁধা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেওয়ার মুখে জাপানের বেশ কিছু গবেষক প্রশ্নটির সঙ্গে সম্পর্কিত ভিন্ন যে দিকটির ওপর আলোকপাত করছেন, তা হলো জাপান-মার্কিন নিরাপত্তা মৈত্রীর সার্বিক গ্রহণযোগ্যতা। জাপানে মার্কিন সৈন্যদের উপস্থিতিকে কতটা আদরের সঙ্গে দেখা হয়, ফুতেনমা কিন্তু সেই সত্যকে নগ্নভাবে তুলে ধরছে। নাগরিক জীবনের মনমানসিকতায় সেই উপস্থিতি অনেকটাই হচ্ছে ঔপনিবেশিক উপস্থিতি। ফলে দেশের ভেতরে এক জায়গা থেকে মার্কিন ঘাঁটি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার প্রশ্ন দেখা দিলে যে সমস্যার মুখোমুখি সরকারকে শুরুতেই পড়তে হয়, তা হলো জাপানের অন্য কোনো জায়গাই মার্কিন ঘাঁটি গ্রহণ করতে রাজি নয়। এ কারণেই ঘাঁটিবিরোধী বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন, জাপান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পাততাড়ি গোটানোর মধ্যেই সমস্যার গ্রহণযোগ্য সমাধান নিহিত রয়েছে।
সে রকম যুক্তির আলোকে জাপান-যুক্তরাষ্ট্র মৈত্রী চুক্তিকেও এখন আর জাপানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে নেওয়ার সেরা পথ হিসেবে না দেখে বরং সম্পূর্ণ নতুন এক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এর মূল্যায়ন এখন করা হচ্ছে। এ রকম গবেষকদের নেতৃত্বে আছেন জাপানের অর্থনীতি ও রাজনীতির বিশিষ্ট বিশ্লেষক জিৎসুরো তেরাশিমা, যিনি মনে করেন ১৯৯০-এর দশকে স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকেই জাপানে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি এর যৌক্তিকতা হারিয়েছে। এখন এই উপস্থিতি অনেকটাই যেন হচ্ছে গায়ের জোরে পুরোনো সেই ব্যবস্থাকে সচল রাখা। ফলে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের পুরো কাঠামোকে পরিবর্তিত আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির আলোকে না দেখে ভিন্নভাবে একটিমাত্র সমস্যার দিকে আলোকপাত করা হলে তা হয়তো সাময়িক সমাধানই কেবল এনে দেবে, সার্বিক ও গ্রহণযোগ্য সমাধান যা হবে না।
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।
জাপানে মার্কিন সামরিক উপস্থিতির সূচনা ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরাজিত শক্তি হিসেবে জাপানের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে। সেই হিসেবে জাপানে মার্কিন সামরিক উপস্থিতির স্থায়িত্বের মেয়াদ ৬৫ বছর পূর্ণ হতে চলেছে। ৬৫ বছর ধরে সার্বভৌম রাষ্ট্রের দাবিদার কোনো ভূখণ্ডে বিদেশি সামরিক বাহিনীর যত্রতত্র উপস্থিতির নজির বিশ্বে আর দ্বিতীয়টি নেই। পশ্চিম ইউরোপের কয়েকটি দেশে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি দীর্ঘসময় ধরে চলে এলেও সৈন্য ও ঘাঁটির সংখ্যার দিক থেকে তা হচ্ছে খুবই নগণ্য। ফলে জাপানে সে রকম লোকজনের সংখ্যার বেলাতেও খুব একটা কমতি চোখে পড়ে না, যাঁরা বলে আসছেন জাপান এখনো কার্যত পরাধীন এক দেশ রয়ে গেছে। ফলে সে রকম পরোক্ষ পরাধীনতার বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারার আহ্বান যাঁরা জানাচ্ছেন, তাঁদের প্রতি সমর্থনের পাল্লাও দেশজুড়ে কোনো অংশে কম নয়।
আগস্ট মাসের নির্বাচনে ইয়ুকিও হাতোইয়ামার গণতান্ত্রিক দল নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। দলের নির্বাচনী ঘোষণায় দেওয়া প্রতিশ্রুতির মধ্যে জাপানে, বিশেষ করে দেশের দক্ষিণের দ্বীপ জেলা ওকিনাওয়ার ওপর চেপে বসা বিদেশি সৈন্যের বোঝা লাঘবে পদক্ষেপ গ্রহণের অঙ্গীকার দলটি করেছিল। ফলে গণতান্ত্রিক দলকে যাঁরা ভোট দিয়েছেন, তাঁদের একাংশ অবশ্যই সে রকম প্রতিশ্রুতিতে আকৃষ্ট হয়ে থাকবে। দলীয় নেতৃত্ব তাই এখন মনে করছে অন্তত ওকিনাওয়ার ভার লাঘবে কিছু একটা তাদের অবশ্যই করা উচিত। আর এ কারণেই ক্ষমতা গ্রহণের সূচনালগ্ন থেকেই হাতোইয়ামা প্রশাসনের অনেকেই ওকিনাওয়ার বিশেষ যে সমস্যার দিকে নজর দিতে শুরু করেন, সেটা হচ্ছে ঘন জনবসতিপূর্ণ এলাকা গিনোওয়ান শহরের একেবারে কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত মার্কিন মেরিন বাহিনীর ফুতেনমা বিমান স্টেশন দ্বীপেরই অন্য আরেক মার্কিন সামরিক ঘাঁটি ক্যাম্প শোয়াবের অদূরের সমুদ্রে সরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন করে আলোচনা শুরু করা।
শহরের ঠিক মাঝখানটায় সামরিক বিমান ওঠানামার ব্যবস্থা থেকে দেখা দেওয়া সমস্যার কথা গিনোওয়ানবাসী অনেক দিন থেকেই বলে আসছে। শব্দ দূষণ ছাড়াও দুর্ঘটনার আশঙ্কার মুখে নাগরিক জীবনে হুমকি দেখা দেওয়া নিয়ে শহরবাসী উদ্বিগ্ন। মনে পড়ে ঠিক এক দশক আগে শিল্পোন্নত দেশগুলোর বার্ষিক শীর্ষ সম্মেলনের সংবাদ সংগ্রহে ওকিনাওয়ায় অবস্থান করার সময় সমস্যার গভীরতা সম্পর্কে সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করাতে গিনোওয়ানের তৎকালীন মেয়র এক দিন তাঁর কার্যালয়ে আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। নগরভবনের ছাদে উঠতেই আমাদের চোখে ধরা দেয় ঠিক এর পাশ বরাবর গড়ে ওঠা সেই বিমান স্টেশনটি, যেখান থেকে ভেসে আসা যুদ্ধবিমান ওঠানামার বিকট শব্দে অন্য কোনো কিছুই আর শোনা যাচ্ছিল না।
গিনোওয়ান শহরের সেই বিতর্কিত বিমান স্টেশনটি নগরকেন্দ্র থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য ২০০৬ সালে মতৈক্যে উপনীত হয়েছিল। উদার গণতান্ত্রিক দল এলডিপির নেতৃত্বাধীন জাপানের সেই সময়ের সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাক্ষরিত চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ওকিনাওয়া জেলাতেই ফুতেনমার বদলে নতুন একটি বিমান স্টেশন জাপানের তৈরি করে দেওয়ার কথা, যে স্থাপনার নির্মাণকাজ শেষ হলে যুক্তরাষ্ট্র ফুতেনমার পালা চুকিয়ে মেরিন বাহিনীর বিমান স্টেশন সেখানে সরিয়ে নেবে। নতুন সেই বিমান স্টেশনের জন্য একটি জায়গাও পরবর্তীকালে ঠিক করে নেওয়া হয়, যার অবস্থান হচ্ছে দ্বীপের নাগো শহরে অবস্থিত মার্কিন বিমান ঘাঁটি ক্যাম্প শোয়াবের সমুদ্রের অদূরে।
সমুদ্র ভরাট করে নেওয়ার প্রক্রিয়ায় পাওয়া ভূখণ্ডে রানওয়ে ও বিমান চলাচলের অন্যান্য ব্যবস্থা মার্কিন মেরিন বাহিনীর জন্য তৈরি করে দিতে জাপান সেই চুক্তিতে সম্মতি ব্যক্ত করেছিল। তবে চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার পর থেকেই বিষয়টিকে ঘিরে নতুন করে নাগরিক অসন্তোষ দেখা দেয়। ওকিনাওয়াবাসীর সংখ্যাগরিষ্ঠ তখন থেকেই বলে আসছে যে, সমুদ্র ভরাট করে নেওয়া হলে দ্বীপের সেই এলাকার অদূরের সাগরে বিরল যেসব সমুদ্র প্রজাতির বসবাস, তার সবটাই চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাওয়ার হুমকির মুখোমুখি দাঁড়াবে। ফলে দুই দেশের মধ্যে ২০০৬ সালে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হলেও নির্ধারিত জায়গায় নির্মাণকাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি এবং ফুতেনমা বিমান স্টেশন এখনো পর্যন্ত গিনোওয়ান শহরের নগরকেন্দ্রেই রয়ে গেছে, যা নিয়ে অন্যদিকে আবার গিনোওয়ানবাসীর ক্ষোভের বোঝাও দিন দিন ভারী হয়ে আসছে।
গত গ্রীষ্মের সাধারণ নির্বাচনে ওকিনাওয়ার সব কয়টি আসনে বর্তমানে ক্ষমতাসীন গণতান্ত্রিক পার্টির সমর্থক প্রার্থীরা জয়লাভ করেন। ফলে প্রধানমন্ত্রী হাতোইয়ামার নতুন সরকারকে ওকিনাওয়ার সমস্যা সমাধানের দিকে শুরু থেকেই নজর দিতে হয়। তবে সরকারের আন্তরিকতা সত্ত্বেও সমস্যার সহজ সমাধান খুঁজে পাওয়া যে সহজ কাজ মোটেও নয়, তা অনুধাবন করতেও খুব একটা কালক্ষেপণ সরকারকে করতে হয়নি। হাতোইয়ামা প্রশাসন নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণে আগ্রহ ব্যক্ত করার মুখে ওয়াশিংটন সরাসরি টোকিওকে জানিয়ে দেয় যে দুই দেশের সরকারের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির রদবদল যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। অন্যদিকে নির্বাচনের পর নতুনভাবে সংঘবদ্ধ হতে থাকা ওকিনাওয়ার জনগণের যে দাবি সরকারের সামনে তুলে ধরে, তা হলো ফুতেনমাকে কেবল গিনোওয়ান শহরের বাইরেই নয় বরং ওকিনাওয়া দ্বীপের বাইরে সরিয়ে নেওয়া তারা দেখতে চায়। দ্বীপবাসীর সেই দাবির সঙ্গে কোয়ালিশন সরকারের ছোট অংশীদার সমাজ গণতান্ত্রিক দল কণ্ঠ মেলালে সরকারকে তা আসলেই কঠিন এক অবস্থার মধ্যে ফেলে দেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে পরবর্তী সময় আরও ঘোষণা করা হয়, জাপান সরকার ফুতেনমা প্রশ্নে অনড় থাকলে ওকিনাওয়া থেকে ১০ হাজার মেরিন সৈন্য গুয়ামে সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত মতৈক্য মেনে চলতে যুক্তরাষ্ট্র বাধ্য থাকবে না। ফলে নতুন অনেক জটিলতা ফুতেনমার প্রশ্নকে ঘিরে তৈরি হতে শুরু করে, যা কিনা সমস্যাটিকে শেষ পর্যন্ত করে তুলেছে অনেক বেশি জটিল।
জাপানের প্রধানমন্ত্রী এখন বলছেন, মে মাসের মধ্যেই বিষয়টির নিষ্পত্তি তিনি করে নেবেন। সেই লক্ষ্যে ওকিনাওয়ার উত্তরে কিউশু দ্বীপের কাগোশিমা জেলার অন্তর্ভুক্ত ক্ষুদ্র দ্বীপ তোকুনোশিমাতে ফুতেনমার সব রকম সুযোগ-সুবিধা স্থানান্তরের প্রস্তাব সরকারের পক্ষ থেকে কিছুদিন আগে রাখা হয়। তবে তার পরও সরকার বিপদমুক্ত হতে পারেনি। সরকারের সেই পরিকল্পনা সম্পর্কে অবগত হওয়ার পর তোকুনোশিমাবাসী কালক্ষেপণ না করে ঘাঁটিবিরোধী বিশাল জনসভার আয়োজন করে সরকারকে জানিয়ে দেয় যে, মার্কিন সৈন্যের উপস্থিতি তাদের দ্বীপে গ্রহণযোগ্য হবে না। ফলে বিকল্প নতুন পথের সন্ধান জাপান সরকারকে আবারও এখন করতে হচ্ছে। ভিন্ন যে নতুন বিকল্পের কথা এখন বলা হচ্ছে তা হলো, আগের সেই নির্ধারিত স্থান, ক্যাম্প শোয়াবের অদূরের সমুদ্রেই সাগরের নিচে পোক্ত পিলার বসিয়ে নিয়ে তার ওপর ভাসমান রানওয়ে তৈরি করে নেওয়া। এর ফলে সমুদ্র ভরাট করে নেওয়ার সমস্যা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হবে, তবে খরচ এতে কী রকম পড়বে তা অবশ্য এখনো হিসাব করে দেখা হয়নি।
ফুতেনমার স্থানান্তরের গোলকধাঁধা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেওয়ার মুখে জাপানের বেশ কিছু গবেষক প্রশ্নটির সঙ্গে সম্পর্কিত ভিন্ন যে দিকটির ওপর আলোকপাত করছেন, তা হলো জাপান-মার্কিন নিরাপত্তা মৈত্রীর সার্বিক গ্রহণযোগ্যতা। জাপানে মার্কিন সৈন্যদের উপস্থিতিকে কতটা আদরের সঙ্গে দেখা হয়, ফুতেনমা কিন্তু সেই সত্যকে নগ্নভাবে তুলে ধরছে। নাগরিক জীবনের মনমানসিকতায় সেই উপস্থিতি অনেকটাই হচ্ছে ঔপনিবেশিক উপস্থিতি। ফলে দেশের ভেতরে এক জায়গা থেকে মার্কিন ঘাঁটি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার প্রশ্ন দেখা দিলে যে সমস্যার মুখোমুখি সরকারকে শুরুতেই পড়তে হয়, তা হলো জাপানের অন্য কোনো জায়গাই মার্কিন ঘাঁটি গ্রহণ করতে রাজি নয়। এ কারণেই ঘাঁটিবিরোধী বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন, জাপান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পাততাড়ি গোটানোর মধ্যেই সমস্যার গ্রহণযোগ্য সমাধান নিহিত রয়েছে।
সে রকম যুক্তির আলোকে জাপান-যুক্তরাষ্ট্র মৈত্রী চুক্তিকেও এখন আর জাপানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে নেওয়ার সেরা পথ হিসেবে না দেখে বরং সম্পূর্ণ নতুন এক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এর মূল্যায়ন এখন করা হচ্ছে। এ রকম গবেষকদের নেতৃত্বে আছেন জাপানের অর্থনীতি ও রাজনীতির বিশিষ্ট বিশ্লেষক জিৎসুরো তেরাশিমা, যিনি মনে করেন ১৯৯০-এর দশকে স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকেই জাপানে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি এর যৌক্তিকতা হারিয়েছে। এখন এই উপস্থিতি অনেকটাই যেন হচ্ছে গায়ের জোরে পুরোনো সেই ব্যবস্থাকে সচল রাখা। ফলে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের পুরো কাঠামোকে পরিবর্তিত আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির আলোকে না দেখে ভিন্নভাবে একটিমাত্র সমস্যার দিকে আলোকপাত করা হলে তা হয়তো সাময়িক সমাধানই কেবল এনে দেবে, সার্বিক ও গ্রহণযোগ্য সমাধান যা হবে না।
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।
No comments