আত্মহৎযা জঘন্য পাপকাজ by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান
আল্লাহ তাআলা মানব জাতিকে দুনিয়ায় মরণশীল করে সৃষ্টি করেছেন। তিনিই জীবন দেন এবং তিনিই মৃত্যু ঘটান। মানুষ যেমন নিজের ইচ্ছায় জন্মগ্রহণ করতে পারে না, তেমনি স্বেচ্ছায় জীবনাবসানও ঘটাতে পারে না। মানুষ নিজকে নিজের প্রাণের মালিক এবং নিজকে ধ্বংস করার এখতিয়ার আছে বলে মনে করতে পারে না। কেননা মানুষের জীবন-প্রাণ তো আল্লাহর দান, সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত আমানত। একে ধ্বংস করা বা অন্যায়ভাবে ব্যবহার করার অধিকার কারও নেই। জীবনের পরিব্যাপ্তি ইহজগতেই শেষ নয়, সত্যিকার চিরস্থায়ী জীবন অপেক্ষা করছে পরকালে। কিন্তু আত্মহৎযার ক্ষেত্রে বান্দা ধর্ম-কর্ম ভুলে স্বাভাবিক মৃত্যুকে উপেক্ষা করে এবং নিজের হাত দিয়ে নিজেই নিজকে হত্যা করে ফেলে। এ জন্য ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে এটি একটি শরিয়ত-গর্হিত জঘন্য কাজ। আত্মহৎযা মানে নিজকে নিজে ধ্বংস করা। নিজ আত্মাকে চরম যন্ত্রণা ও কষ্ট দেওয়া। নিজ হাতে নিজের জীবনের সব কর্মকাণ্ডের পরিসমাপ্তি ঘটানো। এটা আল্লাহ তাআলা মোটেই পছন্দ করেন না।
ইসলাম মানব জীবনের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করেছে। ইসলামে আত্মহৎযা ঘৃণ্য ও জঘন্য মহাপাপ কাজ হওয়া সত্ত্বেও এমন অনেক লোক আছে, যারা নিজেদের সংবরণ করতে পারে না। আত্মহৎযার উপায়-উপকরণ জোগাড় করে বা ডায়েরি লিখে রাখে ও নেতিবাচক কথাবার্তার মাধ্যমে জীবন শেষ করে দেওয়ার ইঙ্গিত রেখে যায়। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ জীবনযাপনের দুঃখ-দুর্দশা ও ব্যর্থতার গ্লানি থেকে পরিত্রাণের জন্য অথবা জেদের বশবর্তী হয়ে কেউ কেউ বেছে নেয় আত্মহননের পথ। অথচ ধৈর্যধারণ করলে, আল্লাহর ওপর দৃঢ় আস্থা থাকলে কারও আত্মহৎযার মতো ক্লেশকর পথে পা বাড়াতে হয় না। এ ঘৃণ্যকাজ থেকে বিরত থাকতে আল্লাহ তাআলা বিশেষভাবে নির্দেশ প্রদান করেছেন এবং ধর্মপ্রাণ মানুষকে এর পরিণামের কথা ভাবার জন্য কঠোর ও যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির বর্ণনা দিয়ে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘আর তোমরা নিজেদের হত্যা করো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু এবং যে কেউ সীমালঙ্ঘন করে অন্যায়ভাবে তা (আত্মহৎযা) করবে, অবশ্যই আমি তাকে অগ্নিদগ্ধ করা; আল্লাহর পক্ষে তা সহজসাধ্য।’ (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ২৯-৩০)
অথচ আজকাল প্রায়ই আত্মহৎযার ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে। বিশেষ করে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে এ প্রবণতা অনেক বেশি। বখাটে লোকের উৎপাতের কারণে যেমন কেউ আত্মহৎযার পথ বেছে নিচ্ছে, আবার দেখা যাচ্ছে পিতা-মাতার সামান্য বকুনির কারণেও আত্মহৎযার মতো ঘটনা ঘটছে। পারিবারিক বিপর্যয়, মানসিক অশান্তি, সন্ত্রাস, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি, মূল্যবোধের অবক্ষয় ইত্যাদি বিষয়ের সঙ্গেও জড়িত আছে আত্মহৎযার মতো ধ্বংসাত্মক ঘটনা। এসব আত্মহৎযার পেছনে কাজ করে প্রচণ্ড মানসিক চাপ। ফলে ভারসাম্য হারিয়ে তা সহ্য করতে না পেরেই আত্মহননের মধ্য দিয়ে তারা মুক্তি খোঁজে। আত্মহৎযার ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিজেকে পাহাড়ের ওপর থেকে নিক্ষেপ করে আত্মহৎযা করে, সে জাহান্নামের মধ্যে সর্বদা ওভাবে লাফিয়ে পড়ে নিজেকে নিক্ষেপ করতে থাকবে। যে ব্যক্তি বিষপান করে আত্মহৎযা করে, সেও জাহান্নামের মধ্যে সর্বদা ওভাবে নিজ হাতে বিষপান করতে থাকবে। আর যে কোনো ধারালো অস্ত্র দিয়ে আত্মহৎযা করে, তার কাছে জাহান্নামে সেই ধারালো অস্ত্র থাকবে, যা দিয়ে সে সর্বদা নিজের পেটকে ফুঁড়তে থাকবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
ইসলামি বিধানে আত্মহৎযা নাজায়েজ এবং এর প্রতিফল হলো চিরস্থায়ী জাহান্নাম। যে ব্যক্তি আত্মহৎযা করে, সে শুধু তার নিজের ওপরই জুলুম করে না বরং এতে পিতা-মাতা, ভাই-বোনসহ আত্মীয়-পরিজন সবাই খুব কষ্ট পান এবং অত্যন্ত বিচলিতবোধ করেন। যে পরিস্থিতিতেই হোক না কেন, ইসলামের দৃষ্টিতে এটি এক বিরাট অন্যায়। কারণ এর দ্বারা আল্লাহর বেঁধে দেওয়া নিয়মের বরখেলাপ হয়ে যায়। তাই এ থেকে সদাসতর্ক থাকা প্রতিটি মুমিন মুসলমানের বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। নবী করিম (সা.) হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন, ‘কোনো ব্যক্তি যেই জিনিস দ্বারা আত্মহৎযা করে, কিয়ামতের দিন তাকে সেই জিনিস দ্বারাই শাস্তি দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি ফাঁস লাগিয়ে আত্মহৎযা করে সে দোজখে অনুরূপভাবে নিজ হাতে ফাঁসির শাস্তি ভোগ করতে থাকবে। আর যে বর্শা ইত্যাদির আঘাত দ্বারা আত্মহৎযা করে, সে দোজখেও সেভাবে নিজেকে শাস্তি দিবে।’ (নাসাঈ, তিরমিজি)
মানুষের আত্মহৎযা করার বিবিধ কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ, পিতা-মাতা ও ছেলে-মেয়ের মধ্যে মনোমালিন্য, পরীক্ষায় ব্যর্থতা, দীর্ঘস্থায়ী রোগ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়া, প্রেম-বিরহ, ব্যবসা-বাণিজ্যে পুনঃ পুনঃ ব্যর্থ হওয়া, শত্রুর কাছে ধরা না দেওয়া প্রভৃতি। যখন কারও জ্ঞান-বুদ্ধি ও উপলব্ধি-অনুধাবনশক্তি লোপ পায়, নিজকে অসহায়-ভরসাহীন মনে হয়, তখনই ধর্ম-কর্ম ভুলে মানুষ আত্মহৎযা করে বসে। জাগতিক ক্ষুদ্র দুঃখ-কষ্ট, লাঞ্ছনা ও অপমান থেকে আত্মরক্ষা করার ইচ্ছায় মানুষ আত্মহননের মাধ্যমে চিরন্তন কষ্ট ও লাঞ্ছনার দিকে চলে যায়। আত্মহৎযা সম্পর্কে হাদিসে কুদসিতে বর্ণিত আছে যে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের এক ব্যক্তি আহত হয়ে সে ব্যথা সহ্য করতে পারেনি। সে একটি ছুরি দিয়ে নিজের হাত নিজেই কেটে ফেলে। এরপর রক্তক্ষরণে সে মারা যায়। এ ব্যক্তি সম্পর্কে আল্লাহ পাক বলেন: আমার বান্দা নিজেকে হত্যা করার ব্যাপারে বড় তাড়াহুড়ো করে ফেলেছে। আমি তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিলাম।’ (বুখারি ও মুসলিম)
অন্যান্য সামাজিক ব্যাধির মতো আত্মহৎযাও একটি ভয়ংকর সামাজিক ব্যাধি। এটি সমাজে ব্যাপকভাবে দেখা না গেলেও মাঝেমধ্যে পত্রিকার পাতায় আত্মহৎযার সংবাদ প্রকাশিত হতে দেখা যায়। নানা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বিভিন্ন রকমের নারী-পুরুষ বেছে নেয় আত্মহননের ঘৃণ্য ও জঘন্য দুর্ভাগ্যজনক পথ। ইসলামে আত্মহৎযা মহাপাপ জেনেও যাদের পরিস্থিতি সামলানোর ক্ষমতা দুর্বল, তারাই ধ্বংসাত্মক ও মর্মান্তিক পথে পা বাড়ায়। তরুণ প্রজন্মকে ধ্বংস নয়, সৃষ্টির পথে এগিয়ে যেতে হবে। অথচ বাস্তবে দেখা যায়, অনেক উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিজীবী, শিল্পপতি, ব্যবসায়ীও এ থেকে মুক্ত নয়। শিক্ষিত ও অশিক্ষিত ছাড়াও আত্মহৎযা যেমন যুবক ও প্রৌঢ়দের মধ্যে দেখা যায়, তেমনি তা নারী-পুরুষের মধ্যেও পরিলক্ষিত হয়। আত্মহৎযা সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা ঘোষিত হয়েছে, ‘আর তোমরা নিজের হাতে নিজেদের জীবনকে ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ করো না।’(সূরা আল-বাকারা, আয়াত-১৯৫)
সৃষ্টিগতভাবে মানব-প্রকৃতি হত্যা ও আত্মহৎযাবিরোধী। তাই এ থেকে বাঁচার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা সকল সুনাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য। এতে নানা রকম পারিবারিক ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় এবং বিভিন্ন ধরনের পাপকর্ম সংঘটিত হয়। একটু সচেতন হলে বিশেষ করে পিতা-মাতা, কাছের বন্ধু-বান্ধব বা শিক্ষক ও ধর্মীয় নেতাদের বিশেষ সতর্কতা আত্মহৎযা প্রতিরোধে ভূমিকা রাখতে পারে। সমাজ জীবনে আত্মহৎযার মতো মহাবিপর্যয়, অন্যায় ও অপরাধ থেকে সর্বস্তরের নর-নারী ও সন্তানসন্তুতির বেঁচে থাকার জন্য ইসলামের বিধিবিধান ও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলাই সর্বোত্তম পন্থা।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমি, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়। পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব হজরত মুহাম্মদ (সা.)।
dr.munimkhan@yahoo.com
ইসলাম মানব জীবনের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করেছে। ইসলামে আত্মহৎযা ঘৃণ্য ও জঘন্য মহাপাপ কাজ হওয়া সত্ত্বেও এমন অনেক লোক আছে, যারা নিজেদের সংবরণ করতে পারে না। আত্মহৎযার উপায়-উপকরণ জোগাড় করে বা ডায়েরি লিখে রাখে ও নেতিবাচক কথাবার্তার মাধ্যমে জীবন শেষ করে দেওয়ার ইঙ্গিত রেখে যায়। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ জীবনযাপনের দুঃখ-দুর্দশা ও ব্যর্থতার গ্লানি থেকে পরিত্রাণের জন্য অথবা জেদের বশবর্তী হয়ে কেউ কেউ বেছে নেয় আত্মহননের পথ। অথচ ধৈর্যধারণ করলে, আল্লাহর ওপর দৃঢ় আস্থা থাকলে কারও আত্মহৎযার মতো ক্লেশকর পথে পা বাড়াতে হয় না। এ ঘৃণ্যকাজ থেকে বিরত থাকতে আল্লাহ তাআলা বিশেষভাবে নির্দেশ প্রদান করেছেন এবং ধর্মপ্রাণ মানুষকে এর পরিণামের কথা ভাবার জন্য কঠোর ও যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির বর্ণনা দিয়ে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘আর তোমরা নিজেদের হত্যা করো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু এবং যে কেউ সীমালঙ্ঘন করে অন্যায়ভাবে তা (আত্মহৎযা) করবে, অবশ্যই আমি তাকে অগ্নিদগ্ধ করা; আল্লাহর পক্ষে তা সহজসাধ্য।’ (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ২৯-৩০)
অথচ আজকাল প্রায়ই আত্মহৎযার ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে। বিশেষ করে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে এ প্রবণতা অনেক বেশি। বখাটে লোকের উৎপাতের কারণে যেমন কেউ আত্মহৎযার পথ বেছে নিচ্ছে, আবার দেখা যাচ্ছে পিতা-মাতার সামান্য বকুনির কারণেও আত্মহৎযার মতো ঘটনা ঘটছে। পারিবারিক বিপর্যয়, মানসিক অশান্তি, সন্ত্রাস, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি, মূল্যবোধের অবক্ষয় ইত্যাদি বিষয়ের সঙ্গেও জড়িত আছে আত্মহৎযার মতো ধ্বংসাত্মক ঘটনা। এসব আত্মহৎযার পেছনে কাজ করে প্রচণ্ড মানসিক চাপ। ফলে ভারসাম্য হারিয়ে তা সহ্য করতে না পেরেই আত্মহননের মধ্য দিয়ে তারা মুক্তি খোঁজে। আত্মহৎযার ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিজেকে পাহাড়ের ওপর থেকে নিক্ষেপ করে আত্মহৎযা করে, সে জাহান্নামের মধ্যে সর্বদা ওভাবে লাফিয়ে পড়ে নিজেকে নিক্ষেপ করতে থাকবে। যে ব্যক্তি বিষপান করে আত্মহৎযা করে, সেও জাহান্নামের মধ্যে সর্বদা ওভাবে নিজ হাতে বিষপান করতে থাকবে। আর যে কোনো ধারালো অস্ত্র দিয়ে আত্মহৎযা করে, তার কাছে জাহান্নামে সেই ধারালো অস্ত্র থাকবে, যা দিয়ে সে সর্বদা নিজের পেটকে ফুঁড়তে থাকবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
ইসলামি বিধানে আত্মহৎযা নাজায়েজ এবং এর প্রতিফল হলো চিরস্থায়ী জাহান্নাম। যে ব্যক্তি আত্মহৎযা করে, সে শুধু তার নিজের ওপরই জুলুম করে না বরং এতে পিতা-মাতা, ভাই-বোনসহ আত্মীয়-পরিজন সবাই খুব কষ্ট পান এবং অত্যন্ত বিচলিতবোধ করেন। যে পরিস্থিতিতেই হোক না কেন, ইসলামের দৃষ্টিতে এটি এক বিরাট অন্যায়। কারণ এর দ্বারা আল্লাহর বেঁধে দেওয়া নিয়মের বরখেলাপ হয়ে যায়। তাই এ থেকে সদাসতর্ক থাকা প্রতিটি মুমিন মুসলমানের বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। নবী করিম (সা.) হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন, ‘কোনো ব্যক্তি যেই জিনিস দ্বারা আত্মহৎযা করে, কিয়ামতের দিন তাকে সেই জিনিস দ্বারাই শাস্তি দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি ফাঁস লাগিয়ে আত্মহৎযা করে সে দোজখে অনুরূপভাবে নিজ হাতে ফাঁসির শাস্তি ভোগ করতে থাকবে। আর যে বর্শা ইত্যাদির আঘাত দ্বারা আত্মহৎযা করে, সে দোজখেও সেভাবে নিজেকে শাস্তি দিবে।’ (নাসাঈ, তিরমিজি)
মানুষের আত্মহৎযা করার বিবিধ কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ, পিতা-মাতা ও ছেলে-মেয়ের মধ্যে মনোমালিন্য, পরীক্ষায় ব্যর্থতা, দীর্ঘস্থায়ী রোগ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়া, প্রেম-বিরহ, ব্যবসা-বাণিজ্যে পুনঃ পুনঃ ব্যর্থ হওয়া, শত্রুর কাছে ধরা না দেওয়া প্রভৃতি। যখন কারও জ্ঞান-বুদ্ধি ও উপলব্ধি-অনুধাবনশক্তি লোপ পায়, নিজকে অসহায়-ভরসাহীন মনে হয়, তখনই ধর্ম-কর্ম ভুলে মানুষ আত্মহৎযা করে বসে। জাগতিক ক্ষুদ্র দুঃখ-কষ্ট, লাঞ্ছনা ও অপমান থেকে আত্মরক্ষা করার ইচ্ছায় মানুষ আত্মহননের মাধ্যমে চিরন্তন কষ্ট ও লাঞ্ছনার দিকে চলে যায়। আত্মহৎযা সম্পর্কে হাদিসে কুদসিতে বর্ণিত আছে যে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের এক ব্যক্তি আহত হয়ে সে ব্যথা সহ্য করতে পারেনি। সে একটি ছুরি দিয়ে নিজের হাত নিজেই কেটে ফেলে। এরপর রক্তক্ষরণে সে মারা যায়। এ ব্যক্তি সম্পর্কে আল্লাহ পাক বলেন: আমার বান্দা নিজেকে হত্যা করার ব্যাপারে বড় তাড়াহুড়ো করে ফেলেছে। আমি তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিলাম।’ (বুখারি ও মুসলিম)
অন্যান্য সামাজিক ব্যাধির মতো আত্মহৎযাও একটি ভয়ংকর সামাজিক ব্যাধি। এটি সমাজে ব্যাপকভাবে দেখা না গেলেও মাঝেমধ্যে পত্রিকার পাতায় আত্মহৎযার সংবাদ প্রকাশিত হতে দেখা যায়। নানা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বিভিন্ন রকমের নারী-পুরুষ বেছে নেয় আত্মহননের ঘৃণ্য ও জঘন্য দুর্ভাগ্যজনক পথ। ইসলামে আত্মহৎযা মহাপাপ জেনেও যাদের পরিস্থিতি সামলানোর ক্ষমতা দুর্বল, তারাই ধ্বংসাত্মক ও মর্মান্তিক পথে পা বাড়ায়। তরুণ প্রজন্মকে ধ্বংস নয়, সৃষ্টির পথে এগিয়ে যেতে হবে। অথচ বাস্তবে দেখা যায়, অনেক উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিজীবী, শিল্পপতি, ব্যবসায়ীও এ থেকে মুক্ত নয়। শিক্ষিত ও অশিক্ষিত ছাড়াও আত্মহৎযা যেমন যুবক ও প্রৌঢ়দের মধ্যে দেখা যায়, তেমনি তা নারী-পুরুষের মধ্যেও পরিলক্ষিত হয়। আত্মহৎযা সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা ঘোষিত হয়েছে, ‘আর তোমরা নিজের হাতে নিজেদের জীবনকে ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ করো না।’(সূরা আল-বাকারা, আয়াত-১৯৫)
সৃষ্টিগতভাবে মানব-প্রকৃতি হত্যা ও আত্মহৎযাবিরোধী। তাই এ থেকে বাঁচার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা সকল সুনাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য। এতে নানা রকম পারিবারিক ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় এবং বিভিন্ন ধরনের পাপকর্ম সংঘটিত হয়। একটু সচেতন হলে বিশেষ করে পিতা-মাতা, কাছের বন্ধু-বান্ধব বা শিক্ষক ও ধর্মীয় নেতাদের বিশেষ সতর্কতা আত্মহৎযা প্রতিরোধে ভূমিকা রাখতে পারে। সমাজ জীবনে আত্মহৎযার মতো মহাবিপর্যয়, অন্যায় ও অপরাধ থেকে সর্বস্তরের নর-নারী ও সন্তানসন্তুতির বেঁচে থাকার জন্য ইসলামের বিধিবিধান ও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলাই সর্বোত্তম পন্থা।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমি, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়। পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব হজরত মুহাম্মদ (সা.)।
dr.munimkhan@yahoo.com
No comments