তথ্য পাওয়া কত কঠিন by মশিউল আলম
তথ্য অধিকার আইনের বাস্তবায়ন-প্রক্রিয়া সম্পর্কে অবশেষে একটা খবর পাওয়া গেল। অবশ্য বাস্তবায়ন নয়, এটা অবাস্তবায়নের খবর। গত মঙ্গলবারের প্রথম আলোয় প্রকাশিত খবরটি ছিল এ রকম: বান্দরবানের কয়েকজন সাংবাদিক গত বছরের নভেম্বরে সেখানকার জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত আবেদনপত্র দিয়ে এই তথ্য চেয়েছিলেন: বান্দরবান জেলায় এ যাবৎ কী পরিমাণ জমি বিভিন্ন কোম্পানি, বহিরাগত ব্যক্তি ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নামে ইজারা, বন্দোবস্ত ও ক্রয়-বিক্রয়সূত্রে হস্তান্তর করা হয়েছে। তারপর পাঁচ মাস চলে গেছে, কিন্তু ওই সাংবাদিকদের কোনো তথ্য সরবরাহ করা হয়নি। প্রথম আলোর বান্দরবান প্রতিনিধি বুদ্ধজ্যোতি চাকমাও ১১ নভেম্বর একই ধরনের তথ্যের জন্য আবেদন করেছিলেন। তিনিও কোনো তথ্য পাননি। গত মাসের ১১ তারিখে তিনি জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিতভাবে জানতে চেয়েছেন ওই তথ্যগুলো তাঁকে কবে সরবরাহ করা হবে। তিনি এখনো কোনো উত্তর পাননি।
কিন্তু এ রকম হওয়ার কথা নয়। তথ্য অধিকার আইন ২০০৯-এ এমন কোনো সুযোগ একেবারেই নেই। আইনটির ৯ ধারা বলছে, (১) বাংলাদেশের কোনো নাগরিক কোনো কর্তৃপক্ষের কাছে কোনো তথ্যের জন্য আবেদন করলে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবেদনপত্র পাওয়ার তারিখ থেকে অনধিক ২০ কার্যদিবসের মধ্যে অনুরোধকৃত তথ্য সরবরাহ করবেন। (২) অনুরোধকৃত তথ্যের সঙ্গে একাধিক তথ্য প্রদান ইউনিট বা কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্টতা থাকলে অনধিক ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে অনুরোধকৃত তথ্য সরবরাহ করতে হবে। আর (৩) দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কোনো কারণে তথ্য প্রদানে অপারগ হলে অপারগতার কারণ উল্লেখ করে আবেদন পাওয়ার ১০ কার্যদিবসের মধ্যে তা অনুরোধকারীকে অবহিত করবেন। যদি (৫) উল্লিখিত সময়সীমার মধ্যে তথ্য সরবরাহ করতে কোনো দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ব্যর্থ হন, তাহলে সংশ্লিষ্ট তথ্যপ্রাপ্তির অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে বলে গণ্য হবে।
অর্থাৎ, এটা খুব পরিষ্কার, বান্দরবানের সাংবাদিকদের উল্লিখিত তথ্যপ্রাপ্তির অনুরোধ আইন অনুযায়ী প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে করণীয় কী? তথ্য অধিকার আইনের ২৪ ধারায় বলা হচ্ছে, কোনো আবেদনকারী ব্যক্তি নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে তথ্য না পেলে বা (তথ্য প্রদানের) দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কোনো সিদ্ধান্তে সংক্ষুব্ধ হলে ওই সময়সীমা অতিক্রান্ত হওয়ার পর ৩০ দিনের মধ্যে আবেদনকারী ব্যক্তি আপিল কর্তৃপক্ষের কাছে আপিল করতে পারবেন। আপিল কর্তৃপক্ষ হলো, যে কর্তৃপক্ষের কাছে তথ্য চাওয়া হয়েছে, তার অব্যবহিত ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। আপিল কর্তৃপক্ষ আপিল পাওয়ার পরের ১৫ দিনের মধ্যে আপিল আবেদনকারীকে অনুরোধকৃত তথ্য সরবরাহের জন্য সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেবেন; অথবা তাঁর বিবেচনায় আপিল গ্রহণযোগ্য না হলে আবেদনটি খারিজ করে দেবেন। তার পরও তথ্য না পেলে বা আপিল খারিজ হলে আবেদনকারীর সামনে আসবে পরবর্তী ধাপ। প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পরের ৩০ দিনের মধ্যে তিনি অভিযোগ করতে পারবেন তথ্য কমিশনের কাছে। তথ্য কমিশন বিষয়টি অনুসন্ধান করে ৩০ দিনের মধ্যে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছাবে এবং সে সিদ্ধান্ত সকল সংশ্লিষ্ট পক্ষকে লিখিতভাবে জানাবে।
তথ্য কমিশন কী ধরনের সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে? অনুরোধকৃত তথ্য সুনির্দিষ্ট পন্থায় অনুরোধকারীকে সরবরাহ করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিতে পারে, অথবা কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তই বহাল রাখতে পারে। আর অভিযোগ নিষ্পত্তির প্রক্রিয়ায় বা অন্য কোনোভাবে তথ্য কমিশনের যদি এ রকম মনে হয় যে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কোনো যুক্তিগ্রাহ্য কারণ ছাড়াই তথ্যপ্রাপ্তির অনুরোধ বা আপিল গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছেন, অসদুদ্দেশ্যে তথ্যপ্রাপ্তির অনুরোধ বা আপিল প্রত্যাখ্যান করেছেন, ভুল বা অসম্পূর্ণ, বিভ্রান্তিকর বা বিকৃত তথ্য দিয়েছেন, তথ্যপ্রাপ্তির পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছেন, তাহলে তথ্য কমিশন সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে দৈনিক ৫০ টাকা হারে জরিমানা আরোপ করতে পারবে।
বলাবাহুল্য, বান্দরবানের সাংবাদিকদের তথ্য চাওয়ার প্রক্রিয়াটি এত দূর পর্যন্ত এগোয়নি; প্রথম ধাপেই শেষ হয়ে গেছে। এখানে প্রক্রিয়াগত কিছু সমস্যা ফুটে উঠেছে। সাংবাদিকেরা তথ্যের জন্য আবেদন করেছেন বান্দরবানের জেলা প্রশাসকের কাছে। জেলা প্রশাসক কোনো তথ্য প্রদান ইউনিটের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হওয়ার কথা নয়। তাঁর কার্যালয়ের তথ্য প্রদানের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। আইন অনুযায়ী প্রথম আবেদনটি করার কথা তাঁরই কাছে। তিনি অপারগতা প্রকাশ করলে জেলা প্রশাসকের কাছে আপিল করতে হতো। এবং এ জন্য পাঁচ মাস অপেক্ষা করার কোনো প্রয়োজন ছিল না, আবেদন করার ৩০ দিন পরই সাংবাদিকেরা জেলা প্রশাসকের কাছে আপিল করতে পারতেন। কিন্তু আপিল করা হয়নি। আর আপিল করাই যখন হয়নি, তখন তথ্য কমিশন পর্যন্ত যাওয়ার কোনো প্রশ্নই দেখা দেয়নি।
তথ্য অধিকার আইন ব্যবহারের ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের মধ্যেই যদি এমন চিত্র দেখা যায়, তাহলে সাধারণ নাগরিকদের ক্ষেত্রে কী অবস্থা হতে পারে। শুধু সাংবাদিক কেন, জেলা প্রশাসক বা সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাও যে তথ্য প্রদানের প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন নন, তার আভাসও এ ঘটনায় পাওয়া কষ্টকর নয়। প্রথম আলোর মঙ্গলবারের প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, সাংবাদিকদের তথ্যের আবেদন পাওয়ার দুই মাস পর বান্দরবানের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের তথ্য ও অভিযোগ শাখা এবং বান্দরবান সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ভূমি অফিসসহ সংশ্লিষ্ট শাখাগুলোর কাছে তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠান। এই কাজ তাঁদের করা উচিত ছিল আবেদনপত্র পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এবং যেহেতু একাধিক দপ্তরের সংশ্লিষ্টতা আছে, তাই অনুরোধকৃত তথ্য সরবরাহের জন্য তাঁদের সর্বোচ্চ ৩০ দিন সময় পাওয়ার কথা—এটা আইনেই স্পষ্ট করে লেখা রয়েছে। যা হোক, দুই মাস পরে চিঠি দিয়েও তথ্যগুলো তাঁরা সংগ্রহ করতে পারেননি। তারপর আরও দুই মাস পার হয়ে গেল। তারপর জেলা প্রশাসক সাহেব ৩১ মার্চ বিভাগীয় কমিশনারের কাছে চিঠি লিখে এ বিষয়ে দিকনির্দেশনা চাইলেন, কেননা, তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী, আইনটির বিধিমালা তখনো হয়নি (কিন্তু ২৯ মার্চেই খোদ তথ্যসচিবের মুখে জেনেছি, বিধিমালা অনুমোদিত হয়ে গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়েছে)। দিকনির্দেশনা চাওয়ার পাশাপাশি জেলা প্রশাসক বিভাগীয় কমিশনারকে এমন কথা জানিয়েছেন যে ভূমিবিষয়ক ও অন্যান্য এমন কিছু তথ্য চাওয়া হয়েছে, যা বিদ্যমান তথ্যভান্ডার থেকে খুঁজে পেতে ন্যূনতম তিন মাস বা তারও অধিক সময়ের প্রয়োজন। এমনকি এ জন্য বাড়তি লোকবলও নিয়োগ করতে হবে।
এটা সাংঘাতিক কথা। তথ্য অধিকার আইনের সুফল পাওয়া কত যে দুষ্কর ব্যাপার হতে পারে, তা এ রকম ঘটনার মধ্য দিয়ে সামনের দিনগুলোতে আরও বেশি করে স্পষ্ট হবে। তথ্য অধিকার আইন থাকলেই তথ্য পাওয়া যাবে না, দেওয়ার কাজটিও সহজ হবে না, যদি তথ্য সঠিকভাবে সংরক্ষিত না থাকে। অবশ্য বান্দরবান পার্বত্য জেলার সরকারি ভূমিসংক্রান্ত তথ্যাবলিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ স্পর্শকাতর ভেবে তথ্য সরবরাহে গড়িমসি করছে কি না, তা বলা কঠিন। তবে সাধারণভাবে সারা দেশের সকল কর্তৃপক্ষের কাছেই তথ্য ব্যবস্থাপনায় খুব যে শৃঙ্খলা আছে, তা আশা করা যায় না।
এ ক্ষেত্রে তথ্য কমিশনের অনেক বড় ভূমিকা রয়েছে। আইনে বলা হয়েছে, তথ্য কমিশন কোনো অভিযোগ নিষ্পত্তির প্রক্রিয়ায় যদি দেখতে পায় কোনো কর্তৃপক্ষ অনুরোধকৃত তথ্য সরবরাহ করতে পারেনি তথ্য ব্যবস্থাপনার ঘাটতির কারণে, তাহলে তথ্য কমিশন সেই কর্তৃপক্ষকে নতুনভাবে তথ্যের প্রকৃতি নির্ধারণ, শ্রেণীবিন্যাসকরণ, সংরক্ষণ, প্রকাশ ও সরবরাহ-সংক্রান্ত নির্দেশনা দিতে পারবে। বান্দরবানের এ ঘটনাটি তথ্য কমিশনের গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নেওয়া উচিত। সাংবাদিকেরা তথ্য কমিশনের কাছে অভিযোগ করেননি, তাতেও কোনো অসুবিধা নেই। তথ্য অধিকার আইনের ১৩ ধারায় বলা আছে, তথ্য কমিশন স্ব-প্রণোদিত হয়েও অনুসন্ধান চালাতে পারবে।
বান্দরবানের সাংবাদিকদের তথ্য চাওয়ার ঘটনাটি আদ্যোপান্ত অনুসন্ধানের ফলে তথ্য কমিশনের কাছে তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নের অনেক সমস্যার চিত্র পরিষ্কার হতে পারে এবং তার আলোকে কমিশন নতুন দিকনির্দেশনা তৈরি করতে পারে। সরকারি-বেসরকারি সমস্ত কর্তৃপক্ষ, যারা তথ্য অধিকার আইনের আওতায় পড়ে, তাদের নিজ নিজ তথ্য সংরক্ষণ-ব্যবস্থা সুশৃঙ্খল না হলে নাগরিকদের চাহিদা ও অনুরোধ মোতাবেক তথ্য সরবরাহ করা সম্ভব হবে না, তার একটি প্রত্যক্ষ দৃষ্টান্ত বান্দরবানের এই ঘটনা।
মশিউল আলম: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com
কিন্তু এ রকম হওয়ার কথা নয়। তথ্য অধিকার আইন ২০০৯-এ এমন কোনো সুযোগ একেবারেই নেই। আইনটির ৯ ধারা বলছে, (১) বাংলাদেশের কোনো নাগরিক কোনো কর্তৃপক্ষের কাছে কোনো তথ্যের জন্য আবেদন করলে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবেদনপত্র পাওয়ার তারিখ থেকে অনধিক ২০ কার্যদিবসের মধ্যে অনুরোধকৃত তথ্য সরবরাহ করবেন। (২) অনুরোধকৃত তথ্যের সঙ্গে একাধিক তথ্য প্রদান ইউনিট বা কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্টতা থাকলে অনধিক ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে অনুরোধকৃত তথ্য সরবরাহ করতে হবে। আর (৩) দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কোনো কারণে তথ্য প্রদানে অপারগ হলে অপারগতার কারণ উল্লেখ করে আবেদন পাওয়ার ১০ কার্যদিবসের মধ্যে তা অনুরোধকারীকে অবহিত করবেন। যদি (৫) উল্লিখিত সময়সীমার মধ্যে তথ্য সরবরাহ করতে কোনো দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ব্যর্থ হন, তাহলে সংশ্লিষ্ট তথ্যপ্রাপ্তির অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে বলে গণ্য হবে।
অর্থাৎ, এটা খুব পরিষ্কার, বান্দরবানের সাংবাদিকদের উল্লিখিত তথ্যপ্রাপ্তির অনুরোধ আইন অনুযায়ী প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে করণীয় কী? তথ্য অধিকার আইনের ২৪ ধারায় বলা হচ্ছে, কোনো আবেদনকারী ব্যক্তি নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে তথ্য না পেলে বা (তথ্য প্রদানের) দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কোনো সিদ্ধান্তে সংক্ষুব্ধ হলে ওই সময়সীমা অতিক্রান্ত হওয়ার পর ৩০ দিনের মধ্যে আবেদনকারী ব্যক্তি আপিল কর্তৃপক্ষের কাছে আপিল করতে পারবেন। আপিল কর্তৃপক্ষ হলো, যে কর্তৃপক্ষের কাছে তথ্য চাওয়া হয়েছে, তার অব্যবহিত ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। আপিল কর্তৃপক্ষ আপিল পাওয়ার পরের ১৫ দিনের মধ্যে আপিল আবেদনকারীকে অনুরোধকৃত তথ্য সরবরাহের জন্য সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেবেন; অথবা তাঁর বিবেচনায় আপিল গ্রহণযোগ্য না হলে আবেদনটি খারিজ করে দেবেন। তার পরও তথ্য না পেলে বা আপিল খারিজ হলে আবেদনকারীর সামনে আসবে পরবর্তী ধাপ। প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পরের ৩০ দিনের মধ্যে তিনি অভিযোগ করতে পারবেন তথ্য কমিশনের কাছে। তথ্য কমিশন বিষয়টি অনুসন্ধান করে ৩০ দিনের মধ্যে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছাবে এবং সে সিদ্ধান্ত সকল সংশ্লিষ্ট পক্ষকে লিখিতভাবে জানাবে।
তথ্য কমিশন কী ধরনের সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে? অনুরোধকৃত তথ্য সুনির্দিষ্ট পন্থায় অনুরোধকারীকে সরবরাহ করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিতে পারে, অথবা কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তই বহাল রাখতে পারে। আর অভিযোগ নিষ্পত্তির প্রক্রিয়ায় বা অন্য কোনোভাবে তথ্য কমিশনের যদি এ রকম মনে হয় যে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কোনো যুক্তিগ্রাহ্য কারণ ছাড়াই তথ্যপ্রাপ্তির অনুরোধ বা আপিল গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছেন, অসদুদ্দেশ্যে তথ্যপ্রাপ্তির অনুরোধ বা আপিল প্রত্যাখ্যান করেছেন, ভুল বা অসম্পূর্ণ, বিভ্রান্তিকর বা বিকৃত তথ্য দিয়েছেন, তথ্যপ্রাপ্তির পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছেন, তাহলে তথ্য কমিশন সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে দৈনিক ৫০ টাকা হারে জরিমানা আরোপ করতে পারবে।
বলাবাহুল্য, বান্দরবানের সাংবাদিকদের তথ্য চাওয়ার প্রক্রিয়াটি এত দূর পর্যন্ত এগোয়নি; প্রথম ধাপেই শেষ হয়ে গেছে। এখানে প্রক্রিয়াগত কিছু সমস্যা ফুটে উঠেছে। সাংবাদিকেরা তথ্যের জন্য আবেদন করেছেন বান্দরবানের জেলা প্রশাসকের কাছে। জেলা প্রশাসক কোনো তথ্য প্রদান ইউনিটের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হওয়ার কথা নয়। তাঁর কার্যালয়ের তথ্য প্রদানের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। আইন অনুযায়ী প্রথম আবেদনটি করার কথা তাঁরই কাছে। তিনি অপারগতা প্রকাশ করলে জেলা প্রশাসকের কাছে আপিল করতে হতো। এবং এ জন্য পাঁচ মাস অপেক্ষা করার কোনো প্রয়োজন ছিল না, আবেদন করার ৩০ দিন পরই সাংবাদিকেরা জেলা প্রশাসকের কাছে আপিল করতে পারতেন। কিন্তু আপিল করা হয়নি। আর আপিল করাই যখন হয়নি, তখন তথ্য কমিশন পর্যন্ত যাওয়ার কোনো প্রশ্নই দেখা দেয়নি।
তথ্য অধিকার আইন ব্যবহারের ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের মধ্যেই যদি এমন চিত্র দেখা যায়, তাহলে সাধারণ নাগরিকদের ক্ষেত্রে কী অবস্থা হতে পারে। শুধু সাংবাদিক কেন, জেলা প্রশাসক বা সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাও যে তথ্য প্রদানের প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন নন, তার আভাসও এ ঘটনায় পাওয়া কষ্টকর নয়। প্রথম আলোর মঙ্গলবারের প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, সাংবাদিকদের তথ্যের আবেদন পাওয়ার দুই মাস পর বান্দরবানের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের তথ্য ও অভিযোগ শাখা এবং বান্দরবান সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ভূমি অফিসসহ সংশ্লিষ্ট শাখাগুলোর কাছে তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠান। এই কাজ তাঁদের করা উচিত ছিল আবেদনপত্র পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এবং যেহেতু একাধিক দপ্তরের সংশ্লিষ্টতা আছে, তাই অনুরোধকৃত তথ্য সরবরাহের জন্য তাঁদের সর্বোচ্চ ৩০ দিন সময় পাওয়ার কথা—এটা আইনেই স্পষ্ট করে লেখা রয়েছে। যা হোক, দুই মাস পরে চিঠি দিয়েও তথ্যগুলো তাঁরা সংগ্রহ করতে পারেননি। তারপর আরও দুই মাস পার হয়ে গেল। তারপর জেলা প্রশাসক সাহেব ৩১ মার্চ বিভাগীয় কমিশনারের কাছে চিঠি লিখে এ বিষয়ে দিকনির্দেশনা চাইলেন, কেননা, তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী, আইনটির বিধিমালা তখনো হয়নি (কিন্তু ২৯ মার্চেই খোদ তথ্যসচিবের মুখে জেনেছি, বিধিমালা অনুমোদিত হয়ে গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়েছে)। দিকনির্দেশনা চাওয়ার পাশাপাশি জেলা প্রশাসক বিভাগীয় কমিশনারকে এমন কথা জানিয়েছেন যে ভূমিবিষয়ক ও অন্যান্য এমন কিছু তথ্য চাওয়া হয়েছে, যা বিদ্যমান তথ্যভান্ডার থেকে খুঁজে পেতে ন্যূনতম তিন মাস বা তারও অধিক সময়ের প্রয়োজন। এমনকি এ জন্য বাড়তি লোকবলও নিয়োগ করতে হবে।
এটা সাংঘাতিক কথা। তথ্য অধিকার আইনের সুফল পাওয়া কত যে দুষ্কর ব্যাপার হতে পারে, তা এ রকম ঘটনার মধ্য দিয়ে সামনের দিনগুলোতে আরও বেশি করে স্পষ্ট হবে। তথ্য অধিকার আইন থাকলেই তথ্য পাওয়া যাবে না, দেওয়ার কাজটিও সহজ হবে না, যদি তথ্য সঠিকভাবে সংরক্ষিত না থাকে। অবশ্য বান্দরবান পার্বত্য জেলার সরকারি ভূমিসংক্রান্ত তথ্যাবলিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ স্পর্শকাতর ভেবে তথ্য সরবরাহে গড়িমসি করছে কি না, তা বলা কঠিন। তবে সাধারণভাবে সারা দেশের সকল কর্তৃপক্ষের কাছেই তথ্য ব্যবস্থাপনায় খুব যে শৃঙ্খলা আছে, তা আশা করা যায় না।
এ ক্ষেত্রে তথ্য কমিশনের অনেক বড় ভূমিকা রয়েছে। আইনে বলা হয়েছে, তথ্য কমিশন কোনো অভিযোগ নিষ্পত্তির প্রক্রিয়ায় যদি দেখতে পায় কোনো কর্তৃপক্ষ অনুরোধকৃত তথ্য সরবরাহ করতে পারেনি তথ্য ব্যবস্থাপনার ঘাটতির কারণে, তাহলে তথ্য কমিশন সেই কর্তৃপক্ষকে নতুনভাবে তথ্যের প্রকৃতি নির্ধারণ, শ্রেণীবিন্যাসকরণ, সংরক্ষণ, প্রকাশ ও সরবরাহ-সংক্রান্ত নির্দেশনা দিতে পারবে। বান্দরবানের এ ঘটনাটি তথ্য কমিশনের গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নেওয়া উচিত। সাংবাদিকেরা তথ্য কমিশনের কাছে অভিযোগ করেননি, তাতেও কোনো অসুবিধা নেই। তথ্য অধিকার আইনের ১৩ ধারায় বলা আছে, তথ্য কমিশন স্ব-প্রণোদিত হয়েও অনুসন্ধান চালাতে পারবে।
বান্দরবানের সাংবাদিকদের তথ্য চাওয়ার ঘটনাটি আদ্যোপান্ত অনুসন্ধানের ফলে তথ্য কমিশনের কাছে তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নের অনেক সমস্যার চিত্র পরিষ্কার হতে পারে এবং তার আলোকে কমিশন নতুন দিকনির্দেশনা তৈরি করতে পারে। সরকারি-বেসরকারি সমস্ত কর্তৃপক্ষ, যারা তথ্য অধিকার আইনের আওতায় পড়ে, তাদের নিজ নিজ তথ্য সংরক্ষণ-ব্যবস্থা সুশৃঙ্খল না হলে নাগরিকদের চাহিদা ও অনুরোধ মোতাবেক তথ্য সরবরাহ করা সম্ভব হবে না, তার একটি প্রত্যক্ষ দৃষ্টান্ত বান্দরবানের এই ঘটনা।
মশিউল আলম: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com
No comments